আমেরিকার গ্রাম দেখা
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ০৫ আগস্ট, ২০১৯, ০৯:০৬:৩১ সকাল
গ্রামে যাওয়া এবং গ্রাম দেখার অভ্যাস আমার বলা যায় চিরাচরিত। মালয়েশিয়া থাকাকালীন সময়ে দুইবার ক্লেন্তানের গ্রামে গিয়েছিলাম। ১৯৯৪ সালে, থাইল্যান্ড সফরকালে বাংকক ছাড়াও ব্যংকক থেকে প্রায় ৮/৯ শত মাইল দক্ষিণে ফাতানিতে আমার বন্ধু সুকরীর গ্রামের বাড়ি গিয়েছিলাম, প্রায় ২৪ বছর আগের সেই সফরের কথা তেমন কিছু মনে না থাকলেও হাজ্জাই (হাত্যায়ি) থেকে লক্কড় ঝক্কর টেম্পুতে চড়ে ভাঙ্গা রাস্তায় ধাক্কা খাওয়ার কথা এখনো স্মরণ আছে।
আমেরিকায় এসে যখনই সুযোগ পেয়েছি একে বারে পাহাড় পর্বত ঘেরা কিংবা নদীর ধারে অথবা বিস্তৃত মাঠের গ্রামান্তরে চলে গিয়েছি। আমেরিকার ড্রাইভিং জীবনে কমপক্ষে দশ পনের বার এমন হয়েছে সোজা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম হঠাৎ মেঠো পথে গাড়ী নামিয়ে দিলাম। ২০১৪ সালে আমার বড় মেয়ে রাহমার জন্মের পর তার বয়স যখন মাত্র ৫৯ দিন আমরা রওয়ানা দিলাম মিশিগান, ভার্জিনিয়া থেকে মিশিগান, কিন্তু ফ্রি ওয়ে বা হাই ওয়ে ধরে নয়, রওয়ানা করলাম লোকাল পথ ধরে, ৮-৯ ঘণ্টার রাস্তা লাগল প্রায় ১৩ ঘণ্টা। ফিরে আসার সময় পাহাড়ের উপর লোকাল রাস্তায় হঠাত তুফানের কবলে পড়ে হারিয়ে গেলাম। ফোন, জি পি এস কিছুই কাজ করছিল না। বুদ্ধি করে আগে ছাপানো মাপ নিয়ে নিয়েছিলাম, তাই যখন জি পি এস কাজ করছিলোনা তখন রাস্তায় থামিয়ে একটা ম্যকডলান্ড এ গিয়ে মাপ হাতড়াচ্ছিলাম তখন এক আমেরিকান এসে দিক নির্দেশনা দিল।
এইতো কিছুদিন আগে এ বছর ২০১৯ সালে রমজানের ঈদ করতে গিয়েছিলাম মিশিগান, আসার পথে সোজা পথ বাদ দিয়ে ওহাইও পান্সেল্ভানিয়াতে ৮০ ভাগ রাস্তা ফ্রি ওয়ে বাদ দিয়ে গ্রামের রাস্তা দিয়ে ঘুরে ঘুরে আসলাম।
সে যাক এবার আসা আজকের কোথায়, গত বৃহস্পতিবার পহেলা আগস্ট কিছুটা ছুটি কাটাতে গিয়েছিলাম উইলিয়ামস বার্গ নামে আমেরিকার এক ঐতিহাসিক শহরে। ওয়াশিংটন ডিসি থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার ড্রাইভ। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় সেখানে অনেকগুলো যুদ্ধ হয়েছিল যে সব যুদ্ধের মাঠগুলো এখনো ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে রয়ে গেছে। অনেকগুলো জাদুঘর রয়েছে। শুক্রবার জুমার দিন, গুগল সার্চ করে একটি প্রাচীন মসজিদের ও খোঁজ পেলাম যদিও সে মসজিদে এখন নিয়মিত নামাজ হয়না, তবে উইলিয়ামস বার্গ শহরে নতুন একটা মসজিদ হয়েছে যেখানে জুমার নামাজ পড়লাম, মসজিদ বলতে একটা শপিং কমপ্লেক্স এর একটি দোকান ভাড়া নিয়ে স্থানীয় মুসলমানরা নামাজ পড়ছে। নামাজ পড়ালেন মিশরীয় এক তরুণ, এখানকার উইলিয়ামস এন্ড মেরি ইউনিভারসিটিতে পি এইচ ডি করছে। ইমামের পরনে হাফ শার্ট, জিনস প্যান্ট মাথায় তও টুপির প্রশ্নই আসেনা। তবে তাঁর খুতবা ছিল অনেক জ্ঞান গর্ভ।
নামাজের আগে আমরা গিয়েছিলাম উইলিয়ামস বার্গ এর নদীর অপারের অন্য একটি শহরে ফেরিতে চড়ে, ঐ শহরের নাম সুরী(Surry) , ফেরি দিয়ে নদী পার হয়ে সুরী কাউন্টিতে আরও প্রায় ২৫ মিনিট ড্রাইভ করে শহরে ঢুকলাম, আসলে শহর বললে ভুল হবে, একেবার বিরান গ্রাম বলা যায়। ফেরি ঘাট থেকে ২৫ মিনিট ড্রাইভ করে যেখানে গেলাম যাকে শহর বললাম, তা ছিল মূলত একটি চৌরাস্তার মোড়। একটা গ্যাস স্টেশন, একটা চার্চ, পোস্ট অফিস, একটা পিজার দোকান, ব্যাংক, কি একটা মেকানিক দোকান। আর কি একটা বিল্ডিং। আরেকটু দূরে কাউন্টি কোর্ট অফিস। পাশে একটা পুলিশে গাড়ী দাঁড়ানো। আরেকটু দূরে একটা সেভেন এলেভেন। চৌরাস্তার এক কোণে লাইব্রেরির চিহ্ন দেয়া এরো সাইন। অর্থাৎ বাম দিকে পাবলিক লাইব্রেরি আছে।
আলহামদুলিল্লাহ, আমার মেয়েদের লাইব্রেরি খুব প্রিয়, বড় মেয়ে রাহমা দুই বছর থেকেই লাইব্রেরিতে যেতে পাগল। প্রতিবার লাইব্রেরিতে এমন ভাবে বই নাড়া ছাড়া করবে মনে হবে কি যেন এক গবেষক। ভাবলাম এতদূর যেহেতু আসলাম আর এখানে দেখার মত সবুজ ঘাসের মাঠ এন্ড জঙ্গল ছাড়া আর কিছুই তো নাই, লাইব্রেরি যেহেতু আছে মেয়েদেরকে লাইব্রেরিটা দেখিয়ে নি।
গাড়ী চালানো অবস্থাতেই ঘাড় পেছনে ফিরিয়ে বললাম "আব্বু লাইব্রেরিরতে যাবে?", আমার দু মেয়েই বেশ আগ্রহ ভরে বলল, লাইব্রেরিতে যাবে।
গ্রামের লাইব্রেরি, দেখলাম আনুমানিক ৮০ বছরের এক বুড়ো রিডিং সেকশনে বসে বসে পত্রিকা পড়ছেন। তবে এখানের সব লাইব্রেরিতেই শিশুদের জন্য আলাদা সেকশন থাকে। লাইব্রেরিয়ানকে বললাম, "দেখ, আমরা জাস্ট ঘুরতে এসেছি, লাইব্রেরিয়ান আমাদেরকে শিশুদের সেকশন দেখিয়ে বলল ইচ্ছা হলে বসতে পারো।
ফিরতি ফেরিতে উইলিয়ামস বার্গ ফিরে এসে জুমার নামাজ পড়ে খেয়ে দেয়ে বিকেলে গেলাম হাম্পটন শহরে। হাম্পটন মোটামুটি নামকরা শহর, সেখানে একটি ফার্ম এ গেলাম যেটা কিছুটা চিড়িয়াখানার মত। ময়ূর, গরু ছাগল, ভেড়া, শুকর, হাঁস, মুরগি প্রায় সবি আছে।
শনিবার গেলাম প্রায় তিন ঘণ্টা ড্রাইভ করে গেলাম আটলান্টিক সাগরের পাড়ে এক অজ পাড়া গাঁয়ে। এই অজ পাড়া গাঁ শহরের নামে শিঙ্কুটেইগ (chincoteague)। আগ্রহী পাঠকে অনুরোধ করবো গুগল করে দেখে নিতে, কারণ গুগল মাপ দেখলে মনে হবে কত অজ পাড়া এটা। এবং এখানে যে কোন মানুষ বাস করতে পারে তা ম্যাপে দেখলে বুঝা কঠিন।
এই দ্বীপের সবচেয়ে বড় বিশিষ্ট হল প্রাচীনতম ঘোড়া।
আজ রবিবার বাড়ি ফেরার পালা। কাল রাতে শিঙ্কুটেইগ দ্বীপ থেকে ফিরে এসে প্রায় দুই তিন ঘণ্টা গুগল করলাম, খুজছিলাম আসার পথে কোনো গ্রাম হয়ে ঘুরে আসা যায় কিনা। হ্যাঁ, খুঁজে পেলাম আরেক বিখ্যাত গ্রাম্য শহর।
আমার বিশ্বাস সারা বিশ্বের প্রায় সকল সচেতন মানুষ শারলট ভিল (Charlottesville) এর নাম শুনেছেন। ২০১৭ সালে বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গদের যে সমাবেশ হয়েছিল এবং তোলপাড় হয়েছিল সেই শারলট ভিল, আমার আসার পথ থেকে একটু ভিন্ন রাস্তা দিয়ে দুই ঘণ্টা বেশি ড্রাইভ করলে শারলট ভিল হয়ে আসা যাবে। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম শারলট ভিল জাব।
শারলট ভিল থেকে ১০-১৫ মাইল উত্তরে, আরেকটি গ্রাম, তার নামে গরডন ভিল, গ্রামের রাস্তা দিয়ে যখন গাড়ী চালাচ্ছিলাম, নয়নাভিরাম সবুজ খেতের মাঠ দেখে সত্যিই নয়ন জড়িয়ে গেল। মাইলকে মাইল, সবুজ আর সবুজ। কিন্তু সমস্যা হল কোথাও থামানর সুযোগ নাই, এক লেইনের রাস্তা, আস্তে চালানোর ও সুযোগ নাই, পেছনে গাড়ী আছে। কয়েকবার ইচ্ছা করলাম থামাবো, লক্ষ্য করলাম পেছনে গাড়ীর লাইন পড়েছে, নিজের কাছে লজ্জা লাগলো, বুঝলাম আমি আস্তে চালানো কারণে পেছনে লাইন পড়েছে।
হঠাৎ একটা রাস্তা দেখলাম ডান পাশে, ততক্ষণে রাস্তা পার হয়ে গেলাম। ভাবলাম, নাহ, এই রাস্তাটা মিস করা যায় না। একটু দূরে গিয়ে গাড়ী ইমারজেঞ্ছিতে দিয়ে ইউ টার্ন করলাম। ঐ ছোট রাস্তায় ঢুকলাম, ছোট রাস্তাটা দূরে এক বা দু বাড়িতে ঢুকবার ড্রাইভ ওয়ে। গাড়ী পার্ক করলাম এই ছোট রাস্তা বা ড্রাইভ ওয়ে তে। হাত দিয়ে গাছগুলো ধরলাম। দেখে মনে হচ্ছিলাম মুগ ডাল জাতীয় কোন একটা ডালের বিশাল খেত। শুধু শত শত একর নয়, মাইলকে মাইল শুধু সবুজ খেত। মনের মত করে কিছু ছবি তুললাম।
বিষয়: বিবিধ
৯৪৭ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন