ফেরারী সময়
লিখেছেন লিখেছেন অনল দুহিতা ২৯ জুলাই, ২০১৩, ০৯:০৯:৫১ রাত
জানালার পাশেই রাখা টেবিলটার উপর বসে জানালায় মাথা রেখে শিউলী গাছটার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ষা। সেই শিউলী গাছ, রোজ যে গাছের ফুল নিতে হুড়োহুড়ি পরে যেত পাড়ার মেয়েগুলোর মাঝে। যে গাছের ফুল দিয়ে মালা গেথে সে মালা দিয়ে সাজানো হতো পুতুলের বাসর ঘর। আজ অনেককিছুই নেই। শিউলী গাছের ডালগুলোও নুয়ে পড়েছে বয়সের ভারে। যে পুতুলের বিয়ে হয়েছিল মহা ধুমধামে, তারাও হয়ত পড়ে আছে অবহেলায় ঘরের পরিত্যাক্ত জিনিসগুলোর সাথে। প্রাণ নেই, তাই হয়ত বিচ্ছেদের যাতনাও নেই......।
রাতে বৃষ্টি হয়েছে। ছোটবেলায় যখন আম্মা বৃষ্টিতে ভিজতে দিতেন না, তখন এই পড়ার টেবিলটায় মাথা রেখে গাল ফুলিয়ে বৃষ্টি দেখত বর্ষা। জন্মটা কোন এক বর্ষায়। তাই নাম বর্ষা। আর তাই হয়ত আষাঢ়-শ্রাবণের ঝুম বৃষ্টিতে মোহগ্রস্থ হয় বর্ষা। ছোটবেলায় কতবার বায়না ধরেছে বৃষ্টিতে ভেজার! আম্মা রাজি হননি। আব্বা যে বড্ড রাগী! পরে একদিন বৃষ্টিস্নাত সকালে শিউলী গাছের তলায় ফুল কুড়াতে গিয়ে বর্ষা আবিষ্কার করল, বৃষ্টির পর গাছের ডাল ধরে আলতো করে ঝাকি দিলে পাতায় পাতায় জমে থাকা জলকণারা ঠিক বৃষ্টির মত করেই ঝরে পড়ে! এরপর কতবার ওই মিছেমিছি বৃষ্টিতে ভিজে সত্যিকার বৃষ্টির স্পর্শ বুঝতে চেয়েছে......!
তারপর অজান্তেই একটু একটু করে বড় হওয়া। ছোট্ট ফ্রক ছেড়ে লম্বা হাতার জামা আর মেঘলা মায়াময় অবাধ্য চুলের গোছাকে আড়াল করা বড়সড় ওড়নায়। কিছু রঙ্গিন মুহুর্ত......
হুট করে ছন্দপতন হল। বড় ভাইয়া ঢাকায় চাকুরী পেলেন। এসএসসিতে ভাল রেজাল্টের পর তিনি একপ্রকার জোর করেই সবাইকে রাজি করালেন বর্ষাকে ঢাকায় পড়ানোর ব্যাপারে। অজপাড়াগায়ের কলেজে আর কি পড়ালেখা হবে? পড়বে যখন পড়ার মত পড়ুক!
শিক্ষানুরাগী পরিবারের সম্মতি মিলে গেল। আর বর্ষাও ছোট্ট বিড়ালছানা, পাড়ার পুরোনো সই, অজস্র স্বৃতি, কিছু ঠুনকো আবেগ আর অসংখ্য ছোট গল্প অসমাপ্ত রেখে পাড়ি জমালো ঢাকায়। চোখার জলে ঝাপসা হয়ে এল পেছনের সব......
তারপর অনেকটা দিন, কয়েকতা বছর.........। ভাইয়া বিয়ে করলেন। জোর করে ঢাকা নিয়ে গেলেন আব্বা-আম্মাকেও। বেশিদিন না, এর ক’মাস পরেই রাগী বাবাটা একদম শান্ত হয়ে গেল। কবর দেয়া হল গ্রামে। সেই শিউলী গাছটার অদূরেই। মা আর ফিরতে চাইলেন না কিছুতেই। বাস্তবতার তাকিদে ফিরে গেল বর্ষারা। সামনে যে পরীক্ষা! তারপর আর সময় হয়ে উঠল না। ছুটিতে সহপাঠিরা বাড়ি গেলে বর্ষা একলা ঘরে মুখ লুকিয়ে কাঁদত। বড় হওয়া কি খুব জরুরী? কি হবে এত পড়ালেখা করে? এত্ত বড় হয়ে! মূর্খই না হয় থাকতাম। আগের মত করে দিঘির পাড়ের নয়ানো গাছটার ডালে বসে কাটিয়ে দিতাম মন খারাপের একেকটি প্রহর! কঠিন বাস্তবতার কাছে যুক্তির বাইরে কিছু টেকে না। টেকে না বর্ষার অবুঝ ছেলেমানুষিও। লেখাপড়ার কঠিন শেকলে আবদ্ধ হতেই হয়।
এরপর কাল চার বছর পর পা রাখল সেই পুরোনো উঠোনে।কাদায় মাখামাখি হয়ে আছে ক’টা শিউলী ফুল। সেই মিষ্টি বুনো ঘ্রাণ, সেই মাটির সোদা গন্ধ......। বর্ষা প্রাণ ভরে নিঃশাস নেয়। হাজার হাজার স্বৃতির যন্ত্রনায় ঘুম হয়নি কাল সারারাত। তাই ফযর পড়ে সেই তখন থেকেই উদাস চোখে বসে আছে বর্ষা। হঠাৎ খানকটা চমকে উঠল সে। শিউলী গাছের আড়ালে কি কেউ আছে! সদর্পণে পা ফেলে বেরিয়ে এসে দেখল, চার-পাঁচ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে একটা ঝুড়ি হাতে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে চেয়ে। এই সাত-সকালে টুকটুকে লাল জামা পরা আর মাথায় ছোট্ট করে হজুটি করা একটা বাচ্চাকে দেখে অবাক হল বর্ষা।
-নাম কি তোমার?
-মৌ। মেয়েটার ছোট্ট জবাব।
-ফুল নেবে? হাতের ঝুড়িটা দেখে আন্দাজ করল বর্ষা।
-হু।
মিষ্টি করে হাসল বর্ষা। তারপর বলল, চলো একসাথে কুড়াই!
বাচ্চাটা একটু মেঘলা মুখে বলল,
-আমার অনেক ফুল লাগবে।
বর্ষা খিলখিল করে হেসে বলল,
-হ্যা বাবা, সব ফুল তোমার। সঅঅব।
-সত্যি!
-হ্যা বাবা সত্যি। বাচ্চাটা উচ্ছসিত হয়ে বর্ষার সাথে ফুল কুড়াতে কুড়াতে রাজ্যের গল্প জুড়ে দিল।
হঠাৎ কেউ দূর থেকে টেনে টেনে ডাক দিল। মঅঅউউউ!
বাচ্চাটার সাথে চমকে ফিরে তাকাল বর্ষাও। দূর থেকে কে যেন আসছে। হাটার ভঙ্গিটা খুব চেনা। ছন্দময় আর স্থির। বর্ষা উঠে দাড়ায়। স্বভাবসুলভ বড় ওড়নায় ঢেকে নেয় চুলগুলো।
ধিরে ধিরে কাছে আসতেই যেন একলাফে পেছনে চলে গেল সময়। সেই পুরোনো চুলের ছাট। পুরোনো চশমার ফ্রেম। একই রকম ঢোলা শার্ট। অকারনে ঠোঁট কামড়াবার অভ্যেস......... আবীর ভাই!
আবীর চমকে ওঠে। অতি পরিচিত কন্ঠস্বর চিনতে ভুল হয়না। এক পলক দেখে চোখ ফিরিয়ে নেয়।
-কে? বর্ষা নাকি?
-জ্বি...
-চাচ্চু দাড়াও, আমি সব ফুল নিয়ে আসি।
-আচ্ছা।
-ও! মৌ বুঝি জাবীর ভাইয়ের মেয়ে? বর্ষা অবাক হয়।
-হু।
-ও তো অনেক বড় হয়ে গেছে!
-না, ঠিকমতই বড় বড় হয়েছে। আপনি অনেকদিন আসেন না তো, তাই এমন মনে হচ্ছে।
আপনি-তুমির দ্বিধায় হাবুডুবু খেয়ে আপনি করেই বলে আবীর।
বর্ষা অবাক হয়।
-আপনি করে বলছেন কেন?! আপনার মনে আছে, কতদিন মার দিয়েছেন আমাকে! কতদিন আমাদের হাড়ি-পাতিল খেলা দলবেধে এসে ভেঙ্গে দিয়েছেন! রেগে গেলে চুল ধরে টেনে দিতেন, আর আমি খালাম্মার কাছে বিচার দিতাম। আর প্রতিবার কেদে কেদে বিচার দেয়ার পর খালাম্মা আমাকে তিনটা করে তিলের নাড়ু দিতেন!
আবীর মুচকি হাসে।
-আপনি আমাকে তুই করে বলতেন।
আবীর কথা খুজে পায়না। চার বছর অনেক সময়। যার সাথে সবচেয়ে বেশি ঝগড়া ছিল, আর সবচেয়ে বেশি ভাব, তার প্রতি বিশেষ আবেগ জন্মানো মাত্রই সে চোখের আড়াল হয়। এ বাড়িতে প্রায়ই আসা হয়। হয়ত পুরোনো স্বৃতির খোজে, হয়ত অবচেতন মনের তাড়নায়.........
-আবীর ভাই বসুন, চা করে দিই?
-না বর্ষা, আজ না। হাটবারের দিন, অনেক কাজ জমে আছে। আবীর ব্যাস্ততা দেখিয়ে বলে।
মৌ, চলো দেরী হয়ে যাচ্ছে তো!
-বর্ষা, আসি......
মৌয়ের ছোট্ট হাতটা হাতে ধরে আবীর দ্রুত পা চালায়। অনেকটা পথ এসে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায়।
একটা কথা জিজ্ঞেস করা হয়নি। মেয়েটা ভাল আছে তো!
বিষয়: বিবিধ
৩৯৮০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন