আত্মদান
লিখেছেন লিখেছেন অনল দুহিতা ০২ মার্চ, ২০১৪, ০৪:২৪:৩৩ বিকাল
-যয়নাব, এদিকে একটু আয় তো, তাড়াতাড়ি!
যয়নাব উপন্যাসের বইটা হাতে ঠোঁট উলটে করুণ ভঙ্গিতে তাকায়। গল্পের এমন একটা থ্রিলিং অংশে আছে যে এই মুহূর্তে উঠতে জান বেরিয়ে যাচ্ছে তার। কেন যে সব সময় এমন অসময়ে ডাক পড়ে...! উফ্!!
যয়নাব কচ্ছপ গতিতে রান্নাঘরে এগিয়ে আসে। মিনমিন করে বলে, কি?
-কি আবার, আমার সাথে একটু হাত লাগা তো, তাড়াতাড়ি খাবারগুলো পাঠাতে হবে হাসপাতালে। দেরী হয়ে গেছে এমনিতেই।
যয়নাব নিরাসক্ত ভঙ্গিতে এগিয়ে যায়। টিফিন ক্যারিয়ারের বাটিগুলো ভরে রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করল, কার জন্যে?
জবাব দেয়ার আগেই হুড়মুড় করে ঘরে প্রবেশ করল জাবির। আম্মু! তাত্তাড়ি!!
-হ্যা, হ্যা! হয়ে গেছে এইতো।
যয়নাব আবার জিজ্ঞেস করল, বলোনা, কার জন্য?
জাবির বিমর্ষ ভঙ্গিতে জবাব দিল, আমাদের মুয়াজ ভাইয়ের জন্য...।
-কি হয়েছে?? কৌতুহলে জিজ্ঞেস করে যয়নাব।
জাবির মুখ কাল করে বলল,
-গতকালকের মিছিলে রাবার বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল ওনার ডান চোখে। চোখের কর্ণিয়া গলে গেছে। ডাক্তার বলেছে ওই চোখ আর ভাল হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
-ইশ! আল্লাহ্ মাফ করে দিন তাঁকে...। যয়নাব অস্ফুটে বলে উঠল।
আর কতদিন যে, এমন খবর আসবে, আর কতদিন যে এমন মানুষগুলোর জন্য ক্যারিয়ার ভরে খাবার পাঠাতে হবে... আল্লাহ্র পরীক্ষা যেন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন...
জাবির দ্রুত পায়ে বেরিয়ে যায়। জয়নাব জানালা দিয়ে দেখে, জাবির সাইকেলে উঠে দ্রুত প্যাডেল চালিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। যয়নাব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এই মানুষগুলোর কি হবে, যাদের এভাবে পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে? যাদের হাত-পা ভেঙ্গে চিরকালের জন্য অক্ষম করে দেওয়া হচ্ছে? হয়ত এদেরও অনেক কিছু দেওয়ার ছিল পৃথিবীকে। হয়ত মিষ্টি কিছু স্বপ্ন ছিল যেমনটা সবাই দেখে...। কেমন যেন এক অদ্ভুত শূণ্যতা বুকের বা’পাশটা খামচে ধরল যয়নাবের।
জাবির সন্ধ্যা থেকেই ভীষণ উশখুশ করছে। যয়নাব সেটা অনেক আগেই লক্ষ্য করলেও কিছু বলল না। অবশেষে জাবির নিজেই এগিয়ে আসল।
-ও আপু, কি করো??
-দেখিস না, কি করি? কি বলবি বল।
জাবির ইতস্তত করতে থাকে। খানিকবাদে চিন্তিত কন্ঠে বলে,
-আপু জানো, মুয়াজ ভাইয়ের ফ্যামিলির কেউ না ওনাকে দেখতে আসতে পারেনি। অনেক দূরে থাকে তো। আবার পুলিশের পাহারা, আরো নানা ঝামেলা...। কিন্তু এভাবে একা একা কয়দিন থাকবে উনি? এমনিতেই চোখের ব্যাপার, যত্নের দরকার। তার মধ্যে আমরা ঠিকমত দেখাশোনাও করতে পারছিনা। কিযে ঝামেলা...।
যয়নাব কিছু বলল না। জানে, জাবির তার ভাইদেরকে একটু বেশিই ভালবাসে। অবশ্য মানুষগুলো ভালবাসার মতই...।
জাবির একটু থেমে আবার বলল,
-আপু, আসলে... আমি ভাবছিলাম, মানে ওনাকে যদি আমাদের বাসায় রাখা যেতো কয়দিনের জন্য...। কি বলো??
জয়নাব চোখ তুলে তাকায়।
-দ্যাখ, এ রকম কিছু করার আগে অনেকবার ভাবতে হয়। আমাদের বাসাও যে খুব নিরাপদ তাতো না! আর এসব নিয়ে আমার সাথে কথা বলে কি লাভ, আব্বুর সাথে কথা বল! আম্মুকে বলছিস?
জাবির একটু এগিয়ে এসে বলে,
-আম্মুকে বলছি। তুমি হইলা আব্বুর আদরের কন্যা, সেজন্যেই তো তোমাকে বললাম। তুমি একটু বলোনা...! আমার খুব খারাপ লাগে ভাইয়ার জন্যে... আমাকে অনেক আদর করেন উনি। আচ্ছা, তুমি তো চিনবা মনে হয়, ওইযে, একবার আমাদের বাসায় একটা প্রোগ্রামের শেষে যে গান গাইল, ওইযে ওই হামদটা! উনি, উনি।
যয়নাবের মনে পড়ল। কয়েকমাস আগে এক সন্ধ্যায় কিসের যেন একটা প্রোগ্রাম ছিল ওদের। শেষে হঠাৎ একটা গান শুনে রুম থেকে বেরিয়ে আড়াল থেকে শুনছিল যয়নাব। অসাধারণ গায়কী। মুগ্ধ হবার মত। সবাই চলে যাবার পর কে গান গেয়েছে কৌতুহলে জিজ্ঞেস করেছিল জাবিরকে। জাবির হেসে জবাব দিয়েছিল, আমাদের দি গ্রেইট মুয়াজ ভাই! যয়নাব ঠোঁট উচিয়ে বলেছিল, ভালই গায়। জাবির চোখ উলটে বলেছিল, “ভালই গায় মানে! এর চেয়ে সুন্দর করে আর কাউকে গাইতে শুনেছো তুমি? হুহ!” জবাবে যয়নাব ভ্রু কুচকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গি করেছিল।
-হু মনে আছে।
-বলবা আব্বুকে? বলোনা... জাবিরের কন্ঠে অনুনয় ঝরে পড়ল।
-আচ্ছা, আব্বু বাসায় আসুক আগে। তুই বলিস, আমি সায় দিবো।
জাবির উঠে দাঁড়িয়ে স্যালুট দেয়ার ভঙ্গি করে বলে, ওকে কমরেড! দেখা হবে ময়দানে।
-ধুর, যাতো! পড়তে যা এখন। যয়নাব কন্ঠে বিরক্তি এনে বলে। তারপর মুচকি হেসে ফেলে আনমনেই।
অনুমতি মিলে গেল সহজেই। মুয়াজের নিষেধ সত্তেও জাবিরের পিড়াপিড়িতে সবাই মিলে রাজি করিয়ে ফেলল ক’দিনের জন্য। আর জাবিরের রুম হয়ে গেল ছোটখাট হাসপাতাল ও ভিজিটিং রুম।
চোখের আঘাতটা গুরুতর ছিল। অথচ তার জন্যে মুয়াজ নামের ছেলেটাকে এতটুকু বিচলিত হতে দেখা গেলনা। বরং কেউ মন খারাপ করে ফেললেই একগাল হেসে বলে, আরে গাল ফুলিয়ে আছেন কেন আপনারা? ছোটদের মধ্যে একজন বলল, আপনার বুঝি একটুও খারাপ লাগেনা!! মুয়াজ মুচকি হেসে বলে, তাতো একটু লাগেই। বিয়ে-শাদী আটকে যায় নাকি সেটা ভেবে একটু খারাপ লাগে আরকি! বলেই নিজেই হেসে উঠল একটু জোরে। অন্যরাও বিষন্ন চেহারায় হেসে ফেলল। জাবির কথায় কথায় সেসব বলতেই যয়নাব আশ্চর্য হয়ে গেল। আজব পাগলামি এদের। সবকিছু নিয়ে ঠাট্টা করে নাকি মানুষ!? যয়নাব আনমনেই মাথা নাড়ে।
বিচ্ছিরি এক দুঃস্বপ্নে মাঝ রাতে ঘুম ভাঙ্গে যয়নাবের। চোখ-মুখ কুচকে ঝিম মেরে বসে থাকে কিছুক্ষণ। ইদানিং কেন যেন খুবই অস্থির লাগছে...। পানির তেষ্টা পেতেই ধির পায়ে রুম থেকে বের হল যয়নাব। গুনগুন শব্দে থমকে দাড়াল খানিকক্ষণের জন্য। শব্দের উৎসে কান পাতলো ভালভাবে।
“তোমার রঙে যারা রঙ্গিন,
তোমারই ডাকে হয় সঙ্গিন...
যারা সকল শক্তি দিয়ে তাড়িয়ে থাকে,
মিথ্যার করে অবসান...।
সেই সংগ্রামী মানুষের সারিতে...,
আমাকেও রাখিও রহমান...
যারা কোরআনের আহ্বানে নির্ভিক,
নির্ভয়ে সব করে দান...”
খুবই ক্ষীণ আওয়াজে শোনা যাচ্ছে লাইন ক’টা। কিন্তু মধ্য রাতের নিরবতা খানখান হয়ে যাচ্ছে সুরের মাধুর্যতায়। যয়নাব দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল ডাইনিং-এর মেঝেতে। ত্যাগ, দান, কুরবানী কথাগুলো অনবরত ঘুরপাক খাচ্ছে মাথার ভেতর। আলতো হাতে নিজের সিক্ত দুচোখ চেপে ধরল যয়নাব।
রেজা সাহেব ও মিসেস রেজা চুপচাপ বসে আছেন। যয়নাবের দীর্ঘ বক্তব্যের পর ঘরে পিনপতন নিরবতা। জাবির স্তম্ভিত হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। হ্যা আর না-এর সিদ্ধান্ত যে এত কঠিন, আজকের আগে ভাবতেই পারেনি সে! আপুর শেষ কথাগুলো কানে প্রতিধ্বনিত হয়েই চলেছে ক্রমাগত। “আমি আজীবন তাঁর সঙ্গে একত্রে যুদ্ধ করতে চাই। যদি তোমরা সে অনুমতি দাও।”
এতবড় ত্যাগ! অথচ অনেক ভাল ভাল প্রস্তাব আপু নানা অযুহাতে ফিরিয়ে দিয়েছে। এমন একজন মানুষকে জীবনসঙ্গী করার কথা সাধারণ কেউ ভাবতে পারে??
রেজা সাহেব নিঃশব্দে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের মেয়েটাকে কখনোই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারেননি তিনি। ঈমানের পরীক্ষায় মেয়েটা বুঝি আজ তাকে হারিয়েই দিল!
মুয়াজ চুপ করে রইল। সে স্বপ্নেও ভাবতে পারছেনা রেজা সাহেব নিজে তাকে তাঁর একমাত্র মেয়ের ব্যাপারে প্রস্তাব করেছেন, এবং সেই মেয়েটা এই মুহুর্তে তার সামনে বসে আছে! দীর্ঘ নিরবতার পর মুয়াজ শীতল কন্ঠে বলল,
-কারো করুণা আমার চাইনা।
যয়নাব ধীর কন্ঠে বলল,
-বরং সেটা হবে আমার উপর আপনার অনুগ্রহ। এখানে আপনার ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা না থাকলে আপনার রাজী না হওয়াটাকে আমি নিজের অযোগ্যতা হিসেবেই নিচ্ছি।
মুয়াজ মাথা নিচু করে রইল। একদম নিচু। এইরকম একটা মেয়েকে সে নিজের দূর্বল আবেগের স্ফুরণ দেখাতে চায়না। একেবারেই না।
(গল্পটা লেখার ছোট্ট একটা পটভূমি আছে। আর কিছু ঘটনা তো বটেই! সেদিকে যাচ্ছিনা।
বিয়ে নিয়ে পনের-ষোল বছর থেকে মানুষের সহজাত কিছু ফ্যান্টাসি থাকে। বিশেষত যারা কোন হারাম সম্পর্কের কথা ভাবেন না। ফেইসবুক ভার্চুয়াল একটা জায়গা। তবু বাস্তব জীবনের গল্পগুলোই এখানে উঠে আসে। এখানে আমরা যে মানুষগুলো সহচর্যে থাকি, তারা একই সাথে আধুনিক সহীহ ইসলামী পদ্ধতিতে নিজের জীবনের স্তরগুলোকে সাজানোর স্বপ্ন দেখেন।
কিন্তু কোথাও যেন আমরা ভুলে যাই এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা সমস্ত যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও আট-দশটা সাধারণ মানুষের মত স্বপ্ন দেখতে পারেন না জীবনটাকে নিয়ে। এটা তাঁদের ব্যার্থতা নয়, আমাদের ব্যর্থতা যে, আমরা তাদের কথা ভাবতে পারিনা। ছেলেরা ভাবতে পারেনা স্বামী হারানো কোনো দ্বীনদার মেয়ের সঙ্গী হবার কথা, আর মেয়েরা ভাবতে পারেনা, আল্লাহর পথে এমন কুরবাণী হয়ে যাবার আকাংখায় কন্টাকীর্ণ পথে চলতে গিয়ে গাজী হওয়া কোন মানুষের দুনিয়ার হুর হয়ে থাকবার কথা।
আমাদের স্বপ্নগুলো দিনকে দিন কেবল আরো বেশি করে রঙ্গিন হয়ে ওঠে। আমরা কেবল একজন নিখুত মানুষের মাঝেই খুঁজে থাকি দুনিয়ার জান্নাত তৈরীর যোগ্যতা। জেল-জুলুম আর নানা প্রতিকূলতায় নিঃস্ব মানুষয়গুলোর কথা বেমালুম ভুলে যাই আমরা।)
বিষয়: সাহিত্য
১৪৬৪ বার পঠিত, ১৯ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
এমন সুন্দর একটা গল্পের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ অগ্নি-কণ্যাকে। আশাকরি আরো লিখবেন।
আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ সুন্দর মন্তব্য আর অনুপ্রেরণার জন্য।
এখানে পোস্ট কর্বেন প্লিজ!
তবে এমন মানসিকতাই তো প্রয়োজন। বিয়ে কি শুধু ভাল সময় উপভোগ করার জন্য, দুঃসময় ভাগাভাগি করে নেয়ার জন্য নয়?
আসলেই, বিয়ে মানে একজন উত্তম সঙ্গী!
মন্তব্য করতে লগইন করুন