হবু শ্বশুরের নিকট পত্র
লিখেছেন লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম তানিন ৩১ আগস্ট, ২০১৫, ১০:০১:২৬ সকাল
আসসালামু ‘আলাইকুম ওয়া রহ্মাতুল্লাহে ওয়া বারাকাতাহুহ্!
যাবতীয় প্রশংসা আল্লাহর তা’আলার। সর্বোত্তম দরুদ ও সালাম বর্ষিত হোক আল্লাহর রসূল ও প্রিয় হাবীব মুহাম্মদ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর উপর। পরম করুণাময় ও অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।
আজ আমরা এমন এক ঘোর সময় অতিবাহিত করছি, যখন আমাদের চারিদিকে ফিত্না ও পাপাচারের জয়-জয়কার। শয়তানের ধোঁকায় বা নফসের প্ররোচনায় পড়ে, নিজের অজান্তেই নানাভাবে বড় ধরনের হারাম কাজের মধ্যে নিমজ্জিত রয়েছি। আর, বিবাহের মত পুতঃ-পবিত্র বন্ধনের শিরা-উপশিরায়ও আজ বহু বিধর্মী কার্যকলাপ এবং রীতি-নীতি রাজত্ব করছে। তাই, নিজেকে এবং ভালোবাসার মানুষ সবাইকে সর্ব প্রকার ফিত্না থেকে হেফাযত তথা আল্লাহর ক্রোধ থেকে বাঁচানোর নিমিত্তে, অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে নিন্মের বিষয়াদির অবতারনা করতে বাধ্য হচ্ছি। অনিচ্ছাকৃত ভুল-ত্রুটিকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন বলে আশা রাখি। আল্লাহ আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সকল প্রচেষ্টাকে কবুল করে নিন। একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টি এবং জান্নাতুল ফেরদাউস হাসিলের তরে সকল কাজ করার তাওফিক দিন। আমীন।
ক্বুর’আন ও হাদীসের আলোকে বিবাহের কতিপয় নীতিমালা
আপনারা অবগত আছেন যে, ইসলামী শরিয়াত মোতাবেক, মসজিদে আক্বদ্ (বিবাহ্) এবং পাত্রের বাড়িতে ওয়ালিমা (বৌভাত) হয়। এর আগে বা পরে, অন্যকোন ধরনের অনুষ্ঠান নেই এমনকি পাত্রীর বাড়িতেও কোন অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রয়োজন নেই। এরপরেও, সামাজিকতা বিবেচনায় পাত্রীপক্ষ (সংক্ষিপ্তভাবে) অনুষ্ঠান করতে চাইলে আশা করি তা সম্পূর্ণ শরিয়াত মোতাবেক হবে, ইন শা আল্লাহ।
করনীয়ঃ
০১. মোহরে ফাতেমী বা সুন্নতি মোহরানা তে বিবাহ্ হবে এবং পুরোটাই উসূল হবে, ইন শা আল্লাহ! (উল্লেখ্য, মোহরে ফাতেমী = ১২.৫ উকিয়া = ৫০০ দিরহাম = ১৩১.২৫ ভরি রূপা = নগদ মূল্য [আনুমানিক ৮০ হাজার টাকা]/সমপরিমান মূল্যের স্বর্ণ/এই জাতীয়) [আবু দাঊদ-২১০৫, তিরমিযী-১১১৪]
০২. সুন্নতি পদ্ধতিতে, মসজিদে আক্বদ্ (বিবাহ্) হবে, ইন শা আল্লাহ! (উল্লেখ্য, শাওয়াল মাসে এবং শুক্রবারে বিবাহ্ সুন্নাহ)
বর্জনীয়ঃ
০১. উভয় পক্ষ গায়ে হলুদ বা অন্য যেকোন অনৈসলামিক অনুষ্ঠান করা থেকে বিরত থাকবেন।
০২. বাংলা, ইংলিশ, হিন্দী বা যে কোন ধরনের গান এবং বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকবেন।
০৩. পাত্রী এবং অন্যান্য মহিলারা পার্লারে যাওয়া, ভ্রু প্লাক করা এবং ঊটের কুঁজের ন্যায় উঁচু করে খোঁপা বাঁধা থেকে বিরত থাকবেন।
০৪. পাত্রী এবং অন্যান্য মহিলারা সুগন্ধি এবং সুগন্ধিযুক্ত ক্রিম/পাউডার/মেকাপ ব্যবহাত করা থেকে বিরত থাকবেন।
০৫. পাত্রী এবং অন্যান্য মহিলাদের সব ধরনের ছবি তোলা বা ভিডিও করা (মোবাইলে/ক্যামেরায়) থেকে বিরত থাকবেন।
০৬. পাত্রী এবং অন্যান্য মহিলারা বিবাহ্ তে নুপুর, পায়েল, ঘুংগুর এবং এ জাতীয় অলংকার পরা থেকে বিরত থাকবেন।
০৭. কপালে তিলক আঁকা, ঘরে মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো, গলায় মঙ্গল সুত্র পরা, হাতে রাঁখি বাঁধা বা যেকোন বিধর্মী নিয়ম পরিহার করবেন।
০৮. সকল আয়োজনের ক্ষেত্রে, সব ধরনের অপচয়, আড়ম্বরতা, অনৈসলামিক কাজ পরিহার করবেন এবং তা যথাসম্ভব সাদাসিদে হবে।
০৯. ঘরে/অনুষ্ঠানস্থলে পুতুল, অঙ্কনকৃত ও তোলা ছবি (দেয়ালে বা ফটো ফ্রেমে) এবং যাবতীয় প্রাণীর প্রতিকৃতি রাখা থেকে বিরত হবেন।
১০. বিবাহ্তে, পাত্রীপক্ষের নন-মাহ্রাম/বেগানা (নিন্মে বর্নিত ১৪ জন মাহ্রাম/এগানা ব্যতীত - নোট ১ দ্রষ্টব্য) মহিলারা স্বাভাবিক কৌতুহলবশতঃ পাত্রকে (একান্তই) দেখতে বা কথা বলতে চাইলে যথাযথ হিজাব করে (নিকাবসহ বোরকা পরে) সামনে আসার অনুরোধ রইলো। অথবা, অন্দরমহল/পর্দার আড়াল থেকেই কাজটি সেরে নিতে পারেন। আর, এটাই সর্বোত্তম।
১১. বেগানা নারীগন পাত্রকে এবং বেগানা পুরুষগন পাত্রীকে স্পর্শ করে অভ্যর্থনা জানানো, উপহার দেয়া, কোলে তুলে অন্য স্থানে নেয়া, আয়নায় মুখ দেখানো, মিষ্টি মুখ করানো, পা ছুঁয়ে সালাম বা অন্য কোনভাবে পর্দার খেলাফ হয়, এমন কাজ থেকে বিরত থাকবেন।
১২. সকল আনুষ্ঠানিকতার ক্ষেত্রেই, মহিলা এবং পুরুষদের আলাদা-আলাদা ব্যবস্থা থাকবে। কেউ কারো সাথে গিয়ে অহেতুক হাসি-ঠাট্টা বা খোঁশ-গল্প করা থেকে বিরত থাকবেন। বেগানা পুরুষ মহিলার স্থানে এবং বেগানা মহিলা পুরুষের স্থানে যাওয়া থেকে নিজেকে সংযত করবেন। পর্দার খেলাফ তথা আল্লাহর অসন্তুষ্টি হয়, এমন সকল ধরনের কাজ থেকে নিজেদেরকে হেফাযত করবেন।
১৩. পাত্রী পরিপূর্ণ হিজাব সহকারে বিবাহ্তে উপস্থিত থাকবেন অর্থ্যাৎ নিকাবসহ (অতিমাত্রায় কারুকার্যখচিত নয় এমন) বোরকা পরিধান করবেন। আক্বদ্ (বিবাহ্) বা ওয়ালিমার (বৌভাতের) দিন মাহ্রাম (নোট ১ দ্রষ্টব্য) ব্যাতীত অন্যদের সামনে পর্দাহীন হয়ে নিজের চেহারা বা সৌন্দর্য প্রকাশ করাকে অপছন্দ করবেন।
* প্রধানত পাত্রীপক্ষকে লক্ষ্য করে বলা হলেও, উপরোক্ত কথামালা পাত্রপক্ষের জন্যও একইভাবে প্রযোজ্য হবে।
** উল্লেখিত বর্জনীয় প্রতিটি কাজই কবিরা গুনাহ্ (হারাম) এমনকি কিছু কিছু বিষয় শির্কও। এর চর্চায় বড় ধরনের গুনাহগার হতে হবে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------
নোট (১):
পুরুষদের মাহ্রাম/এগানা ১৪ জনঃ
ক) মায়ের মত ৫ জনঃ– (১) মা, (২) খালা, (৩) ফুফু, (৪) শ্বাশুড়ি, (৫) দুধ-মা
খ) বোনের মত ৫ জনঃ– (১) বোন, (২) দাদি, (৩) নানি, (৪) নাতনি, (৫) দুধ-বোন
গ) মেয়ের মত ৪ জনঃ– (১) মেয়ে, (২) ভাইয়ের মেয়ে, (৩) বোনের মেয়ে, (৪) ছেলের বউ
মহিলাদের মাহ্রাম/এগানা ১৪ জনঃ
ক) বাবার মত ৫ জনঃ– (১) বাবা, (২) চাচা, (৩) মামা, (৪) শ্বশুর, (৫) দুধ-বাপ
খ) ভাইয়ের মত ৫ জনঃ– (১ ) ভাই, (২) দাদা, (৩) নানা, (৪) নাতি, (৫) দুধ-ভাই
গ) ছেলের মত ৪ জনঃ– (১) ছেলে, (২) ভাইয়ের ছেলে, (৩) বোনের ছেলে, (৪) মেয়ের জামাই
উভয়ের এই ১৪ জন ব্যতীত আর কারো সঙ্গে পরিপূর্ণ পর্দা ব্যাতিরেকে (নন-মাহরাম/বেগানাদের সাথে) দেখা করা বা দেয়া জায়িজ নয়।
-----------------------------------------------------------------------
চিঠিটি ২ জন আলেমের (ইমাম ও খতিব) দ্বারা তাহ্ক্বিক করা হয়েছে এবং হুবুহু এভাবেই পাঠানো হয়েছে।
------------------------------------------------------------------------
বিবাহের পূর্ববর্তী, পরবর্তী করনীয়, শিক্ষণীয় এবং জ্ঞাতব্য বিষয় নিয়ে অনেক বিবাহিত ও অবিবাহিত ভাই-ই প্রশ্ন করছেন আমাকে। এমনকি এক ভাই তো সরাসরি বলেই ফেললেলঃ
"আপনার বিবাহের খবর জেনে অনেক খুশি হলাম। আল্লাহ আপনাদের পৃথিবী ও পরকালে সফল করুন। তা, আগে বলেন- যৌতুক নিলেন কিনা! :-P সরাসরি নিলেন না, ঘুরায়া নিলেন। বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় কতটুকু নৈতিকটা বজায় রেখেছেন? এসব নিয়ে শিক্ষণীয় কিছু লেখা আপনার কাছ থেকে আশা করি :-) জানি, ইসলামী পথে চলা অনেক মুসকিল ও সংগ্রামের, আর বিশেষ করে বিয়ের ক্ষেত্রে তো আরো ঝামেলা, তারপরও বললাম আর কি..."
আলহামদুলিল্লাহ্! বিবাহের সাথে সম্পৃক্ত সকল লিখিত, অলিখিত, কথ্য, কাম্য, লুকায়িত যৌতুকের বিপক্ষে আমাদের অবস্থান। আজ থেকে ২ বছর আগে, যখন বিবাহের নিয়ত করি তখনই আমাদের পারিবারিক এক বৈঠকে আমি, বাবা, মা এবং ছোট ভাই এই বিষয়ে একাত্নতা প্রকাশ করি যে, "পাত্রীপক্ষ থেকে লিখিত, অলিখিত, কথ্য, কাম্য, লুকায়িত - কোন ধরনের যৌতুক নেয়া হবেনা। এমনকি সামাজিকতার নামে যে ফ্রীজ, টেলিভিশন, ফার্নিচার ইত্যাদি দেয়া হয়, তা-ও নেয়া হবেনা, ইন শা আল্লাহ্। জোর করে দিলেও না। অর্থাৎ, দ্বীনদার, শিক্ষিত ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের দ্বীনি পাত্রী ব্যতিত আর একটি সূতাও নেয়া হবেনা।"
আল্লাহর কাছে সবসময় প্রার্থনা করতাম যেন সর্বোচ্চ সুন্নাহ মোতাবেক বিবাহ সম্পাদন করতে পারি। আল'হামদুল্লিহ! আল্লাহ আমার সে ইচ্ছা পূরন করেছেন। শুকরিয়া জানাই সেই মহান স্বত্ত্বার কাছে।
যাবতীয় প্রথা বা লজ্জার ভুলে, বেয়াদবি না হয় এমন ভাষায় এবং পরিপূর্ণ বিনয় সহকারে, বিবাহের কথাবার্তা চলাকালীন সময়েই হবু শ্বশুরের কাছে আমি একটি লিখিত চিঠি দিয়েছিলাম, যেন সর্বোচ্চ শরীয়াত মোতাবেক বিবাহ সংঘটিত হতে পারে। তবে, এ পথও এত সহজ, সরল, সংক্ষিপ্ত এবং কন্টকমুক্ত ছিলোনা। আল্লাহ্ হেফাযত করেছেন আমাকে। শ্বশুর সাহেব, পাত্রীর দাদী এবং অন্যান্য কিছু লোকের জোরালো সমর্থন এবং অন্যান্যদের প্ররোচনার বিরুদ্ধে তাদের শক্ত অবস্থানের কারনেই আমার পক্ষে সম্ভব হয়েছে এতদূর আসা।
ভাইদের অনুরোধে উক্ত চিঠিটি "হবু শ্বশুরের নিকট পত্র" নামে প্রকাশে ইচ্ছা জাগে; কারো বিয়েতে কাজে লাগলে বা কেউ এর দ্বারা আলোকিত হওয়ার সুযোগ পেলে, এর বিনিময়ে ইন শা আল্লাহ কিছু সাওয়াব পাওয়ার একান্ত অভিপ্রায়ে। আল্লাহু মুস্তা'আন
বিষয়: বিবিধ
২৩০৯ বার পঠিত, ৫ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
ভালো লাগলো অনেক শুকরিয়া।
এটা তো বাংলা লিংক দামে হয়ে গেল
মন্তব্য করতে লগইন করুন