কারাভ্যন্তরে কি খুন হতে যাচ্ছে জামাতের শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা?
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ১২ ডিসেম্বর, ২০১৩, ১০:১১:৪৪ সকাল
দ্য ইয়েলো আইজ অব আওয়ামী লীগ
সোভিয়েত শাসনামলে মস্কো-ওয়াশিংটনের মধ্যে স্নায়ুযুদ্ধ যখন ভরা কাইমেক্সে, তখন খুব আলোচিত একটা বই ছিল দ্য রেড আইজ অব কেজিবি। মস্কো শহরের সবচেয়ে আতঙ্কের স্থাপনা ধূসর ভবনের অভ্যন্তরে কী ঘটত এসব নিয়ে রচিত ওই বইয়ে স্পর্শকাতর এমন কিছু তথ্য ফাঁস করে দেয়া হয়, যা ক্রেমলিনের কাছে রীতিমতো ছিল বিব্রতকর। সেই বইয়ের লেখক বেঁচে থাকলে আজকের বাংলাদেশে মতাসীন দলের কাণ্ডকীর্তি দেখে নিশ্চয়ই লিখতেন আরেকটি বই দ্য ইয়েলো আইজ অব আওয়ামী লীগ বা আওয়ামী লীগের হলুদ চোখ। বাংলায় একটা জনপ্রিয় প্রবাদ আছে চোখে সর্ষে ফুল দেখা। আজ যারা বাংলাদেশের রাষ্ট্রমতায় আসীন এবং যারা মতাকে চিরস্থায়ী করতে ক্রমাগত ছলচাতুরী করে যাচ্ছেন, তাদের মনে নিঃসন্দেহে একের পর এক ধাক্কা লেগেই চলেছে। ভারতের বিধানসভা নির্বাচনে বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির বিরাট বিজয়ে একটা বিষয় এখন পরিষ্কার আসন্ন লোকসভার নির্বাচনেও তারা জিতবে এবং দিল্লির মসনদ থেকে দুর্নীতিবাজ কংগ্রেসকে হটাবে। এটা বাংলাদেশের মতাসীনদের জন্য বিরাট দুঃসংবাদ। কারণ, কংগ্রেস নেত্রী সোনিয়া গান্ধী এবং তার সরকার কোনো ধরনের রাখঢাক না করেই শেখ হাসিনার সরকারকে সমর্থন দিয়েছে। বিনিময়ে অবশ্য বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী অসংখ্য চুক্তি সই করিয়ে নিতে ভুল করেনি সোনিয়া গান্ধী নিয়ন্ত্রিত সরকার। ভারত জানে আওয়ামী লীগ যত দিন মতায় থাকবে তত দিন এরা দিল্লিকে সন্তুষ্ট রাখতে আত্মসমর্পিত পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণের মাধ্যমে বাহ্যত ভারতের অকথিত অঙ্গরাজ্য অথবা করদরাজ্য বানিয়ে রাখবে বাংলাদেশকে। এসব কারণেই সম্প্রতি ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং তার ঢাকা সফরের সময় প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন যে কোনো উপায়ে একটা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আরেক দফা আওয়ামী লীগকে মতায় বসিয়ে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধী দলের আসন দিয়ে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী শক্তির চরম সর্বনাশ করতে। কিন্তু তিনি ভাবতেও পারেননি সাবেক সেনাপ্রধান এরশাদ তার দেশের সঙ্গে এতবড় বেঈমানি কখনোই করবেন না। একজন সৈনিক এরশাদের বিবেক তাকে বাধা দিয়েছে সুজাতা সিংয়ের কূটকচাল মেনে নিতে। এ কারণেই তিনি সুজাতার সঙ্গে বৈঠকের পর হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিলেন সব কথা ফাঁস করে। জাতি জেনে গেল, সুজাতা সিংদের মনের খবর। তবে জেনারেল এরশাদ যে কথাটা বলেননি সেটা হলো, সুজাতা সিং তাকে বলেছিলেন, জাতীয় পার্টি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগের পে আর নির্বাচনকে বিশ্বের কাছে গ্রহণযোগ্য করানোর সামান্যতম সুযোগও থাকবে না। সুজাতা এ কথাও বললেন, বিএনপি যদি নির্বাচনে আসে তাহলে বিএনপি-জামায়াত জোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন নিয়ে মতায় আসবে। কিন্তু সুজাতা সিং জেনারেল এরশাদকে এ কথাটা বললেন না, জাতীয় পার্টি যদি মতাসীন দলকে একতরফা নির্বাচন করতে না দেয় তাহলে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পে এমনকি প্রধান বিরোধী দল হওয়ার মতো আসন লাভও সম্ভব হবে না। বরং প্রধান বিরোধী দল হিসেবে আসবে জাতীয় পার্টি। দিল্লির মসনদে আসীন বিদায়ী কংগ্রেস দলের আকাক্সা ছিল সুজাতা সিং তার ঢাকা মিশনে সফল হবেন। কিন্তু সৈনিক এরশাদের দেশপ্রেম সুজাতাদের সেই ঘৃণ্য অভিলাষের রুগ্ন কূটনীতির গালে কষে একটা চড় বসিয়ে দিয়ে স্বীয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের পে অবস্থান নিলেন। এরশাদের এই সিদ্ধান্ত তার নিজের দলের নেতাকর্মীদের কতটা উজ্জীবিত করেছে তা এরই মধ্যে আমরা সবাই জানি।
ব্যর্থ মনোরথ নিয়ে সুজাতা সিং যখন দিল্লি ফিরে গেছেন, তখন ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প থেকে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংকে পাঠানো গোপন একটা নথির বিষয় এরই মধ্যে ফাঁস হয়ে গেছে, যা থেকে লোমহর্ষক তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত ২২ নভেম্বর ২০১৩ তারিখে ‘র’-এর সদর দফতর থেকে EF6/DHK/43/69 স্মারকে একটি অতি গোপনীয় মেমোতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কারাগারে আটক অন্তত পাঁচজন জামায়াত নেতাকে একটি পরিকল্পিত নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে ডিসেম্বর মাসেই হত্যার পরিকল্পনা হয়েছে। বাংলাদেশে দশম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে যদি বিএনপি-জামায়াত যোগ দিয়ে দেয় সে ক্ষেত্রে মতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পে নির্বাচনে জয়লাভ করে আবার মতায় যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। আবার, বিএনপিবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে আওয়ামী লীগ পুনরায় মতায় এলেও এদের পে প্রথম বাজেট সেশন পর্যন্ত মতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। এ কারণেই আওয়ামী লীগ চলতি বছর ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই কারাগারে আটক জামায়াতে ইসলামীর অন্তত পাঁচ শীর্ষ নেতাকে কারাভ্যন্তরে নৈরাজ্য সৃষ্টির মাধ্যমে হত্যা করার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে। এ লক্ষকে সামনে রেখেই কারা-প্রশাসনের মহাপরিদর্শক পদ থেকে সেনা অফিসারকে সরিয়ে মতাসীন দলের প্রতি অনুগত একজন আমলাকে বসানো হচ্ছে। কারণ মহাপরিদর্শক পদে কোনো সেনা অফিসারকে রাখলে এ ধরনের অঘটনের দায় সেনাবাহিনীর ওপর পড়বে। এ কারণেই কোনো সেনা অফিসার কারাভ্যন্তরে এ ধরনের হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দেবেন না। তাকে আগে থেকেই সব ঘটনা দেশটির সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা অবহিত করে দেবে। এসব বিবেচনা মাথায় রেখেই কারা মহাপরিদর্শক পদে রদবদল হতে যাচ্ছে।
‘র’-এর ওই গোপন নথি থেকে আরো জানা যায়, কারাভ্যন্তরে পরিকল্পিত এই হত্যাযজ্ঞের বিষয়টি কারাগারে বসেই গোছাচ্ছেন আওয়ামী লীগপন্থী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত একজন শীর্ষ সন্ত্রাসী, যাকে মিশন সফল করার পর কারাগার থেকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করা হবে। তবে এই শীর্ষ সন্ত্রাসীকে ভারতে যেন আশ্রয় দেয়া না হয়, অথবা সে যেন ভারতে প্রবেশ করে আত্মগোপনেও না থাকতে পারে সে বিষয়টি জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়েছে গোপন ওই মেমোতে। ‘র’-এর ধারণা, ভারতে আশ্রয় না পেলে বাংলাদেশ থেকে পালানো ওই শীর্ষ সন্ত্রাসী নেপাল অথবা মিয়ানমারের আরাকান অধ্যুষিত এলাকায় আশ্রয় নেবে।
মতাসীন আওয়ামী লীগ এক দিকে যেমন মতায় আরেক দফা বসার নানা প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে, ঠিক তেমনিভাবে মতা থেকে অগত্যা সরে যেতে বাধ্য হলে শেষ মুহূর্তে এ ধরনের লোমহর্ষক ঘটনা ঘটানোর পরিকল্পনা পাকাপোক্ত করে রেখেছে। কারণ তারা জানে, ২০১৪ সালের নির্বাচনে জয়ী না হতে পারলে আওয়ামী লীগের অস্তিত্বই সঙ্কটে পড়বে। এ ছাড়া ভারতের আগামী নির্বাচনে কংগ্রেস পরাজিত হলে আওয়ামী লীগ তাদের অভিভাবকসুলভ আশীর্বাদ থেকেও বঞ্চিত হবে। এখানে উল্লেখ্য, ভারতীয় জনতা পার্টির সাথে আওয়ামী লীগের মিত্রতার বন্ধন নেই। এসব বাস্তবতায়, ২০১৪ সালের পরবর্তী পাঁচ বছর আওয়ামী লীগের জন্য দারুণ দুঃসময় হবে বলেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচন ঘিরে দেশে যখন চরম অস্থিরতা বিরাজমান তখন বাংলাদেশ সফরে এসেছেন জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব তারানকো। উদ্দেশ্য সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠানে মতাসীন দল এবং প্রধান বিরোধী দলের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের মধ্যে বিরাজমান রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাব্য মহাসঙ্কটের হাত থেকে রা করা। ঢাকায় আসার আগেই জাতিসঙ্ঘের সহকারী মহাসচিব রাষ্ট্রপতি এবং সেনাপ্রধানের সাথেও সাক্ষাতের আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সরকারের প থেকে এ দু’টি সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়নি। অনেকের মনেই প্রশ্ন জাগতে পারে, অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো এবং তার সফরসঙ্গীদের সেনাপ্রধানের সাথে সাাতের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে? এক্ষেত্রে আমাদের সবার খেয়াল রাখা দরকার, বর্তমানে জাতিসঙ্ঘের শান্তিরা মিশনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পঞ্চাশ হাজারের বেশি সদস্য নিয়োজিত আছেন। এ ছাড়া আছেন পুলিশসহ অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার আরো কয়েক হাজার সদস্য। তাই তারানকো বাংলাদেশের সেনাপ্রধানের সাথে সাক্ষাতের আগ্রহ ব্যক্ত করতেই পারেন। এখানে দোষের কী আছে? তাছাড়া চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট মিটে না গেলে বাংলাদেশের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্ব এবং জাতিসঙ্ঘ কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে বলে পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম আভাস দিয়ে যাচ্ছে। যদি সত্যি সত্যিই পরিস্থিতি সেদিকে গড়ায় তাহলে তো জাতিসঙ্ঘের শান্তিরা মিশনে দায়িত্বরত বাংলাদেশী সেনা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেয়ার মতো মারাত্মক কিছুও ঘটতে পারে, যা বাংলাদেশের কোনো নাগরিকেরই কাম্য নয়। কিন্তু মতাসীন দল যখন চোখে সর্ষে ফুল দেখছে, তখন তাদের কাছ থেকে কোনো বিষয়েই সঠিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাশা করা অবান্তর। আর এ কারণেই বাংলাদেশের সামনে যে মারাত্মক সঙ্কট অপেমাণ, তা থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সব দলের অংশগ্রহণে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য অবাধ ও নিরপে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান। এটা সম্ভব যদি মতাসীনদের মাথায় শুভবুদ্ধির উদয় হয়।
লেখক: মনজুরুল ইসলাম
১২ ডিসেম্বর ২০১৩
লিংকঃ http://www.dailynayadiganta.com/details.php?nayadiganta=MjUxMg%3D%3D&s=Nw%3D%3D
বিষয়: বিবিধ
১৫৪৬ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন