বাংলাদেশে এই সময়ের সাংস্কৃতিক আগ্রাসন
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ০৮ জুলাই, ২০১৪, ০২:১৩:৫৭ রাত
বাংলাদেশের সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি বাংলাদেশের মানুষের যুগ যুগ ধরে চলে আসা জীবনাচার। এ দেশের মাটি, নদনদী, জনগোষ্ঠীর শিকড় থেকে উঠে আসা শিল্প-সাহিত্য মূলত এ দেশে গড়ে তুলেছে সমৃদ্ধ এক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এ সংস্কৃতি নিশ্চিতভাবেই আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে স্বতন্ত্র। এ সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। উনিশ ও বিশ শতকের বাঙালি রেনেসাঁর সময় লেখক, শিল্পী-সাহিত্যিক, সুফি-দরবেশ, গবেষক-চিন্তক, সঙ্গীতসাধক, চিত্রকর, চলচ্চিত্রকার, বিজ্ঞানী-শিক্ষাবিদ আর এ দেশের মাটি ও মানুষের সম্মিলিত অবদানের ফসল আমাদের অনন্য এ সংস্কৃতি। হাজার বছরের ঐতিহ্য লালন করেই চলে এসেছে আমাদের জীবনযাপন আর সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড : শিল্প-সাহিত্য, সঙ্গীত, নাটক-সিনেমা, লোকশিল্প, কুটির শিল্প, লোককাহিনী, দর্শনচর্চা, উৎসব-আয়োজনসহ যাবতীয় লোকাচার। আমাদের সংস্কৃতির ওপর নানা ধর্মের নির্দোষ প্রভাবও ছিল বরাবর। কিন্তু এর পরও স্বীকার করতেই হবে, সব কিছুকে ছাপিয়ে আমাদের সংস্কৃতি আগ্রাসনের শিকারও হয়েছে নানাভাবে। সে আগ্রাসন মোকাবেলা করেই আমরা আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ধারক-বাহক।
কিন্তু আজকের এই দিনে কেন জানি মনে হচ্ছে, আমাদের সংস্কৃতি প্রবলভাবে সাম্রাজ্যবাদী আর সম্প্রসারণবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। এক সময় আমরা পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে নিজস্ব সংস্কৃতি সম্পর্কে থেকেছি বেখেয়াল। এখন নতুন করে মুখোমুখি আরেক সম্প্রসারণবাদী সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের। সময়ের সাথে এই আগ্রাসন ক্রমেই পরিব্যাপক হচ্ছে। এই আগ্রাসনের সহজ শিকার আমাদের তরুণ প্রজন্ম। কোনো ধরনের ভালো-মন্দ বিবেচনা না করেই এরা অন্ধভাবে অনুকরণ করছে এমন বিদেশী সংস্কৃতি, যার পরিণাম ভয়াবহ। এর অনিবার্য পরিণাম নিজস্ব সংস্কৃতিকে অস্থিত্বহীনতার দিকে ঠেলে দেয়া। সম্প্রসারণবাদীদের চাওয়াটা কিন্তু তাই। কারণ, এরা ভালো করে জানে একটি জাতিকে পদানত করতে সবার আগে প্রয়োজন এর শিক্ষা-সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে দেয়া। নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে তরুণ প্রজন্মকে বিচ্ছিন্ন করা।
বিশ্বের অন্যান্য প্রগতিশীল উদারমনা বিবেকবান মানুষের মতো বাংলাদেশের মানুষও মনে করে, পৃথিবীর প্রতিটি দেশের সাথে পারস্পরিক সাংস্কৃতিক বিনিময় মানবজাতির স্বার্থের অনুকূল এক প্রক্রিয়া। এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার কোনো সুযোগ নেই, যৌক্তিকতা নেই। কিন্তু সাংস্কৃতিক বিনিময়ের নামে তা যদি হয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, প্রশ্রয় দেয়া হয় অপসংস্কৃতিকে, আর এর বিরূপ প্রভাবে ধ্বংসের দিকে ধাবিত হয় দেশের তরুণ প্রজন্ম তবে তা কোনো মতেই মেনে নেয়া যায় না।
১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে বাংলাদেশে ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো সম্প্রচার শুরুর পর থেকে কার্যত ভারত আমাদের ওপর অব্যাহতভাবে এক ধরনের সাংস্কৃতিক আগ্রাসনই চালিয়ে যাচ্ছে। আজকের দিনে রাজনীতি ও অর্থনীতির পাশাপাশি এই সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিষয়টি এ দেশের মানুষের কাছে এক সাধারণ আলোচনার ও সেই সাথে উদ্বেগের উপাদান হয়ে উঠেছে। অনেকেই আজ খোলাখুলি বলছেন কিংবা যথার্থ কারণে বলতে বাধ্য হচ্ছেন, আমরা আজ ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার। সংস্কৃতির নামে ভারত আমাদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে যতসব অপসংস্কৃতি। রাজধানী ঢাকাসহ অন্যান্য শহর, এমনকি গ্রামগঞ্জে এর আলামত সুস্পষ্ট। ভারতীয় স্যাটেলাইট টিভির সাংস্কৃতিক আগ্রাসন আমাদের সমাজে কী ভয়াবহ পরিণতি ডেকে এনেছে, সে প্রসঙ্গে একটু পড়ে আসছি। এর আগে নজর দেয়া যাক এর প্রেক্ষাপটের দিকে।
বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টিভির সূচনা ১৯৯২ সালে। এর আগে ১৯৬৪ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত সময়ে বাংলাদেশে চালু ছিল শুধু বিটিভি। ১৯৯২ সাল থেকে প্রধানত টেলিস্টার-১০ স্যাটেলাইটের মাধ্যমে অনেক বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে আসছে। এগুলোর মধ্যে কোনো কোনোটি অন্যান্য স্যাটেলাইটও ব্যবহার করছে। বাংলাদেশী এসব টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠান, বিশেষ করে নাটক, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ও গানের ভিডিও পশ্চিম বাংলার মানুষের কাজে জনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও ভারত সরকার তাদের দেশে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলার ওপর এক অলিখিত নিষেধাজ্ঞা জারি করে রেখেছে। অথচ বাংলাদেশে অবাধে চালু আছে প্রচুরসংখ্যক বিদেশী টিভি চ্যানেল, যার মধ্যে ৯০ শতাংশই ভারতীয়। গণমাধ্যমে খবর এসেছে, বাংলাদেশে প্রচুরসংখ্যক ভারতীয় টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানের ডাউনলিঙ্ক করা হচ্ছে অবৈধভাবে। বাংলাদেশী ক্যাবল অপারেটরেরাও তথ্য মন্ত্রণালয়, বিটিআরসি বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ থেকে অনুমোদন না নিয়েই বিদেশী টিভি চ্যানেলের সিগন্যাল ডাউনলিঙ্ক করছে।
এসব চ্যানেলের মধ্যে আছে :
১) এস সঙ্গীত,
২) জেডবাংলা,
৩) জেডটিভি,
৪) স্টার প্লাস,
৫) সনি,
৬) স্যাট ম্যাক্স,
৭) তারা মিউজিক,
৮) তারা নিউজ,
৯) ইটিভি-বাংলা,
১০) স্টার ওয়ার্ল্ড,
১১) জেড স্টুডিও,
১২) লাইফ ওকে,
১৩) ডিডি বাংলা,
১৪) ডিডি ন্যাশনাল,
১৫) ডিডি স্পোর্টস,
১৬) ফিরেঙ্গি,
১৭) ইউটিভি,
১৮) পগো টিভি,
১৯) বিএইউ মিউজিক,
২০) সিভিও,
২১) নাইনএক্স,
২২) জো মিউজিক,
২৩) সুরসঙ্গীত টিভি,
২৪) আজতক,
২৫) আইবএন৭,
২৬) তেজ টিভি,
২৭) এস৭ নিউজ,
২৮) ই২৪,
২৯) সাহারা সময়,
৩০) সন্ধ্যা টিভি,
৩১) ২৪ ঘণ্টা,
৩২) কলকাতা টিভি,
৩৩) চ্যানেল ১০,
৩৪) এনই বাংলা,
৩৫) মহুয়া বাংলা,
৩৬) কালাইগনার টিভি,
৩৭) জয়া টিভি,
৩৮) রাজ টিভি,
৩৯) তামিল বক্স অফিস,
৪০) তামিলান টিভি,
৪১) জিটিভি,
৪২) এসটিভি,
৪৩) কেটিভি,
৪৪) জে মুভিজ,
৪৫) নিক,
৪৬) সান টিভি,
৪৭) জেড নিউজ,
৪৮) সাব টিভি,
৪৯) কালারস,
৫০) সাহারা ওয়ান,
৫১) জুম,
৫২) এনডিটিভি,
৫৩) এন্টার টেন (১০) টিভি,
৫৪) নাইনএক্সএম,
৫৫) জালওয়া,
৫৬) স্টার জলসা,
৫৭) দাবাং,
৫৮) ধুম মিউজিক,
৫৯) হাঙ্গামা টিভি ইত্যাদি।
বাংলাদেশে যাদের বাড়িতে ডিশ কানেকশন আছে, তারাই শুধু বলতে পারবেন এসব ভারতীয় টিভি চ্যানেল সংস্কৃতিচর্চার নামে কী ধরনের অপসংস্কৃতি চালিয়ে যাচ্ছে। আর এসব সাংস্কৃতিক বেলেল্লাপনা আমাদের তরুণসমাজকে কোথায় নিয়ে দাঁড় করাচ্ছে, তা সুস্পষ্ট। সঙ্গীতের নামে এসব টিভি চ্যানেলে চলে এক ধরনের উলঙ্গ নৃত্য, যা কার্যত পরিবেশিত হয় তরুণসমাজকে বিপথে পরিচালিত করার গোপন উদ্দেশ্য মাথায় রেখে। অপর দিকে ভারতীয় টিভি চ্যানেলের সিরিয়ালগুলো ব্যাপকভাবে বিপথগামী করছে আমাদের তরুণ-তরুণীদের।
সেজন্য দেখা যাবে, এসব টিভি চ্যানেলে আপনি শুনতে পাবেন না আবদুল আলীম, আব্বাস উদ্দিন, হাবিব ওয়ালি মোহাম্মদ, তালাত মাহমুদ, মোহাম্মদ রফি, লতা মুঙ্গেশকর, নূরজাহান, সলিল চৌধুরী, নির্মলেন্দু চৌধুরী ও রাহুলদেব বর্মণ এদের মতো উপমহাদেশখ্যাত কারো গান, যা এ উপমহাদেশের শুদ্ধ সংস্কৃতির প্রাণ হিসেবে বিবেচিত। এসব টিভি চ্যানেলে গানের নামে চলে উলঙ্গ নৃত্যের যৌন সুড়সুড়ি। এক সময় যখন বাংলাদেশে কোনো বিদেশী টিভি চ্যানেল ছিল না, তখন বিটিভি যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনগুলোর ভালো ভালো টিভি সিরিয়াল আমাদের দেখাত। ম্যাকগাইভার, স্টারট্র্যাক, ইনক্রেডিবল হালক, ওশিন ও কার্ল সাগানের বৈজ্ঞানিক সিরিয়াল এমন সব সিরিয়াল যেন ছেলে-বুড়ো সবার নির্মল আনন্দের আধার ছিল। আমাদের বিটিভির রাবেয়া খাতুনের সকাল-সন্ধ্যা, হুমায়ূন আহমেদের ‘বহুব্রীহি’, জহির রায়হানের সংশপ্তক-এর মতো অসংখ্য টিভি সিরিয়াল ছিল অনন্য অসাধারণ। সুস্থ বিনোদনের আধার। কিন্তু ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো আসার পর আমরা পেলাম ভিন্ন চিত্র। আমরা দেশীয় সুস্থ সংস্কৃতি থেকে মুখ ফিরিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠলাম ভারতীয় অপসংস্কৃতির ওপর। ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো নিয়ে এলো অন্য ধরনের টিভি ড্রামা সিরিয়াল। এসব সিরিয়ালের আগাগোড়া ভর্তি যৌন হয়ানি, পরকীয়া প্রেম, প্রতিশোধ, নানা ধরনের কূটকচাল, নারীর বিরুদ্ধে নারীর অনৈতিক তৎপরতার নানা ঘটনা। বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ক, নারী-পুরুষের বেলেল্লাপনা আচরণ যেন এসব সিরিয়ালের অপরিহার্য উপাদান। যারা এসব সিরিয়াল নিয়মিত দেখেন, তাদের মন-মানসে এসবের একটি প্রভাব নিশ্চিতভাবেই পড়ে। এসব সিরিয়াল দেখে দেখে আমাদের এক শ্রেণীর তরুণ-তরুণী আজ বিয়েবহির্ভূত সম্পর্ককে স্বাভাবিক সম্পর্ক হিসেবে ভাবতে শুরু করেছে। এসব সিরিয়ালে যেভাবে অপরাধকর্মের ছড়াছড়ি, তা দেখে দেখে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ক্রমেই অপরাধের প্রতি আসক্ত হয়ে উঠছে। এতে করে সামাজিক ও পারিবারিক বিশৃঙ্খলাও সময়ের সাথে বাড়ছে। ঘটছে মূল্যবোধের অবক্ষয়। ভারতীয় টিভি চ্যানেলের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সব বয়সের বাংলাদেশীদের ওপর। টিভি সিরিয়ালগুলোর প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়ছে আমাদের নারী ও শিশুর ওপর। এর ফলে বাড়ছে পারিবারিক সমস্যা।
যেকোনো সমাজে মিডিয়ার প্রভাব খুবই জোরালো। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে ভারত এই মাধ্যমটিকেই মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে। আর এতে ভারত শতভাগ সফলতা পেয়েছে। এক সময় যে নারী, যে শিশু সারাজীবন একটিও হিন্দি ছবি দেখার সুযোগ পায়নি; আজ এরা বাংলাদেশের ঘরে বসে দেখছে শত শত হিন্দি ছবি আর সিরিয়াল। এর মাধ্যমে এরা ক্রমেই অভ্যস্ত হয়ে উঠছে বিজাতীয় সংস্কৃতিতে। আজ আমাদের বিয়ের উৎসব-আয়োজনও হারাতে বসেছে মুসলিম ঐতিহ্য। আমাদের পোশাক-আশাকে আসছে ভারতীয় ঢং। মুসলমানদের বিয়ের উৎসবেও চলে হিন্দিগান আর নাচের অশ্লীল আয়োজন, আলাদা আলাদা দিনে। এ জন্য বিয়ের উৎসবের সময়-পরিধিও বেড়ে গেছে কয়েক দিন। বাড়তি দিনগুলোতে ভারতীয় সিরিয়ালের আদলে চলে হিন্দি নাচগান, যা কয় বছর আগেও এ দেশে ছিল অকল্পনীয়। আজ দরজিবাড়িতে হিন্দি সিরিয়াল আর সিনেমার নায়কের পোশাকের আদলে পোশাক তৈরি করে দেয়ার অর্ডার যাচ্ছে। ড্রেস ডিজাইনারেরাও শিকার একই প্রবণতার। মরণঘাতী এ ছোবল আমাদেরকে ক্রমেই করে তুলছে পরনির্ভর সংস্কৃতির ধারক-বাহক। ভারতীয় সংস্কৃতি আজ ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিয়েছে আমাদের অনেক মেধাবীদেরকেও। এরা নিজস্ব আইডিয়ার স্ফুরণ ঘটানোর পরিবর্তে আজ ভারতীয় সংস্কৃতি অনুকরণেই বেশি আগ্রহী। ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রভাব আজ আমাদের সমাজে চলে গেছে নিয়ন্ত্রণহীন পর্যায়ে। এর লাগাম টেনে ধরতে না পারলে এক সময় দেখা যাবে, আমরা হয়ে পড়েছি সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যহারা। সাংস্কৃতিক এতিহ্য নিয়ে গর্ব করার মতো কিছুই আমাদের হাতে থাকবে না। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের পাশাপাশি আমাদের ঐতিহ্য চুরির প্রক্রিয়াও যে ভারত যথারীতি জারি রেখেছে তার নানা আলামত এখন জায়মান। বাংলাদেশের শত শত বছরের ঐতিহ্য যে জামদানি শাড়ি, ভারত তা নিজস্ব পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করেছে। এতে বাংলাদেশের জামদানি শিল্প হুমকির মুখে পড়তে পারে। এ ছাড়া নকশিকাঁথা ও ফজলি আমের স্বত্বও ভারত নিয়ে গেছে। বেশ কিছু দিন আগে গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়টি আলোচিত হলেও আমাদের সরকার এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এ প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি ঢাকার এক অনুষ্ঠানে এ বিষয়টি নিয়ে আবারো উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। গত ১৮ জুন ২০১৪ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং জাতীয় কারুশিল্প পরিষদ যৌথভাবে এ বিষয়ে একটি সংলাপের আয়োজন করে। এ সংলাপে বাংলাদেশের স্বার্থে আমাদের এই ঐতিহ্য চুরির ভারতীয় অপপ্রয়াস ঠেকাতে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়ার ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়। সংশ্লিষ্ট অভিজ্ঞজনেরা অভিমত দেন, জামদানি শাড়ি বাংলাদেশের পণ্য হিসেবেই সমগ্র পৃথিবীতে পরিচিত ও স্বীকৃত। তাই ভারত জামদানি শাড়ির সাথে তার কোনো এলাকার নাম জুড়ে দিতে পারে না। শুধু বাংলাদেশই জামদানিকে নিজস্ব ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করার অধিকার রাখে। উল্লেখ্য, মসলিন বস্ত্র প্রাচীনকাল থেকেই বর্তমান বাংলাদেশ ভূখণ্ডের তাঁতশিল্পকে বিশ্বের কাছে পরিচিত করে তোলে। মসলিনের সে ধারাটি আজো টিকে আছে জামদানি শাড়ির মধ্য দিয়ে। জামদানি সর্বতোভাবে আমাদের নিজস্ব পণ্য, নিজস্ব ঐতিহ্য। এ বাস্তবতা সত্ত্বেও ভারত ২০০৯ সালে জামদানিকে তাদের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে নিবন্ধন করে ফেলেছে। কৌশলগতভাবে এরা এই জামদানি শাড়ির নাম দিয়েছে উপ্পাদা জামদানি। এ রীতিমতো বাংলাদেশের ঐতিহ্য চুরিরই নামান্তর। এ চুরি ঠেকাতে হবে।
বাংলাদেশ ভারতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের সামগ্রিক প্রক্রিয়া চলছে গ্লোবালাইজেশনের নামে। বলা হচ্ছে তথ্যের অবাধ প্রবাহ, মুক্ত অর্থনীতি, স্যাটেলাইট, ইন্টারনেট আজ গোটা পৃথিবীকে করে তুলেছে এক গ্লোবাল ভিলেজ। পাশাপাশি আজ বলতে বাধ্য হচ্ছি, এসব একই সাথে আমাদের পৃথিবীকে করে তুলেছে এক গ্লোবাল পিলেজ তথা লুণ্ঠনের স্থানে, পাশাপাশি বিশ্বকে করে তুলেছে সম্প্রসারণবাদীদের আগ্রাসনের অবাধ ক্ষেত্র। নইলে কেন গ্লোবালাইজেশনের দোহাই দিয়ে আমাদের দেশে অবাধে চলবে অসংখ্য ভারতীয় টিভি চ্যানেল, আর ভারতে চলতে পারবে না আমাদের একটি টিভি চ্যানেলও? কেন এসব টিভি চ্যানেল আমাদের দেশ থেকে নিয়ে যাবে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা, আমরা বরাবরই থাকব সে সুযোগ থেকে বঞ্চিত?
সাপ্তাহিক ব্লিটজ পত্রিকার সাম্প্রতিক এক জরিপে উল্লেখ রয়েছে, ভারতীয় কোন চ্যানেল বাংলাদেশ থেকে কত আয় করছে। বিদেশী টিভি চ্যানেল, যার বেশির ভাগই ভারতীয় বাংলাদেশের ক্যাবল নেটওয়ার্কে অনুমোদিত। পত্রিকাটি জানিয়েছে, প্রতি মাসে ভারতীয় চ্যানেলগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশ থেকে আয় করছে গ্রাহকচাঁদা ও বিজ্ঞাপন বিক্রি থেকে। কিন্তু ভারত সরকার আমাদের চ্যানেলগুলোকে সে দেশে প্রবেশের কোনো সুযোগ দিচ্ছে না, অলিখিতভাবে সে নিষেধাজ্ঞা জারি রেখেছে। অথচ অনেক আন্তর্জাতিক টিভি চ্যানেল ভারতে চালু রাখার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, ভারতে বাংলা ভাষাভাষীদের মাঝে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠান, বিশেষ করে বাংলাদেশী নাটক ও সিরিয়ালগুলোর ব্যাপক চাহিদা থাকা সত্ত্বেও তা ভারতে ঢুকতে দেয়া হচ্ছে না।
ভারতীয় চ্যানেলগুলোর কোনটি বাংলাদেশ থেকে প্রতি মাসে কত আয় করছে, তার একটি তালিকা প্রকাশ করেছে ব্লিটজ জরিপদল। এই তালিকা মতে,
এসব চ্যানেলের মাসিক আয় এরূপ :
স্টার প্লাস ১৯৫ হাজার ইউএস ডলার,
স্টার মুভিজ ১১৮ হাজার ডলার,
জি স্টুডিও ৯৪ হাজার ডলার,
জিটিভি ৬৭ হাজার ডলার,
সনি ১২৩ হাজার ডলার,
সেটম্যাক্স ৭২ হাজার ডলার,
স্টার গোল্ড ৬১ হাজার ডলার,
জি সিনেমা ৯৫ হাজার ডলার,
স্টার স্পোর্টস ৭০ হাজর ডলার,
বিএইউ পাঁচ হাজার ডলার,
স্টার জলসা ১৭ হাজার ডলার,
জি প্রিমিয়ার ৩৯ হাজার ডলার,
জি অ্যাকশন ২৯ হাজার ডলার,
জি কাফে ১৯ হাজার ডলার,
জি বাংলা ১৭ হাজার ডলার,
সাব টিভি ছয় হাজার ডলার,
তারা টিভি ছয় হাজার ডলার,
তারা মিউজিক ছয় হাজার ডলার,
স্টারওয়ান ২৩ হাজার ডলার
এবং স্টারওয়ার্ল্ড ২৩ হাজার ডলার।
এ তালিকা সম্পূর্ণ নয়, তবে এ থেকে আন্দাজ-অনুমান করতে অসুবিধা হয় না, ভারতীয় টিভি চ্যানেলগুলো প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি ডলার বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, আমরা কেন ভারতের কাছ থেকে এই সমসুযোগ পাবো না?
এ দিকে বাংলাদেশের ‘অ্যাসোসিয়েশন অব টেলিভিশন চ্যানেল ওনারস’-এর নেতারা গত ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিতের সাথে দেখা করেন। এ সময় এরা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর জন্য একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে বিদেশী চ্যানেলগুলোর ওপর ইউজার ট্যাক্স বসানোর সুপারিশ করেন। তাদের অভিযোগ, প্রতিবেশী ভারত আমাদের টিভি চ্যানেলগুলোকে সে দেশে ঢুকতে দিচ্ছে না। অথচ ভারতীয় চ্যানেলগুলো আমাদের বাজার দখল করে তাদের পণ্য ও বিজ্ঞাপন প্রমোট করছে। ভারতীয় চ্যানেলগুলোকে বাংলাদেশ সরকারকে কোনো কর দিতে হয় না। অপর দিকে বাংলাদেশী টিভি চ্যানেল মালিকদেরকে ভ্যাট দিতে গিয়ে নানা ধরনের হয়রানির শিকার হতে হয়। এরই মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরের বাজেট সংসদে পাস হয়েছে, সেখানে বিদেশী টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর ওপর কোনো কর আরোপ করতে দেখা যায়নি। ফলে আমাদের দেশের টেলিভিশন চ্যানেল মালিকদের লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সৃষ্টির দাবিটি উপেক্ষিতই থেকে গেছে। শোনা যায়, পশ্চিমবঙ্গ সরকার সে দেশের বাংলা ছবি প্রদর্শনের ওপর যে পরিমাণ কর আদায় করে, হিন্দি ছবি প্রদর্শনের ওপর আরোপ করে এর কয়েক গুণ বেশি কর। কারণ, সরকার চায় পশ্চিমবঙ্গের চলচ্চিত্র শিল্পকে সংরক্ষণ সুবিধা দিতে। আমরা আমাদের টেলিভিশন চ্যানেলগুলোর স্বার্থ রক্ষায় পালন করছি সম্পূর্ণ উল্টো ভূমিকা। এর জন্য দায়ী সরকারের নতজানু চরিত্র। এর ফলে আমরা এক দিকে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আয়ের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছি, অন্য দিকে দেশে হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসনের দুয়ার খুলে দিয়েছি। এর পরিণিতি যে ভয়াবহ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
তথ্যসূত্র্র: দৈনিক নয়াদিগন্ত
বিষয়: বিবিধ
২৫৯২ বার পঠিত, ৬ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন