ইতিহাস ঐতিহ্য
লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ১০ মে, ২০১৫, ০৮:৪৫:৩৫ রাত
ড. রইছ উদ্দিন এর মৃত্যু আমাকে আমার ইতিহাস ঐতিহ্যের কিছু জিনিস মনে করিয়ে দেয়, সত্যি বলতে কি, যেগুলো কিছু কিছু আমি ভুলে গেছি বা হারিয়ে ফেলেছি । ড. রইছ উদ্দিন আমার আত্নীয় ছিলেন না, কিন্তু ছিলেন আত্নার আত্নীয়। আজ সকালে মেঝে ভাইয়ের সাথে ড. রইছ উদ্দিনের মৃত্যু বিষয়ে আলাপ করতে গিয়ে জানলাম, আমার আব্বার মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি আমাদের বাড়ীতে গিয়েছিলেন।
ড. রইছ উদ্দিনের মৃত্যু আমার যে ঐতিহ্য স্মরণ করিয়ে দেয়ার কথা বলেছিলাম।
বাংলাদেশে ইসলাম পন্থীদের মধ্যে কয়েকটি ধারা রয়েছে, এই ধারা দেখেই অনেকটা বুঝা যায় কে কোন পন্থী। জামা কাপড়ের ধরণ, দাঁড়ীর সাইজ, কথার মধ্যে শব্দ ব্যাবহার। লম্বা জামা, গোল জামা, সাইড কাটা জামা, কোন কোন ক্ষেত্রে পাগড়ী দেখেও বুঝা যায় কে কোন পীর পন্থী। আমার এক উস্তাদ ছিলেন মাওলানা মুস্তফা আল হোসাইনী। আজ থেতে ২০-২৫ বছর আগেও তিনি ছিলেন বাংলাদেশে নামকরা ওয়ায়েজীনদের একজন। ২৫ বছর আগের তাঁর ওয়াজ মাহফিলের পোস্টারে তাঁর পরিচয়ে লেখা থাকতো হাফেজে তারীখ। তিনি ছিলেন ইতিহাসবিদ। তাঁর ওয়াজ ছিল বেশীর ভাগ ইসলামের ইতিহাস এবং ঐতিহ্য ভিত্তিক।কয়েক বছর আগে সম্ভবত কোন সংবাদে দেখেছিলাম তিনি এখন চর মোনাইর পীরের সংগঠন ইসলামী আন্দোলনের নায়েবে আমীর বা ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি আমাকে তাঁর সাথে অনেক ওয়াজ মাহফিলে নিয়ে গিয়েছিলেন, তাঁর প্রধান টার্গেট ছিল আমি যেন শিবিরের কব্জায় পড়ে না যাই। সে সময় আমাকে অনেকেই টার্গেট করতো। মোস্তফা আল হোসাইনী হুজুর প্রকাশ্যেই বলতেন। শুধু তাই নয় একবার ঢাকার শেখের চর নামক কোন এক এলাকায় বড় এক ওয়াজ মাহফিলে তিনি মাওলানা সুলতান আহমদ নানুপুরী হুজুরকে আমাকে দেখিয়ে দিয়ে বললেন, "হুজুর, এই ছেলেটাকে একটু দোয়া করে দিন, ছেলেটা ভাল আলেমের ছেলে, কিন্তু ছেলেটাকে মওদুদী এ ধরছে। শিবির জামাতকে সে সময় কোন কোন হুজু মওদুদী বলতেন। আমি আগে অনেকবার লিখেছিলাম আমার আব্বাও কট্রর শিবির বিরোধী ছিলেন, এজন্য একবার আমার আব্বার মাদ্রাসায় বড় করে দেয়াল লেখা হয়েছিল, "শিবিরের দুশমনের ক্ষমা নাই।", আমার আব্বাও আবার সেই লেখাই শিবিরের বিরুদ্ধে ব্যাবহার করেছিলেন। মাদ্রাসার ছাত্ররা যখন তাঁর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে (যার বেশীর ভাগই ছিল শিবির)। তিনি তখন তদন্তে আসা ম্যাজিস্ট্রাটকে বলেছিলেন, আমি তাদেরকে শিবির করতে দেইনা বলেই আমার বিরুদ্ধে আন্দোলন, এই দেখুন তারা কত বেয়াদব, আমার মাদ্রাসায় আমার বিরুদ্ধে কিভাবে দেয়াল লিখেছে। আমার আব্বা সেই পলিসিতে কাজ হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে আব্বার অভিযোগ ছিল, যাঁরা তার বিরুদ্ধে আন্দোলন করে তাদের সাথে আমার যোগাযোগ এবং সম্পর্ক। বলা বাহুল্য, সে সময় আমি শিবিরের সাথে জড়িত হচ্ছিলাম।
আমার এক ক্লাসমেটের নাম ছিল আবদুর রব। এই আবদুর রব সম্পর্কে একদিন মাওলানা মোস্তফা আল হোসাইনী হুজুর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'ইরে (এই) অাবদুর রব কি শিবির করে নি (নাকি)"। আমি বললাম, কেন হুজুর কি হইছে, হুজুর বললেন আবদুর রবের কাছ থেকে শিবিরের গন্ধ পাওয়া যায়। কারণ আবদুর রব তার কথার মধ্যে "ইসলামী আন্দোলন" এই শব্দটা ব্যবহার করেছিল। বলা বাহুল্য, সে সময় "ইসলামী আন্দোলন" শব্দদ্বয় জামাত শিবিরের লোকজন ছাড়া আর কেউ ব্যাবহার করতেন না। যদিও সময়ের প্রেক্ষাপটে এই শব্দদ্বয় এখন প্রায় সবাই ব্যাবহার করেন। এরপর আমি মাওলানা ফজলুল হক আমীনিকে "ইসলামী আন্দোলন" শব্দদ্বয় ব্যাবহার করতে দেখেছি। এমনকি আওয়ামী লীগ নেতা মেয়র হানিফকেও এই শব্দদ্বয় ব্যাবহার করতে শুনেছি।
তেমনিভাবে, অনেক শব্দের বানান ছিল ভিন্ন রকম। সে সময় আরবী যে সমস্ত শব্দ সীন থেকে আগত, সে শব্দ বাংলায় "ছ" লেখা হতো, যেমন আজ আমরা সালাম লিখি সে সময় লেখা হতো "ছালাম", এমনকি ৫২'র ভাষা আন্দোলনের শহীদ সালামের নাম ও সে সময় "ছালাম" লেখা হতো। ড. রইছ উদ্দীন এর নাম সেই থেকে "রইছ" লেখা হতো। আমার আব্বা এগুলো খুব শক্তভাবে মেনে চলতেন। আমার আব্বা আমার নাম লিখতেন, "আবু ছায়ীদ", আমার আব্বা আমর নাম ডাকার সময় আরবী মাখরাজ আদায় করেই আবু ছায়ীদ, বা আবু সাঈদ যেটাই লিখিনা কেন, আরবী আইন অক্ষর এবং মদ্দে তাবায়ী এর হক্ক আদায় করে ডাকতে। আমি যদিও খুবই ছোট ছিলাম, তবু ও আমার কেন যেন মনে হচ্ছে ড. রইছ উদ্দিন এর নাম মাদ্রাসা বোর্ডে রেজিস্ট্র্যশন সহ বাংলা বানান আমার আব্বাই ঠিক করে দিয়েছিলেন। কোন ব্যাক্তি আরবীতে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নাম একটা লেখায় যতবারই লিখবে ততবারই সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পুরো লিখতে হবে, আমার অনেকেই শর্ট কার্ট করার জন্য আরবীতে (সালআম) একটা শব্দ লেখা হতো, এটা দেখলে আব্বা ক্ষেপতেন, বলতেন, ব্যাটা, রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে এত কৃপণতা করো কেন। যতবার লিখবা ততবারইতো সওয়াব হবে।
অামার বাবা, জীবনে কোনদিন কাগজ কলমকে পাঁয়ে লাগতে দিতেন না। এরকম কিছু জিনিস আছে, পাপ নয়, তবু ও তিনি পরিহার করে চলতেন। ড. রইছ উদ্দিন এসেবের কিছু কিছু মৃত্যুর আগ পর্য্যন্ত মেনে চলতে দেখেছি এবং শুনেছি। এর অনেক কিছু আমি পারিনি। আমার বাবা দেয়া নামের বাংলা বানানটা ও আমি রাখিনি। যদিও এটা সত্য আমার বাবা নিজেও অনেক মুক্তমনা ছিলেন, এবং আমাদেরকে মুক্তমনা করে গড়ে তুলেছেন। সময়ের প্রেক্ষাপটে কিছু কিছু জিনিস পরিবর্তন হয়ে যায়। যেমন, একসময় আমরা রমজান বলতাম এবং লিখতাম, এখন লিখা হয় রামাদান। বলা বাহুল্য রমজান আর রামাদান এই পরিবর্তন মুলত এক সময়কা দ্বোয়াল্লিন আর জোয়াল্লিন এর বিরোধের মধ্যে কোন পার্থক্য নাই।
আমার ইতিহাস ঐতিহ্যের কথায় ফিরে আসি, ড. রইছ উদ্দিন ছিলেন ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যলয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর। এ বিষয়টাও একটা গভীর আলোচনার বিষয়। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের কয়েকটি ধারার মত এ বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েও কয়েকটি ধারা রয়েছে। ৮০ এবং ৯০ এর দশকে বেশ বিতর্ক ছিল। কয়েকটি সেমিনারও হয়েছিল। সোজা কথা, ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয় চেয়েছিলেন মাওলানা মান্নান, শর্ষীনার পীর সাহেব এবং দেওবন্দী আলেমরা। অপরদিকে জামায়াত বা জামায়াত সমমনারা চেয়েছিলেন সোজা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এখানে মজার ব্যাপার ছিল, আমার আব্বা চেয়েছিলেন ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, আর আমি চেয়েছিলাম ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। আমার আব্বা ছিলেন জমিয়তুল মোদাররেসীনের জয়েন্ট সেক্রেটারী, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, মাওলানা মান্নান, শর্ষীনার পীর সাহেব হুজুর এবং কওমী আলেমদের দাবী। ড. রইছ উদ্দিন সে ধারার একজন পরিপুরক ছিলেন। ড. রইছ উদ্দিন এর মত মহান ব্যক্তিরা ওস্তাদকে সম্মান করতে গিয়ে আমার আব্বার অনেক আদর্শ ধরে রেখেছে, ছেলে হিসেবেও আমি যা পারিনি। আব্বার হাতের লেখা আমি অনুকরণ করতে পারিনি, আব্বার অনেক ছাত্র পেরেছে। আব্বার দেয়া নামের বানান আমি রাখতে পারিনি। আব্বা এবং তাঁর ঐতিহ্যের ধারকদের আন্দোলনে প্রতিষ্ঠিত ইসলামী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরেছিলেন ড. রইছ উদ্দিন। এমনকি ৪০-৫০বছর পরেও আমার আব্বাকে দেখতে আমাদের বাড়ী গিয়েছিলেন ড. রইছ উদ্দিন, অথচ মৃত্যু আগে আমি আমার বাবাকে দেখতে পারিনি। আল্লাহ তায়ালা আমার বাবা এবং ড. রইছ উদ্দিনের মত মহান ব্যাক্তিদের ভাল কাজগুলো কবুল করুন, ভুল ক্রটি ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফিরদাউস নসীব করুন।
বিষয়: বিবিধ
১২৭৯ বার পঠিত, ৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
পিতা বা শিক্ষক এর অন্ধ অনুকরন করা তাদের হক আদায় করা নয় কিন্তু আমাদের দেশের মাদ্রাসা শিক্ষা এমনকি সাধারন শিক্ষা ব্যবস্থায় ও অন্ধ অনুকরনকেই ইসলামি বিধান হিসেবে শিখান হয়। "মক্কার পথ" বইয়ে আল আযহার এর এক শায়খ এর কথা পড়েছি যিনি তার ছাত্রদের সম্পর্কে বলেছিলেন ওরা সেই ভারতিয় গরুদের মত যারা লিখিত সব কিছু খায়! এরা শুধু শুনছে মুথস্ত করছে আর উগরে দিচ্ছে নতুন কোন চিন্তা ছাড়াই। আমাদের অবস্থাও হয়ে গিয়েছে তাই!!!
মন্তব্য করতে লগইন করুন