যুগে যুগে ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা
লিখেছেন লিখেছেন এমরান ইবনে আলী ২৮ মে, ২০১৩, ০২:১৫:৪৪ রাত
একজন মু’মিনের মর্যাদা পরীক্ষার মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। ঈমানের ঘোষণা দেয়ার পর একজন বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য সূচিত হয়। কেননা ঈমানদারের জ্ঞানের উৎস আর অবিশ্বাসীর জ্ঞানের উৎস এক নয়। তাই বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর কর্মজীবনে পার্থক্য দেখা দেয়। অনুসরণ ও অনুকরণের মানদন্ডের ক্ষেত্রে বিশ্বাসী ও অবিশ্বাসীর মধ্যে পার্থক্য হয়। কৃষ্টি ও কালচারের ক্ষেত্রে পার্থক্য হয়। এর ফলে প্রচলিত সমাজ ও সভ্যতা এবং মিথ্যা রুসম রেওয়াজের ধারক ও বাহকগণের স্বার্থে আঘাত আসে। কেননা তারা মানুষকে মানুষের গোলামে পরিণত করতে চায়। কিন্তু একজন ব্যক্তি এক আল্লাহতে ঈমান আনার পর নিজে শুধু মানুষের গোলামী ত্যাগ করে আল্লাহর গোলাম হয়ে যায়না, বরং অন্যান্য মানুষকেও আল্লাহর গোলামে পরিণত করার জন্য কথা ও উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে দাওয়াত ইলাল্লাহর কাজ করে। তাই তারা ঈমানের দাবীকে সহ্য করতে পারেনা। অতীতে যারাই ঈমানের ঘোষণা প্রদান করেছিল তাদের সাথে কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বন্দ্ব হয়েছে।
মুহাম্মদ (সঃ) ও তাঁর সাহাবীরা ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হয়েছেন। তদানীন্তন মানুষগুলো আল্লাহর রাসূলকে নবুওয়াত পূর্ববর্তী সময়ে আল-আমীন, আস-সাদেক উপাধিতে ভুষিত করেছিল। কিন্তু কালিমা’ লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’’ এর প্রতি দাওয়াত দেয়ার পরপরই তারা নানা অপপ্রচার, বাধা, সামাজিক বয়কট, হত্যা ষড়যন্ত্র ও নির্যাতন শুরু করে দেয়। মূলত ইসলাম কায়েমের চেষ্টা যখনই চলেছে তখনই ইসলাম বিরোধীদের কাছ থেকে বাঁধা এসেছে। এ বাঁধা মোকাবিলার ক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠাকারীরা কখনও উগ্রতা প্রদর্শন করেনি। ধৈর্য ও সহিষ্ণুতা ও হিকমতের মাধ্যমে ইসলামী দাওয়াতী কাজ অগ্রসর হয়েছে। আসহাবে রাসূল (সঃ) ত্যাগের মহিমায় উজ্জীবিত হয়ে দ্বীনের প্রচার ও প্রতিষ্ঠার কাজ করেছেন।
হযরত বেলালের উপর কি অমানবিক নির্যাতন করা হয়েছিল? প্রচন্ড গরম বালুর উপর শুইয়ে দিয়ে বুকে পাথর চাপা দেয়া হয়েছিল। তবুও তিনি আহাদ আহাদ বন্ধ করেননি। হযরত আবূ যারকে ঈমান আনার কারণেই রক্তাক্ত হতে হয়েছে। সুদর্শন যুবক মাসয়াব বিন উমাইরকে দ্বীনের দাওয়াত কবুল করার পর ত্যাগ করতে হয়েছে সকল সহায় সম্পদ। বিলাস বহুল জীবন যাপনের পরিবর্তে কষ্টকর জীবন যাপন করতে হয়েছে। হযরত আমের বিন ফাহিরার শরীর কাঁটা দিয়ে বিদ্ধ করা হয়েছে। এ ধরনের নির্যাতনে তাঁর দৃষ্টি শক্তি লোপ পায়। অবশ্য আল্লাহর কুদরাতে পরে আবার দৃষ্টি ফিরে পান। হযরত খাববাবকে জ্বলন্ত অংগারে শুইয়ে রাখা হতো তাঁর চর্বিতে আগুন নিভে যেতো। হযরত আমেরকে পানিতে ডুবিয়ে নির্যাতন করা হয়। তাঁর মা হযরত সুমাইয়ার লজ্জাস্থানে বর্শা নিক্ষেপ করে শহীদ করে দেয়া হয়। তাঁর পিতা ইয়াসীর ও ভাই আব্দুল্লাহ নির্যাতনের শিকার হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। হযরত যায়েদ বিন দাসানাকে বলা হয় “তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদকে শুলে চড়ালে তুমি কি সহ্য করবে’’? তিনি জবাব দেন “তাঁকে শুলে চড়ানোতো দুরে কথা তাঁর পায়ে কাটার ফোঁটাও সহ্য করবোনা’’। এ কথা শোনার পর তাঁর উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয় ফলে তিনি শহীদ হয়ে যান। হযরত হামজার কলিজা চিবিয়ে খাওয়া হয়েছে। এভাবে অসংখ্য সাহাবীকে অবর্ণনীয় নির্যাতন সহ্য করে দ্বীনের পথে চলতে হয়েছে। এ ধরনের নির্যাতনের সময় আল্লাহ মুসলমানদেরকে প্রতিশোধ পরায়ন করে তোলেননি। তিনি সে সময় ঘোষণা করেছেন,
তোমরা কি মনে করছো, এমনিতেই তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে? অথচ তোমাদের আগে যারা ঈমান এনেছিল তাদের উপর যা কিছু নেমে এসেছিল এখনও তোমাদের উপর সে সব নেমে আসেনি। তাদের উপর নেমে এসেছিল কষ্ট ক্লেশ ও বিপদ মসিবত, তাদেরকে প্রকম্পিত করা হয়েছিল। এমনকি সমকালীন রাসূল এবং তাঁর সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল, আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখন তাদেরকে এই বলে স্বান্ত্বনা দেয়া হয়েছিল, অবশ্যই আল্লাহর সাহায্য নিকটে- (বাকারা ২১৪)।
এটা ঠিক যে, পৃথিবীতে যখনই হকের আওয়াজ উঠেছিল তখনই বাতিল পন্থীদের পক্ষ থেকে নির্যাতন চালানো হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) কে আগুনে নিক্ষেপ, জাকারিয়া (আঃ) কে করাত দ্বারা হত্যা করা হয়। হযরত ইয়াহইয়ার শিরচ্ছেদ করে ইয়াহুদী শাসক হিরোডিয়াস তার প্রেমিকাকে উপহার দিয়েছিল। হযরত ইলিয়াসকে হত্যার চেষ্টা করা হলে তিনি সিনাঈ দ্বীপে আশ্রয় নেন। হযরত ইয়ারমিয়াহকে ক্ষুধা ও পিপাসায় মেরে ফেলার জন্য রশি দিয়ে বেঁধে কুয়ার মাঝে ঝুলিয়ে রাখা হয়। এভাবে হযরত ঈসাকে শুলিতে চড়ানোর চেষ্টা, মুসা(আঃ) কে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা সহ অসংখ্য নবী রাসুলকে হত্যা-নির্যাতন করা হয়। আল্লাহর রাসূল তাঁর আসহাবকে সে সব নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তোমাদের আগে অতীত কালে এমন লোকও ছিল লোহার চিরুনী দিয়ে যাদের গোশত চেঁছে ফেলা হয়েছিল। হাড্ডি ছাড়া তাদের শরীরে আর কিছুই ছিলনা। এ কঠোর অবস্থায়ও তাঁরা নিজের দ্বীনের উপর থেকে আস্থা হারাননি। তাঁদের মাথার উপর করাত চালানো হয়েছে, করাত দিয়ে চিরে তাদেরকে দুভাগ করা হয়েছে। এ সত্বেও তাঁরা দ্বীন ত্যাগ করেননি।
আল্লাহ ও তাঁর রাসূল সাহাবাদেরকে সেসব ইতিহাস স্মরণ করিয়ে দিয়ে উগ্র করে তোলেননি বরং আরও ধৈর্যশীল বানাবার চেষ্টা করেছেন। পাশাপাশি তিনি মুসলমানদের ভয় না পাবার জন্য সাহস যুগিয়েছেন। আল্লাহ মুসলমানদের উদ্দেশ্যে বলেন, তোমরা হীনবল হয়োনা এবং দুঃখিত হয়োনা, তোমরাই সমুন্নত থাকবে যদি তোমরা মু’মিন হও- (আলে ইমরান ১৩৯)।
মুসলমানরা কখনও ইসলাম বিরোধীদের আক্রমণে ভয় পায়নি; ভড়কে যায়নি। তাদের ঐক্যবদ্ধ হামলাও সাহসিকতার সাথে মোকবিলা করেছে। তাই ওহুদ যুদ্ধের পর আহত অবস্থায়ও জিহাদের ময়দানে ছুটে গিয়েছেন। আহতরা একে অপরের কাঁধে ভর করে জিহাদের ময়দানে যাওয়ার বিবরণ কুরআনুল পাকে এভাবে এসেছে, আহত হবার পরও যারা আল্লাহ ও রাসূলের আহবানে সাড়া দিয়েছে, তাদের মধ্যে যারা সৎ নেককার ও মুত্তাকী তাদের জন্য রয়েছে বিরাট প্রতিদান। আর যাদেরকে লোকেরা বললো, তোমাদের বিরুদ্ধে বিরাট সেনা সমাবেশ ঘটেছে। তাদেরকে ভয় করো, তা শুনে তাদের ঈমান আরও বেড়ে গেছে এবং তারা জবাবে বলেছেঃ আমাদের জন্য আল্লাহই যথেষ্ট এবং তিনি সব চেয়ে ভাল কার্য উদ্ধারকারী- (আলে ইমরান ১৭২-১৭৩)। মূলত মুসলমানরা দ্বীনে হক বিজয়ের ক্ষেত্রে নৈতিক আদর্শ ও ত্যাগের মাধ্যমেই মানুষের মন জয় করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে উগ্রতা কিংবা বাড়াবাড়ি ছিলনা। আর তাদের মধ্যে ভীরুতা বা কাপুরুষতার পরিবর্তে ছিল শাহাদাতের তামান্না।
আল্লাহ পাক কুরআনে এই কথা পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন যে ঈমান আনার সাথে সাথেই পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে। এই প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেনঃ
আলিফ- লাম মীম। লোকেরা কি মনে করে রেখেছে যে, আমরা ঈমান এনেছি কেবলমাত্র একথাটুকু বললেই তাদের ছেড়ে দেয়া হবে আর পরীক্ষা করা হবেনা? অথচ আমি তাদের পূর্ববর্তী সবাইকে পরীক্ষা করে নিয়েছি। আল্লাহ অবশ্যই দেখবেন কে সত্যবাদী এবং কে মিথ্যুক। আর যারা খারাপ কাজ করছে তারা কি মনে করে বসে আছে তারা আমার থেকে এগিয়ে চলে যাবে? বড়ই ভুল সিদ্ধান্ত তারা করেছে। যে কেউ আল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ করার আশা করে (তারা জানা উচিত) আল্লাহর নির্ধারিত সময় আসবেই। আর আল্লাহ সব কিছু শোনেন ও জানেন। যে ব্যক্তি প্রচেষ্টা সংগ্রাম করবে সে নিজের ভালর জন্যই করবে। আল্লাহ অবশ্যই বিশ্ববাসীদের প্রতি মুখাপেক্ষীতাহীন। আর যারা ঈমান আনবে এবং সৎ কাজ করবে তাদের দুষ্কৃতিগুলো আমি তাদের থেকে দূর করে দিব এবং তাদেরকে তাদের সর্বোত্তম কাজগুলোর প্রতিদান দেবো- ( আনকাবুত ১-৭ )।
যখন মুসলমানদের উপর নির্যাতন নিপীড়ন চলছিল সে সময় তাদের মধ্যে অবিচলতা এবং ঈমানের দৃঢ়তা আনার জন্য এই আয়াত সমূহে আলোকপাত করা হয়। আল্লাহ পাক কুরআনের অনেক জায়গায় অতীতের নবী রাসূলদের কাহিনী তুলে ধরেছেন যে তাঁরা কতকাল মানুষকে আল্লাহর উপর ঈমান আনার দাওয়াত দিয়েছে এবং এজন্য কত নির্যাতন নীপীড়ন ভোগ করেছেন। তারপর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁদেরকে সাহায্য সহযোগিতা করা হয়েছে। তাই আমাদেরকেও মনে করতে হবে আল্লাহর সাহায্য নিশ্চয়ই আসবে- তবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখা হবে কারা ঈমানের দাবীতে সঠিক আর কারা মুনাফিক। আল্লাহ কুরআনে অতীতে ধ্বংসপ্রাপ্ত জাতিগুলোর কথা তুলে ধরেছেন। এর অর্থ হচ্ছে আজকেও যারা সীমালংঘন করে তারা কখনও পাকড়াও হবেনা এমনটি ভাবা ঠিক নয়। যুলম নির্যাতনকারীরা সীমা ছাড়িয়ে গেলে আল্লাহ তাদেরকে ধবংস করে দেন। মুসলমানদেরকে পথ নির্দেশ দেয়া হয়েছে যে যুলম-নির্যাতন সহ্যের সীমার বাহিরে চলে গেলে ঈমান ত্যাগ করার পরিবর্তে হিজরত করতে হবে। যেখানে ঈমান আক্বীদা নিয়ে চলা যায় এবং আল্লাহর বন্দেগী করা যায় এমন জায়গায় চলে যেতে হবে তারপরও ঈমান ত্যাগ করা যাবেনা।
ক্বুরতুবী বলেন এই আয়াতে নাস বলতে মক্কায় ঈমান গ্রহনকারী সেই সকল ব্যক্তির কথা বুঝানো হয়েছে যারা নির্যাতন ও নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছিলেন। যেমন আম্মার ইবন ইয়াসির, ইয়াসের, সুমাইয়া। তাদেরকে সান্ত্বনা দেয়ার জন্য এই আয়াত নাযিল হয়। এই আয়াতের মাধ্যমে প্রত্যেক যুগের ঈমানদারদেরকে এই মেসেজ দেয়া হচ্ছে ঈমানের পথ ফুল বিছানো নয়- অতীতেও যারা ঈমানের দাবী করেছে তাদেরকে পরীক্ষা করা হয়েছে- বর্তমানেও করা হচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও করা হবে। ক্বিয়ামত পর্যন্ত এই পরীক্ষা অব্যাহত থাকবে। ইতিহাস থেকে প্রমাণিত যে মক্কায় কেউ ইসলাম গ্রহণ করলে তার উপর যুলম নির্যাতনের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো। ভীষণ ভাবে মারপিট আর কঠোর নির্যাতন করা হতো। যেমনঃ বেলাল (রা) বুকে পাথর চাপা দিয়ে রাখা হতো- এভাবে আরও অনেক সাহাবাকে নির্যাতন করা হয়েছে। দোকানদার-কারিগর হলে রুটি-রুজির পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। এমনকি অনাহারে মৃত্যুর প্রহর গুনতে হতো। ঈমানদার প্রভাবশালী হলে তাকে পরিবার পরিজনের সদস্যরা হেয় প্রতিপন্ন করতো। এই কারণে অনেক মানুষ রাসূলে কারীম (সা) এর রিসালাতের সত্যতা স্বীকার করলেও ঈমান আনতে ভয় পেতো। নিষ্ঠাবান ঈমানদারদের মনেও সব সময় একটা চাঞ্চল্য বিরাজ করতো।
হযরত খাব্বাব ইবন আরাত সে অবস্থার বিবরণ দিয়ে একটি হাদীস বলেন যে রাসূলে কারীম (সা) একবার কাবাঘরের ছায়ায় বসে আছেন, সেখানে উপস্থিত হয়ে তিনি বললেন হে আল্লাহর রাসূল আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেননা। একথা শুনে তাঁর চেহারা রক্তিমবর্ণ হয়ে গেছে এবং বললেন তোমাদের পূর্বে যেসব মু’মিনগণ অতিক্রম হয়েছে তারা এর চেয়ে বেশী নিগৃহীত হয়েছে। তাদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হতো। তারপর মাথার উপর করাত চালিয়ে দ্বিখন্ড করা হতো। কারো অঙ্গ প্রত্যঙ্গ লোহার চিরুনী দ্বারা আঁচড়ানো হতো যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে।
ঈমানদারদের প্রতি যুলম নির্যাতন কোন নতুন ব্যাপার নয়- অতীতে যারাই ঈমানের দাবী করেছে তাদের সকলকেই পরীক্ষা করা হয়েছে। আর এ পরীক্ষা হচ্ছে আমরা ঈমানের দাবীতে কতটুকু খাঁটি তা যাছাই করার জন্য। পরীক্ষা ছাড়া কেউ এক ক্লাস থেকে আরেক ক্লাসে যেতে পারেনা। ঈমানের পরীক্ষা ছাড়া আমরা জান্নাতে যেতে পারবোনা। ঈমানের অগ্নি পরীক্ষার মাধ্যমেই মানুষের অবস্থা যাছাই করেন- আল্লাহ বলেনঃ
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে পরীক্ষা করবো, যাতে তোমাদের অবস্থা যাচাই করে নিতে পারি এবং দেখে নিতে পারি যে, তোমাদের মধ্যে কারা মুজাহিদ ও ধৈর্যশীল- (মুহাম্মদ ৩১)।
অতীতে প্রত্যেক যুগেই ঈমানদারেরা নানা পরীক্ষার সন্মুখীন হয়েছে। কিন্তু ঈমানদারগণ সর্বদা বিপদ মুসীবত স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করে। এই প্রসঙ্গে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেঃ
এ সময় যদি তোমাদের উপর আঘাত লেগে থাকে, তাহলে এর আগে তোমাদের বিরোধী দলের উপরও এ ধরনের আঘাত লেগেছে। এটা তো সময়ের উত্থান ও পতন মাত্র, যা আমি মানুষের মধ্যে একের পর এক দিয়ে থাকি। তোমাদের উপর এ সময়টা এ জন্য আনা হয়েছে যে, আল্লাহ দেখে নিতে চেয়েছিলেন যে, তোমাদের মধ্যে সাচ্চা মু’মিন কারা এবং তিনি কি তোমাদের মধ্য থেকে ঐ লোকদেরকে বাছাই করে নিতে চেয়েছিলেন, যারা আসলেই (সত্যের) সাক্ষী। কেননা যালিমদেরকে আল্লাহ পছন্দ করেন না। আর তিনি এ পরীক্ষার মাধ্যমে মু’মিনদেরকে আলাদা করে নিয়ে কাফিরদেরকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন (আল ইমরান ১৪০-১৪১)।
বিপদ-মুসীবতের সময় আল্লাহ তায়ালা কিভাবে মুসলমানদের প্রতি শান্তি দান করেছেন তা নিন্মোক্ত আয়াতে তুলে ধরেনঃ
এ দুঃখ-বেদনার পর আল্লাহ তোমাদের মধ্যে কিছু লোকের উপর এমন সান্ত্বনার অবস্থা কায়েম করলেন যে, তাদের ঘুম পেতে লাগলো। কিন্তু অন্য আর একটি দল ছিলো, যাদের নিকট শুধু তাদের স্বার্থেরই গুরুত্ব ছিলো। তারা আল্লাহ সম্পর্কে নানারকম জাহেলী ধারণা করতে লাগলো, যা সরাসরি সত্যের বিরোধী ছিলো। তারা এখন বলছেঃ এ কাজের ব্যবস্থা করার ব্যাপারে আমাদের কোন অংশ আছে কি? তাদেরকে বলুনঃ (কারো কোন অংশ নেই) এ কাজের সব ক্ষমতাই আল্লাহর হাতে। আসরে এরা তাদের দিলে যে কথা গোপন করে রেখেছে তা তোমাদের কাছে প্রকাশ করে না। তারা বলতে চায়, যদি (নেতৃত্বের) ক্ষমতায় আমাদের কোন অংশ থাকতো তাহলে এখানে আমরা নিহত হতাম না। তাদেরকে বলে দিনঃ যদি তোমরা নিজেদের ঘরেও থাকতে তাহলে যাদের মওত লেখা ছিলো তারা নিজেই তাদের নিহত হবার জায়গার দিকে বের হয়ে আসতো। আর এই যে ব্যাপার ঘটে গেলো তার কারণ এই যে, যা কিছু তোমাদের মনে গোপন রয়েছে আল্লাহ তা পরীক্ষা করতে চেয়েছেন। আর তোমাদের যে ত্রুটি আছে তা দূর করতে চেয়েছেন। আল্লাহ মনের অবস্থা খুব জানেন। (আল ইমরান ১৫৪)।
অতীতে শুধু পুরুষেরা নয় অনেক মহিলাও ঈমানের অগ্নি পরীক্ষা দিয়েছেন। এই প্রসঙ্গে হযরত আসিয়া ও তাঁর দাসীর ঘটনা উল্লেখ করছি। আসিয়ার সাথে কথোপকথনের পর ফেরাউনের মনে এ ধারণা সৃষ্টি হয় যে তার রাজ পরিবারের ভিতরই মুসার অনুসারী হয়ে গেছে। বিশেষত হেযকিল, তার স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে ও আসিয়ার সেবিকা সকলেই মুসার ভক্ত হয়ে পড়ে। ফেরাউন তার সৈন্য বাহিনীকে আদেশ দেয় তাদেরকে নির্মম শাস্তি দেয়ার জন্য। নির্দেশ মতো একদল সৈন্য এসে আসিয়ার সেবিকা ও অন্যদেরকে বন্দী করে ফেলে। আসিয়ার সেবিকাকে কেউ চুল ধরে আর কেউ হাত পা ধরে ফেরাউনের সামনে নিয়ে যায়। ফেরাউন তাকে লক্ষ্য করে প্রশ্ন করে “হে বিশ্বাসঘাতকিনী! বল তোমার রব কে? সেবিকা জবাব দেয়” আমার ও তোমার রব একজনই তিনি হচ্ছেন আল্লাহ। যিনি সকলকেই সৃষ্টি করেছেন। একথা শোনার পর ফেরাউন উত্তেজিত কন্ঠে বলতে লাগলো” হে বিশ্বাসঘাতকিনী! তুমি আমার সাথে একথা বলতে পারলে? তোমার সাহস এত বেশী হয়ে গেছে? অতপর দেহরক্ষীর দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দেয় “একে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা কর। তাকে হত্যার আগে তার সামনে তার ছেলে সন্তানকে আগুনে জ্বালিয়ে হত্যা কর। সে যেন তাদের আর্ত চিৎকার নিজ কানেই শুনতে পায় এবং করুন অবস্থা স্বচোখে দেখতে পায়’’।
ফেরাউনের রক্ষীবাহিনী আগুন জ্বালিয়ে সেবিকা ও তার ছেলে মেয়েকে শাস্তি দিতে লাগলো। ফেরাউন শাস্তি দেয়া অবস্থায় আবারও প্রশ্ন করে “বল তোমার রব কে? সেবিকা জবাব দেয় “আমার রব সেই একক সত্তা, যিনি কারো মুখাপেক্ষী নন। একথা শোনার পর শাস্তি আরও বাড়িয়ে দেয়া হয়। সেবিকার সামনেই তার ছেলেকেও শাস্তি দেয়া হয়। আল্লাহর প্রতি কি ঈমান! এত নির্যাতনের পর ভড়কে না গিয়ে ছেলে তার মাকে লক্ষ্য করে বলে’’হে আমার প্রিয় মা! ধৈর্য ধারণ কর। তুমিই হকের উপর আছ?
আসিয়ার চোখের সামনে এই ধরনের নির্যাতন দেখার পর বেদনায় কাঁদতে থাকে এবং উচ্চস্বরে বলতে থাকে “হে ফেরাউন তুমি ধ্বংস হও। তুমি আমার ও তার রবের জাহান্নামের আগুনে ধ্বংস হবে’’। ফেরাউন আসিয়ার কথা শোনার পর বলতে থাকে “আসিয়াকেও সর্বশেষ মুসার শয়তানে ধরেছে। সে পাগল হয়ে গেছে’’। আসিয়া জবাব দেয় “না আমি পাগল হইনি। আমি পূর্ণ সুস্থ আছি। নিশ্চয়ই আমি আমার, তোমার, তোমার উজিরবৃন্দ, সৈন্য বাহিনী ও সকল কিছুর যিনি রব সেই আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি। যিনি রাব্বুল আলামীন’’। ফেরাউন একথা শোনার পর নির্দেশ দেয় আসিয়াকেও তার সেবিকার মতো শাস্তি দাও। তবে তাকে শাস্তি দেয়ার আগে তার মাকে সংবাদ দাও। তার মা এসে তার মেয়ের পরিণতি স্বচোখে প্রত্যক্ষ করুক। আসিয়ার মা এসে আসিয়াকে লক্ষ্য করে বললো “মা বলো তুমি কি মুসার প্রতি ঈমান আনার কথা সত্য? আসিয়া দৃঢ়তার সাথে জবাব দেয়” হে আমার প্রিয় মা! মুসা যা কিছু দাবী করে তা সত্য। আমি আল্লাহর প্রতি ঈমান এনেছি’’। আসিয়াকে তার মা ঈমানের দাবী থেকে ফিরানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যার্থ হয়। ফেরাউন যখন দেখলো আসিয়া ঈমানের দাবীতে অটল ও অবিচল আছে তখন তাকে শাস্তি দেয়ার আদেশ দেয়া হয়। ফেরাউনের সৈন্য বাহিনী নির্মম নির্যাতন শুরু করে। আসিয়া নির্যাতনের কঠিন মুহুর্তে কাতর কন্ঠে আল্লাহর দরবারে আকুতি জানায় “হে আল্লাহ আমার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ তৈরী কর। আর ফেরাউনের যুলম থেকে পরিত্রাণ দাও’’। আল্লাহ তার দোয়া কবুল করেন। আসিয়া শাহাদাত লাভ করেন।
আসিয়ার এ কাহিনী থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আজকের যুগেও আল্লাহর প্রতি ঈমান আনয়নের কথা ঘোষণা করার অপরাধে মিসরের যয়নাব আল গাযালীসহ অনেক মহিলাকে নির্মম নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। যারা এভাবে নির্যাতন নিপীড়ন ভোগ করে আল্লাহর পথে অটল ও অবিচল থাকে তাদের অনুপ্রেরণার উৎস আসিয়া। আসিয়া রাজ সম্মান, সুখ, শান্তি, আরাম ও আয়েশকে পদদলিত করে নির্যাতনকে হাসিমুখে বরণ করে প্রমাণ করলেন আখিরাতে নাজাতের জন্য দুনিয়ার সুখ স্বাচ্ছন্দ ত্যাগ করার মধ্যেই প্রকৃত সুখ লুকায়িত। আসিয়া আজ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের আবেগ ও অনুভুতির সাথে জড়িত। আর ফেরাউনকে স্মরণ করা হয় ঘৃণা ও ধিক্কারের সাথে। তার পরিণতিও হয়েছিল কত শোচনীয়! নীল নদের মধ্যে ডুবে চরম বেইজ্জতির সাথে তার মরণ হয়। আর আখিরাতে তাকে জ্বলন্ত আগুনে জ্বলতে হবে অনন্তকাল। আর আসিয়াসহ যারা আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার কারণে যালিমদের যুলম ভোগ করেছিল তারা থাকবে সুন্দর সুন্দর বালাখানায়। মনোরম প্রাসাদে।
হযরত খুবাইব এর ঘটনা সত্যের পথে নির্যাত নীপিড়ন ভোগ করার আরেক প্রকৃষ্ট উদাহরণ। হযরত খুবাইব (রা )এর হস্তদ্বয় পিঠমোড়া করে বেঁধে মক্কার নারী পুরুষেরা তাঁকে ধাক্কা দিতে দিতে ফাঁসির মঞ্চের দিকে নিয়ে যায়। জনতা করতালি দিয়ে এ হত্যাকান্ডকে যেন উৎসবে পরিণত করে। কিন্তু তাদের নির্মম নির্যাতনে তিনি ব্যাকুল হনননি। ফাঁসির মঞ্চে বসার আগে তিনি বললেন "তোমরা আমাকে দুই রাকাত নামায আদায় করার সুযোগ দাও এবং অতপর হত্যা কর’"। তারা নামায আদায়ের সুযোগ দিল। খাব্বাব খুব স্বল্প সময়ে নামায আদায় করলেন। অতপর বললেনঃ
’’আল্লাহর শপথ! তোমরা যদি এই ধারণা না করতে যে আমি মৃত্যু ভয়ে নামায দীর্ঘ করছি তাহলে আমি আরও বেশী নামায আদায় করতাম’’। নামায আদায়ের পর তারা তাঁর জীবিত অবস্থায় তাঁর অংগ প্রত্যংগগুলো একের পর এক বিচ্ছিন্ন করতে থাকে আর বলে, “তুমি কি চাও তোমাকে ছেড়ে দিয়ে তোমার পরিবর্তে মুহাম্মদকে হত্যা করি’’? রাসূল প্রেমিক খুবাইব এই করুন অবস্থায় উত্তর দিলেন, “আল্লাহর শপথ আমি মুক্তি পেয়ে আমার পরিবার পরিজনের নিকট ফিরে যাব আর মুহাম্মদ (দ) এর গায়ে কাঁটার আচড় লাগবে তা হতে পারেনা’’। সাথে সাথে তারা চিৎকার করে বলে উঠল “তাকে হত্যা কর- তাকে হত্যা কর’’। সাথে সাথে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলন্ত খুবাইব এর উপর হিংস্র হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়লো কাফেররা। তীর বর্ষা আর খঞ্জরের আঘাতে আঘাতে শাহাদাত বরণ করেন। শাহাদাতের মুহুর্তে কালেমা শাহাদাত পড়ছিলেন আর বলছিলেন “হে আল্লাহ এদের শক্তি ও প্রতিপত্তি ধ্বংস কর এবং কাউকে ক্ষমা করোনা’’। হযরত খুবাইব (রা) এর মৃত্যুর এই দৃশ্য দেখে আর তাঁর বদদোয়া শুনে ভয়ে অস্থির হয়ে হযরত সায়ীদ বিন আমের আল জুমাহী ইসলাম গ্রহণ করেন।
হযরত উমর সিরিয়া যাওয়ার পথে একবার হিমসে যাত্রাবিরতি করেন। তিনি হিমসের জনগণের অবস্থা জানতে চাইলে তারা গভর্ণর সায়ীদ সম্পর্কে গুরুতর চারটি অভিযোগ পেশ করেন। সায়ীদ সম্পর্কে উমরের খুব উঁচু ধারণা ছিল। তিনি অভিযোগের কথা শোনার পর হিমসবাসী ও সায়ীদকে একত্র করলেন। এরপর অভিযোগ সমূহ বলতে বলেন। তাদের প্রথম অভিযোগ ছিল- তিনি প্রত্যহ বিলম্বে অফিসে আসেন। সায়ীদ এর উত্তরে বলেন ব্যক্তিগত বিষয় আমি বলা পছন্দ করিনা তবে খলিফার নির্দেশে বলতে হয়’’ আমার ঘরে কাজের কোন ছেলে-মেয়ে নেই। প্রত্যহ সকালে পরিবারের সদস্যদের জন্য রুটি বানিয়ে তা গরম করার জন্য কিছু সময় রাখতে হয়। এরপর অজু গোসল সেরে আসতে দেরী হয়। দ্বিতীয় অভিযোগ ছিল- রাতের বেলা গভর্ণরকে পাওয়া যায়না। তিনি জবাব দিলেন, ’আমি দিনকে রাষ্ট্রীয় কাজে আর রাতকে আল্লাহর ইবাদতের জন্য নির্দিষ্ট করেছি’’। তৃতীয় অভিযোগ মাসে একদিন অফিসে অনুপস্থিত থাকেন। তিনি জবাব দিলেন আমার কোন কাজের লোক নেই বলে মাসে একদিন বাজার করি। আর পরনের পোশাক ছাড়া আর কোন পোশাক নেই বলে বাজার করে এসে তা পরিস্কার করি এবং পোশাক শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। তাই জোহরের পর ছাড়া অফিসে আসা সম্ভব হয়না। চতুর্থ অভিযোগ হলো মাঝে মধ্যে গভর্ণর অজ্ঞান হয়ে পড়েন যে তাঁর পাশের লোককেও চিনতে পারেননা। এই অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, “হে খলীফা কুরাইশরা যখন হযরত খাব্বাবকে নির্মমভাবে ফাঁসি দিয়েছিল আমি সেদিন জনসমুদ্রে ছিলাম কিন্তু খুবাইবে কোন সাহায্য করেনি। যখন আমার সেই দৃশ্য মনে হয় আমার মনে হয় আল্লাহ আমাকে মাফ করবেননা এবং এজন্য আতংকিত হয়ে পড়ি’’। উক্ত ঘটনার পর খলীফা মদীনা গিয়ে আবার স্বর্নমুদ্রা পাঠালেন। উপঢৌকন দেখে সায়ীদের স্ত্রী প্রথমত খূশী হলেন এবং বললেন যে এবার একটা চাকর রাখা সম্ভব হবে এবং ঘরের কিছু আসবাবপত্র কেনা যাবে। হযরত সায়ীদ স্ত্রীকে বললেন “তোমাকে এর চেয়ে উত্তম জিনিস দিতে চাই’’। তিনি বললে ন, “এগুলো গরীবদের মাঝে বিলি করে আল্লাহকে করজে হাসানা দিতে চাই’’। স্ত্রী বললেন, “হ্যাঁ তাই করুন’’। আল্লাহ নিশ্চয়ই আমাদেরকে উত্তম জিনিস দান করবেন। হযরত সায়ীদ অফিস ত্যাগ করার আগেই সবগুলো দান করে দিলেন।
ইয়ামামার যুদ্ধে হযরত আমর ইবন তুফাইল ও তার ছেলের ডান হাত কবজি পর্যন্ত আল্লাহর পথে উতসর্গ হয়ে যায়। তা তাঁরা দাফন করে আসেন। একবার খলীফা উমরের দরবারে রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় হযরত তুফাইল উপস্থিত ছিলেন কিন্তু বাম হাত ব্যবহার ছাড়া খাবার গ্রহণ সম্ভব নয় বলে খানা গ্রহণ করছিলেননা। হযরত উমর এটা লক্ষ্য করে বললেন “তুফাইল তুমি দুনিয়াতে আছ কিন্তু তোমার হাতের একটি অংশ জান্নাতে চলে গেছে। আল্লাহর শপথ তুমি বাম হাত দিয়ে খাবার স্পর্শ না করলে আমি কোন খাবার খাবনা’’।
হযরত আব্দুল্লাহ ইবন হুযাফা একবার যুদ্ধবন্দী হন। বন্দী থাকা অবস্থায় রোম সম্রাট তাকে বললেন তোমাকে মুক্তি দেব যদি খ্রীস্টান ধর্ম ত্যাগ কর। কিন্তু তিনি জবাব দেন ’’তোমরা যা করতে বল তা করার চেয়ে মৃত্যু হাজার বার উত্তম’’। এরপর সম্রাট বলেন, “তোমাকে ক্ষমতার অংশীদার বানাবো যদি আহবানে সাড়াদাও’’। তিনি বললেন সমগ্র রোম সাম্রাজের ক্ষমতা ও সমূদয় সম্পদ দিলেও আমি অমার আদর্শ ত্যাগ করবোনা। এটা দেখে সম্রাট ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে পড়ে এবং তাকে জ্বলন্ত ডেকচিতে নিক্ষেপ করতে নির্দেশ দেন। যখন জল্লাদরা তাকে জ্বলন্ত ডেকচিতে ফেলার জন্য নিয়ে যাচ্ছিল তাঁর চোখে অশ্রুফোটা আসলো। তা দেখে জল্লাদরা দৌড়ে গিয়ে সম্রাটকে জানায় মনে হয় মৃত্যু ভয়ে কাঁদছে। সম্্রাট মনে করলো এবার কাজ হবে। সম্রাটের নির্দেশে তাঁকে আবার সম্রাটের নিকট ফিরে নিয়ে যাওয়া হলো। সম্রাট আবারও ইসলাম ত্যাগের আহবান জানালে তিনি দৃঢ়তার সাথে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তখন সম্রাট বললো “ধিক্কার তোমার প্রতি তুমি মৃত্যুকে ভয় না পেলে কাঁদলে কেন’’? তিনি জবাব দিলেন “আমি ভেবেছিলাম তোমার অনেকগুলো ডেকচি উত্তপ্ত করবে এবং আমাকে আরও নির্মমভাবে হত্যা করবে আর আমি শাহাদাতের সর্বোচ্চ মার্যাদা লাভ করবো’’। আমি এই জন্য কেঁদেছি যে তোমরা বেশী ডেকচি উতপ্ত করনি। এরফলে আমি আমার কাংখিত মার্যাদা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি কিনা এই কথা ভেবে কেঁদেছি। সম্রাট এই কথা শোনার পর অবাক হলেন এবং বললেন “তুমি যদি আমার মাথায় একটি চুম্বন দাও আমি তোমাকে ছেড়ে দিব’’। এই প্রস্তাব শোনার পর তিনি বললেন “তুমি যদি সমস্ত যুদ্ধবন্দীকে মুক্তি দাও তাহলে এ প্রস্তাব আমি বিবেচনা করে দেখতে পারি’’। তখন অব্দুল্লাহ ইবন হুযায়ফা ভাবলেন, “একটি চুম্বন দিয়ে সকল মুসলিম বন্দীকে মুক্ত করতে পারলে তাহলে চুম্বন দিতে লজ্জা কিসের’’। আব্দুল্লাহ ইবন হুযায়ফা সম্রাটকে একটি চুম্বন দেয়ার পর সকল মুসলিম বন্দী মুক্তি পেল। এরপর আব্দুল্লাহ ইবন হুযায়ফা ফেরত গিয়ে হযরত উমরের কাছে যান। উমর এই ঘটনা শোনার পর বললেন “সকল মুসলমানের উচিত অব্দুল্লাহর কপালে চুম্বন দেয়া আর আমিই প্রথম তার কপালে চুম্বন দিচ্ছি’’।
আল্লাহ পাক তাঁর প্রিয় বান্দাদের নানাভাবে পরীক্ষা করেন। এই প্রসংগে কুরআনে ইরশাদ হচ্ছেঃ
’’আমি অবশ্যই ভয়-বিপদ, ক্ষুধা, জান ও মালের ক্ষতি এবং আয় কমিয়ে দিয়ে তোমাদেরকে পরীক্ষায় ফেলবো। এসব অবস্থায় যারা সবর করে, তাদেরকে সুখবর দাও, যারা বিপদে পড়লে বলে যে, “আমরা আল্লাহর-ই এবং আল্লাহর কাছেই আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে।”তাদের উপর তাদের রবের পক্ষ থেকে বড়ই মেহেরবাণী হবে এবং তাঁর রহমত তাদের উপর ছায়া দেবে। আর এ রকম লোকেরাই সঠিক পথে চলছে’’-(বাক্বারা ১৫৫-১৫৭)।
আজকের যুগেও যারা সত্য ও ন্যয়ের পথে চলছেন তারা যালেমদের যুলমের শিকার হচ্ছে। যালেমের এই ধরনের যুলমের শিকার শুধূ অমুসলিমদের দ্বারা হচ্চেনা। বরং পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশে অনেক কথিত মুসলিম শাসকের হাতেও চরম নির্যাতনের শিকার হচ্ছে অনেক সত্যপন্থী মানুষ। ফিলিস্তীন, কাশ্মীর, ইরাক, বসনিয়াসহ পৃথিবীর নানাদেশে যখন অমুসলিমরা সরসরি অঅক্রমন করে তখন আমরা তা সহজেই দেখি এবং প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠি। কিন্তু মিশর, বাংলাদেশ, আলজেরিয়া, পাকিস্তানসহ বিভিণ্ন মুসলিম দেশে মুসলিম শাসকদের হাতে যখন মুসলমানেরা নির্যাতিত হয় তখন সে খবর খুব কম লোকই রাখে। পৃথিবীর মানুষগুলো না জানলেও আল্লাহ পাক জানেন কারা কিভাবে কাদের উপর নির্যাতন করছে। আল্লাহ পাক অবশ্যই যালিমদের যুলমের বিচার করবেন। কিন্তু আল্লাহ পাক যালিমের বিচার করবেন তাই বলে মাযলুমের পাশে যদি আমরা না দাঁড়াই তাহলে আমরাও হয়তবা বিচারের সন্মুখীন হব। কেননা আল্লাহর রাসুল আমাদেরকে শিখিয়েছেন ’’ যালিম ও মাযলুম উভয়কে সাহায্য করতে’’। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যালিমকে আমরা কিভাবে সাহায্য করব? তার জবাবও আল্লাহর রাসুল (সা) দিয়েছেন। আর তা হচ্ছে যালিমকে যুলম করা থেকে বিরত রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে।
আমরা জানি কিভাবে সাইয়েদ কুতুবকে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। তাঁকে প্রচন্ড জ্বরের মধ্যে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জেলখানায় একটি ছোট কুটিরে রাখা হয়েছে। দীর্ঘসময় একটি চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তা নায়ককে। শিকারী কুকুর ছেড়ে দেয়া হয়েছে তাঁকে কামড় দেয়ার জন্য। তার সাথে অন্যরা খেতো কিন্তু তাঁকে কোন পানি পর্যন্ত দেয়া হয়নি কয়েকদিন। এইভাবে যুলম করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি তাঁকে ’’ ইসলামী সমাজ বিপ্লবের পথ’’ বইটি লেখার কারণে মিথ্যা অজুহাতে ফাঁসি দেয়া হয়েছে। যালেম নাসের একদিকে যুলম এর ষ্টীমরোলার চালায় অপরদিকে তাঁকে মিশরের শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার আপোষ প্রস্তাব দেয়। কিন্তু তিনি ঘৃণাভরে শিক্ষামন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন ’’ যেই অংগুলি দিয়ে আল্লাহর ওয়াহদানিয়াতের সাক্ষ্য দেয়া হয় সে অংলি দিয়ে কখনও যালেমের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইবনা’’। যেই রাতে তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয় সেই রাতেও তাঁর ছোট বোন হামিদা কুতুবকে দিয়ে আপোষ প্রস্তাব দেয়া হয় কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এরপর যালিম নাসের এর নির্দেশে ফজরের নামাযের সময় তাঁকে ফাঁসি দেয়া হয় এবং তার লাশ গোপনে কোথায় দাফন করা হয় তা আজও জানা যায়নি।
ইমাম হাসানুল বান্নাকে শহীদ করার পর তার আত্মীয় স্বজন ছাড়া আর কাউকে জানাযায় উপস্থিত হতে দেয়া হয়নি। তাঁর বৃদ্ধ আব্বা শহীদ হাসানুল বান্নার কফিন কবরে রাখেন। ইখওয়ানের লাখো কর্মী চোখের পানি ফেলে বুক ভিজায় কিন্তু তাদের প্রিয় নেতার জানাযাতেও উপস্থিত হতে পারেননি।
বিষয়: বিবিধ
৩৬৩৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন