রাজা গৌর গোবিন্দের ‘গৌর রাজ্য’ পতনের ইতিহাসঃ মুসলিমদের জন্য একটি চরম ধৈর্য্যের পরীক্ষা।
লিখেছেন লিখেছেন এস আর চৌধুরী ০৮ মে, ২০১৩, ১২:০২:২০ দুপুর
হযরত শাহজালালের (রঃ) পরিচিতি:
তুরস্কের অন্তর্গত একটা ছোট্ট শহরে ১৩২২ খ্রীষ্টাব্দে হযরত শাহজালালের জন্ম। পিতা শেখ মাহমুদ ছিলেন মক্কার কুরাইশ বংশের অন্যতম কৃতি সন্তান। হযরত শাহজালাল(রঃ) মাতার দিক হতে বোখারী এবং সৈয়দ বংশীয় ছিলেন। পিতা-মাতা উভয়েই ছিলেন পরহেজগার মোত্তাকী ।
বালক শাহজালাল বাল্যকাল হতেই ছিলেন উন্নত চরিত্রের, জ্ঞান পিপাষু ও আল্লাহ ভক্ত। ছোটকাল হতেই তার হৃদয় ছিল পূত-পবিত্র। তিনি অল্প বয়স হতেই তার কামেল ও গুণী মামা সৈয়দ আহমদ কবীর সুরাওয়ার্দী সাহচার্যে থেকে জ্ঞান সাধনা করতে থাকেন। অতি অল্প সময়েই তিনি মারেফত সাগরের গভীর তলদেশে প্রবেশ লাভে সক্ষম হন এবং মাত্র ১৬ বছর বয়সেই একজন সত্যিকারের কামেল ওলী বা মহাসাধকে পরিনত হন।
তার কঠোর সাধনা, ত্যাগ, ও আত্ম সংযমের পরিচয় পেয়ে মহানবী হযরত মুহাম্মদ(সঃ) একদিন স্বপ্নযোগে তাকে হিন্দুস্থানে গমনের আদেশ দেন। কারন সেখানে মুসলমানগন কাফেরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।বহু মুসলমান তাদের নিজ ধর্ম থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই তিনি কাফের, মুশরিক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মুসলমানদেরকে আল্লাহ প্রদত্ত ন্যায় ও সত্যের পথে পরিচালিত করার জন্য আদিষ্ট হন।
নির্দিষ্ট প্রস্তুতি শেষে তিনি কিছু সহচর নিয়ে হিন্দুস্থানের উদ্দেশ্যে প্রথমে ইয়েমেনে পৌঁছান। এখানে কিছুদিন থাকার পর বাগদাদে গমন করেন। সেখানে কিছুদিন দীনের দাওয়াতের কাজ করে অসংখ্য পথভ্রষ্ট মানুষকে সৎ পথে আনয়ন করেন। পরে তিনি দিল্লীর পথে রওনা হয়ে কাবুল কান্দার পার হয়ে অবশেষে দিল্লীতে পৌঁছান। সেখানে তিনি সেখানকার শহর কুতুব হযরত নিজাম উদ্দিন আওলিয়া (রঃ) এর আস্তানায় অবস্থান করতে থাকেন। এ সময়ে দিল্লীর মসনদে ছিলেন সম্রাট ফিরোজ শাহ্তুঘলক।
সিলেট রাজা গৌর গোবিন্দ ও শেখ বুরহান উদ্দিন:
১৩১৩ খৃষ্টাব্দে রাজা গৌর গোবিন্দ সিলেটে ‘গৌর রাজ্য’ প্রতিষ্ঠা করেন। রাজা গৌর গোবিন্দ ছিলেন সাহসী যোদ্ধা এবং তিনি তন্ত্র সাধনায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। রাজা গৌর গোবিন্দ ছিলেন গোড়া হিন্দু। অন্য ধর্ম বা জাতির প্রতি ছিলেন খুবই অশ্রদ্ধাশীল ও অসহিঞ্চু। কুটিল বুদ্ধিতে ছিলেন অসমকক্ষ। অত্যাচারী রাজা হিসাবে ছিলো সর্বশ্রেষ্ঠ।
এ সময় বাংলাদেশ পর্যন্ত মুসলিম শাসন ও ওলী আওলিয়ারা ইসলাম প্রচার করতে থাকলেও সেখানে ইসলামের আলো প্রবেশ করেনি। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, গৌর রাজ্যের ‘ঘর দুয়ার’ টিলা গড়ের টুলকিকর মহল্লায় ১৩ জন মুসলমান (অথবা ১৩ টি পরিবার) বাস করতেন। তারই একজন ছিলেন শেখ বুরহান উদ্দিন। তিনি ছিলেন বেশ ধার্মিক। কিন্তু রাজা গোবিন্দের ভয়ে খুব গোপনে ইবাদত বন্দেগী করতেন। কেহই গরু জবাই করতেন না, তা ছিলো চরম শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
শেখ বুরহান উদ্দিনের কোন সন্তান ছিলো না। দীর্ঘদিন সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে কান্নাকাটি করার পর অবশেষে তিনি আল্লাহর কাছে সন্তানের জন্য মানত করলেন। যদি তার একটি সন্তান হয় তাহলে তিনি আল্লাহর নামে একটি গরু কোরবানী করবেন। বেশ কিছুদিন অপেক্ষার পর অবশেষে সত্যি সত্যিই ঘর আলো করে এলো একটি ফুটফুটে পুত্র সন্তান। আনন্দে আত্মহারা হয়ে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জানালেন। অতপর মানত পুরা করার জন্য সংকল্প করলেন তা যতই কঠিন হোক না কেন। আল্লাহর নিকট শোকরিয়া হিসাবে একদিন গোপনে একটি গরু কোরবানী করে মাংস গুলো মুসলমানদের মধ্যে বিলি করতে লাগলেন। এমন সময় একটি চিল এসে ছোঁ মেরে এক টুকরা মাংস নিয়ে গেলো। আল্লাহর কি খেলা, চিলটি মাংস টুকরাটি ফেললো রাজা গোবিন্দের রাজকীয় দেব মন্দিরের প্রধান প্রবেশ পথে। রাজা দেখেতো রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে গেলেন। তার আদেশ অনুযায়ী সৈন্যরা বহু খোঁজাখুঁজির পর শেখ বুরহান উদ্দিনকে রাজার সামনে উপস্থিত করলো। বুরহান উদ্দিন ক্ষমা ভিক্ষা করলেও রাজা কিছুই ভ্রক্ষেপ করলেন না। শাস্তি স্বরুপ তার ডান হাত কেটে দিলেন। নিষ্পাপ কচি শিশুটিকে দেবতার সামনে বলি দিলেন। অবস্থা দেখে শিশুটির মা অর্থাৎ শেখ বুরহান উদ্দিনের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে পরে গেলেন আর ফিরে এলেন না, মৃত্যুর কোলে ঢলে পরলেন। আল্লাহর কাছে বিচার দিয়ে বুরহান উদ্দিন গোপনে স্থান ত্যাগ করলেন এর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য। আর ওই দিনই রাজার লোকেরা আক্রমন চালিয়ে অন্য সব মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করলো।
এদিকে বহু কষ্ট করে বুরহান উদ্দিন পায়ে হেঁটে উপস্থিত হলেন সোনার গাঁয়ে শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের দরবারে। ইলিয়াস শাহ সব শুনে স্থম্ভিত হয়ে গেলেন। হলেন মর্মাহত ও ব্যথিত। একদিকে ইসলাম ধর্মের অবমাননা অপরদিকে নিষ্ঠুর অন্যায় অত্যাচার। তিনি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। রাজা গৌর গোবিন্দকে শাস্তি দেওয়ার জন্য অনেক সৈন্য-সামন্ত পাঠিয়ে দিলেন যুদ্ধ করার জন্য। বেশ কিছুদিন যুদ্ধ হলো, শত শত মুসলিম সৈন্য শহীদ হলো । কিন্তু জয় করা হলো না। বুরহান উদ্দিনের কষ্ঠ, জ্বালা, যন্ত্রনা আরো বেড়ে গেলো।
হযরত শাহজালাল (রঃ) এর সফল অভিযান:
কিন্তু শেখ বুরহান উদ্দিন থামলেন না। তিনি রওয়ানা হলেন দিল্লীর পথে। অনেক কষ্ঠ করে উপস্থিত হলেন দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দিন ফিরোজ শাহ তুঘলকের সামনে। তিনি ছিলেন উদার, ন্যায় পরায়ন ও ধার্মিক। তিনি বুরহান উদ্দিনের নিকট হতে সব বিষয় শুনে খুবই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন। অতপর, গোবিন্দকে শায়েস্তা করার জন্য অনেক সৈন্য-সামন্ত সহ সিকান্দার গাজীকে সেনাপতি করে অভিযানে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু পথি মধ্যে অনেক প্রতিকুলতা ও রোগ-বালাইয়ের পর সিকান্দার গাজী ব্যার্থ হয়ে আবার দিল্লীতে ফিরে গেলেন। সম্রাট পরে গেলেন ভিষন চিন্তায়।
অতপর নতুন কিছু সৈন্য সহ আর একজন বীর সৈয়দ নাসির উদ্দিন কে সেনাপতি নির্বাচন করলেন। তিনি ছিলেন অত্যধিক ধর্মপরায়ন, আমলদার ও সত্যবাদী ব্যক্তি। তিনি কখনও নামাজ ক্বাজা করতেন না। সম্রাটের আদেশ পেয়ে তিনি প্রস্তুতি নিতে থাকলেন। ছুটে গেলেন তাঁর পীর হযরত খাজা নিজাম উদ্দিন (রঃ) এর দরবারে। তখন ওখানেই অবস্থান করছিলেন হযরত শাহ জালাল (রঃ)। সবকিছু শুনে হযরত শাহ জালাল (রঃ) সিদ্ধান্ত নিলেন তিনিও সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সাথে এই অভিযানে যাবেন। অতপর হযরত শাহ জালাল (রঃ) তার ৩৬০ জন সহচর ওলীয়ে কামেল নিয়ে সৈয়দ নাসির উদ্দিনের সৈন্যবাহিনীর সাথে আল্লাহর নাম নিয়ে রওয়ানা দিলেন। সিকান্দার গাজী তার সাথে সৈয়দ নাসির উদ্দিন ও হযরত শাহ জালাল (রঃ) কে পেয়ে অত্যধিক খুশী হলেন।
এর ফলে সিকান্দার গাজী ও সৈয়দ নাসির উদ্দিনের প্রশিক্ষিত বাহিনী এবং ৩৬০ জন ওলীয়ে কামেল সহ হযরত শাহ জালাল (রঃ) আধ্যাতিক সাধনার সংমিশ্রনে তৈরি হলো একটি পরিপূর্ন দল।
পথিমধ্যে গোবিন্দের সৈন্যদের সাথে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। ওলীয়ে কামেলদের দোওয়া, আল্লাহর সাহায্য এবং ব্যাপক সমর শক্তির নিকট গোবিন্দের তন্ত্র-মন্ত্র অকার্যকর হয়ে তার সৈন্যদের চরম পরাজয় হলো। নিহত হলো গোবিন্দের সেনাপতি মনা রায়। এ খবর শুনে গোবিন্দ ভীত হয়ে গেলো। এদিকে মুসলিম বাহিনী অগ্রসর হতে থাকলো রাজধানীর অভিমূখে। সুরমা নদী পার হয়ে রাজধানীর দিকে এগুতে থাকলো। রাজার সকল সৈন্য ভয়ে পালিয়ে প্রান বাঁচালো। মুসলিম বাহিনী প্রাসাদের নিকটবর্তী হলো। রাজা গৌর গোবিন্দ প্রাসাদ ছেড়ে এক দূর্গে আশ্রয় নিলেন।
মুসলমানরা গৌর গোবিন্দের সুউচ্চ প্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আযান দিতে লাগলেন। আযানের ধ্বনিতে গোবিন্দের সুউচ্চ প্রাসাদ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে পড়লো। মুসলমানরা আল্লাহু আকবর বলে ভীষন শব্দে ফেটে পরলো।
গোবিন্দকে পাকরাও করা হলো শেখ বুরহান উদ্দিনের সন্মুখে। গরু কোরবানীর অপরাধে যে বুরহান উদ্দিনের ডান হাত কেটে দেওয়া হয়, নিষ্পাপ শিশু সন্তানকে মন্দিরের দেবতার সামনে বলি দেওয়া হয়, পরিশেষে স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। হযরত শাহজালাল (রঃ) তখন বুরহান উদ্দিনের নিকট এর বিষয়ে মতামত জানতে চাইলেন। বুরহান উদ্দিন তাকে মাফ করে দিলেন। এতে হযরত শাহজালাল (রঃ) খুবই খুশী হলেন। বললেন এটাই তো আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ) এর শিক্ষা। গোবিন্দকে মুক্ত করে দেওয়া হলো। তিনি তার পরিবার-পরিজন ও অনেক ধন-সম্পদ নিয়ে চলে গেলেন পেচাগড় নামক দূর্গের দিকে।
সনটা ছিলো ১৩৪৪ । উদিত হলো নতুন সূর্য। উড়তে লাগলো ইসলামের পতাকা। ‘গৌর রাজ্যের’ নতুন নাম হলো জালালাবাদ। হযরত শাহজালাল (রঃ) সুলতান সিকান্দার শাহ কে দায়িত্ব দিয়ে তিনি আত্মনিয়োগ করলেন ধর্ম প্রচারের কাজে।
ইতিহাসটি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, দীর্ঘদিন ধরে চলা জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়-অবিচার, শোষন, বঞ্চনা ইত্যাদির শেষ পর্যন্ত পরিসমাপ্তি ঘটেছে। মুসলমানদের সর্বাত্বক প্রচেষ্ঠা, ত্যাগ, রক্ত কোনটাই বৃথা যায় নি। অনেক প্রাণ ও রক্তের বিনিময়ে হলেও ইসলামের শত্রুদের পরাজয় হয়েছে। ইসলামের বিজয় হয়েছে। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী, মিথ্যার পরাজয় নিশ্চিত।
বিষয়: বিবিধ
২৭৯৭ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন