হয়রত সাঈদ ইবন‘আমেরআল-জুমাহী’(রা)
লিখেছেন লিখেছেন আহমেদ হোসেন ১৩ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:০২:০৭ সন্ধ্যা
সাহাবীদের জীবন আমাদের জন্য অনুসরণীয়। বর্তমান মুসলমানের দুরবস্থার জন্য তারা নিজেরা দায়ী।কারন তারা ইসলাম র্ধম থেকে দূরে সরে গেছে। আমরা যদি সাহাবীদের জীবন বিশ্লেষন করি তা হলে বুঝব মৃত্যু পযর্ন্ত তারা হকের ওপর ছিল। এই কারনে সাহাবীদের যুগ ছিল মুসলমানের স্বর্ণ যুগ। ঐই সময় তারা বহু রাজ্য ও ধন সম্পদের মালিক হয়।
সাহাবীর জীবন পড়তে পড়তে এক সময় আমি আবেগে আপ্লুত হয়েছি, অশ্রুস্নাত নয়নে মনে ভাবছিলাম আমাদের ঈমানের অবস্থা নিয়ে।আমাদের ঈমান তাদের ঈমানের সাথে তুলনাযোগ্য নয়। তারা আল্লহর হক প্রতিষ্ঠার জন্য নিজের জীবনকে উৎর্সগ করেছেন। এমনকি আল্লাহর হকের জন্য তারা আপন আত্নীয়স্বজনকে ও বিন্দু মাএ সহমর্মিতা দেখান নাই।
এখানে আমি একজন সাহাবীর জীবনী সংক্ষেপে আলোচনা করব। এই সাহাবীর নাম হয়রত সাঈদ ইবন‘ আমের আল-জুমাহী’ (রা) ঐতিহাসিকরা বলেছেন : সাঈদ ইবন ‘আমের এমন ব্যক্তি যিনি দুনিয়ার বিনিময় আখিরাত খরিদ করেন এবং আল্লাহ ও তার রাসুলকে (সা) অন্য সব কিছুর ওপর প্রধান্য দান করেন। তাঁর পিতার নাম আমের এবং মাতা আরওয়া বিনতু মুয়ীত । খাইবার বিজয়ের পূর্বে ইসলাম গ্রহণ করেন।
মক্কার কুরাইশরা ধোঁকা দিয়ে রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর সাহাবী খুবাইব ইবন আদীকে রাদিয়াল্লাহু আনহু বন্দী করে মক্কায় নিয়ে আসে এবং সমবেত জনমন্ডলীর সামনে প্রকাশ্যে জীবিত অবস্থায় অত্যন্ত নৃশংসভাবে তাঁর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেটে তাঁকে শুলবিদ্ধ করে। এ হৃদয় বিদারক দৃশ্য উপভোগ করার জন্য মক্কায় ঢেড়া পিটিয়ে দেওয়া হয়। এ দৃশ্য দেখার জন্য মক্কার তানয়ীম এলাকা থেকে আগত লোকদের মধ্যে সাঈদ ইবন ’আমের আল-জুমাহীও ছিলেন।
তাঁর ধমনীতে তখন যৌবনের টগবগে রক্ত। মানুষের ভীড় ঠেলে তিনিও চলেছেন সামনের দিকে। এক সময় তিনি এসে দাঁড়ালেন প্রথম সারির কুরাইশ নেতৃবৃন্দ- আবু সুফিয়ান ইবন হারব, সাফওয়ান ইবন উমাইয়্যা প্রমুখের পাশাপাশি। কুরাইশদের বন্দীকে তিনি দেখলেন বেড়ী লাগানো অবস্থায়। নারী-পুরুষ, আবাল বৃদ্ধ-বণিতা তাঁকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে মৃত্যুর আংগিনার দিকে। তাঁর হত্যার মাধ্যমে বদর যুদ্ধে নিহত কুরাইশদের বদলা নেওয়াই তাদের উদ্দেশ্য। তাই তারা পৈশাচিক উল্লাসে মাতোয়ারা।
বন্দীকে সংগে নিয়ে অগণিত মানুষ বধ্যভূমিতে উপস্থিত হল। দীর্ঘদেহী যুবক সাঈদ ইবন ’আমের দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। নারী ও শিশুদের চীৎকার ও শোরগোলের মধ্যে তাঁর কানে ভেসে এল খুবাইবের দৃঢ় ও শান্ত কণ্ঠস্বর। বলছেনঃ ‘আমাকে শূলীতে চড়াবার পূর্বে তোমরা যদি অনুমতি দাও, আমি দু’রাকা’আত নামায আদায় করে নিতে পারি’। তারা অনুমতি দিল।
সাঈদ ইবন ’আমের দেখলেন, তিনি কা’বার দিকে মুখ করে দু’রাকা’আত নামায আদায় করলেন। সে নামায কতই না সুন্দর, কতই না চমৎকার! তার পর কুরাইশ নেতৃবৃন্দের দিকে ফিরে তাদেরকে বললেন, ‘আল্লাহর কসম! তোমরা যদি মনে না করতে, আমি মরণ-ভয়ে নামায দীর্ঘ করছি, তাহলে আমি নামায আরও দীর্ঘ করতাম।’
অতঃপর সাঈদ ইবন ’আমের স্বচক্ষে দেখলেন, তাঁর গোত্রের লোকেরা জীবিত অবস্থায় খুবাইবের দেহ থেকে একটার পর একটা অংগ কেটে ফেলছে। আর তাঁকে জিজ্ঞেস করেছেঃ ‘তোমার স্থানে মুহাম্মদকে আনা হোক, আর তুমি মুক্তি পেয়ে যাও, তা কি তুমি পছন্দ কর?’
তাঁর দেহ থেকে রক্তের ধারা প্রবাহিত হচ্ছে, আর তিনি বললেনঃ ‘আল্লাহর কসম, আমি আমার পরিবার ও সন্তান-সন্ততির মধ্যে নিরাপদে অবস্থান করি, আর বিনিময়ে মুহাম্মদের (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) গায়ে কাঁটার আঁচড় লাগুক তাও আমার মনঃপূত নয়।’ একথা শুনে চতুর্দিক থেকে লোকেরা হাত ওপরে উঠিয়ে চীৎকার করে বলতে লাগলঃ ‘হত্যা কর, ওকে হত্যা করা।’
অতঃপর সাঈদ ইবন ‘আমর দেখলেন, শূলীকাষ্ঠের ওপর দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি বলছেনঃ ‘আল্লাহুম্মা আহসিহিম আদাদা- ওয়াকতুলহুম বাদাদা ওয়ালা তুগাদির মিনহুম আহাদা-ইয়া আল্লাহ, তাদের সংখ্যা তুমি গুণে রাখ, তাদেরকে তুমি এক এক করে হত্যা কর এবং কাউকে তুমি ছেড়ে দিও না।’ এই ছিল তাঁর অন্তিম দু’আ। তারপর তরবারি ও বর্শার অসংখ্য আঘাতে তাঁর দেহ জর্জরিত করা হয়।
কিছুদিনের মধ্যে কুরাইশরা বড় বড় ঘটনাবলীতে লিপ্ত হয়ে খুবাইব ও তাঁর শূলীর কথা ভুলে গেল। কিন্তু যুবক সাঈদ ইবন’আমের আল জুমাহীর অন্তর থেকে খুবাইবের স্মৃতি এক মুহূর্তের জন্য দূরীভূত হলনা। ঘুমালে স্বপ্নের মধ্যে, জেগে থাকলে কল্পনায় তিনি খুবাইবকে দেখতেন। তিনি যেন দেখতে পেতেন, খুবাইব শূলীকাষ্ঠের সামনে অত্যন্ত ধীর-স্থির ও প্রশান্তভাবে দু’রাকাত নামায আদায় করছেন। কুরাইশদের ওপর অন্তিম বদ-দু’আর বিনীত সুরও যেন তিনি দু’কান দিয়ে শুনতে পেতেন। তাঁর ভয় হত এখনই হয়ত তাঁর ওপর বজ্রপাত হতে অথবা আকাশ থেকে প্রস্তর বর্ষিত হবে।
তাছাড়া খুবাইবের নিকট থেকে তিনি এমন কিছু শিক্ষালাভ করেন, এর পূর্বে যা তিনি জানতেন না। যেমনঃ বিশ্বাস এবং বিশ্বাসের পথে আমরণ জিহাদই হচ্ছে প্রকৃত জীবন। মজবুত ঈমান অনেক অভিনব ও অলৌকিক বিষয় সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া একজন মানুষ যাঁকে তাঁর সংঙ্গীরা এত গভীরভাবে মুহাব্বাত করতে পারে, তিনি আল্লাহ্ প্রেরিত নবী ছাড়া আর কিছু নন।
সেই সময় থেকে আল্লাহ্ তা’আলা সাঈদ ইবন ’আমেরের অন্তরকে ইসলামের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। একদিন তিনি জনমন্ডলীর সামনে উঠে দাঁড়িয়ে কুরাইশদের দেব-দেবী ও মূর্তির সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিন্ন করে ইসলাম গ্রহণের প্রকাশ্য ঘোষণা দেন। খাইবার যুদ্ধের পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন।
সাঈদ ইবন ’আমের হিজরত করে মদীনায় এলেন এবং সর্বক্ষণ রাসূলুল্লাহর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) সাহচর্য অবলম্বন করেন। তিনি খাইবারসহ পরবর্তী সব যুদ্ধেই অংশগ্রহণ করেন।
হযরত উমর (রা এর খেলাফত কালে তিনি (উমর)
হযরত যয়ীদ বিন আমের আল জুমাহী (রাকে হিমসের গভর্নর করে পাঠালেন।কিছুদিনপর হিমসের একটি প্রতিনিধিদল ওমর (রাঃ) এর সাথে সাক্ষাৎ করে অভাবীলোকদের একটি তালিকা দিলেন।সেই তালিকায় সায়ীদ বিন আমের নাম দেখে ওমর (রাঃ) জিজ্ঞাসা করলেনঃ
“কে এই সায়ীদ বিন আমের?
উত্তরে তারা বললেনঃ
“তিনি আমাদের গভর্নর।”
এ কথা শুনে হযরত ওমর (রাঃ) আশ্চার্যান্বিত হলেন এবং আবার প্রশ্ন করলেনঃ
“তোমাদের গভর্নর কি অভাবী?”
তারা বললেনঃ“নিশ্চয়ই।আল্লাহর শপথ! আমরা সাক্ষ্য দিচ্ছিযে, আমাদের গভর্নরের পরিবারে দীর্ঘ সময় এমনও অতিবাহিত হয় যখন তাদের রান্না করার কিছুই থাকেনা এবং চুলায় আগুন জ্বলেনা।”
এ কথা শুনে ওমর (রাঃ) এর চোখের পানিতে দাঁড়ি মোবারক ভিজে গেল।
তিনি সায়ীদের জন্য এক হাজার স্বর্ণ মুদ্রার একটি থলি পাঠালে, সায়ীদ তা গরীবদের মাঝে বিতরন করে দিলেন।
কিছুদিনপর হিমসের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য হযরত ওমর (রাঃ) হিমসে গেলেন।সেখানকার জনগণ ওমর (রাঃ) এর নিকট ৪টি অভিযোগ ফেলেন সায়ীদ (রাঃ) এর ব্যাপারে।
১ম অভিযোগঃ“সায়ীদ (রাঃ) প্রত্যেহ অফিসে বিলম্বে আসে।”
এ অভিযোগের উত্তর সায়ীদ (রাঃ) এর কাছে ওমর (রাঃ) জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ
“আমার বিলম্বে অফিসে আসার কারন হলো- আমার ঘরে কোন চাকরাণী নেই।তাই আমাকে রুটি তৈরী করে, গোসল সেরে অফিসে আসতে সামান্য দেরি হয়।”
দ্বিতীয় অভিযোগঃ“রাতের বেলা কোন প্রয়োজনে গভর্নর কাছে গেলে তিনি আমাদের ডাকে সাড়া দেননা,।”
এ অভিযোগের জবাবে সায়ীদ (রাঃ) বললেনঃ“আমি দিনকে রাষ্ট্রীয় কার্য ও জনসাধারণের খেদমতের জন্য এবং রাতকে ইবাদাতের জন্য নির্দিষ্ট করে নিয়েছি।তাই রাত্রি বেলা কেউ আসলে তাদের ডাকে সাড়া দিতে পারিনা বলে আমি দুঃখিত।
তৃতীয় অভিযোগঃ“সায়ীদ (রাঃ) মাসে একদিনতার কার্যালয়ে অনুপস্থিত থাকেন।”
হযরত সায়ীদ (রা এই অভিযোগের জবাবে বললেন: “আমীরূল মুমেনীন আমার কোন কাজের লোক না থাকায় মাসে একবার আমাকে বাজার করতে হয়।এ ছাড়া পড়নের এই পোশাক ছাড়া আমার আর কোন পোশাক নেই, যা ঐ দিনই বাজার শেষে পরিস্কার করতে হয়।কাপড় শুকাতে দেরি হওয়ার ফলে আর অফিসে আসার সুযোগ থাকেনা।”
চতুর্থ অভিযোগ: “মাঝে মাঝে সায়ীদ বেহুশ ও অজ্ঞান হয়ে যান।ফলে তার পাশের লোকদের চিনতে পারেন না।”
এর উত্তরে তিনি বলেন: মুশরিক থাকা অবস্থায় মক্কার জনসমুদ্রের মাঝে হযরত খুবাইব ইবন আদীকে (রা কে মক্কায় কাফিররা টুকরো টুকরো কর ছিলএবং বল ছিল- হে খুবাইব তুমি কি রাজী আছ? তোমাকে ছেড়ে মুহাম্মদ (সা কে হত্যা করি।তার সেই শাহাদাতের নির্মম দৃশ্য মনে পড়লে আমি বেহুশ হয়ে যাই।আর কাউকে চিনতে পারিনা।
উমার তখন বললেন, সকল প্রংশসা আল্লাহর জন্য আমার ধারনাকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করেনি। তারপর তিনি তিনি সাঈদের প্রয়োজন মিটানোর জন্য এক লাখ দিনার পাঠলেন। তার সহধর্মনী দিনারগুলি দেখে বলে উঠলেন: ‘সকল প্রংশসা আল্লাহর, যিনি আমাদেরকে আপনার সেবা গ্রহন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। যান, আমাদের জন্য খাদ্য খাবার কিনে আনুন এবং একটি চাকর রাখুন।
একথা শুনে তিনি স্ত্রীকে বললেন: এর থেকে উওম কিছু লাভ কি তুমি চাওনা? স্ত্রী বললেন: সেই উওম বস্তু কী? তিনি বললেন, আমরা এ দিনার গুলি আল্লাহকে করজে হাসানা দিয়ে দেই। তিনি আমাদের উওম বিনিময় দান করবেন, আমরা তো সেই বিনিময়ের সর্বাধিক মুখাপেক্ষী।
স্ত্রী বললেন, হাঁ তা দিন। আল্লাহ আপনাকে উওম বিনিময় দান করুন।
সেই মজলিসে বসে তিনি দিনার গুলি কয়েকটি খলিতে ভরলেন তারপর পরিবারের প্রত্যক সদস্যের হাতে একটি করে থলি তিনি বললেন : অমুক বিধবা,অমুক এতিম, অমুক গোএের মীসকীন এবং অমুক গোএের অভাব গ্রস্তদের মধ্যে বিলি কে এস।
নিজের প্রয়োজন সত্বেও অন্যকে প্রাধান্য দেয়, সাঈদ সেই মহান ব্যক্তিদের একজন।
ইবন সা’দের মতে হিমসের ওয়ালী থাকা অবস্থায় হিজরী ২০ সনে তিনি ইন্তেকাল করেন। আবু উবাইদার মতে তাঁর মৃত্যু সন হিজরী ২১।
তথ্য সূএ: http://www.priyoboi.com/2011/05/blog-post_26.html
বিষয়: বিবিধ
১৬৪৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন