শাহদাতের তামান্নায় উদ্ভাসিত এক যুবক
লিখেছেন লিখেছেন সালাহ আদ দীন ০৫ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:১১:৫২ রাত
মরুভুমির বেদুইন। ৬ ফুট ৯ ইঞ্চির দীর্ঘদেহী এক টগবগে যুবক! তীক্ষ্ণ তার চাহনি! অসীম তার সাহস! ঘোড়া নিয়ে ছুটে বেড়ান মুরুভুমির ধুলা উড়িয়ে। যেন মরুভুমির সাইমুম। বিরুধিদের কাছে তিনি এক আতঙ্কের নাম। যুবক তো নয় যেন সাহসের পর্বত। ধিরে ধিরে তার নাম ছড়িয়ে পড়ছে মরুভুমির আনাচে কানাছে। যিনি জীবনের কোন যুদ্ধেই পরাজিত হননি! পৃথিবীর ইতিহাসে অপরাজিত এক সেনাপতি। আল্লাহ্র রাসুল তার নাম দিয়েছিলেন সাইফুল্লাহ! আল্লাহ্র তরবারি। যিনি প্রতিটি যুদ্ধ করতেন শহীদ হবার প্রচণ্ড আকাঙ্ক্ষা নিয়ে।
তখনও তিনি ইসলাম ধর্মের ছায়াতলে আসেননি। মুসলমানদের সামনে তখন বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা! উহুদ যুদ্ধ! সংখ্যায় মুসলমানরা হাতে গোনা কয়েকজন। কাফেররা বিশাল বাহিনী নিয়ে আক্রমন করল মুসলমানদের উপর! সেনাপতি যুদ্ধের ময়দান ভাগ করলেন। করলেন অত্যান্ত সুচতুর ভাবে! যেন কাফেরদের শায়েস্তা করা যায়। মূল বাহিনীর ব্যাকআপ রাখা হল আরেকটা বাহিনীকে! তীরন্দাজ বাহিনী! নির্দেশ দেয়া হল পাহাড়ের উপর অবস্থান করে শত্রু পক্ষের উপর নজর রাখবেন তারা। যেন কাফেরেরা পেছন দিক থেকে পাল্টা আক্রমন করতে না পারে। শুরু হল যুদ্ধ! সত্য মিথ্যার লড়াই। একদিকে কাফেরদের হুঙ্কার আর সখ্যার বড়াই আর অন্য দিকে শহীদ হয়ে আল্লাহ্র সান্নিধ্য পাবার জন্যে ক্ষুধার্ত একদল সৈনিক। হাতে নেই ভাল একটি অশ্র কিন্তু বুকে আছে ঈমানের জোর! আল্লহু-আকবার ধ্বনিতে প্রকম্পিত উহুদের ময়দান। সৈন্যরা ছুটছেন সামনে দিকে! হাতের শাহদাত আঙুল উচিয়ে ঘোষণা করছেন, আশহাদু আল্লাহ্ ইলাহা ইল্লালাহ্!! কাফেরেরা আর দাড়াতে পারেনি। ছত্রভঙ্গ আর সঙ্গীদের হারিয়ে যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে! বিজয় নিশ্চিত!! করে বসলেন ব্যাকাপে থাকা সৈনিকেরা। নিশ্চিত বিজয় যেনে সেনাপতির নির্দেশের অপেক্ষা না করেই নেমে এলেন ময়দানে! সেই সুযোগটাই নিলেন খালিদ বিন ওয়ালিদ! মুহূর্তের ভিতরে তছনছ করেদিলেন মুসলিম শিবির! মিনিট আগে যেখানে ছিল যুদ্ধ বিজয়ের উল্লাস! মিনিট পরেই সেই ময়দান মৃত্যুপুরী বানিয়ে দিলেন এই যুবক! কে সেই যুবক? কি তার পরিচয়! যুবকের নাম খালিদ বিন ওয়ালিদ।
এর পরে আল্লাহ্র রাসুল তাকে নিয়ে এলেন ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে। ইসলামের ছায়াতলে এসে ভুলেগেলেন মৃত্যু ভয়! মুসলমানদের মৃত্যু ভয় নেই! মৃত্যু যে তাদের জান্নাতে যাবার সোপান! তরবারি হাতে নিয়ে ছুটেন একটা নেশায়! শহীদ হতে হবে। বড় আকাঙ্ক্ষা তার! তার সামনে দাঁড়াবার সাহস নেই কোন কাফিরের! তিনি যেন এক সাইক্লুনের নাম! তিনি যেন বিশাল প্রাচীর!! মিনিটেই শত্রু শিবির তছনছ করে দিতে পারেন তিনি!
ইসলামের খলিফা তখন আবুবকর (রাঃ)। সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদ। পৃথিবীতে তখন রোমানদের রাজত্ব! সেই রোমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ! খলিফার দরবারে ডাকা হল সেনাপতিকে! লক্ষাদিক রোমান সৈন্যের বিরুদ্ধে কতজন সৈনিক আর অশ্র চান সেনাপতি? সেনাপতি যখন খালিদ বিন ওয়ালিদ তখন উত্তরটাও হবে সেই রকম! তিনি দাঁড়িয়ে বললেন, মুসলমানরা সংখ্যা, অশ্র আর শক্তি দিয়ে যুদ্ধ করেনা। করে ঈমান দিয়ে! ঐ বাহিনীর জন্যে আমি একাই যথেষ্ট!! ইসলামী আন্দোলনের একজন সৈনিকের উত্তর এর চেয়ে ভাল আর কি হতে পারে! যারা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করার জন্যে আল্লাহ্র রাস্তায় ঝাপিয়ে পড়ে।
যুদ্ধের ময়দানে যে দিকে তিনি তার তরবারি তুলেছেন সেই দিকেই তুফানের বেগে সব কিছু তচনচ করে দিয়েছেন। যুদ্ধের ময়দানে তিনি মানে নিশ্চিত বিজয়। তিনি নিজেই যেন এক তরবারি। বেশির ভাগ সময়েই চারদিক থেকে শত্রু সৈন্য দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়েই যুদ্ধ করেছেন পৃথিবীর ইতিহাসে অপরাজিত এই জেনারেল!
খলিফা আবু বকর ইন্তেকাল করলেন। খলিফা তখন উমর! এই সেই উমর যিনি আল্লাহ্র রাসুল কে হত্যা করার জন্যে তরবারি হাতে ছুটে গিয়েছিলেন। এই সেই উমর যিনি ইসলাম আনার পরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, আজ থেকে আর লুকিয়ে নয় প্রকাশ্যেই নামাজ আদায় করা হবে কাবা শরিফে! এই সেই উমর যিনি মদ্য পানের অপরাধে নিজের সন্তানকে বেত্রাঘাত করেছিলেন! সন্তান মারা গেলেন! তখনও কয়েকটি বেত্রঘাত বাকি! সন্তানকে কবরে শুইয়ে কবরের উপরে বাকি বেত্রাঘাত গুলো করলেন! এই সেই উমর যার সময়ে অর্ধেক পৃথিবী মুসলমানরা শাসন করত! খালিদ তখন যুদ্ধের ময়দানে! তিনি সেনাপতি! হাজার হাজার সৈনিক তখন তার অধীনে! যুদ্ধের ময়দানে খলিফা দুত পাঠালেন! খালিদ তুমি আর সেনাপতি নয়! সেনাপতি থেকে তোমাকে অভ্যাহতি দেয়া হয়েছে! এখন থেকে সাধারণ সৈনিক হয়েই যুদ্ধ করতে হবে তোমাকে! আজ থেকে আবু উতাইবা মুসলমানদের সেনাপতি। যে উতাইবা তার নিচের সারির একজন সৈনিক! সেই উতাইবার অধীনে যুদ্ধ করতে হবে তাকে! জীবনের কোন যুদ্ধে যেই জেনারেল পরাজিত হননি সেই জেনারেল খলিফার নির্দেশ পালন করলেন। একটা টু শব্দও করলেন না! সেনাপতি থেকে হয়ে গেলেন একজন সাধারণ সৈনিক!
ইয়ারমুকের যুদ্ধ! হেরিক্লিয়াসের দরবারে ডাক পড়ল মুসলমান সৈনিকদের! কথা বলতে চান হেরিক্লিয়াস! খালিদ বিন ওয়ালিদ আরও কয়েকজন সৈনিক নিয়ে বীর দর্পে লক্ষ লক্ষ সৈনিকদের বেতর দিয়ে গেলেন! যে হেরিক্লিয়াস চেয়েছিল তার ক্ষমতা, সংখ্যা আর সম্পদের প্রাচুর্য দেখিয়ে মুসলমান সৈন্যদের মনবল ভেঙে দেবে সেই হেরিক্লিয়াসের মনবল ভেঙ্গেদিলেন খালিদ! হেরিক্লিয়াস ঘোষণা করল এখনই তোমাদের সামনে তোমাদের কয়েকজন বন্ধিকে হত্যা করা হবে! জ্বলে উঠলেন খালিদ! তার চোখ মুখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি বেরিয়ে এলো! সাবধান! একজন সৈনিকের শরীরে হাত দিলে একজনও প্রান নিয়ে এখান থেকে বের হতে পারবেনা! হুঙ্কার দিলেন খালিদ! খালিদের হুঙ্কারে সিংহের গর্জন শুনল হেরিক্লিয়াস! একটা টু শব্দও করার সাহস পেলনা সে! বীর দর্পে চলে এলেন খালিদ! এই ছিল তার সাহস! এই ছিল তার বীরত্বের নমুনা!
আল্লাহ্র রাসুল শহীদদের মর্যাদার কথা যখন বর্ণনা করতেন তখন খালিদ বড় চঞ্চল হয়ে উঠতেন! আহা কবে আমি শাহদাতের পেয়ালা পান করব! কবে জাফর, সুমাইয়াদের মত জান্নাতে উড়ে বেড়াব! প্রতিটা যুদ্ধের ময়দান থেকে ফিরে আসেন বিজয় নিয়ে তবুও কিছু একটা না পাওয়ার শুন্যতা কাজ করে তার মাঝে! শাহদাত মৃত্যু!
মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে, খালিদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) এর সাথে দেখা করতে এলেন তারই এক বন্ধু। বন্ধুটি তার শয্যার পাশে বসলেন। খালিদের মন খুব খারাপ! তিনি যে শহীদ হতে পারেননি! "তুমি কি আমার পায়ে এমন এক বিঘত পরিমাণ কোন খালি জায়গা দেখতে পাচ্ছ, যেখানে কোন তরবারি, তীর বা বর্শার আঘাত নেই?” বড় অসহায়ের সাথে জিজ্ঞেস করলেন খালিদ! কণ্ঠ বড় ব্যাকুল তার!
বন্ধু পা পরীক্ষা করলেন, না! কোন খালি জায়গা নেই! খালিদ প্রথমে তাঁর ডান হাত ও পরে বাম হাত উঠিয়ে দেখিয়ে তাকে অনুরূপ পরীক্ষা করতে বললেন। বন্ধুটি একই ফলাফল বললেন।
এরপর খালিদ তাঁর প্রশস্ত বক্ষ উন্মুক্ত করে তাঁর বন্ধুকে একইভাবে জিজ্ঞেস করলেন। বন্ধুটি আবারো সেই একই দৃশ্য দেখলেন যা প্রথমবার পায়ের ক্ষেত্রে দেখেছিলেন। বড় ব্যাকুল তিনি! “তুমি কি দেখনি? আমি শহীদের আকাঙ্ক্ষা নিয়ে শত শত যুদ্ধ করেছি, কেন আমি যুদ্ধে শহীদ হলাম না?”
বন্ধু তাকে সান্তনা দেন! “তোমার এটা বুঝতে হবে, হে খালিদ! আল্লাহর রাসূল(সাঃ) তোমার নাম রেখেছেন ‘সাইফুল্লাহ’ অর্থাৎ ‘আল্লাহর তরবারি’, তিনি এটা আগেই নির্ধারণ করে গেছেন যে তুমি কোন যুদ্ধে পরাজিত হবে না। কারণ, তুমি যদি পরাজিত হতে তাহলে সবাই এটা বুঝাতো যে আল্লাহর তরবারি কাফিরদের আঘাতে ভেঙ্গে গেছে, আর যা কখনো ঘটবে না!”
শাহদাতের অমন তামান্না নিয়েই পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন ইতিহাসের অপরাজিত এই জেনারেল! তারই বিজিয় করা সিরিয়ায় শায়িত আছেন তিনি! আসুন আমরা সকলে প্রান ভরে দোয়া করি আল্লাহ্ যেন তাকে শাহদাতের মর্যাদা দান করেন!
বিষয়: সাহিত্য
১৯৬৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন