মিজান আজহারির মাহফিল বন্ধ, মামুনুল হকের বক্তব্য এবং দেওবন্দ জামাত সম্পর্ক
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ২৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১০:০৭:০৯ সকাল
সিলেটে কাওমি আলেমদের দ্বারা মাওলানা মিযানুল হক আজহারীর মাহফিল বন্ধ কারা, এবং মাওলানা মামুনুল হক এর বক্তব্য সহ সাম্প্রতিক কালের কিছু বিষয় স্বভাবতই আলোড়ন সৃষ্টিকারি পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এগুলোকে অনেকেই কাওমি আলেমদের হিংসা হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন যে, মিজানুর রহমান আজহারির জনপ্রিয়তা দেখে পীর এবং মাজার ব্যাবসায়িদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ব্যাপারটা আসলেই কি তাই?
অপরদিকে, সম্প্রতি চরমোনাই এর পীর সাহেব তাঁর এক মাহফিলে খুব শক্ত ভাষায় জামাতের কড়া সমালোচনা করেছেন। ব্যাপারটা কি? সমস্যটা আসলে কোথায়?
জামায়াতে ইসলামী এবং ওলামায়ে দেওবন্দের মধ্যে বিরোধ এবং মত পার্থক্য আসলে নতুন কিছু নয়। এ পার্থক্যটা সকল ওলামায়ে কেরাম এবং রাজনীতি সচেতন ব্যাক্তিই জানার কথা। জামাতের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদীর সাথে ওলামায়ে দেওবন্দের মাওলানা হসাইন আহমাদ মাদানি সহ সকল দেওবন্দি ওলামায়ে কেরামের সাথে কাওমিয়াত বা জাতীয়তা নিয়ে চরম মতপার্থক্য এবং বিরোধ ছিল। সে সময় কে সঠিক ছিল আর কে বেঠিক ছিল সে ব্যাপারে মতামত দেয়া আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি শুধু সামান্য ইতিহাস স্মরণ করাতে চাই যে এটা আকিদা বা মোলিক মতামতের সাথে জড়িত। মাওলানা মওদুদির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মুসলমানদের জাতীয়তা বা পরিচয় দেশ বা স্থানের সাথে নয় বরং বিশ্বাসের সাথে। অপরদিকে ওলামায়ে দেওবন্দের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল,জাতীয়তা দেশ এবং স্থানের সাথে সম্পৃক্ত। তাঁরা যুক্তি দিয়েছিলেন কাওমে আদ এবং কাওমে সামুদ এর এসব কাওম স্থান এবং দেশের সাথে জড়িত। তাঁরা বলেছেন আল্লাহ পাক কোরানে এদেরকে কাওম হিসাবে ডেকেছেন। মাওলানা সাইয়েদ আবুল আলা মওদুদি (রহ) বিরুদ্ধে ওলামায়ে দেওবান্দের আরেকটা অভিযোগ ছিল, তিনি তাঁদের ভাষায় সাহাবাদের সমালোচনা করেছেন। বিশেষভাবে মাওলানা মওদুদির বই “খিলাফাত ও মুলিকিয়াত” এবং “রাসায়েল মাসায়েল” বই দুটির মধ্যে তিনি ঊস্টের যুদ্ধ, সিফফিনের যুদ্ধ সহ ইতিহাস আলোচনা করতে গিয়ে আমিরে মুয়াবিয়া বা আরও কারো কারো সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন তাঁকে সাহাবাদের সমালোচনা হিসাবে ধরে নিয়েছিলেন। মাওলানা মওদুদির আরেকটি অভিমত “মিয়ইয়ারে হক” বা সত্যের মাপকাঠি অভিমত নিয়ে ওলামায়ে দেওবান্দের সাথে জামায়াতের সাথে মত পার্থক্য চলে আসছে। ওলামায়ে দেওবন্দের পরে বাংলাদেশে দেওবান্দের অনুসারী কাওমি ঘরানার আলেমগণ কমবেশি জামাত বা জামাতের অনুসারী সম্পর্কে কমবেশি একই ধারনা পোষণ করেন। এরই অংশ হিসাবে বলা যায়, উর্দুতে “ইঝহারে হাকিকত” নামে একটি বই রচিত হয়েছিল, “ইঝহারে হাকিকত” এর বাংলা তরজমা হতে পারে “সত্যের প্রকাশ” বলা বাহুল্য বইটি জামায়াতের সমালোচনাতেই রচিত। তারপর আল্লামা শামসুল হক ফরিদপুরী (রহ) “ভুল সংশোধন” নামে বাংলায় আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। বলা বাহুল্য এটি ও মূলত জামাত এবং মাওলানা মওদুদির সমালোচনা করে রচিত। “ইঝহারে হাকিকত” এবং “ভুল সংশোধন” গ্রন্থদ্বয়কে ক্লাসিকাল বা একডেমিক হিসাবে ধরা যেতে পারে, যেখানে সুনির্দিষ্ট বিষয়গুলো যেগুলো তাঁরা আপত্তিকর মনে করেছেন তা তুলে ধরা হয়েছে। অপরদিকে “মিস্টার মওদুদির নুতুন ইসলাম” নামে আরেকটি গ্রন্থ রচিত হয়েছিল, যেটার রচয়িতা কে আমার সঠিক মনে নাই, যতদূর মনে পড়ে “মওলানা আব্দুল আউয়াল” যিনি দেওবান্দি নন। তাঁর বইটি ছিল আপক্ষিকভাবে আক্রমণাত্মক।
সালটা সঠিক মনে নাই, চারদলীয় জোট যখন ক্ষমতায়। বলা বাহুল্য চার দলে অন্যদের সাথে জামাত এবং দেওবান্দি আলেমরা একত্রেই কাজ করেছিল, সে সময় মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী যখন শিল্প মন্ত্রী সে সময় জামাতের সাথে দেবান্দি আলেমগণ বিশেষভাবে মুফতি আমিনী সাহেবের সাথে, তখন মুফতি আমিনী সাহেব অভিযোগ তুলেছিলেন যে জামাত ষড়যন্ত্র করে সিলেবাসে তাফহীমুল কোরআনকে অন্তর্ভুক্ত করতে চায়। তাছাড়া সে সময় বিতর্ক একটু বেড়ে গেলে অনেকে জামাতকে মওদুদীবাদ বলে কটাক্ষ করেছিলেন। সে প্রেক্ষাপটে মাওলানা নিজামির উত্তরটি আমার দৃষ্টিতে ছিল ঐতিহাসিক এবং উল্লেখযোগ্য। সে সময় মাওলানা নিজামি বলেছিলেন। ‘তাফহিমুল কোরআন পড়ার জন্য সিলেবাসে জোর করে ঢুকানর কোন প্রয়োজন আমরা মনে করিনা, বাংলাদেশে তাফহিমুল কুরআন পড়ার জন্য আমাদের হাজার হাজার কর্মী আছে।‘ একই বক্তব্যে মওলানা নিজামি মাওলানা মওদুদি সম্পর্কে বলেছিলেন, “আমরা মাওলানা মওদুদিকে ফিকাহ এবং আকায়েদের ইমাম মনে করিনা, তবে আমরা এবং যুগে যুগে যারাই ইসলামী আন্দোলন করেছেন এবং করবেন তাঁরা কেউ ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে মাওলানা মওদুদির সাহিত্যের অবদানকে অস্বীকার করতে পারেনা।“ উল্লেখ্য আমার জানামতে মাওলানা নিজামির সে বক্তব্যের পর কোন বাড়াবাড়ি হয়নি।
জামাতের ব্যাপারে আরেকটা বিষয় তাঁরা মনে করেন বা কোন কোন ক্ষেত্রে দোষারোপ করেন এই বলে যে জামাতের লোকজন হাদিস এবং কোরানের মনগড়া ব্যখ্যা দেন। সেদিন যেমন মওলানা মামুনুল হক তাঁর পিতা বা উস্তাদ দের রেফেরেঞ্চ দিয়েছেন বা সবসময় দেন। চর মোনাই এর পীর সাহেব ও দেন, হাদিস এবং কোরআন এর ব্যাখ্যার ব্যাপারে তাঁরা সলফ এর এই সিলসিলা মানেন কিন্তু তাঁরা মনে করেন একমাত্রই জামাতই এই সিলসিলা মানেন না। তাছাড়া আমরা জানি যে বাংলাদেশের যে তাফসিরগুলূ বাংলাদেশ উপমহাদেশের আলেমগণ এমনকি মাদ্রাসায় যেগুলো সিলেবাস হিসাবে যে তাফসিরগুলো পড়ানো হয় যেমন তাফসিরে জালালাইন , তাফসিরে কাসসাফ, তাফসিরে ইবনে কাছীর, তাফহিমুল কোরআন সে ধাঁচে লেখা নয়, যেটা তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন ঐতিহাসিক সিলসিলা বা ট্র্যাডিশন ভঙ্গ কড়া হয়েছে। মিজানুর রহমান আজহারির কিছু ব্যাখ্যাকে তাঁরা ঐ চরাচরিত পদ্ধতি ভঙ্গ করে মনগড়া ব্যখ্যা হিসাবে হিসাবে মনে করেন। তাছাড়া মিজানুর রাহমান আজহারির কিছু শব্দও চয়ন সাহাবাদের প্রতি অসম্মানজনক হিসাবে দেখেছেন। যেমন মিজানুর রহমান আজহারি আলী রা সম্পর্কে বা খাদিজা রা সম্পর্কে যে শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন সেগুলোকে তাঁরা জামাতের লোকজনের সাহাবাদের প্রতি অসম্মানের নমুনা হিসাবে দেখেন।
ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা
আগেই বলেছিলাম, মাওলানা মামুনুল হকের বক্তব্য বা কাওমি আলেমদের দ্বারা মাওলানা মিজান আযহারির ঠেকানোকে অনেকেই হিংসা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। এব্যাপারে আমি আমার ব্যাক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতা পেশ করছি। আমার ব্যাক্তগত অভিজ্ঞতার আলোকে আমি এটাকে হিংসা হিসাবে মনে করিনা। আমি মনে করি, ওলামায়ে দেওবান্দ এবং জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে যে মত পার্থক্যগুলো ছিল সেগুলো শেষ হয়ে যায়নি, এবং ঐক্য হলেও সেগুলো থেকে যাবে, ঐক্য হলেও সেগুলো আছে এবং থাকবে মনে করেই হবে। কেউ কার মত পরিবর্তন করতে পারেনা, সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায় সম্মান বোধের মাধ্যমে। এক্ষেত্রে পশ্চিমা জগতে যারা ইন্টারফেইথে খ্রিস্টান এবং এহুদিদের সাথে কাজ করেন। প্রত্যেকেই তাঁর নিজের আকিদা বিশ্বাসের উপর থাকতে দিয়েও একত্রে কাজ কড়া যায়। এ ব্যাপারে একটা বই আছে “You Don’t have to be wrong for me to be right”. জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই দুজনের কথাই ঠিক হতে পারে, শুধু দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। কে কিভাবে দেখছেন বা ব্যাখ্যা করছেন।
আমার আব্বা মরহুম মাওলানা তোফায়েল আহমদ, দেওবান্দ ফারেগ একজন আলেম ছিলেন। প্রায় ৩৫ বছর আলিয়া মাদ্রাসার প্রিঞ্চিপাল ছিলেন, জমিয়তুল মুদাররেসীন এর কেন্দ্রীয় জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন। স্বভাবতই আমার আব্বা জামাত বিরোধী ছিলেন। লন্ডনস্থ ইস্ট লন্ডন মসজিদের ইমাম মাওলানা আব্দুল কাইউম ভাই আমার আব্বার ছাত্র ছিলেন, আমি কাইউম ভাইর ৬-৭ বছরের ছোট এবং জুনিয়র ছিলাম, কাইউম ভাই অসাধারণ মেধাবী ছিলেন বিধায় আব্বা কাইউম ভাইকে খুব আদর করতেন, কিন্তু কাইউম ভাই সম্ভবত শিবির করতেন বা জামাতের সমর্থক ছিলেন এই কারণে কাইউম ভাই বা মাদ্রাসায় যারা যারা শিবির করতেন তাঁদের সাথে আমার কথা বলাই নিষেধ ছিল। আব্দুল হালিম নামে আরেকজন সিনিয়র ভাই ছিলেন, যিনি শিবির করতেন তাঁর সাথে একদিন কিছুক্ষণ দাঁড়াতে দেখেছেন সে জন্য আমাকে আব্বার কাছে জবাবদিহি করতে হয়েছে, হালিম ভাইয়ের সাথে আমার কি প্রয়োজন ছিল?একবার সম্ভবত শিবিরের কোন ভাই আমাকে একটা বই দিয়েছিলেন “ঢাকায় কাবা শরিফের ইমাম” এই বইটি, বইটিতে সম্ভবত শিবিরেরে অফিসের সিল ছিল বা কোনভাবে। এরপর আব্বা আমাকে শক্তভাবে শাসিয়ছেন যে তাঁর বাসায় কোনদিন যেন শিবিরের বই প্রবেশ না করে।
আমরা ছয় ভাইয়ের মধ্যে আমি সম্ভবত লেখপড়ায় একটু ব্যতিক্রম ছিলাম বিধায় আব্বা সম্ভবত একটু বেশী আদর করতেন, তবে এটা বলতে হবে, এ ব্যাপারগুলোতে আব্বা খুবী সুবিচারক ছিলেন, কোন ব্যাপারে কার প্রতিই কোন ব্যাপারে কোন কিছুই কম বা বেশি যেন না হয়।
আমার বয়স ১০ বার বছর থেকে আম্যাকে মাঝে মধ্যে ইমামতী করতে দিতেন, আমি এবং আমার বড় ভাই হাফেয মাওলানা খালেদ সাইফুল্লাহকে আব্বা মাঝে মধ্যে ইমামতি করতে দিয়ে আব্বা পিছে দাঁড়াতেন, কিন্তু আমার বয়স ২০-২২ বছর হবার পর থেকে আমি শিবির করতাম এই অভিযোগ বা সন্দেহে আমাকে আর কোনদিন আব্বার সামনে ইমামতি করতে দেন নি। একবার স্মরণ আছে আমার এক বোনের বিয়ের প্রস্তাব এসেছিল, ছেলে সম্ভবত ডাক্তার ছিল, কিন্তু সম্ভবত শিবির করত, আব্বা শিবির করা ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেবেন না। চাই সে ডাক্তার হোক বা কিছু।
আমার আব্বা এভাবে কট্টর জামায়াত বিরোধী ছিলেন, কিন্তু জীবনে কোনদিন জামায়াত বা শিবির সম্পর্কে খারাপ কোন শব্দ ব্যাবহার করেন নি। তাঁর অনেক প্রিয় ছাত্র ছিল যারা জামাত করতেন, জামায়াতের এক সময়ের নোয়াখালী জেলা আমীর মাওলানা হিফযুর রহমান ভাই আব্বার প্রিয় ছাত্র ছিলেন, হিফযু ভাই সারা জীবন এবং আজো আব্বাকে খুব সম্মানেড় চোখে দেখেন।
একবার আমার বড় ভাই হাফেয সাইফুল্লাহ, কামেল কোথায় পড়বেন ভাবছিলেন। তিনি সম্ভবত তামিরুল মিল্লাত এবং মহাম্মাদপুর কাদেরিয়া তয়্যেবিয়া আলিয়া দুটোতেই ভর্তির সুযোগ পেয়েছিলেন, আব্বার কাছে যখন পরামর্শ চাইলেন, তখন আব্বা বললেন, “দুটারই আকিদা খারাপ, তবে কাদেরিয়ার চেয়ে তামিরুল মিল্লাতরা ভাল”।
আমাদের মাদ্রাসায় এক ওস্তাদ ছিলেন মরহুম মাওলানা মস্তোফা আল হুসাইনি। সে সময়কার দেশ জুড়ে খ্যাত ওয়ায়েজ ছিলেন, সময় অবশ্য আল্লামা খ্যাতিটা শুরু হয়নি। মোস্তোফা আল হুসাইনি সাহেবকে সে সময় হাফেজে তারিখ বা ইতিহাসের হাফেজ হিসাবে লকব দেয়া হতো। হসাইনি সাহেব পরে বাংলাদেশ ইসলামী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির হয়েছিলেন। হুসাইনি সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন, চেষ্টা করতেন আমি যেন তাঁর মত বা আমার বাবার মত হই , আমাকে তাঁর বড় বড় মাহফিলে সাথে নিয়ে যেতেন। একবার ঢাকার অদূরে শেখের চর নামে যতদূর মনে পড়ে এক জুট মিলে বিশাল ওয়াজ মাহফিল, যেখানে দেওবন্দি আরও ওয়ায়েজ আছেন। সবচে বড় ওয়ায়েজ হলেন মাওলানা সুলতান আহম্মদ নানুপুরি। নানুপুরি হুজুর নামে পরিচিত ছিলেন। হুসাইনি সাহেব আমাকে সে ওয়াজে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সাথে। এক পর্যায়ে তিনি আমাকে নানুপুরি হুজুরের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “হুজুর এই ছেলেটাকে একটু দোয়া করে দেন, ছেলেটা ভাল আলেমের ছেলে, কিন্তু তারে মওদুদিয়া পাইছে”। নানুপুরি হুজুর তখন বাথরুমে যাচ্ছিলেন, আমি ভাবলাম তিনি শুনেন নি কিংবা পাত্তা দেননি। তিনি বাথরুম থেকে এলেন, অজু করে এলেন, বসলেন, কথা বলতে শুরু করলেন। বিশেষভাবে জামাত সম্পর্কে, এক পর্যায়ে দারুল উলুম দেওবান্দের কোন উস্তাদের কথা বললেন যিনি তাঁকে বলেছিলেন “মুঝে মওদুদি কো কুফর কা আন্দিশা হায়”।
ওলামায়ে দেওবান্দ বা দেওবান্দি সিলসিলার আলেম বা অনুসারীরা দেওবান্দকে খুব আন্তরিকতার সাথে উনুসরন করেন।
আমি যখন মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলন পরিষদের আহাবায়ক সে সময় খতিব মাওলানা ওবাইদুল হক সাহেবের সান্নিধ্যে কয়েকবার যাবার সুযোগ হয়েছিল, খতিব সাহেব আব্বাকে চিনতেন এবং সে সূত্রে তাঁর সাথে কথা বার্তা বলা আমার পক্ষে সহজতর হয়েছিল। খতিব সাহেব একবার আমাকে বললেন, ‘বাবা তোমরা কিসের লেখাপড়া কর? আর কিসে রাজনীতি কর, তোমাদের মাদ্রাসার ছেলেরা মাদ্রাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখলেই সব ভুলে যায়, মাদ্রাসায় পড়েছে সে কথাটাও ভুলে যায়, অথচ দেখ আমরা দেওবান্দ থেকে ফারেগ হয়েছি তিরিশ বছর হয়ে গেছে এখনো দেওবান্দের নাম শুনলে গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়।“ দেওবন্দ যারা পড়েছেন তাঁদের মধ্যে এটা আরও দেখেছি। আমার আব্বা ছাড়াও আমাদের বৃহত্তর পরিবারে ৭-৮ জন দেওবন্দ ফারেগ আলেম ছিলেন। দেওবান্দ সম্পর্কে তাঁদের সকলের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধাবোধ দেখেছি অসাধারণ। সম্ভবত খতিব ওবাইদুল হক সাহেবের সময়ে এবং কারণে জামাতের সাথে ওলামায়ে দেওবন্দের ঘভীরতম সম্পর্ক ছিল। এর কারণ আমার দৃষ্টিতে পরস্পর স্রদ্ধাবোধ এবং সম্মান।
এবার আজকের জন্য উপসংহারে চলে আসি।
না, আমি মনে করিনা কাওমি আলেমরা যা করছেন বা বলছেন তা হিংসার বশবর্তী হয়ে করেছেন বা বলছেন। ওলামায়ে দেওবান্দের সাথে যে মত বিরোধ ছিল তা এখনো আছে। যেটা অনেকটা আকিদাগত। পরস্পর সম্পর্ক উন্নয়ন এবং ঐক্যের জন্য পরস্পর স্বীকৃতি এবং শ্রদ্ধাবোধ। এ প্রসঙ্গে আমার আব্বার একটা উদাহরণ টানতে পাড়ি। আমি যখন মাদ্রাসা ছাত্র আন্দোলনের আহবায়ক। ১৯৯২ সালের জুলাই মাসে ঢাকার ইঞ্জিনায়রস ইন্সিটিউট আমরা মাদ্রাসা ছাত্রদের দাবী দাওয়া নিয়ে সমাবেশ করেছিলাম। সে সম্প্যকার পূর্ত মন্ত্রী মিরযা গোলাম হাফিয ছিলেন প্রধান অতিথি, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে মির্জা সাহেব আসেন নি, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামি সাহেব ছিলেন বিশেষ অতিথি, মাওলানা মুহিউদ্দিন খান কেও আরেক বিশেষ অতিথি হিসেবে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল, কিন্তু নিজামি সাহেবকে কেন দাওয়াত দিলাম সে জন্য মুহিউদ্দিন খান সাহেব আসেন নি, বরং আমাকে পলিটিক্স করছি এরকম একটা বকা দিলেন। মুহিউদ্দিন খান সাহেব আমার আব্বার বন্ধু ছিলেন। জমিয়তুল মুদাররেসীনের প্রতিনিধি হিসাবে দাওয়াত দেয়া হয়েছিল আমার আব্বাকে, কামাল উদ্দিন জাফরি সাহেব ও ছিলেন বিশেষ অতিথি। আমার স্মরণ আছে সে সমাবেশে এবং ব্যাক্তিগতভাবে আমাকে অনেকবার বলেছিলেন জামাত শিবিরের অবদানের কথা। আমরা বাপ ছেলে কথা বলতাম অথচ আব্বা আমাকে বলতেন “তোমাদের লোক আর আমাদের লোক।“ বলতেন, “অমুক তো তোমাদের লোক।“ মাঝে বলতেন, “কাজ তো এখন তোমাদের লোকেরাই করছে আমদের লোকেরা তো এখন ঘুমিয়া আছে”। সেদিন মাদারাসা ছাত্রদের সমাবেশ শেষে আমরা যখন ট্যাক্সি চড়ে বাপ ছেলে বাসায় যাচ্ছিলাম, তখন এক পর্যায়ে কিছুটা কানে কানে আব্বা আমাকে বলেন, “আচ্ছা যুব কমান্ড এরা কারা, এরা কি তোমাদের লোক?ছেলেগুলি খুলি সাহসী।“ বলা বাহুল্য সে সময় যুব কমান্ড যুগান্তকারী একটা ভুমিকা রেখেছিল। আমার আব্বার মুখে কানে কানে কথাগুলো অনেক মূল্যবান ছিল।
আমার জানা মতে অধ্যাপক গোলাম আযম সাহেব, মাওলানা মতিউর রাহমান নিজামি সাহেব সহ জামাত নেতৃবৃন্দ ওলামায়ে দেওবন্দ বিশেষভাবে খতিব ওবাইদুল হক এবং শাইখুল হাদিস আজিজুল হক সাহেব সম্পর্কে যথেষ্ট সম্মানবোধ ছিল, অপরদিকে তাঁরাও জামাত সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন থাকলে একত্রে কাজ করতে সমস্যা ছিলোনা।
আমার আজকের এখানকার মূল বক্তব্য হল অন্যদের প্রেক্ষাপট বুঝতে হবে, শক্রুতা না বাড়িয়ে বন্ধুত্ব বাড়ানো উচিৎ। আর ইউটিউবের যুগ বলেই যে যার মত করে বক্তব্য ছেড়ে দেবে এটা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। আলেমদের সম্পর্কে কিছু ইউটুবার যেভাবে পোস্ট দিয়েছেন তা খুবি দখজনক, আর ওয়ায়েজিনে কেরামরা আরেকটু সতর্ক হওয়া দরকার।
আমার এই ছোট্ট লেখায় আমার পরিচিত জামাত নেতৃবৃন্দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, বিশেষ করে আমার একসময়ের খুবই ঘনিষ্ঠ মাওলানা আব্দুল হালিম ভাই, আমার আত্নিয় বড়ভাই মওলানা এ টি এম মাসুম, উদীয়মান নেতা আমার সহপাঠী, বন্ধু ডক্টর মাওলানা সামিউল হক ফারুকি ভাই আশা করি এ ব্যপারটা একটু বিশেষভাবে চিন্তা করবেন। আল্লাহ পাক আমাদেরকে ক্ষমা করুন। আমার এই লেখায় অনিচ্ছায় কোন ভুল হয়ে থাকলে আল্লাহ পাক আমাকে ক্ষমা করুন।
বিষয়: বিবিধ
১২৯১ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
অনেক ধন্যবাদ
মন্তব্য করতে লগইন করুন