দক্ষিণাঞ্চলের জনপদে ভয়ঙ্কর আতঙ্ক
লিখেছেন লিখেছেন খাস খবর ০৯ জুলাই, ২০১৫, ১১:৪০:৪২ রাত
।।অহিদুজ্জামান।।
‘বরিশাল বিভাগ এখন এক ভয়ঙ্কর জনপদ। ঘরে ঘরে গুম-খুনের আতঙ্ক। নিষ্ঠুরতা সকলকেই তাড়া করছে প্রতিনিয়ত। কে কখন গুম-খুন হবে তা কেউ জানে না। সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসী কর্মকা-ের প্রধান পৃষ্ঠপোষক আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। আদালতে গিয়েও কেউ বিচার পাচ্ছেন না। দস্যু রানির রাজত্ব চলছে পাঁচ বছর ধরে।’
সম্প্রতি রাজাপুর উপজেলার তারাবুনিয়া গ্রামের খলিলুর রহমানকে (৪৫) নৃশংসভাবে পিটিয়ে সমস্থ শরীর থেঁতলে দিয়েয়েছে আওয়ামী লীগের স্থানীয় দুর্ধর্ষ গ্যাংসরদার আবদুর রহিম ওরফে আফজাল এবং তার সহযোগীরা। এই ভয়ঙ্কর ঘাতকরা শুধু পিটিয়ে থেঁতলে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। খলিলের একটি পা কেটে ফেলে উল্লাস করেছে দিনদুপুরে। তিনি স্থানীয় নির্বাচনে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীকে ভোট দিতে কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন।
স্থানীয় বাসিন্দারা টেলিফোনে জানিয়েছেন, শুধু খলিল নয়। গত পাচঁ বছরে রাজাপুরে অন্তত ৭০-৮০ জন এমন নৃশংসতার শিকার হয়েছেন। একই এলাকার ১৬ বছর বয়সী স্কুল ছাত্র লিমন হোসেনকে “ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী” বানিয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত এলিট ফোর্স র্যাপিট অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) ২০১০ সালে গুলি করার পর তার একটি পা চিকিৎসক কেটে ফেলেছে। এর কোন বিচার পায়নি লিমন। বরং রাষ্ট্রের দায়ের করা একাধিক মিথ্যা মামলায় তার জেল খাটতে হয়েছে। এখনো সে ভুক্তভোগী। আর খলিলের পা সন্ত্রাসীরাই কেটে ফেলেছে। হাসপাতালে যেতে হয়নি। সন্ত্রাসী ও র্যাব উভয়ই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আশির্বাদ প্রাপ্ত। লিমনের ‘অপরাধ’ ছিল তার বাবা বিএনপির একজন সমর্থক। মি. খলিল আওয়ামী লীগের কাছে একই ‘অপরাধ’ করেছে। অতএব কারোরই যাবার কোন স্থান নেই। আমরা এক আতঙ্কের রাষ্ট্রে আছি বলেছেন স্থানীয় ভুক্তভোগী মানুষ।
স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষোভের সঙ্গে আরো বললেন, প্রধানমন্ত্রীর আরএক আশির্বাদের বরপুত্র রাজাপুর-কাঠালিয়ার সংসদ সদস্য রাজাকারপুত্র বিএইচ হারুন। তিনি নব্য আওয়ামী লীগার।
এই হারুন কাউখালি উপজেলা থেকে ১৯৯৬ সালে নির্বাচন করেছিলেন জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী হিসেবে। এরপরে ২০০১ সালে ভান্ডারিয়া থেকে বিএনপির মনোনয়নে ধানের শীষ মার্কায় নির্বাচন করেন। দু‘বারই জামানত হারিয়েছে। প্রথমবারে তার প্রাপ্ত ভোট আর খরচের টাকা হিসাব মিলিয়ে দেখতে পেয়েছে প্রতিটা ভোটের মূল্য দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৮৯ হাজার টাকা। এঘটনা চাউর হলে তার মাজননী মুর্”ছা যায়। এসময়ে মায়ের প্রতি তার শান্তনা ছিল –‘ ডোন্ট বি ওয়ারি। নদীর পানি শেষ হবে। হারুনের টাকা শেষ হবে না।’
কারণ তিনি শেখ হাসিনার ছোট বোন লন্ডনি শেখ রেহেনার বয়ফ্রেন্ড ডা. ইকবালের বোন জামাই। এই ইকবাল ১৯৯৯ সালে মালিবাগ ও কাকরাইল মোড়ে বিএনপির মিছিলে গুলি চালিয়ে ১১ জনকে হত্যা করেছিলেন। সে অগাদ টাকার মালিক। আর এই টাকার উৎস হলো মানুষ পাচার। বাংলাদেশে টাকার বিনিময় মানব পাচার এই শালা-দুলাভাই (হারুন-ইকবাল) মিলেই শুরু করেছিল। যা এখনো আছে বহাল তবিয়তে।
অতএব একজন অসহায় খলিলের শরীর থেঁতলে দিয়ে পা কেটে দেয়া খুব স্বাভাবিক ব্যপার! খলিলকে বাঁচিয়ে রেখেছে সেটাই এখন শেখ হাসিনার আশির্বাদের কাছে খলিলকে কৃতজ্ঞ থাকতে হবে সারাটি জীবন।
খলিলের জনৈক প্রতিবেশী টেলিফোনে বলেন, বিকেল ৩ টায় খলিল ভোট দিতে ঘর থেকে বের হয়। এসময়ে হানিফ নামে একজন আওয়ামী লীগ কর্মী খলিলের পছন্দের প্রার্থী কে তা জানতে চায়। মি. খলিল সরল মনে তার মনোনীত প্রার্থীর কথা বলে দেন। এর কিছু সময়ের মধ্যেই এই নৃশংস ঘটনা ঘটে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের েপনীয় শখার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দক্ষিণাঞ্চলের ৫ জেলায় ২০০৯-২০১৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত গত ৫ বছরে আওয়ামী লীগের বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমর্থক গুম হয়েছেন ৫শ‘ ৮৪ জন। হত্যাকা- ঘটেছে প্রায় তিন হাজার । জেলে বন্দি রয়েছেন ১৭ হাজার ৮শ‘ ৫৬ জন। মামলা রয়েছে প্রায় ২৫ হাজার। ২০০৬ সালের তুলায় খুনের ঘটনা বেড়েছে প্রায় ৩শ‘গুন। স্বাধীনতার পর অর্থাৎ ১৯৭৬- ২০০৮ সাল পর্যন্ত ২১টি গুমের ঘটনার রেকর্ড রয়েছে। তবে ২০০৯-২০১৩ পর্যন্ত গোপন নথিতে রেকর্ডকৃত সংখ্যা ৫শ‘ ৮৪ জন। প্রকৃত সংখ্যা এর অনেক বেশি হবে জানালেন এই কর্মকর্তা।
টেলিফোনে বরিশাল জেলা আইনজীবী সমিতির কয়েকজন প্রবীণ সদস্যের কাছে জানতে চেয়েছিলাম দেশের অবস্থা কেমন চলছে? প্রথমে টেলিফোনে কথা বলতে রাজি হননি কেউ। পরে বিকল্প উপায় জানালেন তারা সবসময়ই আতঙ্কে থাকেন। কেন আতঙ্কে আছেন? এমন প্রশ্নের উত্তরে বললেন- স্বাধীনতা যুদ্ধের ভয়াল দিনগুলোতেও তারা বর্তমান সময়ের মত দুঃসাশন কখনো দেখেননি।
প্রবীণ অ্যাডভোকেট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক-গবেষক মি. আবদুল মতিনের (বর্তমানে জার্মান প্রবাসি) কাছে জানতে চেয়েছিলাম স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পর বাংলাদেশে আজ এমন পরিস্থিতি কেন হলো? তিনি বলেন- ‘অতিতের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ১৯৭৪ সালে শেখ মুজিবের প্রাইভেট মিলিশিয়া রক্ষিবাহিনী দেশজুড়ে হত্যা করেছিল ৮০-৯০ হাজার মানুষ। ‘৯৬ সালে শেখ হাসিনা ক্ষমতা গ্রহণের পর বরিশালে তার ফুফাত ভাই শেখ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ এবং খুলনায় শেখ হেলাল নিজেদের নামে “হাসনাত বাহিনী” ও “হেলাল বাহিনী” নামে পৃথক দু‘টি বাহিনী তৈরি করেছিল। ওই সময়ের ৫ বছরে তারা শুধু দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চে হত্যা করেছিল ২০-২৫ হাজার ভিন্নমতাদর্শের মানুষ। তারা এসবকিছুই করেছিল ক্ষমতা দীর্ঘায়ীত করতে। ক্ষমতার লোভ থেকেই এসব করছে। কিন্তু কোন টার্মেই তারা ক্ষমতা খুব দীর্ঘ করতে পারেনি। এবারে সেই পিছনের মানষিকতা থেকেই আরো কঠোর অবস্থান নিয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ আগের চেয়ে অনেক শক্ত অবস্থানে রয়েছে প্রতিবেশী একটি দেশের শিষ্টার বর্জিত পক্ষপাত সমর্থনের কারণে। এতে বর্তমান সরকারের জনসমর্থন দিন দিন তলানিতে নেমে আসলেও সামনের আরো একটি মেয়াদ তারা পুরো করবে।
তিনি আরো বলেন, এক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল বিএনপিরও দায় রয়েছে। এ দলটির শীর্ষ নেতা এবং বেগম খালেদা জিয়ার নিকটস্থ লোকজন সরকারকে টিকে থাকতে সহায়তা করছে। তারা মীরজাফরের ভূমিকায় রয়েছে। বেগম খালেদা জিয়া বিষয়টি বুঝতে পারছেন না বলে আমি মনে করি।
আর বিরোধী ও ভিন্নমতের লোকজনের উপর সরকারের স্টিম রোলার তো রয়েছেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূলত বিএনপির তৃণমূল নেতা-কর্মী ও সাধারণ সমর্থকদেরকে সরকার কঠোরভাবে দমন করছে। কারণ বিএনপির শীর্ষ নেতারা মাঠে নেই। এতে সরকারের নীতি নির্ধারকরা মনে করছেন তৃতীয় স্তর থেকে অর্থাৎ তৃণমূল থেকে আন্দোলন গড়ে উঠতে পারে। তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। এমন চিন্তা থেকেই সরকার ভিন্নমত ও বিরোধী তৃণমূলের ওপর কঠোর দৃষ্টি রাখছে। ফলে সাধারণ সমর্থকরাই সবচেয়ে ঝুঁতিতে রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের ‘৯৬-এর মেয়াদে ১৩ জন নিজ দলীয় বিদ্রোহী সংসদ সদস্য প্রার্থী সহ ১০৩ জন নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও ২০৯ জন ইউনিয়ন পরিষদ মেম্বারকে হত্যা করা হয়েছিল।
খুলনার প্রবীণ সাংবাদিক হেফজুর রহমানের প্রকাশিত নিবন্ধে দেখা যায়- খুলনার এসএম রব, বাগের হাটের অ্যাডভোকেট কালিদাস বড়াল, রুপসার রাসেল, ফুলতলার হারুন, নোয়াপাড়ার বাচ্চু, পিরোজপুরের লিয়াকত, বরিশালের আইয়ুব সিকদার সহ ২৭ জনকে খুন করা হয়েছিল হেলাল-হাসনাতের প্রকাশ্যে নেতৃত্বে।
তবে ১৯৯৬-এর সংসদে সরকারের চীফ হুইপ মোস্তফা রশিদী সুজা ও তার ভাইদের ‘সুজা-দারা-দোজা বাহিনী’, তালুকদার আবদুল খালেকের ‘তালুকদার বাহিনী’, বর্তমান খুলনার মেয়র ‘মিজান বহিনী’, বাগের হাটের সমাজ কল্যাণ প্রতিমন্ত্রী মোজাম্মেল হকের মোজা বহিনী, পিরোজপুরের মেজর জিয়ার ‘জিয়া গ্রুপ’, সিরিয়াল কিলার এরশাদ সিকদার সহ শতাধিক বাহিনীর প্রায় তিন লাখ সদস্যকে আত্মসমর্পন করার নামে ২০০০ সালে একটি নাটক মঞ্চায়ান করা হয়। এসময়ে সন্ত্রাসীদের পক্ষে প্রায় দুই লাখ অস্ত্র ও গোলা বারুদ জমা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরে যশোরের প্রখ্যাত সাংবাদিক শামসুর রহমান ক্যাবল ধারাবহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। ত্রিশ পর্বের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের ১৫ পর্ব প্রকাশের পরই তাকে খুন করা হয়।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক একজন মেজর জেনারেল মনে করেন, ক্ষমতায় প্রতিদ্বন্দি র্নিমূল করার থিউরি আওয়ামী লীগ উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। সেইসূত্রেই ২০০৯ সালের পর থেকে তারা এখন বিরোধী দলের সমর্থক, ভোটার নির্মূল যজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়: বিবিধ
১২৪২ বার পঠিত, ২ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন