কালের পরিক্রমায় ইসলামপন্থীদের যত ভুলঃ পলাশী থেকে বাংলাদেশ(২০১৩) এবং খেলাফতের অন্তঃরায়। ১ম পর্ব
লিখেছেন লিখেছেন মাজহার১৩ ১৯ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ০৪:৫৯:১৭ বিকাল
উপমহাদেশে খিলাফত আন্দোলন
১৯১৪ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে বৃটেন তাদের বৃহত্তম উপনিবেশ ভারতবর্ষে যাতায়াতের পথ খোলা রাখার জন্য আরব দেশগুলোকে উসমানী খিলাফত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার জোর চক্রান্ত চালাতে থাকে। এতদুদ্দেশ্যে খিলাফত বিরোধী মনোভাব উস্কে দেয়ার জন্য তারা আরবের বিভিন্ন অঞ্চলে নিজেদের দক্ষ গুপ্তচরদেরকে নিয়োগ করে। বৃটিশদের হয়ে আরব এলাকায় খিলাফত বিরোধী চেতনা ও আরব জাতীয়তাবাদী ধারণা ছড়ানোর গোয়েন্দাবৃত্তিতে নেতৃত্ব দানকারী কর্ণেল টি.ই. লরেন্স এর প্রচেষ্টায় গোটা মধ্যপ্রাচ্যকে তারা উত্তপ্ত ও বিভক্ত করে ফেলে। ভারত উপমহাদেশের উলামাগণ খিলাফতের এই বিপদ দেখে ভীষণভাবে আতংকিত হয়ে উঠেন। যে কোন মূল্যে খিলাফত শাসন বহাল রাখার জন্য তারা জোর তৎপরতা শুরু করেন। খিলাফত রক্ষার জন্য ভারতীয় উলামাদের সেই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাকেই ইতিহাসে 'খিলাফত আন্দোলন' নামে অবিহিত করা হয়।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ভারতের মুসলমানরা ব্রিটিশকে এই শর্তে সমর্থন দিয়েছিল যে, ব্রিটিশরা তুরস্কের খলীফার কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু এই যুদ্ধে তুরস্ক ও জার্মানি মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হলে ব্রিটেন ও ফ্রান্সসহ অন্যান্য ইউরোপীয় শক্তি তুর্কী খিলাফতকে বিভক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। পবিত্র মক্কা ও মদীনা খ্রিষ্টানদের করতলগত হবার আশস্কায় ভারতের মুসলমানরা ১৯১৯ সালের ৭ অক্টোবর খিলাফত দিবস পালন করে। খিলাফত রক্ষাকল্পে ভারতীয় মুসলমানগণ দেশব্যাপী গড়ে তোলে তীব্র আন্দোলন।
এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন-ভারতের বিখ্যাত বিদ্যাপীঠ দারুল উলুম দেওবন্দ এর তৎকালীন মুহতামিম শায়খুলহিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান (রহ.), মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার এবং মাওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়, মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. মুক্তার আহমদ আনসারী প্রমুখ।
খিলাফত আন্দোলন হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মাওলানা মুহাম্মাদ আলী জাওহার এবং মাওলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয় ১৯১৯ সালে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ, ড. মুক্তার আহমদ আনসারী প্রমুখকে সঙ্গে নিয়ে খিলাফত আন্দোলন নামের এই সংগঠনটির কাজ শুরু করেন। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল : তুর্কী খিলাফতকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। এই একটি মাত্র সংগঠন ভারতের সকল ঘরানার উলামা ও সাধারণ মুসলমানদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল এই দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে যে, খিলাফতই হচ্ছে এক উম্মাহ্র ঐক্যের প্রতীক। এখানে উদাহরণ হিসাবে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মাওলানা মাহমুদুল হাসান দেওবন্দী ছিলেন একজন উচ্চতর হানাফী। অথচ তার সাথে এই আন্দোলনে ঘনিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন যে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তিনি ছিলেন একজন গায়ের মুকাল্লিদ। এভাবে সকল মাসলাক, মাশরাফ ও মাযহাবের উলামাগণ খিলাফত ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।
১৯২০ সালে বঙ্গ প্রদেশের আহসান মঞ্জিলে অনুষ্ঠিত খিলাফত কন্ফারেন্সের সভাপতির ভাষণে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ খিলাফতের গুরুত্ব বর্ণনা করে বলেছিলেন : এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য হচ্ছে মুসলমানদেরকে সিরাতে মুস্তাকীমের উপরে চালানোর জন্য সংগঠিত করা এবং দুনিয়াতে আল্লাহ্'র কালামকে বুলন্দ করা। এর জন্য জরুরী হচ্ছে খলীফার হাতে যথাযথ কর্তৃত্ব থাকা। মাওলানা আজাদ বিশ্বাস করতেন মুসলমানদের খলীফা বিহীন জীবনই হচ্ছে ইসলাম বিহীন জীবন। খিলাফত বিহনে বসবাস করলে মুসলমানদেরকে আখেরাতে জবাব দিতে হবে। 'মাসআলায়ে খিলাফত' নামে এক গ্রন্থে তিনি লিখেছেন : "খিলাফত বিহীন ইসলামের অস্তিত্ব অসম্ভব। ভারত বর্ষের মুসলমানদের উচিত সর্বশক্তি দিয়ে খিলাফতের জন্য কাজ করা।" মাওলানা শওকত আলী কেন্দ্রীয় খিলাফত কমিটির পক্ষ থেকে এই ঘোষণা জারী করেছিলেন যে আমরা আশা করি ইসলামের জন্য নিবেদিত প্রাণ মুসলিমগণ ভারতবর্ষে অবস্থান করে বৃটিশ রাজের বিরুদ্ধে অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নেবে। তা অসম্ভব হয়ে উঠলে খিলাফত রাষ্ট্রে হিজরত করার চিন্তা করবে। ভারতবর্ষের বিশিষ্ট উলামাগণ এই আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করেছিলেন। মাওলানা সাইয়েদ সুলায়মান নদভী জোর দিয়ে বলতেন মুসলমানদের জন্য একজন খলীফা থাকা ফরয। ১৯২০ সালে মাওলানা মুহম্মাদ আলী জাওহারের সঙ্গে এক প্রেস কন্ফারেন্সে উপস্থিত তার সঙ্গী সাইয়েদ হুসাইন বলেছিলেন যদি দুনিয়াতে ইসলামের অস্তিত্ত্ব বজায় রাখতে হয়, তাহলে মুসলমানদের একজন খলীফার উপস্থিতি অপরিহার্য্য।
শায়খুলহিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান কঠিন পরিশ্রম করে খিলাফতের অধীনে যুদ্ধরত সৈনিকদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করে খলীফার নিকট প্রেরণ করতেন। তিনি রাশিয়া এবং তুরস্কের যুদ্ধে উসমানী খিলাফতকে সার্বিক সহযোগীতা প্রদান করেছিলেন। খিলাফতের সাহায্যার্থে তিনি দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসা বন্ধ ঘোষণা করেন। ছাত্রদের একটি বিশাল বাহিনীকে তুরস্কে প্রেরণ করে অপর আরেকটি বাহিনী নিয়ে নিজে তুরস্ক চলে যান। তিনি জানতেন সমগ্র ইউরোপ ঐক্যবদ্ধ হয়ে খিলাফত ধ্বংসের মাধ্যমে ইসলামের প্রদীপকে নিভিয়ে দিতে সংকল্পবদ্ধ হয়েছে। তাই প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারত বর্ষের মসজিদগুলোতে খুতবার মাঝে খিলাফতের কথা উল্লেখ করা হতো এবং নামাজে মুসলমানদের বিজয় ও কাফেরদের পরাজয়ের জন্য দোয়া করা হতো। খিলাফত আন্দোলনের আরেক মহান ব্যক্তিত্ব মওলানা শওকত আলীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আপনি কেন খুতবায় তুর্কী সুলতানের নাম অন্তর্ভূক্ত করেন। তিনি জবাবে বলেছিলেন, কারণ তুর্কী সুলতান এই মূহুর্তে মুসলমানদের খলীফা। বৃটিশ সামাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র থেকে খিলাফত রাষ্ট্রকে রক্ষার জন্য মাওলানা মাহমুদুল হাসান তার সর্বশক্তি নিয়োগ করেছিলেন। এই জন্য তিনি হিজাজ সফর করেন। গভর্নরের পক্ষ থেকে ভারতবর্ষের মুসলমানদের জন্য পত্র মারফত এই অনুরোধ নিয়ে এসেছিলেন যে তারা যেন বৃটিশ সরকারের বিরুদ্ধে খিলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। এই চিঠি ইতিহাসে গালিব নামা নামে খ্যাত। খিলাফতের পক্ষে এই ধরণের তৎপরতার দরুন নিষ্ঠুর ইংরেজ শাসকরা মাওলানা মাহমুদুল হাসানের উপর কঠিন চাপ সৃষ্টি করে। সত্য ভাষণ থেকে নিবৃত করা এবং ইংরেজ সরকারের বিপক্ষে গিয়ে উসমানী খিলাফতকে সমর্থন দেয়া থেকে বিরত রাখার জন্য তাঁর উপর অনেক অত্যাচার করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাঁকে সুদূর মাল্টাদ্বীপে নির্বাসনে পাঠানো হয়। ইংরেজরা দাবী করেছিল তিনি যেন মক্কার বিশ্বাসঘাতক গভর্নর শরীফ হোসেনকে ইংরেজদের স্বার্থে সমর্থন দিয়ে খিলাফতের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী করেন। এ জঘণ্য অন্যায় কাজটি করতে অস্বীকার করায় গাদ্দার শরীফ হোসেন তাকে এবং তার সঙ্গীদেরকে মক্কায় গ্রেফতার করে ইংরেজদের হাতে তুলে দেয়।
অন্য সব বিষয় নিয়ে কম-বেশী মতভেদ থাকলেও খিলাফত আন্দোলন নিয়ে মুসলিম শিক্ষাবিদদের মাঝে কোন প্রকার অনৈক্য ছিল না। মাওলানা আবুল কালাম আজাদ তার বিখ্যাত পত্রিকা "আল হেলাল"-এ ১৯১২ সালের ২রা নভেম্বর সংখ্যায় নিজের অভিমত এভাবে ব্যক্ত করেছেন : "শুধু উসমানী খিলাফতের হাতেই এখন সেই তলোয়ার আছে যা মুসলিমদেরকে রক্ষা করতে পারে। খিলাফতই হচ্ছে শরীয়তের একমাত্র কর্তৃপক্ষ। এই ব্যবস্থা ওহির মাধ্যমে নির্ধারিত হয়েছে। এই কর্তৃপক্ষের আনুগত্য করা আল্লাহ্'র নির্দেশ। খিলাফতের বিধি-বিধান মেনে চলা ফরয।"
এভাবে খিলাফত রক্ষার আন্দোলন ভারতময় ছরিয়ে পড়লেও ১৯২৪ সালে তুরস্কে উসমানী খিলাফতের পতনের পর এর ধারাবাহিকতায় এক প্রকার ভাটা পড়ে। তাছাড়া বৃটিশ শাসনের শেষের দিকে স্বাধীনতা আন্দোলনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং দেশভাগের প্রশ্নে মতানৈক্য সৃষ্টির ফলে খিলাফতের চেতনা অনেকটাই হ্রাস পেয়ে যায়। যার কুপ্রভাবে উম্মাহ্ আজও ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।
বিষয়: বিবিধ
১৫২০ বার পঠিত, ১৪ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এর পরবর্তী পর্বে ৭১ পরবর্তী বাংলাদেশে ইসলামী দল ও তাদের ভূমিকা
গায়ের মুকাল্লিদ কি? আগে পড়েছিলাম এখন মনে আসছে না তাই প্রশ্ন করলাম।
যাজ্জাকাল্লাহ খায়ের
খিলাফত আন্দোলনের একটি দুর্বলতা কিন্তু ছিল তা হচ্ছে এই আন্দোলনের সাথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ ছিল কম।
মন্তব্য করতে লগইন করুন