একজন গার্মেন্টস কর্মীর আত্ম-কাহিনী
লিখেছেন লিখেছেন এস আর চৌধুরী ০৩ মে, ২০১৩, ০৪:৪৫:২৬ বিকাল
ছোট্ট একটি গ্রাম। গ্রামের নাম শিমুলবাড়ি। শিমুল ফুলে ভরে ওঠে বছরের একটি বিশেষ সময়। চারিদিকে সবুজ শ্যামলিমা আর লতা পাতায় ঘেরা। মাঝে বেশকিছু ঘর-বাড়ি। এখানেই আমার জন্ম। পাশ দিয়ে ছলাৎ ছলাৎ শব্দে বয়ে যাওয়া খরস্রোতা নদী । মাঝে মাঝে এ নদী হয়ে ওঠে বড় বেপরোয়া, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবকিছু যেখানে যা পায়। মাটির সাথে সাথে হৃদয়ও ভাঙ্গে।
খড়ের চালে তৈরি দু’টি ঘর, কাশের বেড়ায় ঘেরা। জোছনা রাতে চাঁদের আলো চাল ভেদিয়ে ঘরের ভিতর, বর্ষায় বৃষ্টির জল ঠেকানো দায়। শীতের কুয়াশায় সবকিছু একাকার। মাঘের হাড়কাঁপানো শৈত্য প্রবাহ বাধাহীন একদিক দিয়ে প্রবেশ করে চলে যায় অন্য দিকে।
কাকডাকা ভোরে বৃদ্ধ বাবা বেরিয়ে পরেন কাজের খোঁজে । কাজ জোটে পাট ক্ষেতে, ধানক্ষেতে, গমক্ষেতে কিংবা কোন বিরান ভুমিতে । কখনও ইটের ভাটা কিংবা রাস্তার মাটি কাটার কাজ। সকাল থেকেই হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, দুপূরে এক চিলতি পিঁয়াজ আর একটি শুকনো মরিচের মহাআয়োজনে এক প্লেট পানিভাত অথবা পাতলা ডালের সাথে দুইটি রুটি। তারপর আবারও শুরু হয় নতুন উদ্দ্যমে দাপদাহে দেহের রক্তকে পানি করা আর শেষ হয় প্রভাকরের শুভ প্রস্থানের পূর্বমুহুর্তে। দিন শেষে ১০ টাকার চারটি নোট, মোট চল্লিশ টাকা। চোখ জ্বলজ্বল করে কি এক আনন্দে পথ চলা। এক কেজি মোটা চাল, আধাকেজি আলু, আর এক টাকা, দুই টাকা করে যা পাওয়া যায়। কি এক অজানা স্বপ্নের আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফেরা।
কখনও কাজ জোটে না কোথাও, ভাগ্যের পরিহাস ভেবে ছিন্ন হৃদয়ে বাড়ি ফেরা শুন্য হাতে। অপারগতা, অক্ষমতা আর অতৃপ্তির দৃষ্টি সকলের হৃদয় ভেদ করে বেরিয়ে যায়। তবুও নিভে যায না অজানা স্বপ্ন। হয়তো একদিন সুদিন আসবে ভেবে।
অনাহারে অর্ধাহারে দিন চলতে থাকে। বাবার কষ্ট আর স্বপ্ন থেমে থাকে না। বাবার কষ্ট সইতে না পেরে জীবন যুদ্ধে নামতে চেয়েছি অনেকবার অল্প বয়সে। কিন্তু বাবার স্বপ্নের কাছে আমাকে পরাজিত হতে হয়েছে। বাবা ভেবেছিলেন লেখাপড়া করে ছেলে আমার বড় একটা কিছু হবেই।
হয়নি কিছুই। দারিদ্রের করাল থাবায়, পাশের বাড়ির রফিকের হাত ধরে অবশেষে একদিন ঢাকায়। তারপর এক গার্মেন্টস-এর পোশাক-কর্মী। বেতন মাসে আড়াই হাজার। সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা। চলতে থাকে মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকে দিনদিন। এরই মধ্যে পেরিয়ে যায় প্রায় ১০ টি বছর। বেতন বেড়েছে কিছু, কিন্তু বাড়েনি জীবনযাত্রার মান। মোটা চালের ভাত আর ডালের টলটলে জল জীবন সাথী। সূর্য যেমন পূর্বেদিকে ওঠে আর পশ্চিমে অস্ত যায় চিরাচরিত নিয়মে, আমরাও তার সাথে চলি পাল্লা দিয়ে। সকাল থেকে সন্ধা অবদি চলে বাঁচার লড়াই।
আমার মতো লক্ষ শ্রমিকের দক্ষ হাতে গড়ে উঠেছে এদেশের পোশাক শিল্প। বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের গায়ের কাপড় তৈরি হয় আমাদের হাতে। বাংলাদেশের হাজার হাজার গার্মেন্টস ব্যবসায়ী আজ আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ।
এইতো আমার গার্মেন্টস মালিকের কথাই ধরুন। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন প্রতিষ্ঠানটি ছিল হাঁটি হাঁটি পা পা। শ’দুয়েক শ্রমিক নিয়ে চালু হয় একটি ছোট কারখানা, শুরু হয় ব্যবসা। অতপর প্রতিদিনই ব্যবসা বেড়েছে, আয় বেড়েছে। কারখানা অনেক বড় হয়েছে। কারখানা একটার পরিবর্তে এখন তিনটা হয়েছে। মালিকের ব্যাস্ততা বেড়েছে অনেকগুন। তিন তিনটা গাড়ি। প্রতি বছরই পরিবর্তন হয় গাড়ির মডেল। মাঝে মাঝেই সপরিবারে বিদেশ ভ্রমন। ছেলেমেয়েরা পড়ছে দেশের বাইরে। প্রতি রাত্রেই পার্টি, প্রতি মাসেই পার্টি। হোমরা-চোমরারা মেহমান। বড় বড় রাজনীতিবিদ, এমপি-মন্ত্রি, ব্যবসায়ীদের সাথে এখন চলাফেরা। সাধারন ব্যবসায়ী থেকে এখন বিশিষ্ট শিল্পপতি।
কিন্তু আমি? আমরা? আজও একই রকম। ডাল-ভাতের পরিবর্তন হয়নি, বাসস্থানের পরিবর্তন হয়নি। বাড়ির ঘর দু’খানি রয়েছে আগের মতই। বাবার শরীরটা আরো দুর্বল হয়েছে, রক্তের শিরা-উপশিরা গুলি উপরে উঠেছে, মায়ের মুখটা এখনও অনুজ্জ্বল, সুখের ছোঁয়া লাগেনি আজও। তবে স্বপ্নটা এখনও আগের মতোই। মাঝে মাঝেই মা ছেলেকে নিয়ে বুনে আকাশ কুসুম কত সব কল্পনা।
কিন্তু আমি এখন এক নতুন সংশয়ে। অজানা ভয় বাসা বেঁধেছে মনে। আমার গন্তব্য কোথায়! কোথায় শেষ পরিণতি! এখন প্রায়ই মনে পরে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা, সাভার ট্র্যাজেডির। হতভাগী শাহিনার মর্মস্পর্শী আর্তনাদ। আরো অনেক নাম না জানা শ্রমিকের নির্মম পরিণতি। মনে পরে তাজরিন ফ্যাশানের লেলিহান অগ্নীশিখা। কলাপ্সিবল গেটে আটকানো শতশত সতীর্থের ছাই ভস্ব হয়ে যাওয়া। প্রতি নিয়তই কানে আসে হাজারো স্বজনের হৃদয় বিদারক কান্না চোখে ভাসে লাশের মিছিল।
তাই মাঝে মাঝে পাগলী মা টাকে বলি:
মা,
তুমি কেন স্বপ্ন দেখো
ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁকে,
নির্যাতিতের সুপ্ত বাসনা
চিরদিন স্বপ্নই থাকে।
-------*------------
বিষয়: বিবিধ
৩২৭২ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন