গুচ্ছ অনুভূতি
লিখেছেন লিখেছেন অনল দুহিতা ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৩, ১১:৪১:৪১ সকাল
আম্মু চতুর্থবারের মত ফোন করলেন। এবারও আমার চোখ ভরে পানি আসলো। যতবারই ফোনটা কেপে কেপে বেজে উঠছে, ততবারই মোবাইলের চতুস্কোণ স্ক্রিনটা ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি ফোন ধরে চতুর্থবারের মত মিষ্টি কন্ঠে বললাম, “আম্মু, আমি ট্রেনে উঠেছি। ট্রেন এখনো ছাড়েনি। কাউকে পাঠিয়োনা প্লিজ! এখানে বেশি বৃষ্টি হচ্ছেনা। আর কয়েক ঘন্টার মধ্যে তো চলেই আসবো।”
আম্মু অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। জানি, আম্মু খুব চাচ্ছেন আমাকে ইচ্ছেমত বকা দিতে। কিন্তু কান্নার দমকে বড় বড় হুমকি সম্বলিত বকাগুলো গলার মাঝে আটকে যাচ্ছে। যত দূরেই থাকিনা কেন, এই বেতার যন্ত্রটার ওপাশটা আমি খুব বুঝতে পারি। যখন ওপাশে থাকে মা। নিঃশ্বাসের শব্দে অবলিলায় বুঝে নিতে পারি তার অনুভূতিগুলো।
-বৃষ্টির পানি গায়ে লাগাস না। হুট করে এখানের আবহাওয়া হয়ত তোর সহ্য হবেনা। পরে ঠান্ডা লেগে যাবে। আর বাইরের আজেবাজে কিছু খাস না। শরীর খারাপ করবে।
-আম্মু, আজকে কিছু মানা করোনা প্লিজ! এইটুকু বৃষ্টিতে কিছু হয়না। আর স্টেশনে ফুচকা দেখে লোভ সামলাতে পারিনি। ফুচকা খাচ্ছি।
-তুই তো কোনদিনই কথা শুনবিনা…
-রাখি আম্মু, কথার জন্য খেতে পারছিনা। ফুচকার ঝোলে হাত ভরে যাচ্ছে।
-আচ্ছাহ।
আমি তাড়াতাড়ি ফোন কেটে দিলাম। কথা বাড়াতে চাইনা। ফুচকার ঝোলে হাত ভরেনি, কিন্তু অনুভূতিতে চোখ ভরে যাচ্ছে। আম্মুকে সেটা বুঝতে দিতে চাইনা…
ফুচকাওয়ালাকে চকচকে ক’টা নোট ধরিয়ে দিলাম। বখশিশ পেয়ে লোকটা ঝকঝকে দাঁতদুপাটি বিকশিত করে ঝলমলে চেহারায় হেড়ে গলায় গান ধরলো। ট্রেন ছেড়ে দিল। ধিরে ধিরে স্টেশনের সংকীর্ণ করিডোর, হাতলভাঙ্গা বেঞ্চি, কুলিদের হাকাহাকি, ব্যস্ত হকারের ছুটোছুটি দূরে মিলিয়ে যেতে লাগল। স্টেশন থেকে ট্রেনের বিশাল দেহটা বের হতেই গা শিরশিরে এক ঝলক বরফ শীতল বাতাস জানালা দিয়ে উকি দিল। সাথে ক’ফোটা বৃষ্টির জল। আমি গাল পেতে দিলাম। মুখ ভরে গেল বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণায়। লোকালয় পেরুতেই সেই পুরোনো মাটির ঘ্রাণ পেলাম। প্রকৃতির স্পর্শ পেলে আমাকে ভাবালুতায় পেয়ে বসে। নিজের অজান্তেই পাড়ি দেয়া পথে উকি দিই। মনে হয়, এইতো সেদিনই তো বর্ষা এলে হাটুসমান জল পেরিয়ে স্কুলে যেতাম। বিচ্ছিরি নোংরা পানিতে দাপাদাপি করে নষ্ট করতাম ইউনিফর্ম। সেদিনই তো কলেজে ভর্তি হলাম। ঘর্মাক্ত একঝাক মানুষের সাথে প্রতিযোগীতা করে বাসে উঠে ক্লান্ত দেহে বাড়ি ফিরতাম। দলবেধে লেকের পাড়ের আড্ডা, কিংবা স্টার কাবাবের কোনার টেবিলটায় কথার ফুলঝুরি... এইতো সেদিনই তো! তারপর হুট করে কি হল আমার...... যে আমি ঢাকা ভার্সিটিতে লিটারেচারে পড়ার জন্য বেহুশ ছিলাম, সে আমি জেদ করলাম বাইরে যাবো ল পড়তে। ভাগ্যই বলতে হবে যে, স্কলারশিপটা জুটেছিল। ফুড়ুৎ করে একদিন উড়ে গেলাম কানাডা। অনুভূতিগুলোকে পাথর চাপা দিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে আবেগের অবাধ্যতায় অতিষ্ট হয়েই পালিয়েছিলাম। সত্যি বলতে কলেজজীবনের রঙ্গিন দিনগুলোয় খুব একটা অনুভব করিনি সমাজের কাছে, সমাজের স্ট্যাটাসের কাছে আমরা কতটা বন্দী। সরলরেখায় চলা জীবনের যেদিন বাক পেরুতে গেলাম, হোচট খেলাম হ্নদয়ের আদিখ্যেতার জায়গাটাতে। জীবনে প্রথম প্রেমে পড়েছিলাম সাহিত্যের। যেখানে মানুষের দিঘির জলের মত টলটলে অনুভূতিগুলো ঢেউ তোলে। যেখানে বাস্তবতাকে চোখ রাঙ্গিয়ে শব্দের শেকলে বাধা যায় হ্নদয়ের অস্থিরতাকে। আমি হ্নদয়ের আবেদন উপেক্ষা করতে পারিনি। কাগজ-কলমের সাথে নিজের মনটাকে বেধে ফেলার একটা উচ্ছসিত আকাংখায় পরিবারের শত আপত্তি উপেক্ষা করে বিজ্ঞান বিভাগে না গিয়ে বেছে নিয়েছিলাম মানবিক বিভাগ। গণিত আর বিজ্ঞানের মত খটমটে বিষয়ের সাথে কোনদিনই সখ্য ছিলনা আমার। কখনোই মানিয়ে নিতে পারিনি..... ভেবেছিলাম জীবনটা এভাবে কেটে গেলে মন্দ না। কিন্তু ছন্দগুলোর ছন্দপতন হল সেদিন, যেদিন ওই বিজ্ঞানই আমাকে বিদ্রুপ করে বসল! অবহেলায় যেটার দিকে ফিরে চাইতাম না...
আমার চোখ পড়েছিল এক অদ্ভুতুড়ে মানুষের উপর। যে আমার ঠিক উলটো! সাহিত্যের মৌন মাদকতা তার বুঝে আসেনা। তার সখ্য জটিল সব ইকোয়্যেশনের সাথে। ভাললাগা কিবোর্ডের বোতামগুলোর জন্য। তুখোড় মানুষটা নামি ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্নে বিভোর...
আমি অতশত বুঝিনি। অনুভূতিতে অত জটিলতা থাকেনা। অনুভূতি পানির মত তরল, কাঁচের মত স্বচ্ছ, আর টুনটুনির হ্নদস্পন্দনের মত অস্থির... এইতো! কিন্তু একটা ফাঁক ছিল। একটা শুণ্যস্থান ছিল। আর কোথাও না, বিজ্ঞান আর মানবিক বিভাগের মাঝে সমাজের তৈরী একটা ফাঁকাঘর ছিল। আমি বুঝিনি... সামাজিক স্ট্যাটাসের কাছে আমার অনুভূতিরা বড্ড গৌন। ওদিকে ফিরে চাইবার সময় আর সুযোগ কোনটাই ছিলনা তার। তাই অবশেষে আত্ম অভিমান আর ইগোর নাগপাশে জড়িয়ে ভুলে গেলাম শব্দের সাথে কিভাবে খেলতে হয়, প্রকৃতির সাথে কিভাবে চোখে চোখে কথা বলে... শুধু ‘স্ট্যাটাস’ নামের একটা শব্দের কাছে ছোট না হতে ছুটে গেলাম কানাডা। আমার আত্মসম্মানবোধ বাধা দিয়েয়েছিল হ্নদয় পেতে কিছু চাইতে। থাকুক না, যে যেমন থাকতে চায়...!
গোমড়ামুখি আকাশ হঠাৎ করে চেচিয়ে উঠল। আমি চমকে তাকালাম। বজ্রপাতের আলো মুহূর্তের জন্য জানালার শিক গলে ছুয়ে গেল। ফোনটাও বেজে উঠল আবার।
-আসসালামু আলাইকুম!
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। হ্যালো, চারু?
-জ্বি, চারুলতা বলছি!
-ফাযিল! তুই আসবি বললিনা ক্যান?
-কে ঝিনুক?
-এছাড়া আর কে? কই এখন?
-কোথায় আছি তাতো জানিনা, তবে আর বেশিক্ষণ লাগবেনা। তুই আমাদের বাসায় আসছিস, না?
-জ্বি মহারানী, অনেক আগেই আসছি। রাগ করে ফোন দিইনি। তুই আজিব! ট্রেনে উঠলি কোন সুখে? কত্ত ঘুরা পথ!
-দুই বছর পর আসলাম দেশে। তাই ভাবলাম সবকিছুতেই একটু চড়ে স্বৃতিচারণ করি...
-হু..., আর আমরা অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে বুড়ো হয়ে গেলাম!
-হি হি হি...। অপেক্ষা খারাপ না, অপেক্ষায় অনুভূতিরা লুকিয়ে থাকে। যত অপেক্ষা করবি, তত বেশি অনুভূতি চুপি চুপি জড়ো হবে।
-তোর মত উড়নচন্ডির জন্য এত অনুভূতি জমা হওয়া ঠিক না। তুই হঠাৎ হঠাৎ ডুব মারিস।
-আচ্ছা, আচ্ছা...। তাও ঠিক! রাখি, সব কথা এখন বলে ফেললে হবে? বাসায় এসে নিই!
-আচ্ছা, আল্লাহ হাফেয।
আমি ফোন রেখে হাসলাম। সত্যিই! সবার জন্য অনুভূতি জমা হওয়া একদম ঠিক না!
বিষয়: সাহিত্য
১৮১৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন