ভুখন্ড ভিত্তিক জাতিয়তাবাদ ও আমার দাদার ভালোবাসার বিয়োগান্তক কাহিনী।
লিখেছেন লিখেছেন উসামা ইউসুফ ১৭ ডিসেম্বর, ২০১৩, ০৭:০২:৩২ সন্ধ্যা
আমার দাদার জন্ম ১৯২৫ সালে তৎকালীন ভারতবর্ষে। তাই দেশপ্রেমের বর্তমান সংজ্ঞা অনুযায়ী উনার কাছে রাজশাহী যতটা প্রিয় ছিল, ঠিক ততটা প্রিয় না হলেও কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধু ও প্রিয় ছিল। ওই অঞ্চলের লোকগুলোকেও তিনি ভালবাসতেন যদি তিনি দেশপ্রেমিক হয়ে থাকেন।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তাকে বলা হোল কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, মাদ্রাজ রাজস্থান তোমার নয়, সেখান কার মানুষগুলোও তোমার কেউ না। তোমাকে ভালবাসতে হবে ঢাকা, রাজশাহী, বেলুচিস্থান, করাচি, লাহোর, চট্রগ্রামকে, সেখানকার মানুষকে, এই সবের জন্য যদি দরকার হয় তোমাকে নিজের জীবন পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হবে। দাদা বলিলেন তোমরা যে আগে বলেছিলে কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, আসাম, রাজস্থানিদের ভালবাসতে, তাদেরকে ভাইয়ের মত মনে করতে? ওই অঞ্চলগুলোকে নিজের মায়ের মতো ভালবাসতে? আমি যে তাদেরকেও ভালবাসি, রাজশাহী, লাহোর যেমন আমার মা, ঠিক তেমনই দিল্লি, হায়দ্রাবাদ, বোম্বে, কলকাতাও তো আমার মা। তাদেরকেও তো আমি আজো ভালবাসি। দাদাকে বলা হোল, না, এখন থেকে তারা আর তোমার কেউ না। তুমি এখন কেবল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে মা বলে মনে করবে, এখানকার সকল মানুষকে তোমার ভাই এর মত ভালবাসবে। দাদা দুঃখ পাইলেও মেনে নিলেন, অন্যথায় তাকে আবার দেশদ্রোহী, ভারতের চর বলে বিচার করা হতে পারে।
কিন্তু এই নতুন ভাবে সংজ্ঞায়িত মাকেও দাদাকে বেশি দিন ভালবাসতে দেওয়া হোল না, ভালবাসতে দেওয়া হোল না, ভালবাসতে দেওয়া হোল না দাদার ভাইদের। দাদাকে বলা হোল, এখন থেকে কেবল বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) তোমার মা, তোমার মায়ের ব্যাপ্তি হোল টেকনাফ হতে তেতুলিয়া পর্যন্ত। এটাকে তুমি তোমার জীবনের চেয়েও বেশি ভালবাসবে। এই মায়ের জন্য জীবন নেওয়ার ওয়াদা কর। দাদার হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে গেল। দাদা কাঁদতে কাঁদতে বলল সিন্ধু, লাহোর, ওয়াজিরিস্তান, ইসলামাবাদ ওটাও তো আমার মা, ওখানকার লোকগুলোও তো আমার ভাই। দাদাকে বলা হোল, না, ওরা আর তোমার কেউ না। ওরা তোমার আজন্ম শত্রু। জীবনেও কখনো ওই নামগুলো মুখে নেবে না, ওখানকার মানুষগুলোকে ভালবাসবে না, ওরা আমাদের শত্রু। দাদা বলিলেন, কেন তোমারাই তো আমাকে আগে ওদের ভালবাসতে বলেছিলে? তমরাই তো বলেছিলে যে ওয়াজিরিস্থান, লাহোর এই সবই আমার মা। এই মায়ের জন্য জীবন বাজি রেখে সংগ্রাম করতে বলেছিলে। আমি তো তোমাদের কথা মতোই ওই অঞ্চলকেও আমার মা মনে করি, সেখানকার অধিবাসিদের আমার ভাইয়ের মত জীবন দিয়ে ভালবাসি। দাদাকে বলা হোল, দেখিসনি না তারা আমাদের কেমন করে অর্থনৈতিক ভাবে ও রাজনৈতিক ভাবে ঠকিয়েছে? আমাদেরকে হত্যা করেছে? দাদা বললেন, তুমিই তো বলেছিলে যে তারা আমাদের ভাই, তাই ভাই যদি অপরাধ করেই ফেলে তাই বলে কি তুমি মাকে ভেঙে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলবে? আমি এখনো সিন্ধুকে ভালোবাসি, যেমনটি ভালোবাসি পদ্মাকে; আমি এখনো ভালোবাসি লাহোরকে, যেমনটি ভালোবাসি রাজশাহীকে। দাদাকে ধমকের শুরে বলে হোল তুই তাদের ভুলে যা, তুই তোর হৃদয়ে পশ্চিম পাকিস্থানের জন্য কেবল ঘৃণায় জমা করে রাখ। দাদা চিৎকার করে বললেন, পারব না, আমি পারব না। আবার আমার মাকে ভেঙে দ্বিখণ্ডিত করে নিতে। তোমাদের কথা মত সমগ্র ভারতকে মা বলেছিলাম; আবার তোমরাই আমাকে শেখালে কলকাতা, হায়দ্রাবাদ আমার কেউ না। আমি কষ্ট পেলেও মেনে নিয়েছিলাম। এখন বলছ সিন্ধুও আমার মা না, লাহোর আমার মা না। তাদের ঘৃণা করতে বলছ। হয়ত কদিন পরে বলবে, পার্বত্য চট্রগ্রাম আমার মা না। আমি আর পারব না মাকে ভুলে যেতে, ভাইকে ভুলে যেতে। দাদাকে প্রহার করতে করতে বলা হোল, তুই বাংলাদেশের শত্রু, তুই পাকিস্থানের চর, তুই রাজকার, তোকে ফাঁসিতে ঝুলাব?
[গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক]
বিষয়: বিবিধ
১৫২৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন