গণতন্ত্রের পোষ্টমর্টেমঃ প্রেক্ষিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল

লিখেছেন লিখেছেন সাদাচোখে ৩১ মার্চ, ২০১৪, ১০:৪০:৪৪ রাত

পোলারাইজড বিশ্ব ব্যবস্থায় পশ্চিমা আগ্রাসী শক্তি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশসমূহে 'গণতন্ত্রের' আবরনে লিটারেলী দুটি মনস্তাত্বিক 'নেশার উপাদান' ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। এর অন্যতম আকর্ষনীয় ও গ্রহনযোগ্য উপাদানটি ছিল 'জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যাগরিষ্ঠের' শাসন। আর অন্যটি ছিল 'সম্পদকেন্দ্রিক উন্নয়ন / ক্যাপিটালিজম'।

এ দুটি উপাদানই ইসলামভাবাপন্ন, স্যেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলমানকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বিশেষ করে শিক্ষিত মুসলিম জনগোষ্ঠির ঐ অংশটিকে - যারা দেখছিল, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সমূহের প্রভাব প্রতিপত্তি বিশ্বব্যবস্থাপনায় জ্যামিতিকহারে হ্রাস পাচ্ছে। এ ধরাশায়ী ট্রেন্ড হতে মুসলিম জনমানুষকে পূনরুদ্ধারে - হাতের কাছে আলেম ওলামা হতে কোন রেডিমেইড টুলস কিংবা টেকনিক ছিলনা, আবার তারা নিজেরা ও নতুন কিছু চিন্তা করে আবিষ্কার করার ঝামেলায় যেতে চাননি। বরং তারা তুলনামূলক সহজ ও হাতের নাগালে পাওয়া অপশান তথা 'গনতন্ত্র' নামক ড্রাগ সমতুল্য এ মতবাদকে আলিংগন করলো - নিষ্কলুষ মনে, কোন রকম সন্দেহ না করে। আর মতবাদটিকে গণমানুষের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে তারা কোরআন ও হাদীস হতে প্রয়োজনীয় অলংকার সংযোজন করে মতবাদটিকে হালালিফাইড ও করলেন।

তাদের উদ্দেশ্য ছিল সৎ। তাদের ইচ্ছা ছিল অদম্য। তারা চেয়েছিলেন প্রায় ক্ষয়িষ্ণু ইসলামের ঝান্ডা উচিয়ে ধরতে। তারা টুলস ও টেকনিক ধার করেছেন দুনিয়াবী যুক্তি, প্রজ্ঞা ও বিচার বিশ্লেষনের আলোকে। তারা ধরেই নিয়েছিলেন গনতান্ত্রিক এ মতবাদের আলোকে (১) মুসলিম মেজরিটির ভূখন্ডসমূহে 'জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যাগরিষ্ঠের' শাসন মানে অবশ্যম্ভাবীভাবে তা মুসলিম শাসন নিশ্চিত করবে। আর (২) 'সম্পদকেন্দ্রিক উন্নয়ন' আলটিমেটলী এতদাঞ্চলের মুসলিম জনগোষ্ঠিকে দিবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সাবলম্বিতা ও জীবন ধারনের নিশ্চয়তা।

স্বভাবতঃই - ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ও ক্যারিশমাটিক এ মুসলিম শ্রেনী - সাধারন মুসলিম সেন্টিমেন্ট কে যতটা এ্যাড্রেস করতে পেরেছিল, যতটা যৌক্তিকভাবে পরিবেশ ও পরিস্থিতি বিশ্লেষন করতে পেরেছিল, যতটা পরিষ্কারভাবে তাদের ভবিষ্যৎ চিত্র চিত্রায়িত করতে পেরেছিল এবং তার বিনিময়ে যতটা সাপোর্ট পেয়েছিল - টিপিক্যাল আলেম ও ওলামাশ্রেনী, যারা কোরআন ও হাদীসে অসাধারন পান্ডিত্যপূর্ন ছিলেন, তারা সাধারন মানুষের সামনে কোরান ও হাদীসের আলোকে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিবেশ ও পরিস্থিতিকে যথাযথভাবে বিশ্লেষন করে দেখাতে পারেন নি, পারেন নি এর পরিবেশ ও পরিস্থিতি নিয়ে কোন ইসলামিক ব্যাখ্যা দিতে, পারেনি তাদের সামনে যথাযথ করনীয় উপস্থাপন করতে কিংবা বলেন নি কোন বিকল্প মডেল এর কথা। ফলাফল স্বরূপ স্যেকুলার শিক্ষায় শিক্ষিত মুসলিমদের চিন্তাধারা মুসলিম সমাজে সাধারনভাবে গৃহিত হয় এবং আমরা 'গণতন্ত্রের' আবরনে 'জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সংখ্যাগরিষ্ঠের' শাসন ও 'সম্পদকেন্দ্রিক উন্নয়ন / ক্যাপিটালিজম' এর নেশায় বুদ হয়ে পড়ি।

লিটারেলী গত প্রায় একশত বছর ধরে, প্রতিদিন ই কোন না কোনভাবে মুসলিম জনগোষ্ঠি 'গণতন্ত্রে'র দাওয়াত পেয়েছে। মাঠে, ঘাটে, বাজারে, সভা সমাবেশে এমনকি পরিবারের সদস্যদের মধ্যে। গণতন্ত্রের গুনগান শুনেছে ধর্মীয় মুরুব্বী হতে শুরু করে সমাজ সংস্কারক এর কাছে। রাজনীতিবিদ হতে আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা হয়ে ভদ্র, সভ্য, শিক্ষিত, মানুষ হয়ে গন্ড, মূর্খ, চামার, কামার, কুমার এর মুখে। স্বভাবতঃই আজ গণমানুষ না জেনে, না বুঝে গণতন্ত্রকে পবিত্রায়ন পয্যন্ত করে ফেলেছে। তারা আজ বলছে (১) পবিত্র সংসদ, পবিত্র সংবিধান, পবিত্র বিচারালয় ইত্যাদি। তারা আজ তাদেরই মত মানুষকে শিরকতুল্য সম্ভোধন করছে 'মাই লর্ড' বলে। (২) তারা আজ গণতন্ত্রের নামে ডিভাইন জাতীয়তাবোধকে সাইডলাইনে পাঠিয়ে, হিজাব ও দাড়ি টুপি মুক্ত ফেইক ও মেকি জাতীয়তাবাদকে উছকে দিয়ে মুসলিমদের ইনক্লুশান আর এক্সক্লুশানের নামে বিভক্তির খেলা খেলছে। (৩) গনতন্ত্রের নামে তারা আজ সমাজের অর্বাচীন, চোর, ডাকাত ও পেশীশক্তির প্রতিভূদের - শাসন মেনে নিয়ে ইসলামিক দায়িত্ব পালন করছে বলে মনে করছে। (৪) গণতন্ত্রের নামে মুসলিমরা আজ ভূখন্ডের সার্বভৌমত্ব আল্লাহর পরিবর্তে ৩৬০ মূর্তির ন্যায় জড়পদার্থরূপী গণমানুষের কাছে হস্তান্তর করছে। (৫) ক্ষমতার উৎস আল্লাহর পরিবর্তে জনগনকে বানিয়েছে।

এমনিভাবে মুসলিমরা আজ অসংখ্যা হারামকে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনের আবরনে হালাল করা মেনে নিয়েছে, নিতে বাধ্য হয়েছে। আবার অন্যদিকে গণতন্ত্রের অন্য উপাদান 'মূলধন কেন্দ্রিক উন্নয়নের' নামে 'সুদ' 'জুয়া' 'লটারী' সহ ঘুষ, দূর্নীতি, কমিশন, চাঁদাবাজি, মজুতদারী ইত্যাদি সব কিছুকে স্বাভাবিক বিবেচনা করা হচ্ছে।

গনতন্ত্রের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে পবিত্রায়ন কিংবা মানুষকে লর্ড এ রূপান্তর কিংবা সুদ, জুয়া, দূর্নীতি ইত্যাদির যে নিরব গ্রহনযোগ্যতার কালচার ও ট্রেন্ড আজ সমাজে প্রতিষ্ঠিত - তার স্বপক্ষে কি আমরা কোন সিম্পল, গ্রহনযোগ্য যুক্তি কিংবা ফ্যাক্টচ্যুয়াল দৃষ্টান্ত দেখিয়ে ইসলাম দিয়ে জায়েজ করতে পারবো?

অথচ এর ফলাফল হয়েছে আজ সাধারন মুসলিম জনগোষ্ঠি গণতন্ত্রকে ইসলামের চেয়ে অধিক টেকসই, অধিক প্রাগমাটিক, অধিক সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করে। কে জানে স্যেকুলার ধর্মনিরপেক্ষ পরিচয় দেওয়া মুসলিমরা হয়তো অবচেতন মনে এ বিশ্বাসই পোষন করে যে, গণতন্ত্রের ধ্বজ্জাধরে তারা আখেরাতেও পার পেয়ে যাবে। এ্যাটলিস্ট ধর্মনিরপেক্ষ নেতানেত্রীর কিছু মন্তব্য আমাকে এমন কমেন্ট যোগ করতে বাধ্য করছে।

মূলতঃ এ সব হয়েছে কারন আমরা মুসলিমরা গণতন্ত্র নামক এ নেশায় নেশগ্রস্থ হয়েছি। আমরা ইহলৌকিক সমাধান কে নিয়েছি পারলৌকিক সাফল্য নিশ্চিত করতে। যার কারনে বছরের পর বছর - এ জনগোষ্ঠির কান্ডারীরা অতি কষ্টে এবং অতি সব মানবীয় ত্যাগ স্বীকার করে ইটের উপর ইট সাজিয়ে জনসেন্টিমেন্ট এর বিরাট প্রাসাদোপম অট্টালিকা নির্মান করেও সাফল্য নিশ্চিত করতে পারেনি, উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

বরং আমরা দেখছি পৃথিবীর নিকৃষ্টতম শারীরিক ও মনস্তাত্বিক নির্যাতন, নিষ্পেষন ও বঞ্চনার রোলার চালানো হচ্ছে পৃথিবীর পূর্ব হতে পশ্চিমে, উত্তর হতে দক্ষিনে।

অথচ কোরআন আমাদেরকে বলছে, 'আমাদের পরিচালনার জন্য, আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যান তথা সাফল্য নিশ্চিতের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা অবশ্যই এ কোরআনে বিবৃত হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা মহানবীর সুন্নাহ বা হাদীসে রয়েছে।' আমরা কেন তাহলে কোরআন ও হাদীসের আশ্রয় না নিয়ে, কোরআন ও হাদীসে পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে, পর্যাপ্ত গবেষনা ও বিচার বিশ্লেষন না করে - 'হেকমাহ' নামক বিষয়টিকে তুলনামূলক অধিক প্রধান্য দিয়ে তথা অবতারনা করে কোরআন ও হাদীসকে পাশ কাটিয়ে কিংবা সাইডলাইনে রেখে 'কম্প্রোমাইজ' এর নামে, বাস্তবতার নামে - গণতন্ত্র নামক সুবিধাবাদী, প্রতারনাপূর্ন, বহুমতের সংমিশ্রনে নির্যাতন ও নিপীড়নের এক হাতিয়ার কে আকড়ে ধরে থাকবো?

আমরা সবাই পরিষ্কারভাবে আখেরী জামানা তথা শেষ সময় সম্পর্কে জানি, এর সিম্পটম কি ও কেমন হবে তা ও জানি - অথচ আমরা তা (ডিসিপশান/প্রতারনা) প্রতিনিয়ত দেখার পর ও - আমাদের কাজ কর্মে তার যেন প্রতিফলন করছি না। আমরা পৃথিবীর চুড়ান্ত প্রতারনাপূর্ন একটা ব্যবস্থা 'গনতন্ত্রের বাণী বুকে পিঠে লিখে' শয়তান ও দজ্জালের মানুষ রূপী এজেন্ট এর গুলি খাচ্ছি।

সম্প্রতিক সময়ের আফগানিস্থান, ইরাক, লিবিয়া, মিশর, বাংলাদেশ, ইমিডিয়েট আগের সাউথ সুদান, ইস্ট তিমুর - আর তা-রো আগের কাশ্মীর, ফিলিস্থিন কিংবা উইগুর মুসলিমদের পশ্চিম চীন এর সাথে সম্প্রতিক সময়ের ক্রিমিয়া নিয়ে গণতান্ত্রিক চিন্তা ও চেতনাকে বিশ্লেষন করলে 'গনতন্ত্র' তথা 'সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন' কিংবা 'সম্পদকেন্দ্রিক উন্নয়ন' এর আদৌ কি কোন সেন্স তৈরী করে? না কি পুরো কনসেপ্টটাকেই প্রতারনাপূর্ন এক জীবন্ত জালিয়াতি মনে হয়? ডেসটিনি ২০০০ যেমন মানুষকে প্রজেক্ট দেখিয়ে কনভিন্স করে প্রতারনা করে ঠিক তেমনি, গনতন্ত্র নামক এ প্রজেক্ট 'সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ও মূলধনকেন্দ্রিক উন্নয়নের' ফানুস দেখিয়ে সাধারনমানুষকে 'চুড়ান্ত দাস' এ পরিনত করছে। যা আখেরী জামানার আর একটি সাইন।

বিষয়: বিবিধ

১৩৪৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

201057
৩১ মার্চ ২০১৪ রাত ১১:১৭

A PHP Error was encountered

Severity: Notice

Message: Undefined offset: 7238

Filename: views/blogdetailpage.php

Line Number: 764

"> রায়হান রহমান লিখেছেন : অথচ কোরআন আমাদেরকে বলছে, 'আমাদের পরিচালনার জন্য, আমাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক কল্যান তথা সাফল্য নিশ্চিতের জন্য যা কিছু প্রয়োজন তা অবশ্যই এ কোরআনে বিবৃত হয়েছে এবং তার ব্যাখ্যা মহানবীর সুন্নাহ বা হাদীসে রয়েছে।

হুম!! আল্লা রসুলের ready made মলম তত্বের মর্ম কেউ বুঝে না!!!!!!
255403
১৮ আগস্ট ২০১৪ সকাল ০৭:৪৪
বুড়া মিয়া লিখেছেন : আমার দৃষ্টিতে গণতন্ত্র আসলে মুষ্টিমেয় দু’দল লোভী মানুষকে একতাবদ্ধ করে প্রমোট করার ব্যবস্থা, যাতে সাধারণ মানুষ-কে ভোটাধিকারের মূলা দিয়ে এক্সপ্লয়েট করে তাদেরকে দাস-দাসী হিসেবে লোভী-দু’দলের লাভজনক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোয় নিযুক্ত রেখে যুগের পর যুগ ডমিনেট করে যাবে।

সারাবিশ্বেই কিন্তু একই চিত্র – গণতন্ত্রের ধারক-বাহকদের হাতেই একটা দেশের সমস্ত বিজনেস এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা; নিরপেক্ষভাবে কেউ সেখানে প্রতিষ্ঠিতই হতে পারে না - বড়জোর একটু ভালো বেতনের দাস-দাসী হিসেবে তাদের অধীনে খেটে খেতে পারে!
১৯ আগস্ট ২০১৪ রাত ০৩:৪৬
199377
সাদাচোখে লিখেছেন : যথার্থ বলেছেন।

মাস ৬/৭ আগে আমার এক সাদা চামড়ার বন্ধু অনেকটা এমন করেই বলেছিল। অতিরিক্ত যা ছিল তা মূলতঃ কিছু ফ্যাক্টস ও ফিগার।

ওদের দূর্ভাগ্য এই যে - ওদের সামনে গনতন্ত্রের বিকল্প কোন কিছু নেই, না মডেল না থিউরী। সো তারা চেষ্টা করছে গণতন্ত্র ও ক্যাপিটালিজম কে হিউমেইন করতে, মানবীয় করতে।

কিন্তু আমাদের সামনে আলহামদুলিল্লাহ একটা প্রুভেন তত্ত্ব আছে, প্রুভেন এ্যাক্সাম্পল ও আছে। শুধু দরকার এক দল স্কলারের ঐ প্রুভেন তত্ত্ব ও এক্সাম্পল এর আলোকে যথাযথ গবেষনা করা, এবং আজকের যুগোপযুগী রূপরেখা পেশ করা। যাতে করে তা জনগনের সামনে বিকল্প হিসাবে উপস্থাপন করা যায় আর সব শেষে তা বাস্তবায়নের জন্য যা দরকার সব করতে আহ্বান জানানো।

কিন্তু আমরা উদ্ভাবন করতে চাইনা, গবেষনা করতে চাইনা। আমরা এখন অনুকরণ করতে চাই - স্বভাবতঃই আমাদের কপালে এই জন্য কৃতদাসের বেড়ী দিনকে দিন আরো শক্ত হয়ে চেপে বসছে।

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File