পান্তা ইলিশ:শেকড়হীন বাঙালী মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য আবিষ্কার
লিখেছেন লিখেছেন ফারুক আহমেদ০২ ০৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:৫২:১৭ সন্ধ্যা
‘সো’, ‘বাট’, ‘দেন’ ছাড়া যারা বাংলা বাক্য গঠন করতে পারে না ।‘শিট’ ছাড়া যারা অভিব্যাক্তি প্রকাশ করতে পারে না । এসব শেকড়হীন বাঙালীর ভাসা পানার মত ভাসতে থাকা ভাল দেখায় না ।না হোক ঐতিহ্য , হোক কৃত্রিম, এদের একটু শেকড় লাগিয়ে দেওয়া প্রয়োজন বোধ করে এসেছেন অনেকেই ।শেকড় যে ছিল না তা নয় । যাঁরা কৃত্রিম শেকড় লাগাতে চাইছেন তাঁরা ভাল করেই জানেন বাঙালীর সেই সাংষ্কৃতিক শেকড় কবে কিভাবে কাদের দ্বারা উপড়ে ফেলা হয়েছে । সে কারণ সন্ধান করতে যাওয়া তাদের জন্য এক বিপদজনক এবং স্ববিরোধী কাজ । তাই কৃত্রিম শেকড় লাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টাই বিধেয় ।রমনা বটমূল এই মহান দায়ীত্বটি পালন করে চলেছে ভাল ।
মাটিতে দৃঢ়ভাবে আটকে থাকা বটবৃক্ষের চেয়ে শেকড়ড়হীন ভাসা পানার বৈচিত্র বেশি ।অনেকটা শ্রমিকের সারাদিনের শ্রমের অর্ধেক ছিনতাইয়ের পর বাকী অর্ধেকে কেনা চাল-ডালের সাথে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত চাল-ডালের বৈচিত্রের পার্থক্যের মত ।বৈচিত্র্য কোন খারাপ কিছু নয় । তবে শেকড়ের ওপর দাঁড়িয়ে বৈচিত্র্য এক আর ভাসা পানার বৈচিত্র্য আরেক ।ভাসা পানার বৈচিত্র্যে যে আনন্দ নেই তা বুঝা যায় তখন, যখন বৈচিত্র্যকে ঐতিহ্য হিসেবে পরিচয় করানো হয় ।
ঐতিহ্যের মধ্যে অনেক ঐতিহ্য থাকে সুখের এবং অনেক ঐতিহ্য থাকে দুঃখের । আসলে যা’ দুঃখের এবং কষ্টের তাকে ঐতিহ্য বলা যায় কিনা তা নিয়ে তর্ক আছে ।গ্রামের অনেক অভাবি মানুষকে দেখেছি অল্প চালের মধ্য প্রচুর পানি এবং লবন দিয়ে জাউ রান্না করে খেতে ।এ ধরণের জাউয়ের সাথে আমি পরিচিত ।আমার মা এ জাউ খাইয়ে আমাদের বাঁচিয়ে রেখেছেন আনেক দিন, বিশেষ করে ৭৪ সালে । এর সুবিধা ছিল এই যে, পরমাণে বেশি হতো তাতে বেশি জনের মধ্যে ভাগে সুবিধা পাওয়া যেত এবং বিনা তরকারিতে খাওয়া যেত ।গ্রামের হাটগুলোতে একসময় দেখা যেত গামছা কাঁধে দেওয়া খালি গায়ের মানুষ এবং অনেকের কাঁধে গামছাও থাকতো না, গোটা হাটে এই মানুষের সংখ্যাই বেশি দেখা যেত ।হয়তো এগুলোও বাঙালীর ঐতিহ্য!আবার পিঠা-পুলি , খেজুরের রস, আখের রস ,কবি গান, যাত্রা পালা,গ্রামীণ মেলা এগুলোও আমাদের ঐতিহ্য ।
লুটপাটের মহাসমারোহে আনন্দের ঐতিহ্যগুলোর শেকড় উৎপাটিত হয়েছে ।লুটপাটের সাথে সংষ্কৃতির বিকৃতি হাত ধরাধরি করে চলে ।লুটপাটের সাথে ‘চল যাই আনন্দের বাজারে’ যাওয়া সম্ভব নয় ।এর সাথে শুধুই বিকৃতির বাজারে যাওয়াই সম্ভব ।
লুটপাট,দখল, দুর্নীতির সাথে সাথে বাঙালীর সংষ্কৃতি উপড়ে ফেলা হলে কি হবে ?বাঙালীপনার আওয়াজতো দিয়ে যেতেই হবে !এ আওয়াজের মধ্যে বাঙালীর সংষ্কৃতি ,ঐতিহ্য এবং সংষ্কৃতি বিকাশের ধারাবাহিকতা না থাকেলই বা কি?এই আওয়াজই যে তঞ্চকতায় একদিকে পিষ্ঠ এবং অপরদিকে এর মধ্য থেকে উদ্ভুত বিকৃত সংষ্কৃতির সুদৃশ্য মোড়ক ।
সংষ্কৃতির এই বিকৃতির মধ্যে এক সাধারণ বিকৃতি হলো গরীবের কষ্ট এবং বিভিন্ন অভ্যাস নিয়ে
তামাশা ।আমরা যারা গ্রামে বসবাস করে এসেছি তারা জানি পান্তা বা পন্তা গ্রাম বাংলার গরীব মানুষের এক সাধারণ খাবার ।বেশ কতগুলো কারণে রাতে রান্না করা ভাতে পানি দিয়ে সকালে খাওয়া হয় ।সেটা কোন আনন্দের খাবার নয় ।সে খাবার খাওয়া হয় লবন, কাঁচা মরিচ , পেঁয়াজ সহযোগে । অধিকাংশ সময় কাঁচা মরিচ , পেঁয়াজ ছাড়া শুধুই লবন সহযোগে ।গ্রামের গরীবদের মধ্যে যাদের সামান্য সঙ্গতি থাকতো তারাও পহেলা বৈশাখে চেষ্টা করতেন অন্ততঃ একটি দিন বাসি –পান্তা না খেতে ।পান্তার সাথে ইলিশের সংযোগটা থাকতো কদাচিৎ । তাও সেটা গরীবের ঘরে ঘটতো না । যেসব ঘরে ঘটতে পারতো সেখানেও সাধারণভাবে ভাজা ইলিশের সাথে পান্তা এমন ব্যাপার ছিল না ।কিন্তু চুরি-দুর্নীতি-লুটপাটের মাধ্যমে শেকড় উপড়িয়ে যে মধ্যবিত্তের উদ্ভব ঘটেছে তাদের বাঙালীপনা চর্চার এক প্রধান উপলক্ষ্য হয়েছে পহেলা বৈশাখে পান্তা ইলিশ ।এর মধ্যে সংষ্কৃতির বিকৃতি যেমন আছে তেমনই আছে গরীবদের নিয়ে , তাদের খাদ্য সংষ্কৃতি নিয়ে বেল্লিকী মষ্করা ।এই বিকৃতিকে ভোগ বিকৃতি বলা যায় ।এই বিকৃতির মধ্যে যেটা ঘটছে তা হলো ইলিশের মৌসুম থেকে শুরু করে পহেলা বৈশাখ পর্যন্ত ইলিশের বাজার থাকে অস্থির ।গরীব সাধারণের সে বাজারে প্রবেশের কোন ক্ষমতা থাকে না ।বিকৃত মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য চর্চার ফল হয়েছে যে , গরীব সাধারণ ইলিশের স্বাদ ভুলতে বসেছে ।এ বিকৃতি এমনই যে ,পহেলা বৈশাখে এদের মধ্যে আলোচনার প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়ায় কে কত টাকায় ইলিশের জোড়া কিনেছে !খবর পাওয়া যায় এ সময় প্রতি জোড়া ইলিশ ২০ হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় ।এর মধ্য দিয়ে মধ্যবিত্তের এই লুটেরা অংশের লুটপাটের পরিমাণও বুঝা যায় ।
এ বিকৃতি চর্চা এখন সরকারীভাবে সরকারী পর্যায়েও চলছে ।পহেলা বৈশাখে বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এবং সরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পান্তা ইলিশের আয়োজনের খবর পাওয়া যায় ।এই হলো শেকড় উপড়ানো চরিত্রহীন লুটেরা বাঙালী মধ্যবিত্তের ঐতিহ্য চর্চা।
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন