সাধু সাবধান

লিখেছেন লিখেছেন মোহাম্মদ শাব্বির হোসাইন ১৪ এপ্রিল, ২০১৩, ০৬:০০:১৬ সন্ধ্যা

বাংলাদেশ বর্তমানে এক সংকটকাল অতিক্রম করছে। দেশের আর্থ-সামাজিক অবস'া অত্যন- নাজুক আকার ধারণ করেছে। যে যার অবস'ান থেকে বলছেন, সংলাপ প্রয়োজন। কিন' বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধার যেন কেউ নেই। কী সরকারী দল কী বিরোধী দল, যে যার অবস'ানে গোঁ ধরে বসে আছেন, কেউ ছাড় দিতে নারাজ। যেন ছাড় দিলেই রাজনৈতিকভাবে পরাজয় ঘটবে। যদিও বিশেষজ্ঞদের মত হলো, সরকারী দলকেই এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে।

গ্রামে একটা প্রবাদ চালু আছে। শিল-পাটার ঘষায় জান যায় মরিচের। অবস'া হয়েছে যেন তাই। এতদিন আমরা দেখেছি, দেশে এ ধরণের রাজনৈতিক অসি'রতা তৈরি হলে সাধারণ মানুষ প্রাণ হারাতো। এবার তার সঙ্গে নতুন যুক্ত হলো পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা। যে কোনো ঘাত, প্রতিঘাত কিংবা অপঘাতই হলো নিন্দনীয়। শুধু নিন্দনীয় নয় বরং তা জঘন্য। এ ধরণের হানাহানি, রক্তপাত ইসলাম কখনো সমর্থন করে না। অথচ ৯০% মুসলমানের দেশে তা-ই ঘটছে। মানুষের ভেতর থেকে মায়া-মমতা, মহব্বত এসব যেন লোপ পেয়েছে। ভাবখানা যেন এ শব্দ শুধুমাত্র অভিধানে থাকতে আছে বাস-বে নেই।



গত ২ এপ্রিল ২০১৩ মঙ্গলবার বিভিন্ন পত্রিকায় গুরুত্বপূর্ণ একটা নিউজ ছিল ‘‘পুলিশকে পিটিয়েছে শিবির”। অবশ্য পত্রিকাগুলো আগের দিনই তাদের অন লাইন সংস্করণে এ নিউজ প্রকাশ করে বেশ গুরুত্বের সাথে। এছাড়া বিভিন্ন চ্যানেলগুলো তো প্রচার করেছেই। দেশের একটি প্রথম শ্রেণীর পত্রিকা তাদের অন লাইন সংস্করণে লেখে, ‘‘রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় আজ সোমবার সকালে এক উপপরিদর্শককে (এসআই) পিটিয়ে তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে ছাত্রশিবিরের কর্মীরা।

ঐ পুলিশ কর্মকর্তার নাম জাহাঙ্গীর আলম। তিনি রাজশাহী উপশহর পুলিশ ফাঁড়ির এসআই হিসেবে কর্মরত আছেন। রাস-ায় পড়ে থাকা জাহাঙ্গীরকে ঝর্ণা বেগম নামে এক নারী পরে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।”

ঘটনার বিবরণে প্রকাশ, সেদিন সকাল ১০টার দিকে শিবিরের কর্মীরা রাজশাহী নগরের শালবাগান এলাকায় একটি মিছিল বের করে। এ সময় পুলিশ রাস-ায় বাধার সৃষ্টি করলে উভয়পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পুলিশ মিছিলকারীদের লক্ষ্য করে কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবারের গুলি ছুঁড়লে তারাও পাল্টা ইটপাটকেল ও ককটেল ছোঁড়ে। এক পর্যায়ে পুলিশ সদস্যরা পিছু হটতে শুরু করলে মিছিলকারীরা এসআই জাহাঙ্গীরকে ধরে ফেলে এবং লাঠি ও হেলমেট দিয়ে পিটিয়ে মাথা থেঁতলে দেয়। এর পরদিন দিনাজপুরের চিরিরবন্দরেও ঘটে একই ধরণের ঘটনা। এসআই আব্দুস সবুরকে লাঠি দিয়ে আঘাত করে মাথা থেঁতলে দেয়া হয় বলে পত্রিকায় সংবাদ বেরিয়েছে। ঘটনাগুলি নিঃসন্দেহে অমানবিক এবং নিষ্ঠুরও বটে। কিন' যদি বিষয়টিকে একটু অন্য আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে এর অন-র্নিহিত কারণ বের হয়ে আসবে নিশ্চয়। আমাদের দেশের প্রশাসনের যাঁরা কর্তাব্যক্তি ও সমাজবিজ্ঞানী তাঁদেরকে বিষয়টি একটু গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনার জন্য অনুরোধ করছি। নতুবা আগামী দিনগুলি হয়ে উঠবে ভীষণ রকমের বিপদ-সংকুল, যা থেকে আপনার আমার কারোরই নিস-ার নেই।

প্রথমেই আমি আলোচনা করতে চাই, এসআই জাহাঙ্গীর কিংবা এসআই সবুরের গায়ে তারা হাত তুললো কেন? পুলিশ বাহিনী হলো একটা দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনকারী। পুলিশ বাহিনী তার উপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনে ব্যর্থ হলে কিংবা তাদের কাজের মধ্যে পক্ষপাতিত্ব দেখা দিলে দেশের শানি--শৃঙ্খলার ব্যাঘাত ঘটবে। বর্তমানে আমাদের দেশে পুলিশ বাহিনীকে যেভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রতিপক্ষকে দমানো ও ঘায়েল করার কাজে নিয়োজিত করা হচ্ছে এতে করে সাধারণ মানুষের মনে এক ধরণের ঘৃণার সৃষ্টি হচ্ছে। এছাড়াও তাদের বেশ কিছু কর্মকান্ড জনগণের মাঝে ব্যাপক আতংক ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। উদাহরণ হিসেবে পরদিন প্রকাশিত সংবাদের কথা বলা যায়। ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার একটি গ্রামে ১৫ বছরের এক কিশোরী ধর্ষিত হবার পর পুলিশ সদস্যদের কাছে মেয়েটির আচরণ যৌনকর্মীর মতো মনে হয়েছিল বিধায় তারা তাকে একজন যৌনকর্মী হিসেবে আদালতে হাজির করে। পরে বিষয়টি জানাজানি হলে বিচারক মেয়েটিকে জামিন দেন এবং ধর্ষকদের নামে মামলা করার নির্দেশ দেন। অথচ ঘটনার পর মেয়েটি পুলিশ সদস্যদের কাছে অভিযোগ করার পরও তারা সেটা অগ্রাহ্য করে তাকে যৌনকর্মী হিসেবে আখ্যায়িত করে। এ ব্যাপারে ঐ এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের এক নারী সদস্য জানিয়েছেন, প্রেমের সম্পর্কের সূত্র ধরে ঐ কিশোরীকে নিয়ে গিয়ে তার কথিত প্রেমিক ও এক বন্ধু ধর্ষণ করেছে। এত বড় একটা ঘটনা কীভাবে তাঁরা এড়িয়ে গেলেন?

এটা তো হাজার হাজার ঘটনার একটি মাত্র। পুলিশের এ রকম শত-সহস্র ঘটনা আছে যেগুলি বলা যায় ওপেন-সিক্রেট ব্যাপার। কিছুদিন আগে একটা টিভি চ্যানেলে প্রচার হলো, গাজীপুরে পুলিশ টোকেনের মাধ্যমে ট্রাকের ড্রাইভারের কাছে থেকে ঘুষ খাচ্ছে। অর্থাৎ, ২০০ টাকার টোকেন নিলে সারা মাস ফ্রি। নতুবা প্রতি ট্রিপেই টাকা দিতে হবে কাগজ-পত্র সব ঠিক থাকার পরও। আর এ ঘটনা পরবর্তীতে ফেসবুকের মাধ্যমে সারা পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়ে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সুনাম প্রচুর পরিমানে বাড়িয়ে (!) দিল। এ জাতীয় টোকেন প্রথা সারা দেশেই চালু আছে। প্রশাসন সব জানার পরও মনে হয় নির্বিকার। কেননা সাধারণ মানুুষ যেখানে এসব জানেন সেখানে প্রশাসন জানবে না এটা কেউ বিশ্বাস করতে চাইবে না।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারী জামাত-শিবিরের হরতাল চলাকালে সারা দেশে তাদের কর্মীসহ অসংখ্য নিরীহ মানুষ মারা গেছেন। তখন ফেসবুকে একটা ভিডিও ক্লিপ দেখেছিলাম যেটা ছিল কক্সবাজারের ঘটনা। পুলিশ মিছিল থেকে এক শিবিরকর্মীকে কিল-ঘুষি-লাথি মারতে মারতে নিয়ে যায় একটি ঘরের মধ্যে। সেখানে রাইফেলের বাট দিয়ে চলে তার ওপর অকথ্য নির্যাতন। এমন অবস'ায় তরুণটি দু’হাত জোর করে ৩/৪ জন পুলিশের কাছে অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। কিন' তাতে পুলিশ সদস্যদের মন গলে না। এরমধ্যে একজন এগিয়ে এসে তরুণটির ডান হাঁটুতে শর্টগান ঠেকিয়ে ২/৩ রাউন্ড গুলি করে। তরুণটি চিৎকার দিয়ে পড়ে গেলে পুলিশ সদস্যরা রূমের বাইরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে রাস-ায় যথারীতি ডিউটি শুরু করে মিছিল ঠেকাতে। পরে জানা যায়, তরুণটি অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মারা গেছে। নিশ্চয় সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরণের হঠকারিতার নির্দেশ ছিল না। তরুণটি যদি সত্যিই কোনো অপরাধ করে থাকে তাহলে তার বিচারও হওয়া উচিত ছিল আইন অনুযায়ী। পুলিশকে রাষ্ট আইন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছে কোনো বিচারিক কাজের জন্য নয়। আইনের লোক হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিয়ে তাঁরা কী পক্ষান-রে আইন, বিচার বিভাগ ও আইন প্রণেতাদেরকেই অসম্মান করছেন না? বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।

এ ধরণের হাজারো লাখো ঘটনা সাধারণ মানুষের মনে ক্ষোভ তৈরি করেছে পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে। যখন শালবাগানে মিছিলকারীরা এসআই জাহাঙ্গীরকে পিটাচ্ছিল তখন তারা মনে করছিল এটা মানুষ নয় পুলিশ। অর্থাৎ, পুলিশ তথা একটা সিস্টেম। কাজেই তখন তাদের ভেতর মনুষ্যত্ববোধ লোপ পেয়েছিল, হারিয়ে গিয়েছিল বিবেক যেমন হারিয়েছিল হাঁটুতে শর্টগান ঠেকিয়ে গুলি করার সময়। তখন তারা জাহাঙ্গীরকে মারছিল না, ক্ষোভ ঝাড়ছিল ঘুণে খাওয়া একটা সিস্টেমের ওপর। কেননা প্রকাশিত সংবাদের সাথে পত্রিকায় যে ছবি দেয়া হয়েছে সেখানে দেখা যায় ২০-২২ জন মিলে একজন পুলিশকে পেটাচ্ছে। পত্রিকান-রে প্রকাশ, এরমধ্যে ১০-১২ জন শিবির-কর্মী। প্রশ্ন হলো, তাহলে অন্যরা কারা? জানা যায়, অন্যরা ছিল, আশপাশের ট্রাক-বাসের হেলপার কিংবা অন্য পেশায় কর্মরতরা। তারাও সুযোগ পেয়ে তাদের কোনো অতীত ক্ষোভ ঝেড়েছে বেচারা জাহাঙ্গীরের ওপর।

যখন তার ওপর নির্দয়ভাবে আঘাত করা হচ্ছিল তখন তার সঙ্গী অন্য পুলিশ সদস্যরা পালিয়ে নিজেদের জীবন বাঁচিয়েছিল। কেননা তারাও জানত নিজেদের অপকর্মের কথা। অথচ আশ্চর্য লাগে যে, ঐসব পুলিশ সদস্যরা তাদের কমান্ডারকে বাঁচাবার কোনো চেষ্টাই করল না। এমন কী আক্রান- হবার পর উদ্ধারের জন্য তারা নিকটস' থানার শরণাপন্ন হয়ে কোনো মেসেজ পাঠিয়েছিল কী না তা আমার জানা নেই।

পরে এসআই জাহাঙ্গীর যখন রাস-ায় পড়ে আর্তনাদ করছিল তখন সামান্য একজন বিউটিশিয়ান ঝর্ণা বেগমের মনে হলো, এটা পুলিশ নয় মানুষের আর্তনাদ। তাই সে মানবতাবোধের দায় মেটাতে ছুটে গেল তাকে উদ্ধারে খালি হাতে, যা পুলিশ সদস্যরা অস্ত্র নিয়েও সাহস করেনি। এরপর আশপাশ থেকে আরো কয়েকব্যক্তি এসে ঝর্ণা বেগমের সাথে এসআই জাহাঙ্গীরকে ধরে একটা টেম্পুতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। যাবার সময় লুকিয়ে থাকা পুলিশ সদস্যদের মধ্যে একজন এসে তাদের সাথে টেম্পুর সামনে বসে হাসপাতালে যায়।

আমার এ লেখা কাউকে আঘাত দেয়া কিংবা কাউকে কটাক্ষ করার উদ্দেশ্যে নয় বরং এক ধরণের আতংকবোধ থেকে। আসলে কোথায় চলেছি আমরা? এর শেষ কোথায়? আমরা কী একটা স্বাধীন দেশে এটাই চেয়েছিলাম? এর জন্য কী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল? মুক্তিযোদ্ধারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে বুলেটের মুখে এগিয়ে গিয়েছিল কী এ রকম একটা দেশ পাবার জন্য? ওপার থেকে এসব দেখে কী তাঁদের আত্মা শানি- পাবে? এভাবে বিভ্রানি- সৃষ্টি করে কে কাকে মারছে? এক ভাই কী আরেক ভাইকে মারছে না?

পুলিশ নাকি জনগণের বন্ধু। উন্নত দেশগুলোতে সেসবের বহু প্রমাণ আছে। কিন' আমাদের দেশে? কদাচিৎ পত্রিকায় পুলিশের মানবতার কোনো ঘটনা দেখলে নিজের অজানে-ই কেনো যেন চোখে পানি চলে আসে। সাধারণ মানুষের মধ্যে একটা বিশ্বাস প্রবল হয়ে আছে যে, বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা আর পুলিশে ছুঁলে ছত্রিশ ঘা। কেন তা হবে? পুলিশ তো আপনার আমার হয় বাবা, চাচা নয়ত ভাই। অর্থাৎ, একান- কাছের মানুষগুলি একটা সিস্টেমের মধ্যে ঢুকলেই কেন তাদের ভেতর হৃদয়শূণ্য হয়ে যাবে?

আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা তথা দেশের সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে এখনই আমাদের এসব বিষয় নিয়ে ভাবতে হবে। এর পেছনে যেসব সমস্যা অন-রায় হয়ে আছে সেগুলিকে দূর করতে হবে জরুরীভাবে। নতুবা আগামী প্রজন্ম কর্তব্যে অবহেলা কিংবা সুচিনি-ত সিদ্ধান- নিতে ব্যর্থতার কারণে আমাদের মরণোত্তর বিচার চাইতে পারে।

বিষয়: বিবিধ

১৪৫০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File