ফেরাউন নমরুদ ও মশা কাহিনী।
লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ কাশেম মরিচ্যা ১৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৫:৪৯:২৫ বিকাল
হিব্রোণে বাসকরার এক পর্যায়ে আল্লাহ ইব্রাহিমকে বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! তুমি ফেরাউন নমরুদকে সতর্ক কর তার উপর শাস্তি আসার আগেই।’
সুতরাং ইব্রাহিম পুনঃরায় মিসরে এলেন এবং রাজদরবারে উপস্থিত হলেন। ফেরাউন নমরুদ (Pharaoh Nimrod) ইব্রাহিমকে চিনতে পেরে বললেন, 'হে ইব্রাহিম! কি উপলক্ষ্যে তোমার এ আগমন?'
ইব্রাহিম বললেন- ‘হে নমরুদ! আমি আল্লাহ প্রেরিত রসূল, যিনি এক-যার কোন শরীক নেই, যিনি আরশের অধিপতি।’
ফেরাউন বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! দুনিয়ার রাজত্ব তো আমার। শীঘ্রই আকাশের রাজত্বও আমি তোমার আল্লাহর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেব।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘হে নমরুদ, কিভাবে আপনি আকাশে পৌঁছিবেন?’
তিনি বললেন, ‘আমার বিজ্ঞ পরিষদবর্গই এ ব্যাপারে আমাকে পূর্ণপথ বাৎলে দেবে।’
অতঃপর নমরুদ যখন এ ব্যাপারে পরিষদবর্গের পরামর্শ চাইলেন, তখন পরিষদবর্গের একজন হয়ে ইবলিস তাকে পূর্ণ পরামর্শ দিল। সুতরাং ফেরাউন নমরুদের হুকুমে চারটি শকুনকে লালন-পালন করা হল। অতঃপর একটি সিন্দুক তৈরী করে শকুন চারটিকে কয়েকদিন অভুক্ত রেখে ঐ সিন্দুকের চার কোনায় বেঁধে দেয়া হল। তারপর সিন্দুকের উপরদিকে শকুনের নাগালের বাইরে কিন্তু দৃষ্টির সীমানায় ঝুলিয়ে দেয়া হল মাংসের টুকরো। নমরুদ ও তার সেনাপতি প্রস্তুত হয়ে সিন্দুকে আরোহণ করলেন। শকুনেরা মাংসের টুকরো খেতে চাইল, আর তাদেরকে নিয়ে সিন্দুকসহ উড়ে চলল।
উর্দ্ধ আকাশে পৌঁছে নমরুদ ও তার সেনাপতি একের পর এক তীর উপরের দিকে নিক্ষেপ করলেন। এসময় আল্লাহ জিব্রাইলকে বললেন, ‘আমার এই বান্দা যেন নিরাশ না হয়। সুতরাং তার তীরগুলিকে রক্তরঞ্জিত করে ফেরৎ পাঠাও।’
এদিকে সকল তীর নিক্ষেপ শেষে নমরুদ পৃথিবী পৃষ্ঠে ফিরে আসতে চাইল। সেজন্যে শকুনগুলিকে নিম্নগতি করার লক্ষ্যে সিন্দুকের উপরের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া মাংস একইভাবে নিচের দিকে ঝুলিয়ে দেয়া হল।
মাটিতে অবতরণের পর নমরুদের রক্ষীরা নিক্ষিপ্ত তীরগুলি কুড়িয়ে আনল। যেগুলো পাওয়া গেল তার সবগুলোই রক্তরঞ্জিত। ফেরাউন রক্তমাখা তীরগুলি দেখে সফলতার আনন্দে আত্মহারা হয়ে ইব্রাহিমকে বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! আমি তোমার আল্লাহকে হত্যা করেছি, তীরে লেগে থাকা রক্তই তার সাক্ষ্য বহন করে।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘আমার স্রষ্টা চিরঞ্জীব, চিরস্থায়ী।’
নমরুদ বললেন, ‘ঠিক আছে, তিনি যদি মারা গিয়ে না থাকেন, তবে তাঁর সৈন্যদলকে একত্রিত করতে বল। আমিও আমার সৈন্যদল ময়দানে সমবেত করছি।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘আল্লাহকে ভয় করেন, তিনিই তো আপনাকে রাজ্য ও রাজত্ব দান করেছেন। আর তিনিই পরজগতের প্রতিফলদাতা।’
নমরুদ বললেন, ‘আমিই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। সুতরাং তোমার আল্লাহ বলে যদি কেউ থাকেন, তবে অবশ্যই তাকে আমার শক্তির মোকাবেলা করতে হবে।’
নমরুদ ষাট লক্ষ সেনা ময়দানে সমবেত করলেন। এদিকে প্রতিপক্ষের কোন দেখা নেই। নমরুদ ইব্রাহিমকে ডেকে বললেন, ‘তোমার প্রতিপালকের সেনাদল কোথায়? তিনি নিশ্চয় আমার শক্তিবল দেখে ভীত হয়ে পশ্চাৎপসারণ করেছেন।’
ইব্রাহিম বললেন, ‘আমার রব ক্ষমতায় মহান, কোনরূপ ভীতি তাকে আচ্ছন্ন করতে পারে না, বরং তিনিই তা প্রদর্শণ করে থাকেন। একথা নিশ্চিত যে তার সেনাদল ময়দানে এসে পৌঁছিবেই-আর তা অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।’
নমরুদ সেনাপতিদের বললেন, ‘যুদ্ধ পতাকা উড়িয়ে দাও, সতর্ক হও, নাকাড়া বাজাও।’
ষাট লক্ষ সেনার শোরগোলে ভূমি প্রকম্পিত হল। ফেরাউন পুনঃরায় ইব্রাহিমকে বললেন, ‘কোথায় তোমার রবের সৈন্যদল?’
ইব্রাহিম দূরে আকাশের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করলেন। দূরে কাল রঙের একটা মেঘ দেখা যাচ্ছে। যখন সেটা কাছে, মাথার উপর চলে এল, লক্ষ লক্ষ মশার গুণ গুণ কলতানে চারিদিক মুখরিত হল।
মশা! ক্ষুদ্র এ প্রাণীটি সন্ত্রাসী, বেপরোয়া। রক্তের নেশায় জীবনের ঝুকি নিয়ে তারা আক্রমণ করে মানুষ, পশুকে। আর এ মশা তো আল্লাহ প্রেরিত, যুদ্ধের নিমিত্ত। কিন্তু ফেরাউন এদের ব্যক্তিত্বকে খাটো করে দেখলেন। অবজ্ঞার সূরে বললেন, ‘এ তো মশা! তুচ্ছ এক প্রাণী, তার উপর নিরস্ত্র। তোমার রবের কি অস্ত্রভান্ডার বা মালখানা নেই?’
ইব্রাহিম বললেন, ‘আমার রবের সেনাবাহিনী সম্পর্কে আপনার কোন ধারণাই নেই। আপনার এই সেনাবাহিনীর জন্যে তিনি এই তুচ্ছ, নিরস্ত্র মশাকেই যথেষ্ট মনে করেছেন। আর নিরস্ত্র হলেও এরা তাদের যুদ্ধ কৌশল জানে। এখন আপনি শুধু এই বাহিনীর মোকাবেলা করে আপনার শক্তি ও সামর্থ্য ও মেধার পরিচয় দিন।’
এদিকে এই মশা বাহিনীর সঙ্গে কিরূপে যুদ্ধ করতে হবে তা ভেবে পাচ্ছিল না নমরুদের সেনারা। এত ক্ষুদ্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তাদের পূর্ব কোন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা বা ট্রেনিং-কোনটাই নেই। সুতরাং তারা হতভম্ভ হয়ে আদেশের অপেক্ষায় সাঁরিবদ্ধভাবে নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল। এই অবসরে প্রতিটি সৈন্যের মাথার উপর একটি করে মশা অবস্থান নিল। অতঃপর কেউ কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই তারা তাদের নাসিকা পথে মস্তিস্কে প্রবেশ করল। অতঃপর দংশন। সেনাবাহিনীর মধ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হল। হিতাহিত জ্ঞানশুণ্য হয়ে তীরন্দাজগণ উর্ধ্বে তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। আর পদাতিক সেনারা নিজেদের চতুষ্পার্শ্বে অন্ধের মত তরবারী চালনা শুরু করল। এভাবে একে অপরকে নিজেদের অজান্তেই হত্যা আহত বা নিহত করে ফেলল।
ফেরাউন নমরুদ পালিয়ে প্রাসাদে ফিরে আসছিলেন। এসময় একটি দূর্বল মশা তাকে তাড়া করল। সে কিছুক্ষণ তার শিরোস্ত্রাণের চতুষ্পার্শ্বে কয়েকবার প্রদক্ষিণ শেষে সুড়ুৎ করে তার নাসিকাপথে মস্তিস্কে ঢুকে পড়ল। তারপর ধীরে সুস্থ্যে মগজে দংশন শুরু করল। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে পড়লেন ফেরাউন। উন্মাদের ন্যায় প্রাসাদে প্রবেশ করলেন। একসময় দিশেহারা হয়ে পাদুকা খুলে নিজের মাথায় আঘাত করতে শুরু করলেন তিনি। এতে মশা দংশনে বিরত রইল। তিনি একটু আরাম বোধ করলেন। কিন্তু আঘাত বন্ধ করতেই মশা পুন:রায় দংশন শুরু করল। অবশেষে ফেরাউন তার মাথায় মৃদু আঘাত করার জন্যে একজন সার্বক্ষণিক কর্মচারী নিযুক্ত করলেন।
এটা অদ্ভূত ছিল যে, পাদুকা ব্যতিত অন্য কিছুর আঘাতে মশা দংশনে বিরত থাকত না। এসময় একদিন ইব্রাহিম তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বললেন, ‘হে নমরুদ! স্বীয় মস্তকে, স্বীয় পাদুকা দ্বারা আঘাতের জন্যে, স্বীয় অর্থেই গোলাম নিযুক্ত করে রাখা জঘণ্য। সুতরাং এখনও সময় আছে আল্লাহকে সর্বশক্তিমান ও অদ্বিতীয় বলে স্বীকার করে নিন। তাতে তিনি আপনার পাপসমূহ ক্ষমা করবেন এবং আপনি এই কঠিন বিপদ থেকে মুক্তি পাবেন।’
নমরুদ বললেন, ‘হে ইব্রাহিম! আমি যাকে চিনি না, জানি না, তাকে কি প্রকারে সর্বশক্তিমান বলে স্বীকার করব?’
ইব্রাহিম দেখলেন এই অবাধ্য মানব সন্তান সম্পূর্ণ সত্যপথ বিচ্যূত। তিনি হতাশ হয়ে ফিরে এলেন।
এদিকে ফেরাউন নমরুদের সার্বক্ষণিক দায়িত্বে নিয়োজিত কর্মচারী অতিষ্ট হয়ে পড়েছিল। একমুহুর্ত অবসর নেই। সামান্য বিরতিতেই তিরস্কার। একসময় তার মনে এমন বিরক্তি ও ক্রোধের সৃষ্টি হল যে, সে তার হস্তস্থিত পাদুকা দ্বারা ফেরাউনের মাথায় সজোরে এক আঘাত হানল। ঐ আঘাতেই তার মৃত্যু হল।
এক দোর্দন্ড প্রতাপশালী ফেরাউনের এভাবে জীবনাবসান হল।
বিষয়: বিবিধ
৭৮৫১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন