আমেরিকায় এবারের কোরবানের ঈদ।
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ১৭ আগস্ট, ২০১৯, ০৯:১৪:০৮ রাত
আমেরিকায় আমার বয়স চব্বিশ বছর। আর চব্বিশ বছরে চব্বিশটা রোজা আর চব্বিশটা কোরবানির ঈদ কাটালাম। এত বছর পর আজ ঈদ নিয়ে বসার কারণ হল,এক সময় আমরা জানতাম,বুঝতাম গর্ব করতাম বাংলাদেশ দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশ। যেখানে ঘুম ভাংতো আজানের সুরে। ঢাকাকে বলা হয়ত মসজিদের নগরী। বাংলাদেশের আউল ভাটিয়ালি পল্লিগীতি ছিল ধর্মকে ঘিরে। আব্দুল আলিমের জ্ঞান ছিল নবী মোর পরশ মনি,নবী মোর সোনার খনি। জাতীয় কবি নজরুলের জ্ঞান ছিল মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই,যেন গোর থেকে আযান শুনতে পাই।
রোজার ঈদ এবং কোরবানির ঈদ ছিল বাংলাদেশের শতকরা নব্বই ভাগ মুসলিমের প্রধান উৎসব। আজ আধা হিন্দুয়ানী এ দেশে কোরবানির মধ্যে নির্মমতার প্রশ্ন দলে কনফিউসড ইন্টেলেকচুয়াল জাতীয় তথাকথিত বুদ্ধিজীবি। শুধু কোরবানি নয়,ইসলামের অনেক আচার আচরণ সংস্কৃতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে হিন্দুয়ানী সংসৃতি আমদানি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। এ প্রেক্ষাপটে ভাবলাম সারা বিশ্বে ইসলাম কিভাবে দেখা হচ্ছে তা একটু তুলে ধরবো ইনশাআল্লাহ। আমেরিকায় ঈদ নিয়ে আজকের ঈদ নিয়ে আজকের এই লেখাটা তারই অংশ।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটা কথা না বলে লোভ সামলাতে পারছিনা। কাশ্মীরে ভারতীয় সাম্প্রতিক নির্লজ্জ অত্যাচারের প্রতিবাদে গত শনিবার হোয়াইট হাউজের সামনে প্রতিবাদ সভা হয়েছিল এবং আজ হয়েছে ওয়াশিংটন ডিসিতে ইন্ডিইয়ান হাই কমিশনের সামনে। গত শনিবার এবং আজকের উভয় প্রতিবাদ সভাতেই অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছে আলহাদুলিল্লাহ। উপরন্তু আজকের প্রতিবাদ সভা শেষে আজ গিয়েছিলাম উজবেকিস্তানের এম্বেসিতে। উজবেকিস্তান সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?মুসলমানদের জন্য পবিত্র কোরআনের পরে দ্বিতীয় পবিত্রতম গ্রন্থ হল বোখারি শরিফ,এই বোখারি শরিফের ইমাম বোখারি রহঃ এই উজবেকিস্তানের,বোখারা শহরে। শুধু বোখারা বা ইমাম বোখারিই নয়,এই উজবেকিস্তানে রয়েছে ইসলামের উল্লেখযোগ্য ইতিহাস। শুধু উজবেকিস্তানই নয়,উজবেকিস্তানকে ঘিরে রয়েছে আরও ৫টি স্তান পাঠকে উনুরোধ করছি ইচ্ছা হলে গুগুলে চার্চ করে নিবেন বা বই পুস্তকে পড়ে নিবেন আজ এ ব্যাপারে লিখবনা,পরে ইনশাআল্লাহ লিখব। কারণ উজবেকিস্তান এম্বেসিতে আমি শুধু শুধুই অপরিকল্পিতভাবে যাইনি,পরিকল্পনা করে আপন্টমেন নিয়েই গিয়েছিলাম।
সে যাক,ধান বানতে গিয়ে গীত গাওয়ার মুদ্রা দোষ অনেকের মত আমার ও আছে। হ্যাঁ বলেছিলাম আমেরিকার কোরবানির ঈদের কথা।
আমেরিকায় আসার পড় প্রথম বছর কোরবানির ঈদ কিভাবে করেছিলাম ঠিক খেয়াল নেই,সেই ১৯৯৬ সালের কথা। তবে যতদূর মনে করার চেষ্টা করলাম সম্ভবত ১৯৯৬-৯৭ সেই দুই বছর কোরবানীর ঈদে কোরবানি করা বা দেখা হয়নি। ১৯৯৮ সালেই প্রথম কোরবানি করার জন্য মাঠে গেলাম। হ্যাঁ কোরবানি করার জন্য এদেশে আমরা দূরে অনেক দূরে মাঠে চলে যাই। ১৯৯৮ সালে তখন থাকতাম মিশিগানের এন আরবরে। সেখানে আমার এক পুরানো বন্ধু কাদির ভাইয়ের পরও আত্মীয় স্বজন পরিবার সবাই সেখানে থাকতেন,তাদের সাথে আমি খুব ঘনিষ্ঠ ছিলাম তাই তাদের সাথে কোরবানি দিতে মাঠে চলে গেলাম। সে সময় মাঠে গরুকে বেঁধে মাথায় গুলি করা হতো। এটাই ছিল বা এখনো আছে আমেরিকায় গোস্ত সরবরাহের পদ্ধতি। গরুকে গুলি করার আগে আমরা কোরবানির পদ্ধতিগুলো করে দোয়া কালাম পড়ে নিলাম। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি এই পদ্ধতিতেই প্রতিদিন পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ প্রাণীকে হত্যা করা হচ্ছে। আর এটা ২০১৯ সালের নতুন সংবাদ বা ইতিহাস নয়,এটাই পৃথিবীর ইতিহাস। মানুষ পশুকে পাক্ষিকে হত্যা করে আমিষ সংগ্রহ করে। সুতরাং কোরবানি আসলে যাদের হঠাত করে পশু প্রেম উতলে উঠে তারা যে বিদেশি পেট্রো ডলারের পালিত আরেক প্রাণী কিংবা নপুংসক নাদান মুসলিম নামধারী তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। তবে হ্যাঁ,জবাই করার সময় বা যে কোন সময় পশুর সাথে আমানবিক আচরণ করা নিয়ে অবশ্যই কথা আছে। আমরা সবাই জানি বা জানা উচিৎ যে এ ব্যাপারে ইসলামের স্পষ্ট বিধান রয়েছে পশুর সাথে যেন নির্দয় আচরণ করা না হয় এমন কি জবাই করার প্রাক্বালে।
সে যাক আবার আসি কোরবানির ঈদ প্রসঙ্গে। বিশেষভাবে এবারের ২০১৯ সালের আমার ঈদের কিচ্ছায়। ২০১৩ সালে মিশিগান থেকে চলে আসি ওয়াশিংটন ডি সি উপকণ্ঠে ভারিজিনিয়াতে। মিশিগান বা আমের অন্য অনেক স্টেইট এর তুলনায় ভারিজিনিয়া হলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর,টিলা টঙ্গর পাহাড় পর্বতে ভরা। আমেরিকায় দিন দিন মুসলমানের সংখ্যা বাড়ছে তাই বাড়ছে ঈদের নামাজে,জুমা নামাজে ভিড়। বিশ বছর আগে যেখানে মসজিদ ছিলোনা সেখানে অনেক বড় মসজিদ,জুমার দিনে তিন থেকে চারটি জুমার নামাজ হয় একই মসজিদে একটার পড় আরেকটা। ঈদের নামাজ হয় কোন মাঠে কিংবা বড় হলে বয়া স্টেডিয়ামে।
আমি যেখানে থাকি ভার্জিনিয়ার স্টারলিং শহর। এখানে কয়েকটি শহরকে একত্রে ডালাস ও বলা হয় ওয়াশিংটন ডি সি চার পাশে আরও ব্যাপক আরিয়া নিয়া পড়া ভারিজিনিয়া এবং ম্যারিল্যান্ড এর ব্যপক এরিয়াকে বলা হয় ডি সি মেট্রো এরিয়া। ডি সি মেট্রো তে অনেক গুলো বড় বড় মসজিদ আছে সব মিলিয়ে তিরিশটা বা আরও বেশি মসজিদ হতে পারে। তবে বড় বড় মসজিদ রয়েছে প্রায় দশ বারটা। আমি যেখানে থাকি আমার বাসা থেকে ৬ থেকে ৭ মিনিটের ড্রাইভ বা এক দেড় মাইলের মধ্যে বড় মসজিদটি রয়েছে তার নাম এডাম সেন্টার,এই মসজিদের আরও ৫-৬ টি শাখা রয়েছে,প্রায় প্রতিটি শাখায় জুমার নামাজ হয় তিনবার করে,বেলা ১২.৫০,১.৩০,এবং ২:১৫। ঈদের নামাজের জন্য বিরাট হল বা অডিটরিয়াম ভাড়া নেয়,এছাড়া হোটেল এর অডিটোরিয়াম,ভাড়া নেয় ঈদের জন্য।
২০১৩ সালে ওয়াশিংটন এরিয়াতে আসার পর থেকে কোরবানি দিতে মাঠে যেতে শুরু করি। কোরবানির মাঠগুলো অনেক অনেক দূরে,অনেক ক্ষেত্রেই প্রায় দেড় থেকে দুই ঘণ্টা ড্রাইভ করেতে হয় মাঠগুলো একেবারে অজ পাড়া গাঁ এরিয়া,পাহাড়ের পাদ দেশে। ২০১৩ এবং ২০১৪ সালে দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ করে ম্যারিল্যান্ড এর এক ফার্মে গেলাম। কিন্তু আগে যে বললাম আমেরিকাতে মুসলমান বাড়ছে তাই মসজিদ নামাজের পাশাপাশি বাড়ছে ভিড় কোরবানিতেও। ঘণ্টার পড় ঘণ্টা লাইনে দিড়িয়ে থেকে পাওয়া যায় না। নিয়ম হল আপনি গরু বয়া ছাগল হয়তো আগেই কিনে নিবেন বা ঈদের দিন সকালে কিনবেন,কিন্তু স্বভাবতই আগে আসলে আগে পাবেন ভিত্তিতে। আপনাকে সিরিয়াল নম্বর বা টিকেট নিতে হবে। এই লম্বা লাইনের কারণে ২০১6 সালে আমরা কোরবানির মাঠেই ঈদের নামাজ পড়েছিলাম প্রায় ৩০-৪০ জন মিলে। ২০১৭ সালে আমি এবং আমার ছেলে সালেহ গেলাম কোরবানি মাঠে,পরিকল্পনা ছিল সিরিয়াল নম্বর বা টিকেট নিয়ে আমরা ঘুরতে চলে যাব,আমরা নিশ্চিত ৩-৪ ঘণ্টার আগে আমাদের সিরিয়াল আসবেনা। মজার ব্যাপার ছিল সে কোরবানি মাঠ থেকে মাত্র ৪-৫ মাইল দূরেই সারা পৃথিবী বিখ্যাত আব্রাম লিঙ্কনের গ্যাটিসবারগ এড্রেস এর সেই যুদ্ধ ময়দান।
পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী টিকেটা নিয়ে আমরা বাপ ব্যাটা চলে গেলাম গ্যাটিসবারগ,৩-৪ ঘণ্টা ঘুরে এসে দেখি এখন আমাদের সিরিয়ালের ধারে কাছে আসেনি,বেলা তখন প্রায় ৫টা। ভাবলাম কোরবানি আজ আর করা হবে না। পরের দিন আসব।
এবছর ২০১৯ কোরবানির এক সপ্তাহ আগে থেকে ৫-৬ টা ফার্মে ফোন করলাম,কোথাও আডভাঞ্চস সিরিয়াল নাই,বুঝতে পারলাম ঈদের দিন কোরবানি দেয়া অসম্ভব,একটাই পথ খোলা ভরে উঠে গিয়ে রাস্তায় কোথাও ঈদের নামায পড়ে সারা দিন বসে থেকে বিকেল বেলা বা রাতে বাসায় ফেরা। তাই সিধান্ত নিলাম ঈদের দিন কোরবানি না করে পরের দিন করবো। সকালে ঈদের নামাজ পড়ে এসে ভাত চারটা খেয়ে পরিবার নিয়ে বের হলাম ফার্ম পরিদর্শনে। আমরা বাসা থেকে বের হলাম বেলা বাররটার দিকে। আগেই জানি, বেলা বারটায় গিয়ে কোন ফারমেই কোরবানি দেয়া যাবেনা,আমরা শুধু দেখতে যাব কত মানুষ হয় এন্ড মানুষ কি করে।
প্রথমে গেলাম এক ফার্মে,এ ফার্মের মালিক সম্ভবত মুসলমান। বলা বাহুল্য অন্যান্য অনেক ফার্মের মালিক মুসলমান না হলেও তাঁরা মুমুসলমানদের হালাল হারাম বুঝে এবং অনেক ফার্মে লেখা থাকে হালাল,তাঁরা শুকর বিক্রি করে না। আর তাছাড়া জবাই আপনি নিজে করবেন তাঁরা সব আপনার ইচ্ছা মত সব ঠিক করে দেবে। ফার্মে গিয়ে যা দেখার কথা তাই দেখলাম,আহা কি ভিড়। যার অপেক্ষা কৃত নতুন তাঁরা অনেকে রাগ করে চলে যাচ্ছিলেন। তাঁরা চিন্তাই করতে পারেন নি এত দেরী হবে।
কিন্তু আমি তো সেটা জানতাম,তাই ঈদের দিন কোরবানি নিয়ে মাথা ঘামালাম না। চলে গেলাম পাহাড়ের উপর। আমাদের বাসা থেকে অন্যদিকে প্রায় দেড় ঘণ্টা ড্রাইভ দূরে একটা বড় পাহাড়। এই পাহাড়ের সবচেয়ে বড় বিশিষ্ট হল পাহাড়ের ঠিক চুড়ায় একশত পাঁচ (১০৫) মাইল লম্বা রাস্তা। হ্যাঁ,আমি সেটাই বলেছি,পাহাড়ের ঠিক চুড়া দিয়ে দিয়ে রাস্তা করেছে একশত পাঁচ (১০৫) মাইল। আমরা অর্ধেকের বেশি রাস্তা ঘুরলাম,পাহাড়ের উপর,থামলাম,বার বার ছবি তুললাম,দেখালাম ছোট ছোট শহর,বাড়ি ঘর নদী,অন্যান্য পাহাড়গুলো।
সন্ধ্যা বা রাত বলা যায় প্রায় ৮টার সময় বাসায় ফিরলাম ক্লান্ত,শ্রান্ত বিধ্বস্ত হয়ে। পরদিন সোমবার,সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে ফজর নামাজটা পড়েই চলে গেলাম ফার্মে ,গিয়ে দেখি অলরেডি ৭-৮ জন গিয়ে উপস্থিত,তাদের অবশ্য গরু কোরবানি করবে,আমরা ছাগল বা ভেড়া কোরবানি করবো। আগে কোনদিন ভেড়া কোরবানি দিইনি,ভেড়ার গোস্ত খেয়েছি কিন্তু কোরবানি দিইনি,তাই এবার সাহস করে ভেড়া কোরবানি দিলাম।
বিষয়: বিবিধ
৭৪১ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন