ইসলামি আন্দোলনে সংস্কারঃ বোকামী, পথভ্রান্তি নাকি বিচক্ষনতা ও নতুন পথের সন্ধান? (তুরষ্কের অভিজ্ঞতার আলোকে একটি মূল্যায়ন)

লিখেছেন লিখেছেন ধর্মচিন্তা ০৭ এপ্রিল, ২০১৩, ০৯:২৬:৩৩ রাত

সংস্কারের কথা শুনলেই ইসলামী রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত অনেকে আঁতকে উঠেন। মনে করেন সংস্কারের নামে ইসলামকে বিসর্জন দেওয়া হবে। অথবা ইসলামের উদার ব্যাখ্যা দিয়ে বা ইসলামী বিধিবিধানে ছাড়দিয়ে ইসলামকে আহত বা পঙ্গু করা হবে। এমন আতঙ্ককে অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দেওয়ার উপায় নেই কারণ অনেক দেশেই সংস্কার বাদী ইসলামী রাজনৈতিকদের ক্ষেত্রে এরূপ ঘটেছে। সুতরাং আতংকটি অমুলক নয়। এমনকি দোষেরও নয় কারণ ইসলামের প্রতি গভীর অনুরাগ থেকেই এই আতংকের সৃষ্টি। পক্ষান্তরে, সংস্কার বাদীরা সংস্কারকেই ইসলামী রাজনীতির সংকট উত্তরণের একমাত্র উপায় মনে করেন। নানা প্রতিবন্ধকতা ও কঠিন সমস্যার জালে আটকে পড়া ইসলামী রাজনীতিকে চলমান বাস্তবতার সাথে খাপ খাইয়ে একটি নতুন গতিশীল স্তরে উন্নীত করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ইসলামের ক্ষতিকরা বা অঙ্গহানি করে ইসলাম বিরুদ্ধ অঙ্গ সংযোজন করাও তাদের এজেন্ডা নয়। উভয় পক্ষের মূল বিরোধটা স্রেফ পন্থা গত। পন্থা গত ভিন্নতা অথবা বৈপরীত্যই তাদেরকে মুখোমুখি দাড় করাচ্ছে। যাহোক, সংস্কার প্রশ্নে একপক্ষের অতি-উৎসাহ এবং অপর পক্ষের দ্যার্থহীন বেকে বসার কোন পক্ষে বাস্তবতার অবস্থান তা নির্নয় করার জন্য রেডিক্যালী সংস্কার হওয়া এবং ধীরে ধীরে বিশ্ব ইসলামী রাজনীতির অনেকটা মডেল হয়ে উঠা তুরস্কের চলমান ইসলামী রাজনীতির উপর একটি সংক্ষিপ্ত আলোকপাত করবো। তুরস্কের ক্ষমতাসীন জনপ্রিয় এ কে পার্টি সেদেশে ইখওয়ান বা জামায়াত টাইপ ইসলামী রাজনীতি প্রায়ত নাজমুদ্দীন এরবাকানের মিল্লি কোরোশ থেকে বেরিয়ে আসা সংস্কারপন্থী একটি দল। দলটির শীর্ষ নেতৃবৃন্দ মিল্লি কোরোশের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ছিলেন এবং এ কে পি’র বর্তমান প্রধান ও তুরস্কের বর্তমান প্রধান মন্ত্রী এরদোগান এই পার্টি থেকেই ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচিত হন। এই দলটিকে বলাযায় সংস্কার বাদী ধারার লেটেস্ট ভার্সন। দলটির নাম বা কর্মসূচীতে ইসলামের নাম গন্ধও নেই। নিজেকে ইসলামী দল হিসাবে পরিচয়ও দেয় না। দলটি রক্ষণশীল ইসলামিস্ট ও রক্ষণশীল সেকুলার উভয় শিবিরেই সমালোচিত। দেশটির রক্ষণশীল সেকুলার শক্তি ও পশ্চিমা দেশগুলো দলটিকে ছদ্মবেশী ইসলামী শক্তি বলে ধারণা করে। এরদোগানকে তারা ইসলামের ট্রোজান হর্স বলে আখ্যায়িত করে। অপর দিকে দলটিকে ঘিরে রক্ষণশীল ইসলামিস্টদের রয়েছে রুক্ষ তির্যক ও হীন সমালোচনা ... গাদ্দার, মুনাফেক, লেবাস ধারী......... ইত্যাদি, ইত্যাদি। ভাবটা এমন যে সংস্কার করে দলটি ইসলামের মহা সর্বনাশ করেছে। তাদের সমালোচনায় সংস্কারের প্রেক্ষাপট, কারণ, সংস্কার ছাড়া আর কি করা যেত, সংস্কার না হলে কি হত, সংস্কারের কি ফল পাওয়া গেছে, সংস্কারের আগে ও পরের ভূমিকার তুলনা একেবারেই অনুপস্থিত। দলটির সংস্কার বাদী পদক্ষেপকে তারা দেখছেন ইসলাম থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদে ধর্মান্তর। এ ধরনের ভাসমান সমালোচনাকে প্রজ্ঞা হীন বললে অতিরঞ্জন হয় কিনা তার বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম।

প্রিয় পাঠক, দলটি কেন সংস্কারের পথ বেছে নিয়েছে তার ইতিহাস ও প্রেক্ষাপট অনেক দীর্ঘ। সুযোগ হলে পরে বিস্তারিত লিখবো ইনশাআল্লাহ। এখনে শুধু এরদোগানের কয়েকটি সাক্ষাতকার, তুরস্কের ইসলামী আন্দোলন নিয়ে আমার স্টাডি ও চাক্ষুশ অভিজ্ঞতার আলোকে সংক্ষেপে পেক্ষাপটটা তুলে ধরার চেষ্টা করবো। সচেতন পাঠক অবশ্যই জানেন যে মুসলিম বিশ্বকে সেকুলারাইজেশন শুরু হয় উপনিবেশিক শাসনামল থেকে। এই উদ্দেশ্যে তিনটি দেশ তুরস্ক, মিশর ও লেবাননকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসা হয়। তুরস্কে এই প্রক্রিয়া অন্য যে কোনো দেশের চেয়ে ছিল অনেক ভিন্ন, ভয়ঙ্কর এবং পীড়াদায়ক। আতাতুর্ক শুধু ইসলামের শিকড় তুলে ফেলার চেষ্টায় করেনি ইসলামী সিম্বলকেও ধ্বংশ করে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আরবি আদ্যক্ষর পরিবর্তন করে ল্যাটিন চালু, তুর্কি ভাষায় আজানের প্রবর্তন, মসজিদ মাদ্রাসা বন্ধ করে আস্তাবল তৈরি, নামাজ পড়লেই ব্ল্যাক লিস্টেড, ড্রেস কোড বদলে ইউরোপীয় ধাঁচ গ্রহণ, খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, শিক্ষা কারিকুলাম থেকে ইসলামের নাম গন্ধ মুছে ফেলা, সামরিক বাহিনী থেকে ইসলাম পন্থীদের উৎখাত ইত্যাদির মাধ্যমে সর্ব পর্যায়ে সর্বাঙ্গীণ ভাবে পাশ্চাত্যের আদলে অত্যন্ত সিস্টেমেটিক উপায়ে সত্তর বছর ধরে ধর্মনিরপেক্ষ করন করা হয়েছে। জেনে অবাক হবেন বড় বড় অনেক মুসলিম স্কলারদের কবর পর্যন্ত অজ্ঞাত স্থানে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তুরস্কের ইসলামী জাগরণের একজন প্রাণপুরুষ বদিউজ্জামানের কবর তুলে কোথায় দাফন করা হয়েছে কেউ জানেনা। এখনো পর্যন্ত অনেক মসজিদ আজান ফিরে পায়নি। অনেক মাদ্রাসা এখনো পানশালা অথবা মার্কেট। সাত/আট দশকের এই সিস্টমেটিক প্যারাডাইম শিফটের ফলে অন্তত অর্ধেকটা জনসংখ্যা এখন রক্তে মাংসে আল্ট্র সেকুলার। এদের সাথে রয়েছে রক্ষণশীল ধর্মনিরপেক্ষ সেনা বাহীনি, খোঁড়া অজুহাতে ঘন ঘন সামরিক অভ্যুত্থান করা যাদের রুটিন ওয়ার্ক। এর উপর আরও রয়েছে সাংবিধানিক আদালত যা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের রক্ষক। ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদের সাথে সাংঘর্ষিক কোন রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা যাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এই আপাদমস্তক সেকুলার রাষ্ট্র যন্ত্র এবং সেকুলার গন ভিত্তিকে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকা একটি পিওর ইসলামী দলের জন্য কত কঠিন তা সহজে অনুমেয়। বাস্তবেই দেখুন এরবাকানের দলকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা থেকে আর্মি দলটিকে অপসারণ করার পর কোর্ট কিভাবে এটিকে নিষিদ্ধ করেছে। দলটি বিভিন্ন নামে যেমন ভার্চু, রাফা, ওয়েলফেয়ার ঘুরে দাঁড়ানো চেষ্টা করেও সফল হয়নি। এখন একটু বিচার করে দেখুন, বার বার ভেঙ্গে পড়া এবং সেকুলারদের টার্গেটে পরিণত হওয়া দলটির কাল উত্তীর্ণ ভঙ্গুর পলিসির পিছনে অন্ধভাবে ঘুর ঘুর করা সংস্কারপন্থীদের জন্য যথার্থ ছিল না কি সংস্কারের মাধ্যমে নতুনভাবে আসাটাই সিদ্ধ হয়েছে। এবার আসুন ইসলামের জন্য কোন পক্ষের অবদান কেমন তুলনা করে দেখা যাক। কারণ এই পয়েন্টটিই বিচারের একটি মানদণ্ড “সংস্কারপন্থীরা পথ খুঁজতে গিয়ে পথ হারাচ্ছে কিনা”। পরিসংখ্যান বলছে এরবাকানের শাসনামলে ইসলামের জাত শত্রু ইসরাইলের সাথে তুরস্কের বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ছিল। তিনি প্যালেস্টাইন ইস্যু নিয়ে চোখে পড়ার মত কোন ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হননি। পক্ষান্তরে সংস্কারপন্থী এরদোগান দাভোস ইকোনোমিক সামিট থেকে প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ওয়াক আউট করেছেন এবং এ ধরনের আন্তর্জাতিক ফোরামে ইসরাইলের প্রেসিডেন্টকে খুনি আখ্যায়িত করেছেন। বিশ্ব শক্তির রক্ত চক্ষু উপেক্ষা করে হামাসের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন এবং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসাবে আখ্যায়িত করতে অস্বীকার করেছেন। শেখ ইয়াসিন হত্যাকে ইসরাইলের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস বলেছেন এবং সম্প্রতি ইসরাইলের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে তুরস্কের ইতিহাসে এক বিরল নজির স্থাপন করেছেন। এ কে পি হিজাবের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে চেষ্টা করছে। ২০১২ সালে বর্তমান সংবিধান পালটে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে যাচ্ছে যা ইসলামী কার্যক্রমের উপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা অনেকটা শিথিল করবে। বিভিন্ন দেশে ইসলাম পন্থীদের কৌশলগত সহয়তা দিচ্ছে। সিরিয়ার নির্যাতিত ইখওয়ান কর্মীদের আশ্রয়ের জন্য দরজা ওপেন করে রেখেছে একমাত্র এরদোগান সরকার। তুলনামূলক ভাবে সংস্কারপন্থীরাই বরং ইসলামের স্বার্থে বেশি কার্যকর অবদান রেখেছে। তার পরেও হয়তো সংস্কার ফোবিয়া আক্রান্ত ট্রাডীশনালিষ্টরা আর্তি দিয়ে বলে উঠবেন ... সংস্কার !!!! ইসলাম গেলো !!!! সংস্কারের নামে পথ খুঁজতে পথ হারাচ্ছে না তো !!!!!!!!! সংস্কার শুনলেই আঁতকে উঠার কিছু নেই। সংস্কার প্রকৃতির বিধান। সংস্কার মেয়াদ উত্তীর্ণ উপাদানকে হালনাগাদ করে নেওয়া। বর্জ্য ঝেড়ে ফেলা। এই জন্যই তো ইসলামে ইজতিহাদের ব্যবস্থা। ইসলামী রাজনীতির পলিসি সংস্কার ইসলামের সংস্কার নয়। দুটিকে এক করে ফেলা মারাত্মক ভূল।

বিষয়: বিবিধ

২৬৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File