"নোট,থেকে" কী ঘটেছিল সেই রাতে…
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ কাশেম মরিচ্যা ১৬ আগস্ট, ২০১৫, ০৮:৫৫:১৪ রাত
কী ঘটেছিল সেই রাতে…
শ্রাবণের রাত শেষে সবে পূর্ব আকাশে সূর্য আবির্ভাবের লগ্ন তখন। পাখিরা কিচিরমিচির করে প্রভাতের আগমন জানান দিচ্ছে। ফজরের নামাজ শেষ করে অভ্যাস মতো তিন তলার জানালার পাশে দাঁড়িয়েছেন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির কর্তা শেখ মুজিবুর রহমান। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, ভালোবেসে যাকে ডাকা হয় বঙ্গবন্ধু। নামাজ শেষ করে পাশে এসে দাঁড়ালেন গৃহকর্ত্রী ফজিলাতুন্নেছা। নতুন সূর্যের প্রতীক্ষায় দু’জনে। হয়তো ছোট ছোট বাক্যে আগামী দিনের কথাও বলছিলেন তারা।
হঠাৎ শান্ত প্রত্যুষের নীরবতা খানখান হয়ে যায় বেপরোয়া গুলির আওয়াজে।
এরপর বাঙালির হৃদয়-বাড়ি হয়ে ওঠে শ্মশান। হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিব লুটিয়ে পড়েন ঘাতকের গুলিতে। নতুন ওঠা সূর্যের সঙ্গে প্রকৃতি যখন আলোকিত হওয়ার প্রতীক্ষায় তখন বাংলাদেশ ধাবিত হতে থাকে ঘোর অন্ধকারের দিকে। ঘাতকের উদ্ধত সঙ্গিন বাঙালির চোখের জলকেও থামিয়ে দেয়। কিন্তু প্রকৃতি কেঁদেছিল তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে হারিয়ে।
কী ঘটেছিল সেই রাতে…এ নিয়ে ইতিহাসবিদরাও কথা বলেছেন, প্রত্যক্ষদর্শীরাও জানিয়েছেন। সেই সবই তুলে ধরা হল উখিয়া নিউজ ডট কম , পাঠকদের জন্য।
হঠাৎ গুলির আওয়াজেও বিচলিত হননি শেখ মুজিব। তিন তলার বারান্দা দিয়েই তিনি দেখেছিলেন একদল জল্লাদ উদ্যত মারণাস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসছিল। প্রথমেই তাদের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছেন বাড়ির কয়েকজন রক্ষী। বঙ্গবন্ধু ব্যাপারটা জানার জন্য টেলিফোন তুলে নিয়ে প্রথমেই ফোন করলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি। এনগেজড! তাকে না পেয়ে তিনি ফোন করলেন জীবনের সবচে বিশ্বস্ত সঙ্গী তাজউদ্দিন আহমেদকে। তার ফোন ডেড! এরপর তিনি ফোন করলেন কর্নেল জামিলকে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘জামিল, আর্মিরা আমার বাড়ি আক্রমণ করেছে। আমি কাউকেই ফোনে পাচ্ছি না।’ বিশস্ত জামিল ভরসা দিয়ে বললেন, ‘স্যার, আমি এক্ষুণি আসছি!’
ওদিকে, ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে থাকা বাড়িটি ঘিরে গুলির আওয়াজ বেড়েই চলেছে। দৃপ্ত বঙ্গবন্ধু দ্রুত পায়ে নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। নামতেই দেখেন জল্লাদ মহিউদ্দিন আর জল্লাদ বজলুল হুদা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে। তাদের দেখে বঙ্গবন্ধু তার জলদগম্ভীর স্বরে জানতে চাইলেন, ‘কী হচ্ছে এখানে? কী চাও তোমরা?’
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে এমন কিছু ছিল যে গুলি চালাতেও যেন ভুলে গেলো ঘাতকরা। কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো, ‘স্যার আপনাকে নিতে এসেছি! আমাদের সঙ্গে চলুন, প্লিজ!’
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কোথায় যাব?’
ঘাতকরা বলল, ‘ক্যান্টনমেন্টে’।
বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তোমাদের কথায় আমি যেতে পারি না। দরকার হলে তোমরা আমাকে মেরে ফেলতে পারো।’
এসময় বজলুল হুদা বলে, ‘আপনি না গেলে আপনাকে পদত্যাগ করতে হবে।’
এর জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘তোরা কী ভেবেছিস? তোদের কথায় আমি কোথায় যাব! আমি ক্ষমতা চাই না; তবে এভাবে দেশকে ধ্বংসও হতে দেব না। আর্মিরা যদি দেশ চালাতে পারে, ক্ষমতা নিক! জেনারেলরা কোথায়?’
মেজর মহিউদ্দিন বলে ওঠে, ‘তারাই আমাদের পাঠিয়েছে। আপনি চলুন, সেখানে গেলেই দেখতে পাবেন।’
বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘বেশ, কামাল (বড় ছেলে শেখ কামাল) আমার সঙ্গে যাবে।’
এই বলে তিনি উপরে উঠে গেলেন। কিশোরগঞ্জের ধসুদল গ্রামের কিশোর আবুল কালাম ভুঁইয়ার কাছ থেকে দুধ সফেদ পাঞ্জাবিটা নিয়ে পরে নিলেন। কয়েকটা জায়গায় ফোন করলেন। জানালেন, তার বাড়ি আক্রান্ত। এ সময় সেনাপ্রধান জেনারেল সফিউল্লার ফোন পেলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু তাকে বললেন, ‘সফিউল্লাহ, তোমার ফোর্স আমার বাড়ি অ্যাটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মেরে ফেলেছে। জলদি ফোর্স পাঠাও।’
সেনা প্রধান বললেন, ‘আই অ্যাম ডুয়িং সামথিং। ক্যান ইউ গেট আউট দ্য হাউস?’
ফোন রেখে স্বভাবসুলভ পাইপটা হাতে নিয়ে প্রস্তুত হলেন নামার জন্য। ততক্ষণে মেজর ফারুক, মেজর রশিদ তাদের দলবল নিয়ে চলে এসেছে ৩২ নম্বরে। বঙ্গবন্ধু আবার নামতে লাগলেন সিঁড়ি দিয়ে। মেজর ফারুক, মেজর রশিদ, মেজর মহিউদ্দিন- ঘাতকরা সব দাঁড়িয়ে সিঁড়ির নিচে। মেজর শরিফুল হক ডালিম সেখানে এসে চিতকার করে বললো, ‘এতো দেরি হচ্ছে কেন? শেখ মুজিব আর পাঁচ মিনিট বেঁচে থাকলে সব শেষ হয়ে যাবে। এক্ষুণি শেষ কর তাকে।’ বলার সঙ্গে সঙ্গে রিসালদার মোসলেম উদ্দিন, নায়েব রিসালদার সারোয়ার হোসেন স্টেনগান দিয়ে ৬৪টি গুলি ছোঁড়ে বঙ্গবন্ধুকে লক্ষ্য করে। যার কয়েকটি এখনো বিদ্ধ হয়ে আছে ৩২ নম্বরের ঐ বাড়িটির দেয়ালে।
ভোর ৫টা ৪০ মিনিট। ঘাতকের তপ্ত বুলেটে বঙ্গবন্ধুর প্রাণহীন দেহটা লুটিয়ে পড়ল সিঁড়িতে। যিনি বলেছিলেন, কোনো বাঙালি তার ক্ষতি করবে না। যিনি একাত্তরে পাকিস্তানিদের খোঁড়া কবরের পাশে দাঁড়িয়ে গর্বভরে বলেছেন, ‘ফাঁসিকাষ্ঠে যাওয়ার আগে বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা….।’ যে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানিরা হত্যা করার সাহস দেখায়নি, সেই তাকে তার বাড়িতে বাঙালি নামে কিছু কুলাঙ্গার হত্যা করলো। হত্যা করলো বাংলাদেশকে, বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে, বাংলাদেশের অহঙ্কারকে।
ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, সেদিন হত্যা করেছিল বেগম মুজিবকে, ছোট্ট রাসেলসহ তিন সন্তানকে, ভাই শেখ নাসেরকে, দুই পুত্রবধূকে। একজন পুলিশ অফিসার রাসেলের প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন বলে তাকেও হত্যা করে কুলাঙ্গারা। সন্তানদের মধ্যে শুধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন দেশে ছিলেন না বলে। ঘাতকরা শেখ মনির বাড়িতে গিয়ে শেখ মনি ও তার স্ত্রী বেগম মনিকে হত্যা করে। আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের বাড়িতে গিয়ে জল্লাদরা হত্যা করে সেরনিয়াবাত, বেবী সেরনিয়াবাত, আরিফ সেরনিয়াবাত, বাবু সেরনিয়াবাত, নান্টু ও কয়েকজন কর্মচারীকে। বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষায় ৩২ নম্বর বাড়িতে ছুটে আসা কর্নেল জামিলকেও হত্যা করেছিল তারা।
পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচার হয়েছে। পাঁচজন ঝুলেছে ফাঁসের কাষ্ঠে, পালিয়ে আছে ছয় জন, একজন মারা গেছেন। তবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পেছনে, বাঙালি জাতিকে কয়েকশ’ বছর পশ্চাতে ঠেলে দেয়ার এ ষড়যন্ত্রের পেছনে শুধু এ কয়েকজন খুনিই জড়িত ছিল না। ছিল আরো অনেক বড় ক্ষমতাধররা- যাদের কোন বিচার হয়নি, কারা ছিলেন তারা তাও এখনো জানা যায় নি। তবে যতদিন পৃথিবীর বুকে একজন বাংলাদেশি থাকবেন, ততদিন তাদের উপর আসবে অভিশম্পাত। কারণ, বাঙালি বেঈমানের জাতি নয়। তারা অবনত চিত্তে চিরকাল ভালোবাসবে বঙ্গবন্ধুকে, ঘৃণা করবে তার খুনিদেরকে।
বিষয়: বিবিধ
১০৬০ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
উনাকে উপরে গিয়া টেলিফোন করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সামরিক বিষয়ে বিন্দুমাত্র ধারনা আছে কেউ এই কথা বিশ্বাস করবে না।
মন্তব্য করতে লগইন করুন