ফেলে আসা দিনগুলি

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন ০৫ আগস্ট, ২০১৩, ০৭:২০:০৯ সন্ধ্যা

চারদিকে ঘন অন্ধকার। মশার কামড়ে অতীষ্ট হয়ে উঠেছে জীবন। জেলার সাহেবের অফিস রূমের বৃটিশ আমলের পুরনো বিশালকায় দেয়াল ঘড়িটা ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজার সময় সংকেত দিল এইমাত্র। চোখে ঘুমের কোন চিহ্ন নেই শাকিলের। হৃৎপিন্ডটা জেলার সাহেবের ঘড়ির মতো হাতুরী পেটাতে শুরু করেছে।

সময় আসে- আসে- এগিয়ে চলেছে জিরো আওয়ারের দিকে। আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা পর শাকিলের ডাক পড়বে। সূর্যোদয় আর কোনদিনই দেখতে পাবে না সে।

প্রচন্ড ঘৃণায় ভরে ওঠে মন। কী চেয়েছিল জীবনে আর কী পাচ্ছে! চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভেসে ওঠে সমস- ঘটনাবলী।

বিচারপতি ফিরোজ রহমানের রায় কানে ভাসে অবিরত। কী-ই বা করার ছিল তার।

বিধবা মা ও ছোট ভাই বোনগুলোর জন্য মনটা ইদানিং ভীষণ কাঁদে শাকিলের। বড় অসহায় লাগে নিজের কাছে। গাধা খাটুনী খেটে লেখাপড়া শিখিয়েছে যে মা তাকে সে কী দিতে পেরেছে?

মৃত্যুর পূর্বে বাবা ওকে কাছে ডেকে বলেছিলেন, বাবা শাকিল, আমার জন্য তোরা দুশ্চিন-া করিস না। এ মরণ ব্যাধি থেকে কোন ডাক্তারই এবার আমাকে ফেরাতে পারবে না। আমার ডাক পড়ে গেছে। ভালোভাবে লেখাপড়া শিখে ‘মানুষ’ হবার চেষ্টা করিস। নদী, রূমপা, গালিবকে দেখে রাখিস। ওরা যেন আমার অভাব কোনদিন বুঝতে না পারে।

বাবার কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল তবু তিনি ছেলেকে জীবনের শেষ এবং দরকারী নির্দেশ ও উপদেশগুলো দিয়ে দিচ্ছিলেন। বাবার নিশ্বাসের কষ্ট দেখে শাকিল বলেছিল, বাবা, তুমি একটু বিশ্রাম নাও। তোমারতো কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে।

শাকিলকে থামিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, বিশ্রাম নিতে গেলে আমি আর বলার সময় পাব না রে। যা বলার বলে নিই। অনন- বিশ্রাম তো সামনেই রয়েছে। শোন - তোর মা কিন' খুব দুঃখী। ও মানুষের কষ্ট সহ্য করতে পারে না। আমার জন্য বেচারীকে অমানুষিক পরিশ্রম করতে হয়েছে। যদি পারিস তাকে সুখী করার চেষ্টা করিস।

নির্দেশ শেষ করার পর তিনি পানি খেতে চাইলেন শাকিলের মা’র হাতে। অর্ধেক গ্লাস পানি খাবার পরই তিনি ঢলে পড়লেন মৃত্যুর কোলে। পানিসহ গ্লাসটা রয়ে গেল মা‘র হাতে।

সেদিন থেকেই শাকিলদের দুঃখের জীবন শুরু হলো। এতগুলো ছেলেমেয়ের খাওয়া পরা যোগাড় করতে মা রীতিমত হাঁপিয়ে উঠলেন।

বাবা মৃত্যুর আগে বলে গিয়েছিলেন তাঁর দেনা-পাওনার কথা। জানাজা নামাযের পূর্বে শাকিল তার বাবার মৃতদেহের সামনে দাঁড়িয়ে সমবেত মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে বলেছিল, আপনারা আমার বাবাকে খুব ভালোভাবেই চেনেন। সন-ান হিসেবে আমি কখনো তাঁকে কোন অন্যায় করতে দেখিনি। তিনি যদি আপনাদের কারো সাথে কখনো কোন রকম দূর্ব্যবহার করে থাকেন কিংবা তাঁর নিজের অজানে- কারো মনে আঘাত দিয়ে থাকেন তবে তাঁর হয়ে আমি হাত জোড় করে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইছি - আল্লাহর ওয়াসে- মাফ করে দিবেন। অনেকের সঙ্গেই তাঁর দেনা-পাওনা রয়েছে। আপনারা যোগাযোগ করবেন, আমরা ইন্‌শাআল্লাহ সব শোধ করে দিব।

এরপর সাতদিন না যেতেই পাওনাদাররা এসে হাজির। মানুষের ভেতরকার মনুষ্যত্ববোধ ও মানবিক মূল্যবোধ কী দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে! মৃত্যুর পরে অন-ত চল্লিশটা দিন পার হবার সময় কী তাঁরা দিতে পারতেন না?

সংসারে দূর্দিন শুরু হয়েছে। পাওনাদারগণ তো তাঁদের পাওনা টাকা চাইতে আসবেনই। আর সে টাকা যত দ্রুত সম্ভব দিয়ে বাবাকে ঋণমুক্ত করতে হবে। কিন' আফসোসের ব্যাপার হলো, বাবা যাঁদের কাছে টাকা পেতেন তাঁরা কেউ এলেন না। শুধু তাই নয়, তাঁরা কেউ সহানুভূতি জানাতেও আসেননি। ব্যাপারটা শাকিলকে ভীষণ কষ্ট দেয়।

মা‘র ধারণা ছিল তাঁদের এ বিপদের দিনে আর কেউ না আসুক

অন-তপক্ষে বাবার ব্যবসায়িক পার্টনার সরোয়ার সাহেব এগিয়ে আসবেন। কিন' পরিতাপের বিষয় তিনিও এলেন না। বরং পরবর্তীতে তিনি কৌশলে ব্যবসায়ে বাবার শেয়ারের সমুদয় টাকা আত্মসাৎ করলেন।

বাধ্য হয়ে মা একটা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতার চাকরি নিলেন। শাকিল তখন অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। নদী, রূমপা ও গালিব আরো ছোট। প্রতিদিন শাকিল তার নিজের পড়া শেষ করে ভাইবোনদেরকে পড়াতে বসত।

মা‘র শখ ছিল শাকিলকে ডাক্তারী পড়াবেন। শাকিলেরও ইচ্ছে ছিল এমবিবিএস পাশ করে মেডিসিনের ওপর গবেষণা করবে।

এইচএসসি পাশ করে যখন সে ঢাকায় এলো, তার ধারণা অনেকাংশেই পাল্টে গেল। এখানে তার মতো আরো হাজার হাজার মেধাবী ছাত্র রয়েছে যারা মেডিক্যালে ভর্তি হবার জন্য রীতিমত কোচিং করছে।

টাকার অভাবে শাকিলের কোচিং করা হলো না। সে জানে, মা‘কে কোচিং করার কথা লিখলে তিনি যেভাবেই হোক টাকা ম্যানেজ করে পাঠাবেন। কিন' সে চায়নি মা‘কে নতুন কোনো সমস্যায় ফেলতে।

ঢাকা এসে সে তার এলাকার এক বড় ভাইয়ের কাছে গিয়েছিল। সাকলায়েন ইউসুফ। প্রাণীবিদ্যা বিভাগে মাষ্টার্সের ছাত্র। এস এম হলের ১০০ নং রূমে থাকে।

রূমে গিয়ে জানল, সাকলায়েন ভাই এখন একটা মেসে থাকেন। পড়া শেষ না করতেই হল ছেড়ে মেসে কেন এর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পেল না শাকিল। তাছাড়া সাকলায়েন ভাইয়ের রূমে যাদেরকে সে দেখেছে, ভালো বলে মনে হয়নি তার। অগত্যা যখন চলে আসবে এমন সময় পাশের রূম থেকে একজন এসে যা বলল তার অর্থ দাঁড়ায়, সাকলায়েন ভাইকে বের করে দিয়ে ওরা রূম দখল করেছে।

বিষয়: সাহিত্য

১১৯১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File