লজ্জাহীনতা—ঈমানের অঙ্গহানি।

লিখেছেন লিখেছেন তাহনিয়া ১৭ মে, ২০১৩, ০৩:০৮:১৯ দুপুর



Bismillahir Rahmanir Rahim

Rabbish rahli sadri wa yas-sir li amri wahloul uqdatam mil-lisaani yafqahu qawli.

O my Lord! expand me my breast; Ease my task for me; And remove the impediment from my speech, So they may understand what I say[20:25-28]

এই তো সেদিন শ্বাশুড়ী পুরনো দিনের ছবিগুলো বের করে দেখাচ্ছিলেন। দেখছিলাম আর একটা কথা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। দিন দিন মানুষের লজ্জা কমে যাচ্ছে। আগের দিনের সাদাকালো ছবিগুলো বা হালকা ঘোলা রঙ্গিন ছবিগুলোর মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ছবিগুলোতে সব সময় একটু না একটু দূরত্ব থাকতোই। মনের দুরত্ব না থাকলেও ছবি তোলার সময় কেউ এত ঘেষাঘেষি করে দাড়াতো না। কারণ তাদের কাছে ব্যাপারটা লজ্জার কারণ ছিল। এমন না যে তাদের মিল মহব্বত কম ছিল। মিল মহব্বত ঠিকই ছিল, কিন্তু সেটা তারা সবার সামনে প্রকাশ করতো না। কিন্তু বর্তমান যুগের স্বামী-স্ত্রীর যুগল ছবিগুলো যখন দেখি , তখন দেখি ভিন্ন চিত্র। দু’জন দু’জনের কাধে হাত রেখে, কোমর জড়িয়ে কত ধরনের পোজ দেওয়া। দেখলে মনে হয় রোমান্সে ভরপুর জীবন। কিন্তু দু’দিন পর শোনা যায় তাদের বিচ্ছেদের ঘটনা। যদিও সবার ক্ষেত্রে যে বিচ্ছেদ ঘটে, তা না। শুধু স্বামী-স্ত্রীর কথাই বললাম। বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড এর কথা না হয় বাদই দিলাম। শুধু ছবি কেনো ? গান,নাটক, সিনেমা দেখেও বুঝা যায় যে মানুষের রোমান্সের নামে ভালগারিসম বেশী বেড়ে গিয়েছে। আর তার কারণ লজ্জাহীনতা।

অভিনেত্রী ফেরদৌসী মজুমদার একবার একটা ঘটনা বলছিলেন। তখন বিটিভি’তে সরাসরি স্টুডিও থেকে নাটক প্রচার করা হতো। রেকর্ডিং এর কোন সুবিধা ছিল না। নাটকের প্রয়োজনে তাকে নায়ক সিডনির হাত ধরতে হবে এবং হাতের শট’টা ক্লোজ করে ধরা হবে। সিডনির হাত তিনি ধরবেন না। কারণ লজ্জা লাগে। এখন কি হবে ? প্রোডাকশনের এক লোকের হাত অনেকটা মেয়েলী ধরণের ছিল। চালিয়ে দেওয়া যায় বলে, তার হাত দিয়েই কাজ সারা হলো। এখন কি এটা কল্পনা করা যায়! উনি নিজেও স্বীকার করলেন যে এখন মানুষ একজন আরেকজনের হাত ধরাটা সহজ ভাবে নিয়ে নিয়েছে।

মাঝে মাঝে আমাকে পাবলিক বাসে আসা যাওয়া করতে হয়। দেখতাম যে, আগে কখনোই একটা মেয়ের পাশে সহজে কোন ছেলে বসতো না। সিট খালি থাকলেও না। কিন্তু এখন সেটা কল্পনা করা যায় না। বরং মেয়েরাও নির্দ্বধায় বসে পরে। এমন কি তিনজনের সিটে অচেনা পুরুষের পাশে জায়গা করে নিয়ে চারজনও বসে। পোষাকের কথা না হয় নাই বললাম। শুধু বলবো আমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের দিকে তাকাতে লজ্জা পাই। আজকাল ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের লজ্জা কম। বাসের পিছনে বসে, স্কুটারে বা গাড়ীতে যে অবস্থায় ছেলে মেয়েদের দেখি , তখন চোখে চোখ পরলে চোখের ভাষাতেই তারা বুঝিয়ে দেয় আমিই ব্যাকডেটেড।

অনেক ছোটবেলায় একটা নাটক দেখেছিলাম। তাই নাটকের পাত্রপাত্রী কে ছিল মনে নেই। সেখানে স্বামী-স্ত্রী একটি বাসা ভাড়া নেয়। বাসার পাশে ট্যানারির দুর্গন্ধ আর মাইকে সারক্ষন ‘বন্ধু তিনদিন তোর বাড়িত গেলাম, দেখা পাইলাম না’ গান বাজার কারণে তারা অতিষ্ঠ। কিন্তু সেখানেই তাদের থাকতে হয়। থাকতে থাকতে পরে সেটাই তাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। একবার কোন কারণে বাসার বাইরে গিয়ে তাদের থাকতে হয়। রাতে তাদের ঘুম আসে না। পরবর্তীতে নাকের কাছে চামড়ার ব্যাগ রেখে আর কাজের ছেলেকে ‘বন্ধু তিনদিন’ গান গাইতে বলার পর তাদের ঘুম আসে।

লজ্জাহীনতাও এখন সেই পর্যায়ে চলে গিয়েছে। অশ্লীলতা, অনৈতিকতা এখন এমন পর্যায়ে পৌছিয়েছে যে, এখন এগুলোই আমাদের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। আর লজ্জা না থাকার কারণে নৈতিক অবক্ষয় দাবানলের মত ছড়িয়ে যাচ্ছে।

অনেক বাবা-মা’কে দেখি ছোট মানুষ বলে বাচ্চাদেরকে খালি গা করে রেখে দেয়। বাচ্চারা কিন্তু এটাতেই অভ্যস্ত হয়ে যায়। তখন অন্যের সামনে কাপড় ছাড়া থাকতে তার লজ্জা লাগবে না। আজকাল মায়েরা তাদের ছোট ছোট মেয়েদের এমন সব পোষাক পরায় যা খুবি দৃষ্টিকটু। তারা ছোট থেকেই এসব পোষাক পরে, ফলে বড় হলেও সেসব পরতে তাদের লজ্জা লাগে না। পরিবারের সবাই মিলে আজকাল যে সিনেমাগুলো দেখে তাতে তো বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের লজ্জার সম্পর্কটাই থাকে না। ছোট থেকেই বাচ্চাদের ভিতরে কোনটা লজ্জা আর কোনটা লজ্জাহীনতা তা বুঝিয়ে দিতে হয়। পরবর্তীতে সেই বাচ্চা সারা জীবন তা ধারণ করে থাকবে।

মাঝে মাঝে বিভিন্ন সুন্দরী প্রতিযোগীদের সাক্ষাৎকার পড়ি। বেশীর ভাগ মেয়ের মূল কথা থাকে যে, প্রথম প্রথম তাদের কাজ করার ক্ষেত্রে আড়ষ্ঠতা থাকে। কিন্তু পরে ঠিক হয়ে যায়। মানে প্রথম প্রথম লজ্জাটা লাগে, পরে লজ্জা ভেঙ্গে যায়। ঠিক তেমনি আপনি যখন কোন অন্যায় করবেন, তখন প্রথমে লজ্জা লাগবে, বুকের ভিতর খচখচ করবে। কিন্তু দুই তিনবার সেই অন্যায়টা করার পর সেই খচখচানি অনুভূতিটা আর থকবে না।

শয়তানের প্রথম কাজই হচ্ছে মানুষের লজ্জা ভেঙ্গে দেওয়া। হাদীসে বলা আছে, ‘‘যদি তোমার লজ্জা না থাকে তাহলে যা ইচ্ছা তাই করতে পার।’’(বুখারী, কিতাবু আহাদীসিল আম্বিয়া, হাদিস নং৩২২৫) । সেজন্য লজ্জা না থাকাটা খুবই ভয়ংকর ব্যাপার। লজ্জা পাওয়ার বোধটা যখন একটি পরিবার বা সমাজ থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকবে, সে সমাজ অধঃপতন এর দিকে চলে যাবে। আব্দুল্লাহ ইবন ‘উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল (সা.) বলেছেন : যে জনগোষ্ঠীর মধ্যে নির্লজ্জতা প্রকাশমান, পরে তারা তারই ব্যাপক প্রচারেরও ব্যবস্থা করে, যার অনিবার্য পরিণতি স্বরূপ মহামারি, সংক্রামক রোগ এবং ক্ষুধা-দুর্ভিক্ষ এত প্রকট হয়ে দেখা দিবে, যা তাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে কখনই দেখা যায় নি।(ইবনু মাজাহ, কিতাবুল ফিতান, হাদিস নং-৪০০৯)

অশালীন পোশাক পরে চলাফেরা করা, অবলীলায় অশ্লীল বাক্য বলে ফেলা, অশ্লীল গান শোনা, অশ্লীল সিনেমা দেখা, অবলীলায় ঘুষ চাওয়া, সুদ খাওয়া, মদ খাওয়া এবং খেয়ে তা বড়াই করে প্রকাশ করা ইত্যাদি যে লজ্জাহীনতা, সেটাও মানুষ আজ জানে না। শুধু সাধারন মানুষের কথা কেনো বলছি। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকান। কি অবলীলায় মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছে, দূর্নীতি করেই যাচ্ছে লজ্জাহীন ভাবে। জন্মের পর প্রতিটি মানুষের ভিতরে স্বভাবজাত হিসাবে লজ্জা থাকে। কিন্তু মানুষের আচার আচরণে সেই স্বভাবজাত লজ্জা হয় বাড়ে, না হয় কমে।

আজকাল টেলিভিশন চ্যানেল গুলোতে, সিনেমা, ইন্টারনেট বা ম্যাগাজিন গুলোতে অন্যদের অপরাধের বা অবৈধ কাজ সম্পর্কের নামে সত্য ঘটনা বা মানুষের মধ্যে সচেতনতা তৈরি করার নামে যা প্রচার করা হয় , তা কিন্তু আস্তে আস্তে লজ্জাটা ভেঙ্গে দেয়। ফলে আগে যা ‘ট্যাবু’ হিসাবে গ্রহণ করা হোত এখন তাই স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে। সমাজ তা গ্রহণ করেও নিচ্ছে। এখানে উদাহরণ হিসাবে গে, লেসবিয়ান , লিভিং টুগেদার বা সারোগেট মাদার এর কথা বলা যেতে পারে।

লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। প্রতিনিয়তই আমরা ঈমানের অঙ্গহানি ঘটাচ্ছি। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, ঈমানের ৭০টির অধিক শাখা প্রশাখা রয়েছে । তন্মধ্যে সর্বোত্তম হল 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ' একথা বলা এবং সর্বনিন্ম স্তর হল রাস্তা থেকে কষ্টদায়ক বস্তু সরানো । আর লজ্জা হল ঈমানের একটি শাখা । (বুখারী, মুসলিম, মিশকাত হা/৫, 'ঈমান' অধ্যায়।) তিনি আরও বলেছেন, 'লজ্জা ও ঈমান অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । সুতরাং এর একটি তুলে নেয়া হলে অপরটিও তুলে নেয়া হয় । অন্য বর্ণনায় আছে, "যখন উভয়ের কোন একটিকে ছিনিয়ে নেয়া হয়, তখন অপরটি তার পশ্চাতে অনুগমন করে" (বায়হাক্বী, হাকিম, মিশকাত)

আবু উমামা (রাঃ) রাসূল (সাঃ) হতে বর্ণনা করেন, 'লজ্জা ও মিতভাষীতা (অল্প কথা বলা) ঈমানের দুটি শাখা । আর অশ্লীলতা ও বাকপটুতা (বাচালতা) মুনাফিকীর দুটি শাখা' (তিরমিযী, মিশকাত)

যায়েদ ইবনু তালহা (রা.) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, 'প্রত্যেক দ্বীনের একটি বিশেষ স্বভাব আছে। আর দ্বীন ইসলামের বিশেষ স্বভাব হ'ল লজ্জাশীলতা'। ( মুত্তাফাক্ব আলাইহ, মুত্তয়াত্তা মালিক, বায়হাক্বী, ইবনু মাজাহ, ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৬৩২; মিশকাত হা/৫০৯০) ।

একটা লেখা পড়ছিলাম। হুবুহু তুলে দিলাম-‘ আল্লাহ কোন বান্দার ধ্বংস চাইলে তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেন। তার থেকে লজ্জা ছিনিয়ে নেয়া হ'লে সে হয় বিদ্বেষ পরায়ণ। বিদ্বেষ পরায়ণ হলে তার থেকে আমানতদারিতা তুলে নেয়া হয়। আমানতদারিতা তুলে নেয়া হলে সে খিয়ানতকারী হয়। খিয়ানতকারী হলে তার থেকে রহমত তুলে নেয়া হয়, ফলে সে কঠোরতা ও নির্দয়তা লাভ করে। নিষ্ঠুর-নির্দয় হলে তার থেকে ঈমানের রশি খুলে নেয়া হয়। আর ঈমানের রশি যখন তার গ্রীবাদেশ থেকে খুলে নেয়া হয়, তখন সে অভিশপ্ত শয়তান হিসাবে বিদ্যমান থাকে'। ( জামিউল উলূম ওয়াল হিকাম, ১ম খন্ড, পৃঃ ৪৯৯)

লেখাটা পড়ে আমার কাছে মনে হয়েছে, লজ্জা ব্যাপারটা এত সহজ বা হেলাফেলার বিষয় না। লজ্জাহীনতা আমাদের জাহান্নামের আগুনে নিয়ে যাবে। আবূ হুরায়রাহ (রা.) হ'তে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, 'লজ্জা ঈমানের অঙ্গ। আর ঈমানের স্থান জান্নাত। পক্ষান্তরে নির্লজ্জতা দুশ্চরিত্রের অঙ্গ। আর দুশ্চরিত্রতার স্থান জাহান্নাম' (আহমাদ, তিরমিযী, হা/২০০৯, হাদীছ ছহীহ; ছহীহ আত-তারগীব, হা/২৬২৮; মিশকাত হা/৫০৭৬, 'শিষ্টাচার' অধ্যায়।)।

শুধু ভাবছি, আমরা যে লজ্জাহীনতার মাঝে বসবাস করছি, সেটা আমাদের কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ভবিষ্যৎ কেউ বলতে পারে না। কিন্তু একটা ভবিষ্যৎ সবাই জানে। সেটা হলো মৃত্যু অবধারিত সবার জন্য। আর মৃত্যুর পর কেয়ামতের সময় সমস্ত মানুষ, জ্বীন, ফেরেশতাদের সামনে যখন আল্লাহ্‌ আমাদের বিচার করবেন, তখন কি নিজেদের অপকর্মের জন্য লজ্জা লাগবে ? অথবা লজ্জা লাগলেও কি সেই লজ্জা পাওয়ার কোন মূল্য থাকবে তখন? আল্লাহ্‌ আমাদের ক্ষমা কর, প্লিজ।

বিষয়: বিবিধ

১৩৭১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File