অণুরিত অনুভবে
লিখেছেন লিখেছেন অনল দুহিতা ২৭ জুলাই, ২০১৩, ০৭:২৫:৩৮ সন্ধ্যা
সামনে দিস্তা খানেক কাগজ ছড়িয়ে ভ্রু কুচকে বসে আছে নিরা। মাথায় আট-দশটা গল্পের প্লট ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু একটাকেও মাথা থেকে কলমের মাথায় নামিয়ে আনা যাচ্ছেনা। হতচ্ছারারা নেমে আয়! নিরা নাক-মুখ কুচকে বিড়বিড় করে বলল।
কিন্তু হতচ্ছারারা নেমে এল না। নিরা হতাশ হয়ে সেলফোনটা হাতে নিল। নিয়েই আঁতকে উঠল। খাইছে! রুপার পাঁচটা মিসডকল! দেখতে দেখতেই আবার কল দিল রুপা।
-আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু ওয়া মাগফিরাতুহু ওয়া জান্নাতুহু ওয়া নাজাতুহু।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়াবারাকাতুহু ওয়া মাগফিরাতুহু ওয়া জান্নাতুহু ওয়া নাজাতুহু। ওই ফাযিল! কই তুই? এতবার ফোন দিই ধরিস না ক্যান? মনে করছিস সালাম দিয়ে ভুলায়া ফেলবি!
-ছিঃ ছিঃ! তা হবে কেন? আমি সাদা মনের মানুষ, সবার জন্যে দোয়া করি। তুই এত কষ্ট করে ফোন দিছিস, তাই বড় করে সালাম দিলাম। হিঃ হিঃ, থিংক পজেটিভ।
-কই তুই?
-আছি, আমার খোয়াড়ের মধ্যেই আছি। কেন?
-আমাদের বাসায় আয় তো!
-ক্যান, কি খাওয়াবি? হিঃ হিঃ
-ওই, সারাদিন এই খোচা দেস কেন? সামনে দিলে তো আর খাইতে দেখি না।
-তাহলে কি জন্য?
-আরে এত কি জন্য কি জন্য করতেছিস কেন? আচ্ছা, আজকে বুয়া আসেনাই, সেজন্যে ঘর মুছতে ডাকতেছি। হইছে এইবার?
-ছিঃ! নিরিহ একটা মানুষ পেয়ে যা তা বলছিস? আল্লাহ কিন্তু মজলুমের পক্ষে। জালিম হইসনা বুঝছিস?
-দশ মিনিটের মধ্যে আয়। মোবাইলে ব্যালেন্স নাই। ফোন রাখ!
-আল্লারে কি কিপটা! আচ্ছা আল্লাহ হাফেয।
হাসতে হাসতে নিরা খাতাপত্র গুছিয়ে রাখল। মাথায় একগাদা টেনশন। এ সপ্তাহের মধ্যে ৩টা গল্প দিতেই হবে। এদিকে হাতে সময় আছে চারদিন। কিন্তু রুপাকে সেটা বলে লাভ নেই। মেয়েটা আজীবনই নাছোড়বান্দা। ব্যাগে কিছু কাগজপত্র নিয়ে বের হয়ে বিশ মিনিটের মাথায় রুপার বাসার বেল বাজাল নিরা।
-আসসালামু আলাইকুম। আয়।
-ওয়ালাইকুম আসসালাম। বান্দা হাজির জাহাপনা। কাহিনী কি?
-বিরাট কাহিনী। ভিতরে আয়।
-কি, কি???
নিরা চোখ বড় বড় করে বলল।
-নে, তোর ফালুদা, খা। আর খেতে খেতে এটা দ্যাখ। দেখে আমারে বাঁচা।
-কি এটা? তুই তো জিন্দাই আছিস দেখা যায়।
আরি! এটা তো দেখি জৈনেক ডা. নাবিলের বায়োডাটা!! এই আল্লাহর বান্দা কে?
-জানিনা। আম্মা কালকে টেবিলে রেখে গেল।
-বাহ! ভাল তো! এর মধ্যে তো মরার মত কিছু দেখি না।
-আমার ডাক্তার ছেলে পছন্দ না।
মুখ গোমড়া করে বলল রুপা।
-আয় হায়! কয় কি? কেন??
-ধুর! ডাক্তারি পাশ করা ভাবলেই মনে হয় পাওয়ারি চশমা পরা, চেহারা বাংলা পাঁচের মত, রস-কষহীন সিরিয়াস টাইপের কেউ। রান্নাঘরে পা দিয়েই বলবে, “এটা এত ময়লা কেন? জান! প্রতি মুহুর্তে এতে কত জীবাণু উৎপন্ন হচ্ছে?!” আমি ভাজাপোড়া খাবো, আর উনি বলবেন, “এসব অয়েলি জিনিস খাচ্ছো কেন? এজন্যেই তো এ্যাসিডিটির প্রবলেম!”
“সকালে দেরি করে খাও কেন?” “লাইট অফ করে টিভি দেখছো কেন?...
-আরে থাম থাম! সারারাত বুঝি এই সব চিন্তা করছিস? পাগল একটা! না জেনেই এত মন্তব্য করিসনা। আচ্ছা, ছেলেটা কে?
-আরে জানিনা রে! আম্মু রাতে ঘুমানোর আগে দিয়ে গেছে। আর সকালে রাশেদের সাথে ওর স্কুলে গেছে বেতন দিতে।
-আচ্ছা, মেইন প্রবলেম কি?
-বললামই তো। আর, তাছাড়া ডাক্তাররা ফ্যামিলিতে এনাফ টাইম দিতে পারেনা।
-আর?
-আর সারাদিনই তো বই আর মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকবে। এই পেশেন্ট ফোন দিবে, ওই ডাক্তার ফোন দিবে......
-আর কিছু?
-আর কিছু না।
-আচ্ছা বুঝলাম। তুই কতটুকু সিরিয়াসলি বললি আমি জানি না। তবে আমার মনে হয় বিষয়টাকে একটু অন্যভাবেও ভাবা যায়।
দ্যাখ, উনি যদি তোর হক সম্পর্কে সচেতন হন, তবে তিনি যে পেশারই হোন না কেন, তাঁর চেষ্টা থাকবে তোর হক্ যথাযথভাবে আদায় করার। আর তিনি যদি সচেতন না হন, তাহলে সময় পেলেও দেখা যাবে উনি বাল্যকালের বন্ধু কিংবা কলিগদের সাথে অবসর কাটাচ্ছেন। এক্ষেত্রে পেশাকে কোন কোন বড় ফ্যাক্টর বলে মানতে আমি নারাজ। বরং আমি মনে করি এক্ষেত্রে তোর কিছু মৌলিক বিষয়ে নজর দেয়া উচিৎ। এগুলো তুই জানিসই, তবু মনে করিয়ে দিচ্ছি,
প্রথামত, দ্বীনদারী। যেটা তুই সবার প্রথমে দেখবি। ইসলামের বিধান সম্পর্কে তিনি যত বেশি ডেটিকেটেড হবেন, তুই তোর অধিকার সম্পর্কে তত বেশি নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। কেননা যে ব্যক্তি আল্লাহকেই ভয় পায়না, সে ছোট-খাট সমস্যা বা খানিকটা মনোমালিন্য হলেই নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে অসচেতন হয়ে যেতে পারে।
এরপর কিছু পারিবারিক ও বংশীয় দিক দেখার প্রয়োজন পড়ে, সেটা মুরুব্বিরাই দেখে নেন সাধারণত। তবে এটা আর কিছুর জন্য নয়, শুধুমাত্র মানিয়ে নেয়ার সুবিধার্থেই দেখা উচিৎ। দুনিয়াবি কোন বিশেষ কারণে নয়।
-কিছু মানুষের কিন্তু বিশেষ কিছু অঞ্চলের প্রতি ইতিবাচক বা নেতিবাচক ধারণা থাকে...
-হু, তবে আমার মনে হয়, মানুষের ভাল অথবা মন্দ হওয়া বিশেষ এলাকার উপর নির্ভর করে না। হ্যা, এলাকার কিছুটা প্রভাব হয়ত থাকে, তবে সেটাকে সবার উপর প্রাধান্য দেয়ার মত গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না।
এরপর একটা বিষয় আসে, দৈহিক সৌন্দর্য। যেটা কোনভাবেই কোন ব্যক্তিকে যাচাইয়ের মানদন্ড হতে পারেনা। আমার এক আত্মীয়ার কথা বলি, ওনার জন্য খুবই ভাল একটা প্রস্তাব আসে। ছেলে সবদিক থেকেই খুবই ভাল। দ্বীনদারী থেকে পারিবারিক আর পেশাগত, সবদিকেই ভাল। আমার আত্মীয়াও কোন অংশে কম নন, কিন্তু প্রস্তাবটি ফিরিয়ে দেয়ার কারণ ছিল ছেলে চাহিদা অনুযায়ী লম্বা ছিল না। পরবর্তীতে কিছুদিন পরই ছেলেটি খুবই ভাল একটি পরিবারের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্কে আবদ্ধ হয়। কিন্তু আমার সে আত্মীয়া এখনো অবিবাহিতা। আল্লাহ তাকে কবুল করুন।
সর্বোপরি, তোর যে বিষয়গুলোতে আপত্তি কিংবা সংশয় আছে, সেগুলো সম্পর্কে খোলাখুলি আলাপ করে নেওয়াই ভাল। তকদীরের উপর তো মানুষের হাত থাকেনা।
কিন্তু কোন পেশা সম্পর্কে ঢালাও মন্তব্য করাটা ঠিক মনে হয় না। আর যদি তাও তোর দ্বিধা থাকে তাহলে আন্টিকে বলি, তোর জন্যে কেউ ঘর জামাই হতে রাজি আছে কিনা দেখতে! হাঃ হাঃ হাঃ......
-অন্যদিন হইলে কান টেনে লাল করে দিতাম। আজকে ক্ষমা করা হল। বেশ গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছিস। তবে কথা হল, পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সামাজিকতা,আনুষ্ঠানিকতা আর লোক দেখানোর মত বিষয়গুলো এত বেশি প্রাধান্য পায় যে, এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো প্রায় বাদই পড়ে যায়। যেগুলোরই আসলে বেশি গুরুত্ব পাওয়ার কথা। বিশেষ করে মোহরানার বিষয়টা তো এত বেশি লোক দেখানো হয়ে গেছে যে, এত বড় এ্যামাউন্ট মোহরানার জন্য ধরা হয়, যেটা হয়ত ছেলে কখনোই পরিশোধ করতে পারবেনা। অথচ এটা প্রত্যেক মেয়ের হক্। ইসলামে যেটা বিয়ের পরপরই পরিশোধ করার নিয়ম।
-হু, আসলে একদিনের সামাজিকতার জালে আমাদের সারাজীবনই অনেক সময় আটকে যায়। অথচ যত ধুমধাম করেই বিয়ে হোক, কিংবা যত অনাড়ম্বরই হোক, মানুষ সেটা দুদিন পরই ভুলে যায়। কিন্তু ওই একদিনের জন্যই আমরা ভুলে যাই যে, আল্লাহর রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে বিয়েতে যত কম খরচ করা হয়, সেটায় ততবেশি বরকত।”
-ঠিক বলেছিস।
-তাহলে তো আর কথাই নাই। নিশ্চয়ই শিঘ্রই একটা বরকতময় বিয়ের দাওয়াত পেতে যাচ্ছি! যেটা পরিপূর্ণভাবে ইসলামিক রীতিতে হবে!
-যদি কিছু হয় সেটা ইসলামিক রীতিতেই হবে ইনশাআল্লাহ। কিন্তু তোকে দাওয়াত দিতে হবে কেন? কাজ তো সব তুইই করবি। ভাবতেসি বুয়া বিদায় করে দিবো...
-আচ্ছা দেখা যাক, আল্লাহর রহমত, বরকতের ভাগিদার হতে আমার আপত্তি নেই।
বিষয়: সাহিত্য
১৫৩৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন