মায়ের জন্য ভালোবাসা, রক্তে লেখা চিঠি।
লিখেছেন লিখেছেন এস আর চৌধুরী ১০ মে, ২০১৩, ০৫:১৮:৩৭ বিকাল
নয়ন।
প্রতিদিনের মতো আজও তার রুটিন মাফিক তাড়াহুড়া। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। তাকিয়েই বুঝলো, মায়ের ফোন। বাড়ির পাশের সবুজের দোকান থেকে মা প্রায়ই ফোন করেন।
হ্যালো, মা! তুমি কেমন আছো?
ব্যাকুল কন্ঠে নয়ন মায়ের কাছে জানতে চায়।
জ্বি বাবা, আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছো বাবা? তোমার শরীরটা কেমন? তোমার চাকরিটা? রাতে কি খেয়েছো বাবা? সকালে এখনও খাও নি? আরো কতো কি!
হাজারো লাগাতার উৎকন্ঠা আর প্রশ্নের মাঝে নয়ন মাকে থামিয়ে দেয়।
তুমি মোটেও ভেবো না মা! আমি এখন অনেক বড় হয়েছি না! আমি কি এখনও তোমার সেই ছোট্ট শিশুটি, বলো? আমি বেশ আছি। আমি বেশ আছি, মা! এভাবে মাকে শান্তনা দেয় নয়ন।
মা, তোমার ঔষধ কি শেষ হয়েছে? শ্বাস কষ্টটা এখন কেমন? নয়ন মাকে প্রশ্ন করে।
ঔষধ দুই এক দিন চলবে, বাবা। শ্বাস কষ্টটা আগের মতোই। মা উত্তর দেয়।
তুমি চিন্তা করো না, মা। ঔষধ শেষ হবার আগেই আমি টাকা পাঠিযে দেবো। দেখো তোমার কোন অসুবিধা হবে না।
ঠিক আছে মা, রাখি! বলেই ফোনটি রেখে দেয় নয়ন।
ফোনটা রেখেই নয়ন চলে কর্মক্ষেত্রের দিকে, জীবন যুদ্ধে। প্রতিদিনের মতো, প্রতি সকালের মতো। সেই ‘রানা প্লাজা’। সাভারের ‘রানা প্লাজা’।
সকাল ৯টা বাজে বাজে। হাজারো মেশিনের চলার ছন্দে বেজেই চলেছে যুদ্ধের দামামা। হাত আর পায়ের অপূর্ব তালে মাত্রা পেয়েছে কাজের গতি। এখনও মায়ের আদর আর উৎকন্ঠার মধুমাখা কথাগুলি মানস পটে বারবার বিমূর্ত হয়ে উঠছে। মাকে নিয়ে ভাবনা গুলো মেলছে পাখা প্রজাপতির মতো। এইতো সে দিন, মা ফোন করে বলল কত কি! একটা মেয়ে নাকি তার খুব পছন্দ হয়েছে। ডাগর ডাগর চোখ, মিষ্টি মিষ্টি কথা। চাহনিতে যেন মায়ার সাগর। ....
হঠাৎ বিদ্যুৎটা চলে গেলো। ছন্দগুলো মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়। ভাবনা গুলো মহাশুন্যে। ঘর্ঘর্ শব্দে চালু হলো জেনারেটরগুলো। বাতি আর মেশিনগুলো আবার জীবন ফিরে পেলো। কিন্তু ফিরলো না সেই আগের পরিবেশটা। জেনারেটরের শব্দগুলো বিরক্তিকর হয়ে কানে বাজতে লাগলো।
দ্রুম্ দ্রুম্ দ্রুম্, শব্দ হলো! নয়ন তাকালো এদিক ওদিক। চারদিকে হৈচৈ, হুড়াহুড়ি। বাবারে, মারে, বাঁচাও, বাঁচাও বলে প্রচন্ড চিৎকার চেঁচামেচি। পঙ্গপালের মতো, উদ্ভ্রান্ত পাগলের মতো ছুটছে সবাই সিঁড়ির দিকে।
দেখতে না দেখতে চোখের সামনেই ভেঙ্গে পড়লো দক্ষিন দিকের ছাদটি। চড়চড় করে ফেটে গেলো, ধুলো-বালিতে সবকিছু অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে গেলো। পঙ্গপালের অর্ধেকটা যেন আটকা পড়ে গেলো সেখানে। বেরিয়ে আসলো হাজারো কন্ঠের আর্তনাদ। নয়ন উঠে দৌড়নোর চেষ্ঠা করলো। শত শত সহকর্মীর ভিড়ে চেষ্ঠা শুধু চেষ্ঠাই থেকে গেলো। বাকি ছাদটিও ধসে গেলো। অন্ধকারে ছেয়ে গেলো সবকিছু। মর্মর্ করে মাথা গুলো পিষ্ঠ হলো। দেহ গুলো চাপা পরে গেলো ছাদের নিচে। নিভে গেলো অনেক জীবন প্রদীপ। তখনও বেঁচে থাকলো কিছু প্রানের আকুল আকুতি।
তার একদিন পর। নয়নের কিছুটা জ্ঞান ফিরলো। নিজেকে আবিষ্কার করলো এক ধ্বংসস্তুপের নিচে। বুঝতে পারলো না কত শত টন ইট-পাথরের বোঝা তার উপরে। পা দু’টি তার থেতলে গেছে বীমের চাপায়। বাম হাতটি ঢুকে আছে ভাঙ্গা দেয়ালের ফাঁকে। মাথাটি আটকানো ছাদের চাপায়। ক্ষত-বিক্ষত দেহটি থেকে রক্ত ঝড়ছে তখনও। অনুভুতিটা কেমন যেন ভোঁতা ভোঁতা লাগছে। নয়ন বুঝলো, সে মরেই গেছে।
চারদিকে সব লাশ আর লাশ। রক্তের স্রোতে একাকার। এক জনের মাথা আর জনের পায়ের কাছে। কোথাওবা এক সংগে অনেকগুলো নিথর দেহ একই সুতোয় গাঁথা। মাঝে মধ্যে দু’একটি মৃদু গোঙ্গানীও সে অনুধাবন করতে পারছে। তার আর বুঝার বাকী রইলো না, সে মৃত্যুর কত কাছাকাছি। সে এখন পরমকরুণাময়ের পথে।
সে কিছু ভাবার চেষ্ঠা করলো। মনে পড়লো মায়ের কথা। সাথে সাথে কোথায় যেন চিন্ চিন্ করে উঠলো। বুঝলো, আত্নাটা এখনও জেগে আছে, হৃদয়টা এখনও মরেনি তার। এখনও মায়ের জন্য হৃদয়টা কাঁদছে। সে ঠিকই মনে করতে পারছে মায়ের স্মৃতি। মায়ের আদর আর ভালোবাসাগুলো এখনও হাতছানি দিচ্ছে। মায়ের স্বপ্নগুলো এখনও ভাবতে পারছে। মনে পরলো সদ্য সকালের কথা গুলোও। ঔষধতো এখনও কেনা হয়নি। মা হয়তো অপেক্ষায় আছে। শ্বাস কষ্টটার কি যে হলো, কে জানে। মা কি জেনেছে আমার কথা! কত সব ভাবনা! সে এখন কী করবে বুঝতে পারছে না।
ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টা হু হু করে কেঁদে উঠলো। কিভাবে জানাবে মাকে মনের কথা। ইস্! যদি একটি কলম আর কাগজ পাওয়া যেতো! হৃদয়ের বেদনা গুলো জানানো যেতো। বেদনাশিক্ত অক্ষমতাগুলো নির্দিধায় বুঝনো যেতো মাকে। প্রিয় মাকে।
ডান হাতটি তার ছিলো তখনও খোলা, তবে রক্তে ভেজা। আঙুলগুলো দিয়ে তখনও ঝরছে তাজা রক্ত। শাহাদাৎ আঙুলটি নাড়ানো যাচ্ছে একটু একটু করে। অনেক মনোবল আর শক্তি দিয়ে হাতটি বুকে রেখে, রক্তঝরা শাহাদাৎ আঙুলে নয়ন লিখতে লাগলো-
প্রিয় মা,
আমাকে ক্ষমা করো,
ঔষধটাতো আর কেনা হলো না!
আমি...............................
অতপর, তিন/চার দিন পরের কথা। ‘রানা প্লাজা’র ধ্বংসস্তুপ থেকে উদ্ধারকৃত শত শত লাশের মাঝে বের হলো অর্ধগলিত আর একটি লাশ। হাতটি তার বুকে রাখা। সাদা শার্টটি ছিলো রক্তে ভেজা। চোখে শুকনো নদী। হাজারো জনতা শুনতে পেয়েছে তার হৃদয়ের বেদনা বিধুর আকুতি মায়ের জন্য।
বিষয়: বিবিধ
২৭৮৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন