শাসক শ্রেণির হেফাজত

লিখেছেন লিখেছেন ফারুক আহমেদ০২ ০৬ এপ্রিল, ২০১৩, ১২:১৬:৩০ রাত

দুর্নীতি, দখল , লুটপাট , জনগণের সম্পদ বিদেশীদের হাতে তুলে দেওয়ার নীতি,জনস্বার্থ বিরোধী কর্মকান্ড,দুঃশাসন ,নিয়ন্ত্রণ-লাগামহীন দব্যমূল্য,আধিপত্যবাদী-সাম্রাজ্যবাদী বিভিন্ন দেশের সাথে দেশবিরোধী-জনস্বার্থবিরোধী চুক্তি, জনগণের গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমন এ সব কিছুতেই শাসক শ্রেণির পরিচিত দুটি অংশেরই একই নীতি ।এক অংশ যখন ক্ষমতায় থাকে তখন অপর অংশের জনস্বার্থের কোন এজেন্ডাই থাকে না যা নিয়ে তারা সংসদে বা সংসদের বাইরে কোন আন্দোলন গড়ে তুলতে পারে ।কিন্তু নিস্তরঙ্গ পরিস্তিতিতে উপরে উল্লেখিত কর্মকান্ডগুলো যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের পক্ষেও করা সম্ভব নয় ।এর জন্য প্রয়োজন এক অস্থির পরিস্থিতির । সে কারণে যারাই ক্ষমতায় থাকে তাদেরই প্রয়োজন পড়ে জনস্বার্থের সাথে সম্পর্কিত নয় এমন কতকগুলো ইস্যু বিরোধী পক্ষের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া যাতে শাসক শ্রেণির উভয় অংশই জনস্বার্থের বাইরের ইস্যু নিয়ে রাজনীতির মাঠ গরম রেখে তাদের নিজ নিজ কর্মকান্ড এক অস্থির পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে চালিয়ে যেতে পারে ।কিন্তু এ কাজ করতে গিয়ে এমন কতকগুলো নতুন পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে যা তাদের পক্ষে সমাধান করা অসম্ভব হয়ে পড়ে ।তাদের রক্ষা বা হেফাজতের প্রয়োজন পড়ে ।ইতিপূর্বে বিভিন্ন তরফ থেকে তাদের হেফাজত হয়েছে ।সংকটের ধরণ অনুযায়ী কখনো সাম্রাজ্যবাদী মুরুব্বী, কখনো সরাসরি সামরিক বাহিনী, কখনো ওয়ান ইলেভেনের মত ছদ্মবেশী সামরিক বাহিনী এগুলো এদেশের মানুষের অজানা নয় ।বর্তমানে সংকটের যে ধরণ এ নিয়ে শাসক শ্রেণির উভয় অংশের মধ্যে তার মীমাংসার কোন ফর্মূলাই কাজ করছে না ।

এদের উভয় অংশের দ্বারা সৃষ্ট অস্থির পরিস্থিতির মধ্যেও স্বতঃস্ফুর্ত মানুষের সংগঠিত হওয়া ঠেকানো তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না ।বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এর আগে এদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্বতঃস্ফুর্ত মানুষের এমনভাবে সংগঠিত হওয়ার অবস্থা সৃষ্টি হয়নি ।শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চ সৃষ্টি হওয়ার পর সারা দেশে স্বতঃস্ফুর্ত মানুষের সংগঠিত হওয়া শাসক শ্রেণির উভয় অংশের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।তাই শাসক শ্রেণির দিক থেকে গণমানুষের তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে এই সংগঠিত হওয়াকে ‘পান’ দেওয়ার কৌশল গ্রহন করা হয় ।লোহাকে ব্যবহার উপযোগী করার জন্য যেমন উত্তপ্ত করে আবার পানিতে দেওয়া হয় । তেমনি শুরু থেকেই গণমানুষের সংগঠিত হওয়াতে ভীত হয়ে শাসক শ্রেণির এক অংশ ভেতর থেকে এবং অপর অংশ বাইরে থেকে তাকে বিভ্রান্ত করার নানা কৌশল গ্রহন করে আসছে ।কেউ এই আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন বলে দেশের মধ্যে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামীলীগ নানা তালবাহানা করে এখন তাদেরই দাবিদাওয়া পুরণ করতে তৎপর হয়েছে ।শাসক শ্রেণির উভয় অংশের হেফাজতের জন্য বা রক্ষার জন্য তারা ধর্মের আশ্রয় নিয়েছে । অত্যন্ত নিকৃষ্টভাবে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যহার এখন তাদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে ।তাদের উভয় অংশের মদদে হেফাজতে ইসলাম নামে তাদের হেফাজতের জন্য একটি সংগঠন খোলা হয়েছে ।এ সংগঠনের নাম এর আগে এদেশের মানুষ কখনো সেভাবে শোনেননি।

এ সংগঠনটি শাহবাগে গণমানুষের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহনের মধ্যদিয়ে গণমানুষের দ্বারা গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কর্মসূচীতে অংশগ্রহনকারী সকলকে নাস্তিক বলে আখ্যায়িত করে সারা বাংলাদেশে এক অস্থির পরিস্থিতির সৃষ্টি করে চলেছে ।বি.এন.পি’র নের্তৃত্বাধীন ১৮ দল সরাসরি এদের সমর্থন এবং মদদ দিয়ে চলেছে ।ঘাপটি মেরে থাকা সরকারী দল আওয়ামীলীগের নের্তৃত্বাধীন ১৪ দল এবং সরকার এখন তাদের মুখোশ খুলে ফেলে এই সংগঠনটিকে মদদ দিচ্ছে ।হঠাৎ সৃষ্টি হওয়া এ সংগঠনটি দেশের জনগণের এমন কোন প্রতিনিধিত্ব করে না ।তাই এর বিরাট শক্তিশালী হওয়ারও কোন বাস্তব কারণ নাই ।এদের শক্তির মূল উৎস সরকার , ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দল ।তারা ৬ এপ্রিল লংমার্চের ঘোষণা দিয়েছে ।চট্টগ্রাম থেকে তারা ঢাকায় লংমার্চ করবে ।তাতে অংশ গ্রহন করবে এক হাজার বাস ,সমসংখ্যক মাইক্রোবাস,অসংখ্য কার, মোটরসাইকেল ইত্যাদি , তারা এভাবেই ঘোষণায় বলেছে ।এতে যে বিপুল অংকের টাকা প্রয়োজন তার উৎস সম্পর্কে এর উদ্যোক্তারা পরিষ্কার করে কিছু বলতে পারেননি।তবে সংবাদপত্র মারফত যা’ জানা যাচ্ছে, তারা বলেছেন তাদের কর্মসূচীর ব্যাপারে বি.এন.পি., আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন দল তাদেরকে সহযোগীতা করছে ।এ সহযোগিতার প্রধান দিক যে অর্থ এটা বলাই বাহুল্য ।শাসক শ্রেণির দলগুলো যতই অস্বীকার করুক না কেন এ সত্যকে আড়াল করা যাবে না ।বলা হচ্ছে এ আয়োজনে তাদের বিশ কোটি টাকা খরচ হবে ।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এত বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে এমন আয়োজন?বলা হচ্ছে কিছু ব্লগার বিভিন্ন ব্লগে ইসলাম ধর্ম, নবী, আল্লাহ সম্পর্কে কটুক্তি করেছে, আপত্তিকর কথা লিখেছে ।এতে মানুষের ধর্মানুভুতিতে আঘাত দেওয়া হয়েছে ।কেউ যদি ধর্ম ,নবী, আল্লাহ সম্পর্কে কোন কটুক্তি করে তাতে বিশ্বাসীদের অন্তরে আঘাত লাগা অত্যন্ত স্বাভবিক ।কিন্তু এই সংগঠনটি যাদের ধর্মানুভুতিতে আঘাতের কথা বলছে তাদের কতজন ঐসব ব্লগারের লেখা সরাসরি পড়েছে?এর উদ্যোক্তাদের যদি সত্যিই আল্লাহ, রাসুল এবং ধর্মের প্রতি এতটুকু প্রেম থাকতো তাহলে তাদের সর্বপ্রথম দাবী হতে পারত এসব লেখা যাতে প্রচার না পায় তার ব্যবস্থা করা ।অথচ দেখা যাচ্ছে এসব কটুক্তি কথিত ব্লগাররা আসলে লিখেছে কিনা এবং তাদের দ্বারা তা কতটুকু প্রচারিত হয়েছে তা জানা না গেলেও এই সংগঠন এবং কতকগুলো পত্রিকার মাধ্যমে তা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়ে চলেছে ।এর মাধ্যমে গরীব ছাত্রদের উত্তেজিত করে তোলা যায় বটে কিন্তু এর মাধ্যমে কি খোদা প্রেম, রাসুল প্রেম এবং ইসলামের প্রতি ভালবাসা প্রকাশ পায়?তাহলে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মানুভূতিতে আসল আঘাত কে করছে ?ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী মানুষ জানেন এবং তারা ইসলাম থেকে এই শিক্ষা পেয়েছেন যে ,ভয়ংকর শত্রুকেও রাসুল প্রেমিক এবং খোদা প্রেমিক যাঁরা, তাঁরা আষ্ফালন না করে ইসলা্মের মর্মবাণী বুঝার দাওয়াত দিয়েছেন ।ইসলামের বিরূদ্ধে,রাসুলের বিরূদ্ধে, কেউ কোন কুৎসা করলে কখনোই খোদা প্রেমিক, রাসুল প্রেমিক , ইসলাম প্রেমিক কেউ ফলাও করে প্রচারে নিয়ে যাননি ।তাহলে এ কোন্ ইসলাম হেফাজতকারী ?সরকার এদের প্রতি আনুগত্য দেখিয়ে কথিত কটুক্তিকারী এমন কয়েকজন ব্লগারকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়েছে ।বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে তান্ডব চলছে । মানুষ হত্যা, অগ্নিসংযোগ ,বোমাবাজি , লুটপাট এগুলোর দৃশ্য মিডিয়াতে মানুষ প্রতিদিন লাইভ দেখছে । এদের গ্রেপ্তার করা , শাস্তি দেওয়ার কোন কিছুই মানুষ দেখছে না ।অথচ অত্যন্ত ঘৃন্যভাবে পবিত্র ধর্মকে ধর্মানুভুতিকে সরকার এবং বিরোধিদল রাজনীতিতে ব্যবহারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছে ।

বাংলাদেশে সবচেয়ে গরীব মানুষের সন্তানেরা মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে ।শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্রের জন্মলগ্ন থেকেই বৈষম্যমূলক নীতির কারণে সবচেয়ে গরীব মানুষের সন্তানেরা সব সময়ই ধর্মব্যবসায়ীদের হাতে জিম্মি থেকে গিয়েছে ।এখনও তারা জিম্মি অবস্থায় আছে ।এদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা শাসক শ্রেণির লোকেরা সবসময়ই নানা ভাবে নানা ফর্মূলায় করেছে এবং করছে ।গরীবদের হাতে ভিক্ষার ঝুলি তুলে দেওয়া হয়, তাদের দ্বারা ভিক্ষা করানো হয় একদিকে অপরদিকে তাদেরই ব্যবহার করে প্রতিবাদের নামে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এবং জৌলুসপূর্ণ কর্মকান্ড করা হচ্ছে ।এটাকি ইসলাম ?সারা পৃথিবীর মানুষ দেড় হাজার বছর ধরে যে ইসলামকে জেনে এসেছে এসব কর্মকান্ড কি সেই ইসলামের অবমাননা নয় ?

হেফাজতে ইসলাম নামের সংগঠনটির উদ্যোক্তাদের কন্ঠে এখন শাসক শ্রেণির দুই অংশের সম্মিলিত জোর ।এ জোরের কারণ শাসক শ্রেণির উভয় অংশই এদের মাধ্যমে একটা কিছু করতে চাচ্ছে ।বলা হচ্ছে ভোটের রাজনীতিতে উভয় অংশই এখন এদের খেদমতে ব্যস্ত ।আসলে ভোটের রাজনীতির সমীকরণের বাইরেও এই সংগঠনটিকে ঘিরে উভয় অংশেরই আরো অনেক জটিল সমীকরণ আছে বলেই মনে হচ্ছে ।এর আগের সংকট তারা ওয়ান ইলেভেনের মধ্য দিয়ে যেমন উৎরিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল এবারের সংকটে তেমনও আর সম্ভব হচ্ছে না ।তাই তাদের নিজেদের হেফাজতের জন্য তারা নানা পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে আছে ।

এদিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি হিসেবে কথিত আয়ামীলীগের ভোটের রাজনীতির হিসাব হচ্ছে,তারা বিশ্বাস করে তারা যেমন নীতিই গ্রহন করুক না কেন সংখ্যালঘু এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে যারা সংগ্রাম করে চলেছেন তাঁদের আওয়ামীলীগ ছাড়া ভোটদানের অন্য কোন জায়গা নাই ।আওয়ামীলীগের এ বিশ্বাসের ভিত্তি হলো উপরে উল্লেখিতদের মুখপাত্র বলে যারা কথিত তাদের আচরণ এবং নীতি ।মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি বলে পরিচিত রাজনৈতিক , সামাজিক এবং সাংষ্কৃতিক সকল সংগঠনই অত্যন্ত নতজানুভাবে আওয়ামীলীগের দিকে এমনভাবে ঝুঁকে আছে যে আওয়ামীলীগ তাদেরকে ভোট ব্যাংক হিসাবে মনে করতেই পারে ।এ বিশ্বাস আওয়ামীলীগ শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের সামনের সারিতে যারা মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত তাদের আচরণ , কথাবার্তা , কর্মসূচী ও আনুগত্যের মধ্য থেকেও পায়।তাই আওয়ামীলীগ মনে করতেই পারে ভোটের রাজনীতিতে এবং সমীকরণে এই অংশকে নিয়ে তাদের ভাবনার কিছু নেই ।এমনকি আওয়ামীলীগের দিক থেকে তাদের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হলেও এর হেরফের হবে না ।তাদের হিসাব হেফাজতে ইসলামের মত যারা আছেন তাদের নিয়ে ।এই হিসাব থেকেই বরাবরের মতই আওয়ামীলীগ ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার করবে এটা খুবই স্বাভাবিক ।আওয়ামীলীগ এখন তাই করছে ।

যতদিন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের এবং গণতান্ত্রিক,প্রগতিশীল শক্তি তার জমিন-ঠিকানা নির্ধারণ করতে না পারবে ততদিনই এ অবস্থা ঘুরে ঘুরে নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হবে ।

বিষয়: রাজনীতি

১১১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File