এ কেমন সংযম !!??

লিখেছেন লিখেছেন তৌহিদুল ইসলাম তানিন ১১ জুলাই, ২০১৩, ০২:৩৯:৩৭ দুপুর

সময়ঃ আজ সকাল ১০টা ২৫ মিনিট । স্থানঃ মগবাজার । আমার অবস্থানঃ পাবলিক বাসে । জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছি । কোমল পানীয় বহনকারী একটা পিকআপ ট্রাক রাস্তার বাম পাশে দাঁড়িয়ে আছে । একটা প্রাইভেট কার রাস্তার বাম পাশ দিয়ে এবং থেমে থাকা পিকআপ ট্রাকের ডান পাশ দিয়ে অতিক্রম করতে গেলে প্রাইভেট কারের ডান দিক দিয়ে আরেকটি কোমল পানীয় (একই কোম্পানীর) বহনকারী পিকআপ ট্রাক পার হতে গেলে প্রাইভেট কার ও পিকআপ ট্রাকের সংঘর্ষে প্রাইভেট কারে স্ক্যাচ পড়ে এবং নিয়মমাফিক প্রাইভেট কারের ড্রাইভার নেমে আসে এর কারন জিজ্ঞাসা করার নিমিত্তে । কিন্তু, কিছু বুঝে উঠারে আগেই থেমে থাকা পিকআপ ও সংঘর্ষ সৃষ্টিকারী পিকআপ দুটো থেকে ৬/৭ লোক এসে ড্রাইভারের উপর চড়াও হয় এবং গনহারে উত্তম-মধ্য দেয়া শুরু করে । ঘটনার আকৎসিকতায় বেচারা ড্রাইভার ও আশেপাশের লোকজন হা হয়ে তাকিয়ে রইল । কিছুক্ষন পর, কিছু সহৃদয়বান কয়েকজন লোক এগিয়ে এসে প্রাইভেট কারের ড্রাইভারকে তাদের হাত থেকে উদ্ধার করে । তারপর, আঘাতপ্রাপ্ত ড্রাইভারকে কোনরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে প্রাইভেট কারে ফেরত পাঠায় আর আক্রমনকারী ব্যাক্তিবর্গকেও কিছু নীতিবাক্য শুনিয়ে চলে যেতে বলে যদিও তারা তখনো সে স্থান ত্যাগ করেনি ! উপস্থিত সাধারন লোকজনের যারা মিমাংসা করতে এসেছিল তাদের উদ্দেশ্যেও মারমুখী ভংগী বা আচরন প্রকাশ করে ! (ট্র্যাফিক জ্যামের কারনে পুরো ঘটনা একেবারে সম্মুখ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছিল !)

এখন, অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারেঃ

আজ থেকে শুরু হলো, সিয়াম সাধনার মাস তথা পাপ মোচন করে অধিক পরিমানে পুণ্য অর্জনের মোক্ষম বা আদর্শ সময় । ক্বুর'আনে বলা হয়েছে, "রমাদান সিয়াম সাধনার মাস" । (সূরা বাক্বারাঃ ১৮৩) । যেহেতু , আমরা জানি "সিয়াম" শব্দের অর্থ সংযম বা বিরত থাকা অর্থাৎ সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, জুলুম, মিথ্যাচার, পাপাচার, গীবত, পরনিন্দা, পরচর্চা, সুদ, ঘুষ, হারাম কাজ ইত্যাদি থেকে বিরত থাকা । তাহলে, এ সময় এমন ঘটনা ঘটল কেনো ? যেখানে, "রমাদানে শৃঙ্খলাবদ্ধ করা হয় অন্যায় কাজে প্ররোচনাকারী শয়তানদের" সেখানে এমন ঘটনার উদ্ভব কেনো !?

এই সম্পর্কিত একটি হাদিসঃ

হযরত আবূ হুরায়রা রাঃ হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাঃ ইরশাদ করেছেন, "যখন রমজান মাসের প্রথম রাত আসে, তখন শয়তান ও অবাধ্য জিনসমূহকে শৃঙ্খলিত করা হয় । জাহান্নামের দরজাসমূহ বন্ধ করে দেয়া হয়, অতঃপর এর একটি দরজাও খোলা হয়না এবং জান্নাতের দরজাসমূহ খুলে দেয়া হয় অতঃপর এর কোন একটিও বন্ধ করা হয়না । এক আহ্বানকারী ফেরেশতা আহ্বান করতে থাকেন, হে পুণ্যের অন্বেষণকারী ! সামনে অগ্রসর হও, আর হে মন্দের (পাপের) অন্বেষণকারী ! থেমে যাও । এ মাসে আল্লাহ তাআলা অনেককে দোজখের অগ্নি থেকে মুক্তি দেন আর এটা প্রত্যেক রাতেই সংঘটিত হয়ে থাকে । (তিরমিযী, ইবনে মাজাহ, হাদীসশাস্ত্রের সংকলিত প্রসিদ্ধগ্রন্থ "মিশকাতুল মাসাবীহ" এর "কিতাবুস সাওম" অধ্যায়ের ১৮৬৪ নং হাদীস।)

তাদের জন্য উত্তর হলোঃ

হ্যাঁ, এটা সঠিক যে শয়তান শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকে কিন্তু, আমরা অন্যায় ও পাপাচারে লিপ্ত হতে হতে অনেক ক্ষেত্রেই শয়তানের চেয়েও অধম হয়ে পড়ি । আর, তখন আমাদেরকে অন্যায়, পাপাচার আর জুলুমের জন্য প্ররোচিত করতে কোন ধরনের শয়তানের প্রয়োজন হয়না এমনকি অনেক ব্যাক্তিকে শয়তান চিরতরে ছেড়ে চলে যায় আল্লাহ্‌র অবাধ্যতা করতে করতে এর সমূহ সীমা লংগনের কারনে কেননা ঐ সব ব্যাক্তিদের জন্য তখন আর কোন ধরনের শয়তানী কুমন্ত্রনার প্রযোজন পড়ে না ! তারা, নিজেরাই এক একজন শয়তানে পরিণত হয়ে পড়ে । যদিও আমরা জানি, সাধারন একজন মানুষের সাথে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন শয়তান ও একজন ফেরেশতা থাকেন । তবে, ঈমান ও আমলের উপর ভিত্তি করে এই সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পায় বা ঈমান -আমলের প্রতি যার কর্মতৎপরতা যত বেশী থাকে তার পিছনে শয়তান তত বেশী কুমন্ত্রনা নিয়ে হাজির হয় বা কুমন্ত্রনায় ফেলার চেষ্টা করে ।

আর তাইতো, এক রাতের বা এক মাসের ব্যবধানে কেউই পরিবর্তন তথা সংযমের অধীকারী/অধিকারিণী হতে পারে না । বাকি ১১ মাসের আচার-আচরন ও কর্মকান্ডের লক্ষণগুলো আমাদের মাঝে সুষ্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় বা পরিলক্ষিত হয় এই রমাদান মাসেও ! আমরা সহজেই এর থেকে পরিত্রান পেতে ব্যার্থ হই !

সুরা বাকারায় রমাদান বিষয়ে আল্লাহ এভাবে বলেন যে,

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُواْ كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ

“হে বিশ্বাসীরা, তোমাদের প্রতি সিয়াম (রোজা) রাখার হুকুম করা হয়েছে যে ভাবে হুকুম করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের জন্য যাতে তোমরা তাকওয়া অবলম্বন করতে পার।“ (২:১৮৩)

তাকওয়া সম্পর্কে ইসলামী স্কলাররা অনেক ব্যাখ্যা দিয়েছেন । এক কথায় তাকওয়ার অর্থ বলা যায় মানুষের সকল কর্মে ও কাজে তার মনে আল্লাহ-অনুভুতি বা সচেতনতা (God consciousness) সজাগ থাকা । তাকওয়া হল আল্লাহ-সচেতনতার এমন এক মানসিক অবস্থা যা পাপ থেকে দূরে রাখে এবং সদাসর্বদা প্রেরণা জোগায় উত্তম কাজের । যে মানুষের মনে সর্বদা তাকওয়া সজাগ থাকবে তার পক্ষে কোন অন্যায় কাজ করা বা খোদার নির্দেশ অমান্য করা সহজ হবেনা কেননা তার বিবেক বাধা দিবে । তাকওয়া নিছক ক্ষুধা, তৃষ্ণা ও যৌনতাকে দমিয়ে রাখার সামর্থ নয়,বরং সর্ব প্রকার জৈবিক,আত্মীক ও আর্থিক কুপ্রবৃত্তি দমনের ঈমানী শক্তি । তাই রমাদান বা সিয়ামের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে এই তাকওয়া অর্জন । একজন রোজাদার প্রকাশ্যে রোজা আছি বলে গোপনে আহার বা পান করার সুযোগ থাকলেও একমাত্র আল্লাহর ভয়ে সে তা করেনা আর এজন্য আল্লাহ বলেন সিয়াম হচ্ছে একজন ঈমানদারের এমন এক এবাদত যা সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উদ্দেশ্যে নিবেদিত ।

শেষ, একটি হাদিস দিয়ে আমার কথা শেষ করব ।

حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، عَنِ الْمَقْبُرِيِّ، عَنْ أَبِيهِ، عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ " مَنْ لَمْ يَدَعْ قَوْلَ الزُّورِ وَالْعَمَلَ بِهِ وَالْجَهْلَ فَلَيْسَ لِلَّهِ حَاجَةٌ أَنْ يَدَعَ طَعَامَهُ وَشَرَابَهُ ". قَالَ أَحْمَدُ أَفْهَمَنِي رَجُلٌ إِسْنَادَهُ.

রসূলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেন, যে রোজাদার মিথ্যা কথা এবং অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে পারলনা, তাকে পানাহার থেকে বিরত রেখে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।

Narrated Abu Huraira: The Prophet (PBUH) said, "Whoever does not give up false statements (i.e. telling lies), and evil deeds, and speaking bad words to others, Allah is not in need of his (fasting) leaving his food and drink."

[ Sahih al-Bukhari 6057, In-book reference : Book 78, Hadith 87, USC-MSA web (English) reference : Vol. 8, Book 73, Hadith 83 (deprecated). ]

রচনাকালঃ ১১.০৭.২০১৩ ঈসায়ী (১ রমাদান, ১৪৩৪ হিজরী)

----------------------------------------------------------------------------------

কৃতজ্ঞতাঃ

১। ৪ জন সুহৃদ মুসলিম

২। http://www.sunnah.com/bukhari/78/87

[আমার ফেসবুকের বড় স্ট্যাটাসগুলো ও নোটসমূহ আমার ব্যাক্তিগত ব্লগ http://www.tanin87.blog.com এ যেকোন সময় পাবেন]

বিষয়: বিবিধ

১৪৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File