এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, আর্ত-মানবতার সেবায় আলোকবর্তিকা।

লিখেছেন লিখেছেন এস আর চৌধুরী ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:৫৫:৪৩ সন্ধ্যা



ঢাকার অদুরে সাভারে অবস্থিত "এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল" ২০০৩ সালে প্রতিষ্ঠিত একটি বেসরকারী মেডিকেল কলেজ।



সম্প্রতি সাভারের ‘রানা প্লাজা’র মর্মান্তিক দূর্ঘটনায় আহত শতশত ব্যক্তিকে পাঠানো হয় এনাম মেডিকেল কলেজের হাসপাতালে। প্রথমে একটি দুইটি করে রোগীভর্তি এ্যাম্বুলেন্স আসতে থাকলেও পরে শত শত এ্যাম্বুলেন্স রোগী নিয়ে আসতে থাকে। এক অ্যাম্বুলেন্স থেকে রোগী নামাতে না নামাতেই চলে আসে আরেকটা। যারা উপস্থিত সকলে যেন দিশেহারা। শত শত ট্রলি, শত শত হুইল চেয়ার । এগুলি আনা-নেয়ার লোক কোথায় ? তখন কর্মচারীদের সাথে হাত লাগালো ছাত্ররা, আশেপাশের মানুষেরা। একেকজন যে কি রকম সর্বাধিক শক্তি দিয়ে, পরিশ্রম দিয়ে, কতটা দ্রুততার সাথে আনা- নেয়া করছিল, তা কল্পনাতীত। একেকজনের চেহারায় যে কতটা উদ্বেগ,উৎকন্ঠা, কতটা আতঙ্ক তা বলে বোঝানো যাবে না।





একজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, এক সময় রোগীদের সংখ্যার সাথে আর তাল মেলাতে পারছিল না ট্রলি আর হুইল চেয়ারগুলো। তখন এক ট্রলিতেই দু’জন। তবুও পারা যাচ্ছে না। এবার কোলে করে দৌড়ে ভেতরে নিয়ে যাবার পালা। এক সময় হাসপাতালের ভিতরে-বাইরে, এখানে-ওখানে রক্তের ছোপছাপ দাগ লাগতে থাকে। ছাত্র/ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী, ডিউটি ডাক্তার, সকলের হাত-পা, জামা-কাপড় ও অ্যাপ্রনগুলোও রক্তে মাখামাখি হয়ে যায়। একসময় ইমারজেন্সি রুমে আর সঙ্কুলান হয় না। একে একে হাসপাতালের বেডগুলি পরিপূর্ণ হয়ে যায়, ফ্লোর উপচে লবি পেড়িয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত গড়িয়ে পরে। হায়! কি বিভৎস দৃশ্য। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো মাথা থেতলে গেছে, কারো ভূড়ি বেড়িয়ে গেছে, কেউবা অচেতন, কেউ ভয়ে কাঁপছে । ক্রন্দন, গোঙ্গানী, কোকানীতে বাতাস ভারি হয়ে গেছে। ওদিকে ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছিল মৃতের সংখ্যাও।



চিকিৎসাও চলছে সাধ্যমতো । একদিকে বড় আকারের মানবিক বিপর্যয়, অপরদিকে সিমিত সংখ্যক চিকিৎসক, সীমিত স্থান, অপ্রতুল চিকিৎসা সামগ্রী। হাসপাতালের নিকট সঞ্চিত রক্ত শেষ হয়ে যায়, স্যালাইনের ঘাটতি দেখা দেয়, জরুরী ঔষধের প্রয়োজন হয়ে পরে। হাজারো মানুষের আহাজারিতে বাতাস ভারি হয়ে উঠে। লোকে লোকারন্য হয়ে যায় চার দিকে। সবকিছু যেন অস্থির, অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে।



এহেন মারাত্বক প্রতিকুল পরিস্থিতিতে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চেয়ারম্যান জনাব এনামুর রহমানের পক্ষ থেকে ঘোষনা আসে বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদানের জন্য। তিনি তার সামর্থ ও সীমাবদ্ধতার কথা না ভেবে, মানবতার কথা চিন্তা করে একমাত্র আল্লাহর উপর ভরসা করেই এ ঘোষনা দিয়ে দেন।



পরক্ষনে সরকারী, বেসরকারী, আধা-সরকারী, সেবামূলক, বানিজ্যিক ইত্যাদি সকল ধরনের প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য আসতে থাকে। ব্যক্তিগত পর্যায়ে ছাত্র, শিক্ষক, ব্যবসায়ী, ব্যাংকার, ডাক্তার, ইন্জিনিয়ার থেকে শুরু করে শ্রমিক, রিকশাচালক, গৃহিনী, বেকার পর্যন্ত সকল শ্রেনি-পেশার মানুষ যিনি যেভাবে পারেন এগিয়ে আসেন। রক্ত দানের জন্য মানুষের মধ্যে প্রতিযোগীতা শুরু হয়। যে ব্যক্তি নিজের আত্নীয়ের জন্যও রক্ত দিতে ভয় পেতেন বা কোন দিন রক্ত দেন নি তিনিও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকেন নি।

এখন পর্যন্তও এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ‘রানা প্লাজা’ থেকে উদ্ধারকৃত রোগীতে ভরপুর। চিকিৎসা সেবায় ও আন্তরিকতায় যেন কমতি নেই। ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্যদের মাঝে অর্থের লালসা কিংবা বিরক্তির ছাপ নেই । চলছে বিরামহীন যুদ্ধ। এ মেডিকেল কলেজের অনেক চাত্র/ছাত্রী, ইনটার্নশিপ ডাক্তার সহ অনেকে দূর্যোগ স্থানে গিয়েও রাতদিন সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

আমি পেশায় ডাক্তার নই । বরং যারা কড়া ভাষায় বাংলাদেশী ডাক্তারদের সমালোচনা করে আমি তাদের একজন। কিন্তু সাম্প্রতিক দূর্যোগ মুহুর্তে চিকিৎসা পেশার সাথে জরিত ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্যরা যে অবদান রেখেছেন তা আমার মতো সমালোচকদের মাথা হেট করে দিয়েছে। চিকিৎসা পেশার ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে।

এহেন দূর্যোগ মুহুর্তে হাজারো অসহায় দুঃস্থ রোগীর আগমন ঘটলে ঢাকার নামী-দামী হাসপাতাল যেমন স্কয়ার, এপেলো, ল্যাব-এইড, ইউনাইটেড, ঢাকা মেডিকেল, সলিমুল্লাহ মেডিকেল, সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল, পিজি হাসপাতাল ইত্যাদি কি করতো জানি না। তবে সাভারের এই প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ নিজেদের উজার করে দুঃসময়ের কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েছে তা নির্দিধায় বলা যায়। পুরো জাতির কাছে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল আর্ত-মানবতার সেবায় আলোকবর্তিকা হিসাবে দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে। আমরা চিরকৃতজ্ঞ।

পরিশেষে, চলুন সাভার ট্রাজেডিতে যারা অত্যন্ত নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন তাদের জন্য মাগফিরাত কামনা করি, যারা প্রাণে বেঁচে আছেন তাদের সুস্থ্যতার জন্য দোয়া করি, তাদের আত্নীয়-স্বজনরা যেন ধৈর্য্য ধারন করতে পারে সে দোয়া করি, সকল শ্রেনি-পেশার মানুষ যারা জীবন বাজি রেখে অক্লান্ত পরিশ্রম করে উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছেন তাদের জন্য দোয়া করি যেন মহান রব্বুল আল-আমিন তাদের এ মহৎ প্রচেষ্ঠার উত্তম প্রতিদান দান করেন। আমিন।

আর প্রকৃত অপরাধীরা যেন বিচারের আওতায় আসে, ছাড়া না পায়। জাতি যেন এখান থেকে শিক্ষা গ্রহন করতে পারে। আমরা আর এ রকম ট্রাজেডির পূনরাবৃতি দেখতে চাই না।

বিষয়: বিবিধ

৩৯৪০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File