আমিও সুবিচার পাওয়ার আশা করি আল্লাহর আদালতে।
লিখেছেন লিখেছেন বাংলাদেশ টাইমস্ ৩০ অক্টোবর, ২০১৪, ০৫:২৫:২৭ বিকাল
প্রিয় বোন রিহানি জাবেরি,
আল্লাহ তোমাকে জান্নাতের জন্য কবুল করুন। আমিও তোমার মত আল্লাহর আদালতে তোমার সুবিচার পাওয়ার আশা করি। জানিনা তোমার দেশ ইরান আমাদের দেশের মত অবিচার সুলভ রায় কিভাবে দিল! তোমার অপরাধ তুমি ধর্ষেণর হাত থেকে বাঁচতে ছুরি মেরেছিলে গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রনালেয়র সাবেক এক কর্মকর্তাকে। আর তাতে সে কুলাঙ্গার নিহত হয়। আমি জানিনা, তোমাকে ওই অবিচারকারী বিচারক বলেছে কিনা তাকে ছুরি না মেরে কিভাবে তার হাত থেকে রক্ষা পেতে পারতে।আমি ধিক্কার জানাই সেই সকল বিচারকদের যারা সত্যেক মিথ্যা আর মিথ্যাকে সত্য রায় বানায়। দোষীকে নির্দোষ বানায় আর নির্দোষকে বানায় দোষী । শেষ বিচারের দিনের জন্য তুমি যাদের অভিযুক্ত করেছ, তাদের পাশাপাশি আমি তেমার দেশের রাষ্ট্র ও ধর্মীয় নেতাগণকেউ অভিযুক্ত করছি, কারণ তারা অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি।
সেই সাথে অভিযুক্ত করছি আমার দেশের রাষ্ট্রকে যারা জোর করে ক্ষমতায় আছে এবং অন্যায়ভাবে গুম-খুন ও হত্যা করছে। বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করছে নির্দোষ ব্যাক্তিদের, এরপর করছে উল্লাস। যারা নৃত্য করে লাশের উপর। আরও অভিযুক্ত করছি সেই সকল বিচাকদের যারা তোমার উপর অবিচারকারীদের মতই ন্যায়নীতি ও আইনকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে এসকল অন্যায়ের প্রধান সহযোগী হচ্ছে।–আমি আশা করি, তোমার মত আমিও শেষ বিচারের দিন আল্লাহর আদালতে সুবিচার পাব।
>>>রিহানি জাবেরিকে ২২ অক্টোবর ফাঁসি দেয়া হয় গোয়েন্দাবিষয়ক মন্ত্রনালেয়র সাবেক এক কর্মকর্তাকে হত্যার দায়ে। তার মাকে লেখা তার শেষ চিঠি।<<<
প্রিয় শোলেহ,
আমি আজ জানতে পারলাম আমার কিসাসের (হত্যার বদলে হত্যা) মুখোমুখি হওয়ার সময় হয়ে গেছে। কষ্ট পেয়েছি এই ভেবে যে, আমার জীবনের শেষ পাতায় পৌঁছে যাওয়ার খবরটা তুমি নিজের মুখে আমায় জানাওনি। তুমি কি ভাবোনি, এটা আমার জানা উচিত ছিল? তুমি দুঃখ পেয়েছো শুনে আমি ভীষণ লজ্জা পাচ্ছি। আর তোমার আর বাবার হাতে কেন আমায় চুমু খেতে দাওনি?
এই পৃথিবী আমাকে ১৯ বছর বাঁচতে দিয়েছে। আমাকে হত্যা করা হতে পারে জানলে সেই অভিশপ্ত রাতেই তো আমার মরে যাওয়া উচিত ছিল। আমার মৃতদেহ ছুড়ে ফেলার কথা ছিল শহরের কোনো অজ্ঞাত কোণে। কয়েকদিন পর পুলিশ তোমাকে ডেকে নিতো তাদের অফিসে। তখন তুমি আমার লাশ শনাক্ত করতে। আর এটাও জানতে পারতে যে হত্যার আগে আমাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। হত্যাকারী কখনোই ধরা পড়ত না, কারণ আমাদের না আছে অর্থ, না ক্ষমতা। তারপর বাকি জীবনটা সীমাহীন শোক ও অসহ্য লজ্জায় কাটিয়ে কয়েক বছর পর তোমারও মৃত্যু হতো। এটাই তো হওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু কীভাবে যেন গল্পটা বদলে গেল। শহরের কোনো গলি নয়, আমার শরীরটা প্রথমে ছুড়ে ফেলা হল এভিন জেলের নিঃসঙ্গ কুঠুরিতে, আর সেখান থেকে কবরের মতো এই শাহর-এ রায় কারাগারের সেলে। কিন্তু এ নিয়ে অনুযোগ কর না মা, এটাই নিয়তির বিধান। আর তুমি তো জানো যে মৃত্যুতেই জীবন শেষ হয়ে যায় না।
মাগো, তুমিই তো শিখিয়েছ পৃথিবীতে অভিজ্ঞতা লাভ ও শিক্ষা পাওয়ার জন্যই মানুষের জন্ম হয়। প্রতিটি মানুষই নিজের দায়িত্ব নিয়েই পৃথিবীতে আসে। আমি আরও শিখেছি, মাঝে মাঝে লড়াইও করতে হয়। তুমি আমাকে আরও শিখিয়েছ, সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে হলে অধ্যবসায় প্রয়োজন। তার জন্য যদি মৃত্যুও আসে, তাকেই মেনে নিতে হয়। স্কুলে যাওয়ার সময় তুমি শিখিয়েছিলে, নালিশ ও ঝগড়াঝাটির মাঝেও যেন নিজের নারীসত্তাকে বিসর্জন না দিই। তোমার মনে আছে মা, কত যতœ করেই না মেয়েদের খুঁটিনাটি আচার ব্যবহার শিখিয়েছিলে আমাদের? কিন্তু তোমার অভিজ্ঞতা ভুল ছিল, মা। কেননা এই ঘটনার সময় তোমার দেয়া কোনো শিক্ষাই আমার কাজে লাগেনি। আদালতে আমায় এক ঠাণ্ডা মাথার খুনি এবং নিষ্ঠুর অপরাধী হিসেবে পেশ করা হয়। কিন্তু আমি এক ফোঁটা চোখের জল ফেলিনি। তাদের কাছে কোনো করুণা ভিক্ষা করিনি। আমি কাঁদিনি, কারণ আইনের প্রতি আমার গভীর আস্থা ছিল। সেই আমিই কিনা খুনের দায়ে অভিযুক্ত হলাম। মা, তুমি তো জান, আমি তো কখনো একটা মশাও মারিনি। আরশোলাদের জুতো দিয়ে না পিষে শুঁড় ধরে জানালার বাইরে ফেলে দিয়েছি। সেই আমিই নাকি ঠাণ্ডা মাথায় মানুষ খুন করেছি!! উল্টো ছোটবেলার ওই কথাগুলো শুনে বিচারপতি বললেন, আমি নাকি মনে মনে পুরুষালি। তিনি একবার চেয়েও দেখলেন না, ঘটনার সময় আমার হাতের লম্বা নখের ওপর কী সুন্দর নেলপলিশের জেল্লা ছিল। হাতের তালু কত নরম তুলতুলে ছিল। সেই বিচারকের হাত থেকে সুবিচার পাওয়ার আশা অতি বড় আশাবাদীও করতে পারে কি? তাই তো নারীত্বের পুরস্কার হিসেবে মাথা মুড়িয়ে ১১ দিনের নির্জনবাসের হুকুম দেয়া হল। দেখেছ মা, তোমার ছোট্ট রেহানা এই ক’দিনেই কতটা বড় হয়ে গিয়েছে?
আমার দয়ালু মা, প্রিয় শোলেহ, তুমি আমার জীবনের চেয়েও প্রিয়। আমি চাই না মৃত্যুর পর আমার এই দেহ মাটিতে পচে যাক। এটাও চাইনা আমার চোখ বা তাজা হৃদয় ধুলোয় মিশে যাক। তাই অনুরোধ, আমার হৃদপিণ্ড, কিডনি, চোখ, হাড্ডি এবং অন্যান্য অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা কর। যাতে এ পৃথিবীর অন্য কোনো মানুষ এগুলো থেকে উপকৃত হয়। তাদের জন্য এগুলো হবে আমার উপহার। তবে আমি যাদের দেহে এসব অঙ্গ প্রতিস্থাপিত হবে তাদের কাছে যেন আমার নামটি গোপন রাখা হয়। আমি চাই না এর জন্য আমার সমাধিতে কেউ ফুলের তোড়া রেখে আসুক। কিংবা গোরস্থানে গিয়ে প্রার্থনা করুক। এমনকি তুমিও না। আমি চাই না আমার কবরের সামনে বসে কালো পোশাক পরে কান্নায় ভেঙে পড় তুমি। বরং আমার দুঃখের দিনগুলো তুমি ভুলে যেও। সেসব স্মৃতি ভাসিয়ে দিও হাওয়ায়।
এই দুনিয়া আমাদের ভালোবাসেনি, মা। চায়নি আমি সুখী হই। এখন আমি মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে চলেছি। তবে আল্লাহর আদালতে আমি সুবিচার পাবই। সেই আদালতে দাঁড়িয়ে আমি অভিযোগ করব পুলিশ ইন্সপেক্টর শামলোউ, আদালতের বিচারক এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকদের বিরুদ্ধে। তারা আমাকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে এবং নানাভাবে হয়রানি করতেও পিছুপা হয়নি। সেদিন আমি আরও অভিযোগ করব আদালতের স ষ্টা ডা. ফারবেন্দি এবং কাসেম শাবানির বিরুদ্ধেও। কারণ তারা আমার অধিকার বুটের নিচে পিষে দিয়েছে, বিচারের নামে মিথ্যা ও অজ্ঞানতার কুয়াশায় সত্যকে আড়াল করেছে। একবারও বোঝার চেষ্টা করেনি, চোখের সামনে যা দেখা যায় সেটাই সর্বদা সত্যি নয়। আমার নরম দিলের মা, মনে রেখো সেই দুনিয়ায় তুমি আর আমি থাকব অভিযোগকারীর আসনে। আর ওরা দাঁড়াবে আসামির কাঠগড়ায়। দেখি না, আল্লাহ কী চান! মাগো, মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত আমি তোমাকে জড়িয়ে রাখতে চাই। মা, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি!
বিষয়: বিবিধ
১৩৩৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন