স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে সিয়ামের উপকারিতা

লিখেছেন লিখেছেন এমরান ইবনে আলী ১৮ জুলাই, ২০১৩, ১২:১৪:১০ রাত



স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যবিধি দুটো দিক বিবেচনায়ই রোজার রয়েছে হিতকর প্রভাব। স্বাস্থ্যবান থাকার জন্য উপবাস যে অপরিহার্য বিষয় তা ধর্ম, সংস্কৃতিচর্চা ও কথকতায় রয়েছে। মন ও শরীর দুটোর কল্যাণের জন্যই উপবাস অবশ্যকরণীয়। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরাও এ কথা এখন স্বীকার করছেন।

সংযম পালন মানুষের ইচ্ছাশক্তিকে দৃঢ় করে, রুচিকে পরিশীলিত করে, ভালো কাজ করার জন্য প্রণোদনা দেয়, সুস্থ মানস ও ব্যক্তিত্ব গঠনে সাহায্য করে। কষ্ট সহ্য করার শক্তি, ধৈর্যশক্তি ও সংযম-এ গুণাবলি মানুষ অর্জন করে আংশিকভাবে হলেও উপবাসচর্চায়।

দৈহিক-মানসিক নানা রোগ প্রতিরোধে ও চিকিৎসায় উপবাসের ভূমিকা এখন স্বাস্থ্যবিজ্ঞানীরা স্বীকার করছেন। পাচকনালির রোগ, কোলাইটিস, যকৃতের রোগ, বদহজম, মেদস্থূলতা, হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হাঁপানি-এসব ব্যাধিতে উপবাসের ভূমিকা নিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানী মহলে ইতিবাচক আলোচনা যেমন শুরু হয়েছে, তেমনি এর প্রয়োগও দেখা যাচ্ছে।

একজন সুইস চিকিৎসক ডা· বার্সিলাস লক্ষ করেছেন, কয়েকবার ওষুধ খাওয়ার চেয়েও প্রতিবিধান হিসেবে ক্ষুধার সুবিধা অনেক বেশি।

সাধারণভাবে বলতে গেলে উপবাস দেহের ক্ষয়ে যাওয়া কোষ ধ্বংসের কাজে সহায়তা করে, ক্ষুধা এ কাজকে পূর্ণতা দেয়। এরপর খাদ্য ও পুষ্টির মাধ্যমে নির্মিত হয় নতুন কোষকলা।

এ জন্য অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন, তারুণ্য পুনরুদ্ধারের জন্য উপবাস হলো একটি কার্যকর উপায়। তবে রোগী ও অতিবৃদ্ধ মানুষের জন্য উপবাসের ব্যাপারে শিথিলতা তো রয়েছেই।

উপবাসের থাকতে হবে নিয়মনীতি, কোনো কোনো বেলা না খেয়ে থাকা মানে উপবাস নয়। এতে স্বাস্থ্য ও স্ট্যামিনা বরং নষ্ট হয়।

একাদশ শতাব্দির শ্রেষ্ঠ চিকিৎসক ইবনে সিনা তাঁর অনেক রুগীদের তিন সপ্তাহ রোজা পালনের উপদেশ দিতেন। আধুনিক বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এই মর্মে মত পোষণ করেছে যে, রোজা সুস্থ শরীর ও স্বাস্থ্যের সহায়ক । ১৯৫১ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্যাথলজি বিভাগে গ্যাষ্ট্রিক জুসের উপর বিশ জন চিকিৎসক গবেষণা করে দেখেছেন যে, রোজা গ্যাষ্ট্রিক আলসার, পেট ব্যথার উপকার করার ক্ষেত্রেও ভূমিকা পালন করে। সারা বছরে দেহাভ্যান্তরে যে জৈব বিষ (টক্রিন) জমা হয় তা রোজার আগুনে জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে রক্ত বিষমুক্ত হয়। রোজা লিভার, পীহা, কিডনী, মূত্রথলি ও পরিপাকতন্ত্রকে দীর্ঘায়ু দান করে। উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অস্বাভাবিক কোলেষ্টেরল, শরীরের অতিরিক্ত মেদ বা চর্বি নিয়ন্ত্রন করে। রোজা মস্তিস্ক ও স্নায়ুতন্ত্রকে সর্বাধিক উজ্জীবিত করে। দেহের অনুকোষ ও প্রজনন অঙ্গ সমূহকে নব-জীবনী শক্তি দান করে। হাঁপানী, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাসিক ঋতুর গোলযোগ, আরটিকেরিয়া, মিগ্রেইন, রোগের প্রতিষেধক হলো রোজা। ডাঃ পেভি ফ্যস ও বার্নাভের মতে, রোজার দ্বারা মেলিটাল, গাইকেসিরিয়া, মেলিকুরিয়া রোগের উপশম হয়। আধুনিককালের বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ থেকে দেখছেন যে, রোজা পালনের ফলে শরীরের অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পায় এবং বিপাকক্রিয়া শক্তিশালী হয়, যা ডায়াবেটিস রোগ থেকে আত্মরক্ষার সম্ভাবনাকে উজ্জল করে তোলে।

হার্টের স্বভাবিক কর্মকান্ড নির্বিঘ্নে চলে, করোনারি ধমনীর মধ্য দিয়ে নির্বিঘ্নে রক্ত প্রবাহিত হলে। করোনারি ধমনীর অনেক শাখা-প্রশাখা হৃৎপিন্ডের পেশির ভেতরে বিস্তার লাভ করে এবং কোষগুলোর স্বাভাবিক কাজকর্ম ঠিক রাখে। কিন্তু হার্টের কাজকর্মে বিপত্তি ঘটে তখন, যখন করোনারি ধমনীতে জমে যায় টুকরো টুকরো চর্বি। ফলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। আর এ কারণেই হঠাৎ হার্টফেল করে। কেউ কেউ মারাও যায়। কিন্তু বছরে এক মাস রোজা পালন করার ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই করোনারি ধমনী চর্বিমুক্ত থাকে।

গ্যাসট্রিক রোগীদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা গেছে যে, রোজা পালনের কারণে, তাদের ধারণা মতো Acidity তো বৃদ্ধি পায়-ই না বরং দীর্ঘ এক মাস রোজা পালন করলে অস্বাভাবিক গ্যাসট্রিক এসিডিটি ( Abnormal Gastic Acidity )স্বাভাবিক পর্যায়ে চলে আসে এবং পেপটিক আলসার থেকে রোগী পর্যায়ক্রমে পরিত্রাণ লাভ করে।

আমেরিকার বিখ্যাত চিকিৎসাবিদ Dr. Dewey এ বিষয়ে গবেষণার রিপোর্ট পেশ করে বলেছেন: ‘

‘ Take the food away from stomach and then you have begun to starve not the sick man but the disease. The digestive organs are given some rest to work with redoubled energy and vigour just as a land which was left without cultivation for one year following or just as a man can work with redoubled vigour after some rest.’

সিয়াম পালনের মাধ্যমে ধূমপান ও নেশা জাতীয় দ্রব্য পরিহার করা সম্ভব। ফলে মানুষের দেহে জটিল রোগ যেমন- ক্যান্সার, হার্ট-স্ট্রোক,ব্রেইন স্ট্রোকসহ বহু জটিল রোগের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।

ডা. এমারসন বলেন, সিয়ামে মানুষের মনের ওপর দারুন প্রভাব পড়ে। যেমন কর্মে মনোযোগ আসে, পশুত্ব দূরিভূত হয়, যা সমাজ গঠনে সহায়তা করে।

প্রখ্যাত স্বাস্থ্য বিজ্ঞানী ডাঃ শেলটন তার “সুপিরিয়র নিউট্রিশন” গ্রন্থে বলেছেন- উপবাসকালে শরীরের মধ্যস্থিত, প্রোটিন, ফ্যাট ও শর্করা জাতীয় পদার্থসমূহ স্বয়ং পাচিত হয়। ফলে গুরুত্বপূর্ণ কোষগুলোতে পুষ্টি বিধান হয়। এই পদ্ধতিকে “এ্যান্টো লিসিস” বলা হয়। এর ফলে শরীরে উৎপন্ন উৎসেচকগুলো বিভিন্ন কোষে ছড়িয়ে পড়ে। এটি হচ্ছে শরীর বিক্রিয়ার এক স্বাভাবিক পদ্ধতি। রোজা এই পদ্ধতিকে সহজ, সাবলীল ও গতিময় করে। ভেষজের জনক হিপ্লোক্র্যাটন দু’ হাজার চারশ’ বছর আগে বলেছিলেন “খাদ্য তোমার রোগের ওষুধ”। অর্থাৎ খাদ্যকে আয়ত্ত করার মাধ্যমে বিভিন্ন রোগ হতে মুক্তি পাওয়া যায়। আর এই আয়ত্ত করার অন্যতম মাধ্যম হলো রোজা।

নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ওষুধ ও শল্য চিকিৎসার প্রখ্যাত ডাঃ অ্যালেকসিস বলেছেন, পুনঃ পুনঃ নিয়মিত এবং বেশি পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ এমন এক শরীর বৃত্তয় ক্রিয়ায় বাধাদান করে যা মানব প্রজাতির ঊর্ধ্বতন বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। রোজার উপবাসের মাধ্যমে লিভার রক্ত সঞ্চালন দ্রুত হয় ফলে ত্বকের নিচে সঞ্চিত চর্বি, পেশীর প্রোটিন, গ্রন্থিসমূহ এবং লিভারে কোষসমূহ আন্দোলিত হয়। আভ্যন্তরীণ দেহ যন্ত্রগুলোর সংরক্ষণ এবং হ্নদপিণ্ডের নিরাপত্তার জন্য অন্য দেহাংশগুলোর বিক্রিয়া বন্ধ রাখে। খাদ্যাভাব কিংবা আরাম-আয়েশের জন্য মানুষের শরীরের যে ক্ষতি হয়, রোজা তা পূরণ করে দেয়।

ডাঃ আইজাক জেনিংস বলেছেন, " যারা আলস্য ও গোড়ামীর কারণে এবং অতিভোজনের কারণে নিজেদের সংরক্ষিত জীবনী শক্তিকে ভারাক্রান্ত করে ধীরে ধীরে আত্মহত্যার দিকে এগিয়ে যায়, রোযা তাদেরকে এ বিপদ থেকে রক্ষা করে।

বিশ্বখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী নাষ্টবারনার বলেন, "ফুসফুসের কাশি, কঠিন কাশি, সর্দি এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা কয়েকদিনের রোযার কারণেই নিরাময় হয়।

ডাক্তার দেওয়ান এ,কে,এম, আব্দুর রহীম বলেছেন, "রোযাব্রত পালনের কারণে মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্র সর্বাধিক উজ্জীবিত হয়।

স্বাস্থ্যবিজ্ঞানী ডা. আব্রাহাম জে হেনরি রোযা সম্পর্কে বলেছেন, "রোযা হলো পরমহিতৈষী ওষুধ বিশেষ। কারণ রোযা পালনের ফলে বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে মানুষ কম আক্রান্ত হয়।

পাকিস্তানের প্রখ্যাত প্রবীণ চিকিৎসক ডা. মুহাম্মদ হোসেনও একই ধরনের কথা বলেছেন। তারমতে, "যারা নিয়মিত রোজা পালনে অভ্যস্ত সাধারণত তারা বাতরোগ, বহুমূত্র, অজীর্ণ, হৃদরোগ ও রক্তচাপজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত কম হন।"

চিকিৎসা বিজ্ঞানী ডা. ক্লাইভ বলেন, "রোযার বিধান স্বাস্থ্যসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত । সেহেতু ভারত, জাপান, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ নাইজেরিয়াতে অন্যসব এলাকার তূলনায় মুসলিম অধ্যুষিত এলাকায় রোগ ব্যাধি অনেক কম দেখা যায়।"

রাশিয়ার অধ্যাপক ডি এন নাকিটন বলেছেন, তিনটি নিয়ম পালন করলে শরীরের বিষাক্ত দ্রব্যাদি বের হয়ে যাবে এবং বার্ধক্য থামিয়ে দেবে।' তার বর্ণিত নিয়ম তিনটি হলো অধিক পরিশ্রম, অধিক ব্যায়াম, এবং মাসে কমপক্ষে একদিন উপবাস।

এব্যাপারে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহান চিকিৎসা বিজ্ঞানী মুহাম্মদ (সাঃ) কম খাওয়ার জন্য বিশেষ গুরুত্বারোপকরেছেন । ক্ষুধা লাগলে খেতে বলেছেন এবং ক্ষুধা থাকতেই খাওয়া বন্ধ করার জন্য উপদেশ দিয়েছেন, যা আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত ।

খাদ্য গ্রহণের ক্ষেত্রে এই নীতিমালা অনুযায়ী পেটের তিন ভাগের অন্তত একভাগ অংশ খালি রেখে খাদ্য গ্রহণ করলে অনেক সময় স্বাস্থ্যগত দিক থেকে নিরাপদ থাকা যায় । মহানবী(সাঃ) এরশাদ করেন, রোজা মুমিনের জন্য ঢালস্বরূপ । একনাগাড়ে একটি পূর্ণ চন্দ্র মাসে সিয়াম সাধনার মাধ্যমে অসৎকাজ, ক্রোধ, লোভ,মোহ, মদ ইত্যাদি দমন করার ব্যবস্থা করা হয়েছে । ফলে রোজাদারমাত্রই রোজার মাধ্যমে আত্মসংযমের পরিচয় দিয়ে মিথ্যা, পরনিন্দা, গালাগালি,বদমেজাজ, ফাঁকি দেয়া, নিরর্থক কথাবার্তায় লিপ্ত হওয়া ইত্যাদি সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে নিবৃত থাকবে, সিয়াম সাধনার শিক্ষাই হলো এটি । আর এভাবে সারাবছর চলার এক বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রত্যেক রোজাদার পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে পেয়ে থাকে । অতএব রোজার প্রভাব মানুষের ব্যক্তি,পারিবারিক ও সামাজিক এবং রাষ্ট্রিয় জীবনেও প্রবল ভূমিকা রাখে ।

বিষয়: বিবিধ

৩৭০৩ বার পঠিত, ১ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

383099
২২ মে ২০১৭ রাত ১১:৩০
ইসলাম কিংডম লিখেছেন : রোযার উপকারিতা ও প্রভাব
- রোযা মানুষকে শৃঙ্খলা, ঐক্য, ভালবাসা, ন্যায়পরায়ণতা এবং সমতা বিধানের শিক্ষা দেয়। রোযা মানুষদের অন্তরে দয়া, সহানুভূতি এবং পরোপকারিতার মনোভাব সৃষ্টি করে। যেমনিভাবে সমাজকে বিভিন্ন অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে দূরে রাখে।
- সিয়াম আত্মাকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং এটি দায়িত্বশীল ও সহনশীল করার একটি কার্যকরী প্রশিক্ষণ।
বাকিটুকু পড়ুন: http://bit.ly/2qO1wIs

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File