কিছু কথা, কিছু আবেগ
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৫, ১১:৩১:১২ সকাল
প্রতিটি মানুষের জীবনে কিছু অধ্যায় থাকে। চড়াই উতরাই। আমি আজ পাকা ২০ বছর আমেরিকায়। যারা আমাকে বাংলাদেশে থাকতে চিনতেন তাঁরা অনেকেই হয়তো জানেন। আমেরিকা আসার আগে প্রায় পুরো সময় আমার জীবনটা ছিল খুব ছন্দময়, প্রানোজ্জল, প্রেরণা প্রেষণায় ভরা, উজ্জল উচ্ছল।
গত ২০ বছরের আমেরিকার জীবনে আমার জীবনে ছিল অনেক চড়াই উতরাই, অনেক পরীক্ষা, কাঠিন্য। আমি নিজেও কিছু কিছু ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।
২০০৭ সালে আমি আমার বাবাকে হারাই। যে আব্বা ছিলেন আমার জীবেনের গর্ব, আমার প্রেরণা, চোখে দেখা আদর্শ মানুষ, সে বাবা হঠাৎ দুনিয়া ছেড়ে চলে যান, শেষ দেখা, শেষ কথা হয়নি আমার সেই প্রিয় মানুষটির সাথে।
২০১২ সালে আমার মা অসুস্থ হন, আমাকে দেখার জন্য ব্যাকুল, বারবার আমাকে দেখতে চান। আমি তখন বিশ্বখ্যাত বুলডোজার প্রস্তুতকারক কোম্পানী কেটাপিলার বা ক্যাট কোম্পানীতে একটি চাকুরীতে সবেমাত্র জয়েন করি। স্বভাবতই কেটারপিলারের সে চাকুরী লোভনীয় অপরদিকে মা মরণপ্রায়। বড়ভাই বললেন, যদি মা দুনিয়া থেকে চলে যান আফসোস থেকে যাবে। ভাবলাম, ছোটবেলা পড়েছি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মায়ের ডাকে নদী পাড়ি দিয়েছেন।
কেটাপিলারের সে চাকুরী ছেড়ে দিয়ে মাকে দেখতে যাই। আমি দেশে গেলে মা যেন সম্পূর্ণ সুস্থ। ৩ সপ্তাহের জন্য দেশে গিয়ে মায়ের সাথে ৩ মাস কাটাই। আমি যেখানে যেতে চাই, মা আমার সাথে যেতে চান, যদিও সবখানে মা'কে নিতে পারিনি। আমি রাতে মশারী না টানিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি, রাত ১টার সময় মা এসে মশারী টানিয়ে দেন। আমার এ মা'ই নাকি ৩-৪ মাস আগে মরনাপন্ন ছিলেন। আমার ভাই বোনরা কেউ কেউ বললেন, জীবনে যাই করেছি, বিদায়ের আগে মায়ের দোয়াটা নিলাম। আমার শিশুকালের পর আর কোনদিন মায়ের কাছে একত্রে ৩ মাস থাকার সেীভাগ্য হয়নি।
তিন মাস পর মাকে অনেকটা সুস্থই গ্রামের বাড়ী রেখে আসি, আমি চলে আসার দু সপ্তাহের মধ্যে ২০১২ সালের ২রা রমজান আমার মা তাঁর চিরস্থায়ী দেশে চলে যান। সকলকেই একদিন যেতে হবে, কিন্তু এক্ষেত্রে আমি ভাগ্যবান, বিদায়ের আগে মায়ের সাথে কাটালাম।
২০১২ সালে আমেরিকায় ফিরে এসেই বিখ্যাত কম্পিউটার কোম্পানী হিউলো প্যাকার্ড বা (এইচ.পি) তে নতুন চাকুরীতে জয়েন করি।
আমার ছেলে সালেহ'র বয়স এখন ১৪, এবার সে দশম শ্রেণীতে, সাধারণ হিসেবে সে এবার ৯ম শ্রেণীতে হবার কথা ছিল। ১৪ বছর বয়স, যাকে বলে টিন এজার। সে কথা মনে রেখেও বলতে হয়, আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে শেষ করতে পারবো না। সালেহ একজন আদর্শ ছেলে। সালেহর পিতামাতা হিসাবে আমাদের জীবনের চড়াই উতরাই, আমাদের ব্যর্থতা, নানা সমস্যা প্রতিকুলতার মাঝে যে সালেহ আমাদের সামনে বড় হচ্ছে, এটা আল্লাহ পাকের বিশেষ রহমত ছাড়া সম্ভব নয়। সকল প্রশংসা আল্লাহর।
গতবছর ২০১৪ সালে আল্লাহ পাক আমাদেরকে একটা কন্যা সন্তান দান করেন। মেয়েটির নামের ব্যাপারে আগে থেকে কোন পরিকল্পনা ছিলনা, মেয়ের জন্মের পর হাসপাতালেই আল্লাহর সাহায্য কামনা করে হঠাৎ চিন্তা করে চিন্তা করলাম নাম রাখবো "রাহমা" সোজা বাংলায় যার অর্থ রহমত। আমার আবাল্য বন্ধু নিউ ইয়র্কে অবস্থানরত মুফতি আবদুল মালেককে ফোন করে একটু পরামর্শ করলাম। মালেক বললো, রাহমা খুব সুন্দর নাম এবং অর্থবহ।
আমি জানি না, আমার আমেরিকার ২০ বছরের জীবনের চড়াই উতরাইয়ের মাঝে আমার মায়ের বিদায় বেলার দোয়া আমার আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো আমার শিশু কন্যা "রাহমা" হয়তোবা আল্লাহর পক্ষ থেকে রহমতই বয়ে এনেছে। আমি মাঝে মধ্যে আমার মেয়েকে বলি, "আমার মা, নিজে পরপারে চলে গিয়ে বুঝি তোমাকে পাঠিয়ে দিয়েছে।"?
আমার মেয়ে "রাহমা" 'র জন্মের বছর ২০১৪সালে আমার উপর আল্লাহ পাকের একটা বিশের রহমত হয়। গতবছর ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাস্ট্রের তথা বিশ্বের একটি বিখ্যাত দেড় শত বছরের প্রবীন প্রকাশক কোম্পানি "টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস গ্রুপ" এর সাথে আমার একটি প্রফেশনাল বই লেখার চুক্তি হয়। এজন্য আমাকে ৬ মাস সময় দেয়া হয়, পরে অবশ্য আরো ২ মাস বাড়ানো হয়।
আলহামদুলিল্লাহ, গত ৮ মাসের কঠোর পরিশ্রমের পর ৩১শে আগস্ট আমি আমার ট্রান্সক্রিপ্ট শেষ করে জমা দেই। প্রাথমিক রিভিউতে বইয়ের মূল বিষয়গুলো সকলেই প্রশংসা করেছেন, তবে স্বভাবতই সকলের দৃষ্টিতে ইংরেজী গ্রামার থেকে শুরু করে ভাষার দিকগুলো অনেক সংশোধন করতে হবে। যা স্বাভাবিকভাবেই বোধগম্য।
আমি জানি না, আমার ভাগ্যে কি রয়েছে বা আমার কি যোগ্যতা রয়েছে, তবে নিঃসন্দেহে আমি মনে করি, টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস এর মত কোম্পানীর সাথে আমার মত নগন্যের চুক্তি আমার বাবা মায়ের দোয়ায় আল্লাহর অসীম রহমত এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো আমার মেয়ে রাহমা এবং ছেলে সালেহ'র উসিলা।
সত্যিই আমি মাঝে মধ্যে একটু শংকিত হই, ভয় লেগে যায়, আমি কে, আমি পারবো তো আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো রহমতের মর্যাদা দিতে? মাঝে মধ্যে চোখ ছল ছল হয়ে পড়ে। আজো শুয়ে শুয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলাম। আমার এই অশেষ আনন্দের সংবাদ আমি আমার মা বাবাকে দিতে পারছি না। অথচ আমার উপর এই মা বাবার অশেষ আশা ছিল। অসম্ভব রকমের আশা ছিল। অথচ, আমি জানি, আমি আমার বাবা মা কে হতাশ করেছিলাম। নিজেকে অপদার্থ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছি।
মাত্র দু'তিন দিন আগে আমার এক বয়সে বেশ ছোট মামাত ভাইয়ের সাথে ফোনে কথা বলছিলাম। এক পর্যায়ে মামাত ভাইটি বললো, "ভাইয়া আপনি জানেন না, আমরা আপনার উপর কত আস্থা রাখতাম, কত আশা করতাম।"
আমি জানি না, আমার ভবিষ্যত কতদুর যাবে। কতদিন বাঁচবো, শরীর স্বাস্থ্যে কতটুকু কুলাবে, আমি সে সবকিছু তক্কদির এবং আল্লাহ পাকের উপর ছেড়ে দিচ্ছি। তবে কিছুদিন আগে আমার একান্ত স্নেহাষ্পদ আত্নিক ছোটভাই তওফিক রসিকতা করে ফেইসবুকে লিখেছিল, বয়স নাকি আমার দিন দিন কমছে। ওয়েল, সবাই জানে এবং বুঝে, তওফিক রসিকতাই করেছে। বয়স সবারই বাড়ে। আমারও বেড়েছে, আজ থেকে ২০ বছর আগে ১০ বছর আগে যা করতে পারতাম এখন আর তা পারি না। তবে, এ কথা ঠিক, আল্লাহর শুকরিয়া, আমার মরহুম বাবা মায়ের দোয়া, আল্লাহর বিশেষ রহমত রয়েছে। আমার আত্নবিশ্বাস বেড়েছে, কর্মতৎপরতা বেড়েছে। আমাকে যারা বাংলাদেশে দেখেছেন। সেই সদা কর্ম তৎপর, সদা হাস্যজ্জল আমি যেন কিছুটা আমার সে জীবনে ফিরে এসেছি। তবে বলার প্রয়োজন অবশ্যই নেই, মাঝখানে ২৫ বছর চলে গেছে তাই শরীর স্বাস্থ্যে আমি আর সেই আমি অবশ্যই নই।
আমি বড় ধরনের দু'তিনটি প্রজেক্ট হাতে নিয়েছি। টেইলর এন্ড ফ্রান্সিস সাথে চুক্তি করা এই অন্যতম একটি প্রজেক্ট। যে ক'দিন আল্লাহ পাক জীবন রেখেছেন যেন কিছু একটা ভাল কাজ করে যেতে পারি।
আমার বন্ধু বান্ধবদের মধ্যে যাঁরা বাংলাদেশের পরে পরিচিত। যাঁরা অনেকেই আমার বাংলাদেশের ইতিহাস জানেন না। যে সব বন্ধুরা আমার জীবনের চড়াই উতরাই দেখেছেন। ব্যার্থতা, ভুল সিদ্ধান্ত দেখেছেন সকলের কাছে আমি শুধু দোয়া চাই।
মানুষ যখন দুঃসময়ে থাকে, মন, মনন, মানষিকতা যখন সমান্তরাল থাকে না তখন মানুষ আচার ব্যাবহারে অন্যকে বিরক্ত বা কষ্ট দিয়ে থাকে। আমার চেনা পরিচিত অনেক বন্ধুজন দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন, বিশেষভাবে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের অনেক পরিচিত মুখের চিরবিদায় আমাকে ব্যাথিত করে। আমাদের ক্ষনস্থায়ী জীবন নিয়ে ভাবিয়ে তোলে। আমার কোন ভুল সিদ্ধান্ত, আমার অসমান্তরাল মন মানষিকতার কোন আচার আচরণ কখনো যদি আপনাকে ব্যাথিত করে থাকে দয়া করে ক্ষমা করে দিবেন।
সর্বপোরী কথা হলো, আমি আমার সকল বন্ধু বান্ধব সুধীজন সকলের দোয়াপ্রার্থী। সত্যি সত্যিই আমি বড় ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। অনেকে শুনলে তাজ্জব হয়ে যেতে পারেন তাই আপাতত বিস্তারিত ব্যখ্যায় যাচ্ছি না। তবে আমি আপনাদের দোয়া প্রার্থী। আপনি যদি যে কোন কারণে আমাকে ভালবাসেন, আমার কোন কিছু যদি আপনাকে জীবনে অনুপ্রাণীত করে থাকে, আপনি যদি মনে করেন আমাকে দিয়ে কোন কিছু করা সম্ভব, তাহলে আমাকে দোয়া করবেন। আমি সত্যি সত্যি দোয়ার কাঙ্গাল। আমার মা বাবা চলে গেছেন। আল্লাহ ছাড়া কোন মানুষের কাছে নিজের সেই অনুভুতি প্রকাশ করার মত । আমার মা বাবাকে বার বারই মনে পড়ে।
বিষয়: বিবিধ
১৪৯৮ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
লেখাটি পড়ে আবেগাপ্লুত হলাম
আপনার বাবা-মায়ের জন্য এবং আপনার পরিবারের জন্য দোয়া করি! আপনার সাফল্য ও দীর্ঘ সুস্থজীবনের জন্য আল্লাহতায়ালার কাছে দরখাস্ত পেশ করছি!
আমিও প্রবাসে থেকে বাবা-মা হারিয়েছি, শেষ দিনগুলো কাছে থাকার সুযোগ হয়নি!
আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনিনা, তবে নামটি আমার খুব চেনা ও প্রিয়! ছোট্ট এক-দু লাইনের মন্তব্য বা অনুরূপ কিছুও চোখে পড়লে মন দিয়ে পড়ি ও গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করি! ফরিদ ভাইয়ের পোস্টে আপনার মন্তব্যটাও পড়েছি!
আল্লাহর জন্যই আপনাকে ভালবাসি!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন