ঘ্রাণ
লিখেছেন লিখেছেন অনল দুহিতা ২৩ জুলাই, ২০১৩, ১১:৫২:১৪ সকাল
অবশেষে বাড়িওয়ালা চাচা বিল্ডিংয়ের সব ভাড়াটিয়ার আপত্তি উপেক্ষা করে নিচতলাটা ব্যাচেলর ছেলেগুলোকে ভাড়া দিলেন। মাসের ২ তারিখ, ছেলেগুলো তাদের জিনিসপত্র নিয়ে মহা ব্যস্ত। আমি বারান্দায় বসে দেখছি আর বিরক্ত হচ্ছি। আসলে নিজের গাছ পাহারা দিচ্ছি। যাতে ওদের জ্বালায় আমার সাধের ফুলের গাছগুলোর কিছু না হয়ে যায়। তাহলে খেয়ে ফেলব একদম! বিরক্ত হবার অনেকগুলো কারণ। সবচেয়ে ছোট কারণ হল, ছেলেগুলো মারাত্মক অগোছালো। তার মধ্যে সবাই মিলে কাজ করতে গিয়ে কাজ না কমিয়ে বরং বাড়াচ্ছে। অধিক সন্নাসীতে যা হয় আরকি। এর মধ্যেও তাদের আনন্দ চোখে পড়ার মত। এটা অবশ্য স্বাভাবিক, ব্যাচেলরদের পক্ষে এমন একটা বাড়ি ভাড়া পাওয়া আর লস্ট সিম্বলের গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া একই কথা।
বিরক্তির ২য় কারণ বাড়িওয়ালা চাচার সিদ্ধান্ত। এত্তগুলো ফ্যামিলির মধ্যে এইসব ছেলে-ছোকরাদের ঢোকানোর কোন মানে হয়! আজব! আর ছেলেগুলো হল যত বদ-অভ্যাসের খোয়াড়। সারাদিন চিল্লাচিল্লি করবে, ছাঁদ দখল করে রাত-বিরাতে আড্ডা দিবে, যাওয়া-আসার পথে ভাব নিয়ে চশমার কোণা দিয়ে তাকাবে, বিল্ডিংএর সামনে ময়লা ফেলবে, সাউন্ড দিয়ে গান শুনবে..., উফ্! ভাবতেই মেজাজ আরেকটু খারাপ হল। আর খবিশ টাইপের দু-একটা থাকলে তো কথাই নেই। আম্মু এর মধ্যে বলে দিয়েছে, ছাদে যাওয়া বন্ধ। মনে হতেই আরেকবার চোখ পাকিয়ে তাকালাম। দুনিয়ায় কি আর বাড়ি ছিলনা?
মেজাজ খারাপ হবার ৩য় ও সবচেয়ে বড় কারণ হল, ছেলেগুলো আজ সকালে জিনিসপত্রগুলো নিয়ে আসামাত্র পাশের ফ্ল্যাটের আন্টি এসেছেন, এবং সেই থেকে বিরক্তিকর ভাবে বকবক করেই যাচ্ছেন।
"ভাবি! বলেন, এটা কোন কথা হল? এইভাবে এত্তগুলা ছেলেকে এইখানে জায়গা দেয়া... আপনার ঘরে মেয়ে আছে, আমার ঘরে মেয়ে আছে্, এদের সুবিধা-অসুবিধা আছেনা! রফিক সাহেব কি এটা ঠিক করল?! আমরা এত করে বললাম, কারো কথা শুনলনা।আমাদের কথার কি কোন দাম নাই! আমরা আজকে এত বছর ধরে আছি, আমাদের সমস্যা উনি দেখবেনা!! না ভাবি, এইভাবে তো হতে পারেনা......"
উফ্ বাব্বাহ! ওনার মুখ ও আছে একটা কিন্তু আমার মস্তিষ্কের ধারণ ক্ষমতা শেষ প্রায়। পুরা দুইটা ঘন্টা ধরে কলের গান গান চলছে।
আরেকবার নিচে তাকালাম। কাজ প্রায় শেষ। খানিকটা অবাক হয়েই দেখলাম, একজন খাবার কিনে এনেছে, আর অন্য একজন ভ্যানওয়ালাকে দুপুরের খাবারটা তাদের সাথে খাওয়ার জন্য জোরাজুরি করছে। ওই বেচারা মুগ্ধ আর বিনয়ে বিগলিত। আশার কথা হল, পোশাকে-আশাকে ছেলেগুলোকে ভদ্র বলেই মনে হয়। আবার ভাবলাম, হু, প্রথম দুদিন তো ভিজা বিড়ালের মতই থাকবে। কিছুদিন যাক, তারপর দেখা যাবে।
মধ্যরাতে গেটের ক্যাচক্যাচ শব্দ শুনে ধড়মড় করে উঠে বসলাম। এতরাতে কে আসল! চোর-টোর না তো!! চশমাটা চোখে দিয়ে জানালা দিয়ে তাকালাম। খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে অনুমান করলাম ছেলেগুলো বোধহয় নামাযে যাচ্ছে! বাব্বাহ! এইসব ছেলে-পেলে আবার নামায ও পড়ে নাকি! তাও আবার মসজিদে!!
চশমা খুলে ভাল মানুষের মত শুয়ে পড়লাম। চোখ বোজা মাত্র মনের মধ্যে খচখচানি শুরু হল, নাহ! আমারও তো পড়া উচিৎ! গাইগুই করে আর না উঠে থাকতে পারলাম না। নামাযটা পড়ে যেই চোখ বুজলাম, ওমা! একি!! শব্দ কিসের? কান পেতে রইলাম কিছুক্ষণ। এবার বেশ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। কেউ একজন কুরআন তিলাওয়াত করছে। কাঁদো কাঁদো চেহারা করে ভাবলাম, ছেলেগুলা কি ঘুমাতেও দিবে না নাকি? বাধ্য মেয়ের মত শুয়ে শুয়ে শুনতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর এমনিতেই সয়ে গেল। বরং ভোরের মিষ্টি মৃদু হাওয়ায় কোমল কন্ঠের তিলাওয়াত অন্যরকম আমেজ এনে দিচ্ছে। আমিও পারলে মন্দ হতো না। ভাবতেই একটু লজ্জা লাগল। আমারও তো পারা উচিৎ ছিল। আচ্ছা, একদিন চেষ্টা করেই দেখি না কেমন পারি! ছোটবেলায় তো পাড়ার মসজিদে একটু-আধটু শিখেছিই। যদিও শেখার অভিজ্ঞতা মোটেও সুখকর নয়। একটা মেয়ে ছিল, কি জানি নাম..., হ্যা, মিমি। ফাজিলটা সবসময় আমার জায়গায় বসে যেত। তারপর ঝগড়া ঝগড়া ঝগড়া। একদিন তুমুল ঝগড়া করে কায়দা ছিড়ে, রেহাল ভেঙ্গে জামা-কাপড় ময়লা করে কাঁদতে কাঁদতে বাসায় এসে বলেছিলাম, আমি আর যাবো না। সেই আমাকে আর মক্তব মূখী করা যায়নি।
উঠে পড়লাম। দখিনের জানালা দিয়ে মিষ্টি রোদের সাথে পাখির কুজন আর মৃদু বাতাস প্রবেশ করছে। উঠে গিয়ে পর্দাটা সরিয়ে দিলাম। প্রাণ ভরে শ্বাস নিলাম একবার। কতদিন এমন সকাল সকাল ওঠা হয়না............ আসলেই ভাল লাগছে।
জানালার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ সাত-পাচ ভেবে বুকসেলফ থেকে কুরআন শরীফটা হাতে নিল। ধুলো ময়লায় একাকার। একটা ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে যত্ন করে মুছলাম। তারপর মহা উৎসাহে শুরু করার পাঁচ মিনিটের মাথায় যাবতীয় উৎসাহ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। বাব্বাহ! এত্ত কঠিন!!! দাঁত ভেঙ্গে ফেললাম আর দুইলাইনও পড়তে পারলাম না! কেমন একটা খারাপ লাগা কাজ করতে লাগল নিজের মধ্যে। অথচ রেকর্ড পরিমাণ দ্রুততায় একেকটা গল্পের বই শেষ করি আমি। এত বই পড়লাম, এতকিছু শিখলাম, আর পাঁচ মিনিটে কুরআনের দুটো লাইন পড়তে পারলাম না! মন খারাপ করে উঠে গেলাম। কেমন যেন একটা জেদ চেপে গেল, কুরআন শেখার!
সেই থেকে প্রতিদিন ভোরে উঠে তিলাওয়াত শুনতাম, আর সাথে নিজেও একটু একটু পড়তাম। কিন্তু হত না।
একদিন আম্মু দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন, কিরে তিতির! তুই কুরআন পড়তে পারিস??
আমি লজ্জায় লাল হয়ে বললাম, কিভাবে পারব, আমাকে শিখিয়েছো?
আম্মু কিছুটা থতমত হয়েই বলল, শিখতে চাইলে বল, টিচার রেখে দিই?
আমি সংকুচিত হয়ে বললাম, আচ্ছা রাখো।
সেদিন গেলাম বান্ধবির বাসায়। পরীক্ষার পর অনেকদিন বান্ধবিদের সাথে দেখা-সাক্ষাত নেই। আজ ঝুমুরের বাসায় সবাই আসল। গল্প করতে করতে সবাই সবার মোবাইল ঘাটছিলাম, আর হাসাহাসি করছিলাম। নিপুর মোবাইল ভরা এ্যানিমেশন স্টারদের ছবি। মেয়েটা কোরিয়ান এ্যানিমেশন বলতে অজ্ঞান। জবার মোবাইল হল গানের লাইব্রেরী হেন কোন গান নাই যেটা তার তিন মেমরীকার্ডের কোনটায় নাই। নিশির মোবাইলে দেখলাম কোন ছেলের ফোটো! সেটা নিয়ে বেচারীকে খুচিয়ে শেষ করে ফেললাম সবাই মিলে। রিতা গম্ভীর কন্ঠে বলল,
"সিংকিং সিংকিং ড্রিংকিং ওয়াটার! যা, তুই পানি খা, কিন্তু আমরা খালি হাওয়া খাইতে রাজি না। কি খাওয়াবি বল!"
অবশেষে বেচারি একদিন সবাইকে খাওয়ানোর ওয়াদা করে তবেই রক্ষা! আসার সময় ঝুমুরের মোবাইলে দেখলাম কুরআন তিলাওয়াতের একটা অডিও। নিতে গিয়ে দেখি মেমরী আর নেই। নিতে চাইলে কিছু গান-ছবি রিমুভ করতে হবে। একটু ভেবে কয়েকটা গান রিমুভ করে পুরো অডিও টাই নিয়ে নিলাম। ঝুমুর যেন একটু অবাকই হল।
আসার পর ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজ কুরআন পড়াতে আসেননি আন্টি। সপ্তাহে তিনদিন এক আন্টি এসে কুরআন শেখান। একমাসের মাথায় মোটামুটি উন্নতি হয়েছে। কিন্তু সাত সকালে যার তিলাওয়াত শুনি, তার কাছে ধারেও যায়নি সেটা। রোজ নামাযের পর একই নিয়মে তার তিলাওয়াত শুনি। কার তিলাওয়াত জানিনা, তবে ভাল লাগে।
একদিন হঠাৎ কোন সাড়াশব্দ পেলাম না। অবাক হলাম। এমনটা তো হয় না! পরদিন ও। একটা উশখুশ ভাব নিয়ে পায়চারি করতে করতে ভাবছিলাম, কি হল? কি হল?
হঠৎ মনে হল, ছোট ভাইটার সাথে তো ওদের অনেক ভাব। ওকেই জিজ্ঞেস করে দেখি... সারাদিন দেখি ওদের সাথেই কি ফিসফাস করে। একটা ফাইভের পিচ্চির সাথে কথা বলে ওরা কি মজা পায় আল্লাহ মালুম। কিছুক্ষণ ভাবাভাবির পর ডাকলাম তুহিনকে।
-এই, নিচের কেউ কি চলে গেছে?
-না আপ্পি। জানো, রাহাত ভাইয়ার খুব জ্বর।
-রাহাত ভাইয়াটা আবার কে?
-ওমা! তুমি রাহাত ভাইয়াকে চিননা?
-কি আজব! সবাইকে আমার চিনতে হবে নাকি?
-ওইযে, আমি যার কাছে পড়ি।
মনে পড়ল, ছেলেগুলো ভদ্র দেখে আম্মু ওদের একজনকে বলেছিলেন তুহিনকে যেন পড়ায়। তার কথাই মনে হয় বলছে।
-হু, ডাক্তার দেখিয়েছে?
-হ্যা, কিন্তু অনেক জ্বর।
দেখে বোঝা যাচ্ছে তুহিনের খুব মন খারাপ হয়েছে তাতে। বললাম,
-এমন সবারই একটু-আধটু অসুখ হয়। আবার ক'দিন পর ভাল হয়ে যায়। ঠিকমত ওষুধ খেলে ঠিক হয়ে যাবে।
-ও...। আমাকে বলেছে দোয়া করতে। আর বলেছে বাসার সবাইকে যেন দোয়া করতে বলি।
-আচ্ছা, যা।
একবার ভাবলাম সেই নাকি? যাহোক, রাতের খাবার খেয়ে ঘুম দিলাম। এখন রাতে জলদি শোয়ার অভ্যেস করে ফেলেছি। সকালে উঠে তিলাওয়াত শোনাটা রুটিন হয়ে গেছে। কিন্ত পরদিনও যখন আর শোনা গেলনা, তখন আমার ধারণা হল, উনিই বোধহয় রাহাত। বিকেলের দিকে নির্লিপ্ত কন্ঠে গিয়ে আম্মুকে বললাম,
-তুহিন বলছিল ওর টিচারের নাকি খুব জ্বর?
-হ্যা।
-সেজন্যে তো সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকে। একটু দেখো গিয়ে কি হয়েছে?
-জ্বর হয়েছে। ভাইরাস জ্বর মনে হয়। তাই ছেলেটা একটু দূর্বল হয়ে গেছে।
-অ...। তাহলে আমাদের বাসা থেকেই খাবার পাঠাও না ক'দিন? মেসের খাবার তো এমনিতেই ভালনা।
-দেখি কি করা যায়...
আসর পড়লাম। মনে হল, দোয়া চেয়েছে যখন একটু দোয়া করে দিই। আগে নামায তেমন পড়তাম না। কিন্তু কুরআন শিখতে শুরু করার পর নামাযও শুরু করেছি। আসলে আগে হতো কি, কাল থেকে পাঁচ ওয়াক্ত পড়ব ভেবে রাখতাম, কিন্তু সেই কাল আর আসতো না। কাল থেকে শুরু করব করব করে আর পড়াই হতো না। এখন যেহেতু সকালেই উঠি, তাই নামযটা না পড়ে থাকতে খারাপই লাগে। তাছাড়া কুরআন শিখতে শুরু করার পর ধর্মীয় বিষয়গুলোতে কেন যেন আগ্রহ জন্মাচ্ছে। ভাল, আমার বন্ধটা সুন্দর কিছু কাজেই ব্যয় হচ্ছে। বারান্দায় গিয়ে বসলাম। আমার অধিকাংশ অবসর কাটে বারান্দায় বসে নিজের ফুলগাছগুলোর দিকে চেয়ে। আর হাতে অবশ্যই একটা বই থাকে! রিতার অনেকগুলো বই এখনো আমার কাছে। মাসখানেক ধরে আসলে পড়া হচ্ছে কম। কিছুক্ষণ বসে থেকে ছোট কাস্তে আর পানি নিয়ে নিচে নামলাম। গাছগুলোর পরিচর্চা করা হচ্ছেনা কিছুদিন। মাথায় অনেক রকম চিন্তা আসছে আর যাচ্ছে। কোনটা স্থায়ী হচ্ছেনা মাথায়। অস্থিরতা কাজ করলে এমনটা হয়। আপাতত অস্থির হবার মত কিছু ঘটেনি। পানি দিতে দিতে আড়চোখে তাকালাম। তুহিনের কথা শোনা যাচ্ছে। ওর টিচার অস্বুস্থ্য হবার পর থেকে প্রায় সারাদিনই ওখানে গিয়ে বসে থাকে। আমাকে দেখে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে এল।
-আপ্পি, দুইটা ফুল দাও না!
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম,
-কিইইই!!!
আমার এত সাধের ফুল! হবেনা।
-দাওনা আপ্পি... ফুল দিলে নাকি রোগীদের অসুখ ভাল হয়!
-এইসব তোকে কে বলেরে? ফাজিল!
তুহিন মন খারাপ করে চলে গেল। একটু খারাপ লাগছে, কিন্তু নিজের গাছের ফুল নিজের হাতে ছেড়ার কথা ভাবতেই পারিনা আমি।
একসপ্তাহ হয়ে গেছে। সকালটা কেমন নিরব নিরব... আমার প্রচন্ড মন খারাপ। উনি বেশি অসুস্থ্য? বিকেলে খবর আসল উনি খুবই অসুস্থ্য হয়ে গেছেন। অবস্থা যদি ভাল না হয়, তাহলে কাল হসপিটালে ভর্তি করাবে। তুহিন এসে কান্নাকাটি করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুম থেকে উঠেই বলল,
-আপ্পি, তুমি না বলেছিলে অষুধ খেলে উনি ভাল হয়ে যাবেন! কেন ভাল হলনা? কেন?
-ছিঃ ভাইয়া, তুমি তো বড় হয়েছো। বড়রা এইভাবে কাঁদেনা।
-তাহলে তুমি কাঁদো কেন?
-কই?
-ওইযে, তোমার চোখে পানি!
-শোন, আমার গাছের ফুলগুলো নিয়ে যাস।
-সত্যি!
-হু।
বিষয়: সাহিত্য
১৪৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন