ধর্ম এবং বিশ্বাস

লিখেছেন লিখেছেন আবু মাহফুজ ১১ ডিসেম্বর, ২০১৪, ১২:৫৯:১৮ রাত

ধর্ম এবং বিশ্বাস

উপক্রমণিকাঃ

ধর্ম বিশ্বাসটা আসলে কি? ধর্ম বিশ্বাসটা মুলতঃ একধরনের বিশ্বাস মাত্র। যে বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু অনেক কিছুই হতে পারে। যদিও পৃথিবীর বেশীর ভাগ ধর্মেরই কেন্দ্রবিন্দু ঈশ্বর, গড, বা আল্লাহ। ঈশ্বর, গড বা আল্লাহ আছে কি নেই এটা যুক্তি দিয়ে বুঝার বিষয় নয়। ধর্ম সম্পর্কে অধিকাংশ পশ্চিমা দার্শনিকদের মতে,very broadly: "Religion is any specific system of belief about deity, often involving rituals, a code of ethics, and a philosophy of life." ধর্ম হলো মূলতঃ এক প্রকার জীবন দর্শন। কোন না কোন প্রকার আধ্যাতিকতায় বিশ্বাস। অধিকাংশ ধর্মই কোন প্রকার ঈশ্বর, আল্লাহ বা এক প্রকার সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে।

ঈশ্বর বা আল্লাহ আছেন একথা যেমন যুক্তি দিয়ে কেউ প্রমাণ করতে পারবেন না তেমনিভাবে ঈশ্বর বা আল্লাহ যে নেই তারও কোন যুক্তি দিয়ে প্রমান করার বিষয় নেই। এই উভয় ক্ষেত্রেই বিশ্বাসটা হলো প্রধান। বিষয়টা যুক্তির নয় বরং বিশ্বাসের। কেউ নিজের, দুর্বলতা, ব্যার্থতা সীমাবদ্ধতা অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তার উপর চাপিয়ে দিয়ে শান্তি পান আবার কেউবা নিজের বিবেককেই চুড়ান্ত ভেবে বিবেকের উপর বিশ্বাস স্থাপন করেন। এক্ষেত্রে কেউ বিশ্বাস করেন অদৃশ্য সৃষ্টিকর্তায় আবার কেউবা বিশ্বাস করেন অদৃশ্য বিবেকে। বিবেকবাদীদের বিবেকটাই ঈশ্বর, তাদের চিন্তাটাই তাদের ধর্ম। কোন কোন ক্ষেত্রে নিজদেরকে বুদ্ধিজীবি ভেবে আতœপ্রসাদ লাভ করেন।

মানুষের বিশ্বাস, আদর্শ এবং অভিমত সম্পর্কে অগাস্টিন বলেছেন, , “Everyone who understands also, believes, and everyone who has an opinion believes, too; but not everyone who believes understands, and no one who merely has an opinion understands. প্রতিটি বোধসম্পন্ন মানুষেরই একটা বিশ্বাস আছে। কোন ব্যাপারে যারা কোন মত ব্যক্ত করে সেটা বিশ্বাস থাকার কারনেই করে। কিন্ত কোন ব্যক্তি কোন কিছুতে বিশ্বাস করলেই তিনি যে বুঝেন তা নয় এবং একজন ব্যাক্তি যার যাচ্ছেতাই অভিমত সে আসলেই বুঝেনা।

ধর্ম হলো মানুষের চিরন্তন প্রয়োজনীয়তা। ধর্মকে বাদ দিয়ে মানুষ বাচতে পারেনা। একজন মানুষ অনেক্ষণ যাবৎ ঠান্ডায় অবস্থানের পর তারপর এরটু গরম বা উষনতার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে অপরদিকে অনেকক্ষণ যাবৎ গরমে অবস্থান করার পর যেমন একটু শীতলতা পেতে চায় ঠিক তেমনিভাবে একজন মানুষ বস্তুবাদী জড়জগতের কর্মব্যাস্ততার পর আতিœক প্রশান্তি খুঁজে বেড়ায়। মানুষের এ চাহিদা কোনদিন কেউই দমন করতে পারেনি এবং পারবেনা। খাদ্য ছাড়া কোন শরীর যেমন কোনদিন বাচতে পারেনা, তেমনিভাবে ধর্ম ছাড়া, বিশ্বাস ছাড়া, আস্থা ছাড়া কোনদিন কোন আতœা বা প্রাণ বাঁচতে পারেনা। বিশ্বাস ছাড়া পৃথিবীটাই আসলে অচল। আপনি গাড়িতে চড়েছেন একটা বিশ্বাস নিয়ে। এখানে আপনার বিশ্বাসটা হলো গাড়িটা আপনার গন্তব্যে নিয়ে যাবে এবং সহি সালামতে পেীছাবে। এ বিশ্বাসটা যদি আপনার না থাকতো আপনি গাড়িতে চড়তেন না। আপনার বিশ্বাসটা সঠিক কি বেঠিক সেটা পরের কথা। তবে আপনার একটা বিশ্বাস ছিল বলেই আপনি গাড়িতে চড়েছেন। মানুষ বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয় একটা বিশ্বাস নিয়ে, একে অপরকে বিশ্বাস করে। সারা জীবন একত্রে বাস করবে, ঘর সংসার করবে বা অন্য কিছু। প্রেমিক প্রেমিকাও একে অপরকে বিশ্বাস করে। বাজারে লেন দেন করতে গেলে সেখানেও একটা বিশ্বাস কাজ করে। এমনিভাবে দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজ পরিচালিত হয় কোন না কোন বিশ্বাস এবং পরষ্পর আস্থার মাধ্যমে। আপনার বিশ্বাস ভুল হতে পারে কিন্তু কাজ করতে হলে বিশ্বাস আপনার লাগবেই। যারা বিশ্বাস করেনা তারা কোন সিদ্ধান্তে যেতে পারেনা। এদেরকে ইংরেজীতে বলা হয় কনফিউজড। এরা খুব তর্ক করতে ভালভাসে, তত্ব ঝাড়তে চায় কথায় কথায়। আপনার বিশ্বাস যে সবসময় ১০০% ঠিক হবে এমনটি কিন্তু নয়। যেমন আসা যাক গাড়ী চড়ার উদাহরনে, আপনি যদি বিশ্বাস না করেন যে গাড়িটি সহি সালামতে পেীছাবে তাহলে আপনি গাড়িতে চড়বেন না। হতে পারে এই গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটাবে, তাতে আপনার মৃত্যুও হতে পারে। কিন্তু আপনার যদি কোন বিশ্বাস না থাকে তাহলে আপনি কোনদিনই গাড়িতে চড়তে পারবেননা। উপরোক্তো বিশ্বাসগুলো ধর্ম বিশ্বাস থেকে পৃথক হলে ও এ গুলোও মানুষের জীবনে বিশ্বাসের অংশ।

বিশ্বাসটা অনেক সময় অযেীক্তিক হতে পারে, হয়ে থাকে। কিন্তু এটার অর্থ এ নয় যে, যারা ঈশ্বর বা আল্লায় বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসটা অযেীক্তিক আর যারা ঈশ্বরহীনতায় বিশ্বাস করে তাদের বিশ্বাসটা সঠিক। পৃথিবীর প্রতিটি বিশ্বাসের পেছনেই রয়েছে কিছু না কিছু অযেীক্তিকতার ছোঁয়া। আপনার দৃষ্টিতে অন্যের বিশ্বাসটা হাস্যকর মনে হতে পারে। আপনি ভাবতে পারেন পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বোকা। সেটা আপনার বিশ্বাস, তবে সেটাই যে সঠিক তা আপনি বলতে পারবেন না। কখনো কখনো আস্তিক বা ধার্মিকদের বিশ্বাসটা হাস্যকর হতে পারে আবারো কখনো বা নাস্তিকদের বিশ্বাসটা হাস্যকর মনে হতে পারে। বিশ্বাসের সাথে যুক্তি টিকে না। আমি আপনাকে বললাম, আমি আপনাকে ৫০ হাজার টাকা দেব, আপনি বললেন প্রমাণ চাই, নিশ্চয়তা চাই। এক্ষেত্রে তখন আর বিশ্বাসের অস্তিত্ব রইলো না। আমি বললাম, প্রমাণ চান?! আর্শ্চয্য! আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন না?! হ্যাঁ, সত্যি সত্যিই এ ক্ষেত্রে আপনি আমাকে বিশ্বাস করেন নি।

একজনের বিশ্বাস অন্যজনের কাছে গাজাখুরি মনে হতে পারে অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে এ ক্ষেত্রে কোনটা ঠিক আর কোনটা বেঠিক তা নির্ভর করবে বাস্তবতার উপর। মনে করুন, বর্তমান প্রযুক্তির যুগে একজন গ্রামের লোক কম্প্যুটার সম্পর্কে কিছুই জানেন না, অথচ গ্রামের এই লোকটি বুদ্ধিমান একজন যুক্তিবাদী। একজন লোক হঠাৎ শহর থেকে এসে বললো যে, কম্প্যুটারে বসে আপনি পৃথিবীর খবর মুহুর্তের মধ্যে নিতে পারেন। ঢাকা থেকে যেসব পত্রিকা বেরোয় এসব পত্রিকার ইন্টারনেট এডিশনে আমেরিকায় বসে ঢাকায় যখন রাত ২টা তখনই আমেরিকার লোকজন পড়তে পারে তখন গ্রামের ঐ লোক নিঃসন্দেহে মনে করবে যে, শহরের ঐ লোকটা শহর সম্পর্কে মিথ্যা গাল গল্পই করে যাচ্ছে। আলোচ্য অংশের মূল বক্তব্য হলো কোন বিষয়ে বিশ্বাস করা বা না করাটা মূলতঃ ঐ বিষয় সম্পর্কে আপনার জ্ঞানের পরিধির উপর নির্ভর করে। যেখানে সেখানে যাকে তাকে বিশ্বাস করাটা যেমন একধরনের বোকামী তেমনিভাবে না জেনে শুনে সকল কিছুতেই অবিশ্বাসটা ও অন্য ধরনের বোকামী।

বিশ্বাসের এই চিরন্তনতা পৃথিবীর জন্ম থেকেই ছিল। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস, এরিস্ট্যাটল, প্ল্যাটো, অগস্টিন, হেগেল, ক্যান্ট সবাই ধর্মের সত্যতা এবং প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে গেছেন। প্ল্যাটোর দর্শনের অন্যতম মূল সুত্র ’বাস্তব জগৎ’ (Real world ) এবং’ছায়া জগৎ’ ((Shadow world/visible world) মুলতঃ ধর্মেরই প্রতিদ্ধনী। বাস্তব জগৎ এবং ছায়া জগৎ দিয়ে প্ল্যাটো বুঝাতে চেয়েছেন যে আমরা যে জগৎ দেখি এটা কিন্তু আসল জগৎ নয় এটা আসল জগতের ছায়া মাত্র। প্ল্যাটোর মতে, মনে করুন আপনার বাসায় যে চেয়ারটা দেখছেন আপনি যদি সে চেয়ারটা ধ্বংশ করে ফেলেন তথাপী আপনি কিন্তু আসল চেয়ারটা ধ্বংস করতে পারেননি আসল চেয়ারটা রয়ে গেছে বাস্তব জগতে। প্ল্যাটোর মতে পৃখিবীতে আমরা যা দেখছি সবকিছুই কিন্তু আসল বস্তুর ছায়া মাত্র। প্ল্যাটোর এই অভিমত বাইবেল এবং কোরানের সাথে সামনজস্যশীল। খৃস্টান ধর্ম অনুযায়ী বিশেষত যারা ট্রিনিটি বা ৩ খোদায় বিশ্বাস করে তারা মনে করে পবিত্র আতœা বা হলি স্পিরিট হলো সকল কিছুর উৎস। অন্যদিকে কোরানের দৃষ্টিতে আল্লাহই হলো পৃথিবীর সকল কিছুর উৎস (নুর)। এছাড়া মুসলমানদের বিশ্বাস হলো আল্লাহই সকল ক্ষমতার উৎস বা মালিক। উপরোক্ত তিনটি বিশ্বাসকে একত্রে দেখতে গেলে বলা যায় যে, প্ল্যাটো যেটাকে বাস্তব জগৎ বলেছেন খৃস্টানরা তাকে বলছে পবিত্র আতœা (হলি স্পিরিট) আর মুসলমানরা বলছে আল্লাহ।

প্ল্যাটো ধর্ম সম্পর্কে সরাসরি বলেছেন, The God should only be represented as good, and pious, because it is the nature of divinity to be good. He says, that the creator, created the universe from his likeness, out of the preexisting chaos.

ধর্ম সম্পর্কে হেগেল বলেন, , “Religion’s proper task is to strengthen, by means of the idea of God as moral lawgiver, what impels us to act ethically and to enhance the satisfaction we derive from performing what our practical reason demands, specifically with regard to the ultimate end that reason posits: the highest good.”

তিব্বতের ধর্মীয় নেতা দালাইলামা বলেছেন, "Every religion emphasizes human improvement, love, respect for others, sharing other people's suffering. On these lines every religion had more or less the same viewpoint and the same goal."

ধর্মে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতাঃ

ধর্মে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতা আসলে কি? অবিশ্বাসটা হলো বিশ্বাসের নেতিবাচক দিক। কোন বিষয়ে বিশ্বাস করাটা যেমন একটা বিশ্বাস আবার বিশ্বাস না করাটাও আবার এক ধরনের বিশ্বাস। তেমনিভাবে নাস্তিকতাটাও এক ধরনের বিশ্বাস। যেমন আপনি একটা লোককে বিশ্বাস করেন যে তিনি যা বলছেন তা সত্য বলছেন, আর যদি লোকটাকে অবিশ্বাস করেন তার মানে আপনি বিশ্বাস করেন যে লোকটা মিথ্যা বলছে। বিখ্যাত ওয়েবস্টার অভিধান অনুযায়ী, An Atheist is "a person who believes that there is no God". নাস্তিক হলো এমন এক ব্যাক্তি যিনি বিশ্বাস করেন যে, ঈশ্বর বা আল্লাহ বলতে কিছু নেই।

Oxford Advanced Learner’s Dictionary অনুযায়ী atheism is belief that there is no God, and atheist is a person who believes that there is no God” অর্থাৎ একজন নাস্তিকেরও একটা বিশ্বাস আছে আর সে বিশ্বাস হলো আল্লাহ নেই এই বিশ্বাস। একজন নাস্তিকের বিশ্বাস হলো, ধর্মটা হলো আসলে প্রতারণা, আফিম। মজার ব্যাপার হলো, একজন নাস্তিকের বিশ্বাসটা ও কিন্তু একজন আস্তিকের মত দৃঢ় হতে পারে, এবং কোন কোন ক্ষেত্রে অন্ধ হতে পারে, হতে পারে অটল, আপোষহীন, এবং অনড়। এদেরকে কেউ কেউ মজা করে বলে থাকেন ঈমানদার নাস্তিক। যেমন বাংলাদেশের প্রয়াত ডঃ আহমদ শরীফ। এদেরই এক গুরু আইজাক আসিমভ (Isaac Asimov) মৃত্যুর আগে বলেছেন, ", "Although the time of death is approaching me, I am not afraid of dying and going to Hell or (what would be considerably worse) going to the popularized version of Heaven. I expect death to be nothingness and, for removing me from all possible fears of death, I am thankful to atheism."

নাস্তিকদের মধ্যেও তাদের বিশ্বাস নিয়ে অন্ধতা থাকতে পারে। আইজাক আসিমভের উপরোক্ত মতকে আমরা তার বিশ্বাসের দৃঢ়তা বলতে পারি। সেটাই তার ঈমান। উপরোক্ত বক্তব্যে মিঃ আসিমভ শেষ বাক্যে বলেছেন I am thankful to atheism, যেটা ঠিক মুসলমানদের আলহামদুলিল্লাহ বলার মত। ইংরেজরা বলে ঞযধহশং এড়ফ. । বাংলাদেশের প্রয়াত অধ্যাপক আহমদ শরীফের অনেকগুলো কথাকে তেমনিভাবে তার বিশ্বাসের দৃঢ়তা বলা যেতে পারে। তবে বাংলাদেশে বুদ্ধিজীবি নামধারী কিছু লোক যখন কথায় কথায় ধর্মকে টেনে এনে দোষারোপ করেন। কবির চেীধুরী যখন বলেন, ”মসজিদে যায় চোর বাটপাররা” যখন মাদ্রাসা শিক্ষাকে বন্ধ করার দাবী আসে, বাংলাদেশের টি,ভি তো যখন প্রত্যক্ষ বা পরক্ষোভাবে ধর্ম সম্পর্কে অবমাননাকর বিষয় উপস্থাপন করা হয়, তাসলিমা নাসরিন যখন কথায় কথায় ধর্মকে টেনে এনে দোষারোপ করে তখন নিঃসন্দেহে সেটাও এক ধরনের অন্ধতা তা হলো ধর্মের বিরুদ্ধে অন্ধতা। যেটাকে বলা যেতে পারে ধর্মহীনান্ধতা বা নাস্তিকতান্ধতা। ব্যাক্তিগতভাবে আমি মনে করিনা যে, কোন ব্যাক্তি যদি নাস্তিকতায় বিশ্বাস করে এতে অন্য মানুষের মাথা ব্যাথা থাকা উচিৎ। সে স্বর্গে যাক কিংবা নরকে যাক সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। তেমনিভাবে কোন মুসলমান যদি নামাজ কালাম করে বেহেশতে যেতে চায় তাতে একজন নাস্তিকের কলমবাজি করাটা অন্যায়। একজন নাস্তিক যদি নিজের বিশ্বাসের সীমানা ডিঙিয়ে অন্যের বিশ্বাসের বিরুদ্ধে নামে তাহলে অবশ্যই তা বাড়াবাড়ি। সেই বাড়াবাড়ির প্রতিরোধ হওয়া উচিৎ।

নাস্তিকদের বিশ্বাস হলো ঈশ্বর বা খোদা মানুষ সৃষ্টি করেন নি বরং মানুষই ঈশ্বর বা খোদাকে সৃষ্টি করেছে। নাস্তিকরা আরো মনে করে যে, প্রকৃতির বাস্তবতা হলো ধর্মে অবিশ্বাস। তারা মনে করে, মানুষকে নিরপেক্ষ ছেড়ে দেয়া হলে সব মানুষ নাস্তিক হয়ে যেত। কিন্তু নাস্তিকদের এ যুক্তি ঠিক নয়। কারণ প্রথম কথা হলো, ধর্ম আসলো কিভাবে তাহলে। প্রকৃতির বাস্তবতা যদি নাস্তিকতা হতো তাহলে প্রথম মানুষগুলো নিশ্চয়ই নাস্তিকই ছিল যেটা নাস্তিকরা প্রকৃতপক্ষেই বিশ্বাস করে কিন্তু এখানে কথা হলো তখন তো ঐ নাস্তিক মানুষগুলোকে (যদি সত্যি সত্যিই থেকে থাকতো) তো নিরপেক্ষই ছেড়ে দেয়া হয়েছিল এবং তখন তো কোন ধর্ম ছিলনা তারপর ও ঐ মানুষগুলো ধর্ম পেল কোথায়? এবং আস্তে আস্তে সারা পৃথিবী গ্রাস করলো কিভাবে? এখনতো ধার্মিকদের সংখ্যাই বেশী। সৃষ্টিকর্তা আছে কি নেই সে বিতর্কে না গিয়েও বলতে হবে আপনি যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস নাও করেন তথাপী মানতে হবে যে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ বিশ্বাস নিয়েই বেচে আছে। আর এই কোটি কোটি মানুষগুলো অথর্ব নয়।

আধুনিক বিশ্বে ধর্মঃ

পৃথিবীর ইতিহাসে এমন কোন সময় ছিলনা যে যখন কোন মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করেনি। এমন কোন স্থান নেই যেখানে কোন ধর্মবিশ্বাসী নেই। পাশ্চাত্য জগতই ধর্মকে কিভাবে মূল্যায়ন করে থাকে। আমার এ কথা দ্বারা পাশ্চাত্য জগতের মাহাত্য বর্ণনা করা উদ্দেশ্য নয়। কিংবা পাশ্চাত্যকে আমাদের জন্য আদর্শ মনে করারও কোন কারন নেই। বরং ধর্ম বিশ্বাসের চিরন্তনতাই এখানে উদ্দেশ্য। বৃটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র অঘোষিতভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে খৃষ্টান ধর্মের ক্যাথলিজমের আদর্শ এবং ধর্ম বিশ্বাস দিয়ে। আমাদের এই বিভ্রান্ত বুদ্ধিজীবিরা যারা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় বা মাদ্রাসা নাম দেখলে সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পান, মাদ্রাসাকে গালাগালি করেন, তাদের এই জ্ঞান আছে কিনা জানিনা যে, এই পাশ্চাত্য জগতে হাজার হাজার ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়, এবং প্রাইভেট স্কুল রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে অনেকগুলো প্রভাবশালী বিশ্ববিদ্যালয়ই হলো ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়। জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটি, সেন্ট লুইস ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অফ সান ডিয়াগো, ইউনিভার্সিটি অফ সান ফ্রানসিসকো, ইউনিভার্সিটি অফ ডেট্রয়েট মার্সি এই সবগুলো নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ই কিন্তু ক্যাথলিক বিশ্ববিদ্যালয়। অপরদিকে ইউরোপ আমেরিকায় অনেকগুলো ইহুদী বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেমন বাল্টিমোর কলেজ অফ জুইশ স্টাডিজ, ক্লিভল্যান্ড কলেজ অফ জুইশ স্টাডিজ, লন্ডন স্কুল অফ জুইশ স্টাডিজ, অক্সফোর্ড সেন্টার ফর হিব্র“ এন্ড জুইশ স্টাডিজ। এছাড়া হার্ভাড, কর্নেল, কলাম্বিয়া, নিউইয়র্ক, ক্যাম্ব্রিজ সহ সবগুলো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে খৃষ্টবাদ এবং ইহুদীবাদের উপর উচ্চশিক্ষার সুযোগ।

যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেস বা প্রায় সবগুলো রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম শুরু হয় বাইবেল পাঠ দিয়ে। আপনার কাছে যদি যুক্তরাষ্ট্রের যে কোন মুদ্রা থাকে এক, পাঁচ, দশ বা যে কোন ডলার নোট কিংবা ১ সেন্ট, ৫ সেন্ট, ১০ সেন্ট, ২৫ সেন্ট যে কোন রকম মুদ্রা, এর এক পৃষ্ঠ ভালভাবে উল্টিয়ে দেখুন। প্রতিটি আমেরিকান মুদ্রায় লেখা রয়েছে In God We Trust ”আমরা আল্লাহ বা ঈশ্বরের উপর আস্থা স্থাপন করি”।

সত্যি এদেশে ধর্মকে খুবই সম্মান করা হয়। এদেশের জনগন যে কোন ধর্ম বিশ্বাসকে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন। ১১ই সেপ্টেম্বরের আগে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কেও তাদের অনেক শ্রদ্ধা ছিল। আপনি ধর্ম পালন করলে যে কোন অফিসে আপনি বিশেষ সম্মান পাবেন। হ্যাঁ ধর্মান্ধতা বা ফেনাটিসিজম এদেশেও আছে তবে আপনি যদি কোন ফেনাটিক এর হাতে না পড়েন তাহলে এদেশে যে কোন ধর্ম পালন করা অনেক নিরাপদ বাংলাদেশের তুলনায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের বাংলাদেশে দাড়ি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেতে ভয় করতে পারে কিন্তু এদেশের ক্যাম্পাসে বা কোথাও ভয় করবেনা।

শুধু ইহুদীবাদ এবং খৃষ্টবাদের উপরই নয় ইসলামের উপরও রয়েছে বিশ্বের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে উচ্চতর ডিগ্রী। শুধু ডিগ্রীই নয়, এত উন্নত গবেষনা হয় যে ইসলাম ধর্মের অনেক দুর্লভ পুস্তকাদি হয়তো মুসলিম বিশ্বে পাবেন না অথচ এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষনাগারে গেলে তা হয়তো পেয়ে যাবেন। কথাটা আরো স্পষ্ট করেই বলি, যেমন বোখারী শরীফের ব্যাখ্যা বা শরাহ ’ফাতহুল বারী’ পুস্তকটির খন্ডগুলি, কিংবা মনে করুন ইমাম ফখরুদ্দিন রাজী রচিত তাফসীর আল কবির কিংবা বিখ্যাত ইতিহাস গ্রন্থ ”সিয়ার আ’লাম আন নুবালা” গ্রন্থটি বাংলাদেশের খুব কম সংখ্যক আলেম আছেন যারা চোখে দেখেছেন। উক্ত পুস্তকত্রয়ের কপি বাংলাদেশের একেবারে গুটি কয়েক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্টানে থাকতে পারে অথচ যুক্তরাষ্ট্রের অনেকগুলো বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ যেমন, হার্ভাড, টেম্পল, ইউনিভার্সিটি অফ মিশিগান, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরীতে এসব গ্রন্থের কপি দেখতে পাবেন। এমনিভাবে অনেকগুলো গবেষনাধর্মী দুর্লভ ইসলামী পুস্তক এখানকার লাইব্রেরীতে বিদ্যমান।

শুধু তাই নয় এখানকার অনেক নামকরা নামজাদা জ্ঞানী অধ্যাপক ইসলামের উপর গবেষনা করে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ভাবতে পারেন যে, এ সমস্ত অরিয়েন্টালিস্টরা তো ইসলামের বিরোধীতা করার জন্যই ইসলামের উপর গবেষনা করে। না, কথাটা সর্বাংশে সঠিক নয়। হ্যাঁ, এ সমস্ত গবেষকদের অনেকে ইসলামের বিরোধীতায় রয়েছেন আবার এদের অনেকে ইসলামের সমর্থনে অনেক পুস্তকাদি রচনা করেছেন। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ওয়াশিংটন ডি,সির জর্জ টাউন ইউনিভার্সিটির Religion, International Affairs and Islamic Studies অধ্যাপক (জন এসপোজিটো) John Esposito যিনি Center for Islam and Christian Muslim Understanding প্রতিষ্ঠাতা ডাইরেক্টর ও। তিনি ইসলামের উপর অনেকগুলো বই রচনা করেছেন। ইসলামের উপর তার রচিত পুস্তকাদির মধ্যে রয়েছে: Islam: The Straight Path; The Islamic Threat: Myth or Reality?; Islam and Democracy (with John 0. Voll); Islam and Politics; Political Islam: Revolution, Radicalism or Reform?; Islam and Secularism in the Middle East (with Azzam Tamimi); The Iranian Revolution: Its Global Impact; Islam, Gender and Social Change and Muslims on the Americanization Path (with Y. Haddad); Voices of Resurgent Islam; Islam in Asia: Religion. Politics, and Society; and Women in Muslim Family Law. এছাড়াও তিনি The Oxford Encyclopedia of the Modern Islamic World and The Oxford History of Islam এর সম্পাদক। জন এসপোজিটোর মত অন্য অধ্যাপক হলেন জন ও, ভল (John 0. Voll) তিনি ও ইসলামের উপর একাধিক পুস্তক রচনা করেছেন।

শুধু আমেরিকা নয় ইসলামের উপর গবেষনা রয়েছে বিশ্বময়। এছাড়া অনেক নামকরা মুসলিম অধ্যাপক এবং গবেষক রয়েছেন, তাদের মধ্যে উল্যেখযোগ্য ব্যাক্তিত্ব হলো টেম্পল ইউনির্ভাসিটির প্রফেসর মাহমুদ আইয়ুব যিনি একজন অন্ধ প্রফেসর। এছাড়াও টেম্পল ইউনির্ভাসিটির ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান, প্রফেসর খালিদ ব্ল্যাংক্যানশীপ। যিনি আমেরিকায় জন্মগ্রহনকারি ইসলাম ধর্মে দিক্ষীত সাদা আমেরিকান মুসলমান। এছাড়া ও যুক্তরাস্ট্র এবং যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান রয়েছে যে গুলো ইসলামের উপর গবেষনা চালিয়ে যাচ্ছে। তন্মধ্যে উল্যেখযোগ্য হলো Islamic Foundation UK

এছাড়াও ইসলামের উপর গবেষনা রয়েছে লন্ডনের University of London SOAS (School of African and Oriental Studies) ) আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন অধ্যাপক এই প্রতিষ্ঠান থেকে পি,এইচ, ডি ডিগ্রীধারী। এমনিভাবে ইসলামের উপর গবেষনা রয়েছে ইউরোপের অন্যান্য দেশে এবং অস্ট্রেলিয়াতে ও ।

বিষয়: বিবিধ

১২৭২ বার পঠিত, ৪ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

293242
১১ ডিসেম্বর ২০১৪ সকাল ০৫:৫১
পললব লিখেছেন : ভাল বিশ্লেষণ!
বিশ্বাসীর আশা থাকে,থাকে গন্তব্যে পৌঁছার আকুলতা। কিন্তু অবিশ্বাসীর থাকে নিরাশা,থাকে হতাশা আর ব্যস্ত থাকে মুরগী আগে না ডিম আগে তাই নিয়ে ব্যকুলতা। তবে বিশ্বাসী আর অবিশ্বাসীদের একটি বিষয়ে একমত তা হল প্রত্যেককে মরতে হবে। এখানে কিন্তু বিশ্বাসীরা মরা বলতে অবিশ্বাসীদের মত করে ভাবে না, তাঁরা ভাবে ইন্তেকাল অর্থাৎ পরলোকে গমন। মদ্দাকথা অবিশ্বাসী মনে সবচেয়ে বড় খটকা আসলেই কি আত্মা আছে!!!! ধন্যবাদ।
১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০১:২৫
237942
আবু মাহফুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য।
293438
১১ ডিসেম্বর ২০১৪ সন্ধ্যা ০৬:৩৪
রিদওয়ান কবির সবুজ লিখেছেন : চমৎকার লিখাটির জন্য অনেক ধন্যবাদ।
এথিজম এর পিছনে যতটা না বিশ্বাস আছে তার চেয়ে বেশি আছে ভোগবাদ। সব ধর্মই কিন্তু ভোগের চেয়ে ত্যাগ কে প্রাধান্য দেয় এবং অপচয় কে খারাপ বলে।
294402
১৫ ডিসেম্বর ২০১৪ রাত ০১:২৫
আবু মাহফুজ লিখেছেন : ধন্যবাদ।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File