ইংলিশ ফুটবল, মুসলিম খেলোয়াড়দের কারনে যেভাবে বদলে যাচ্ছে -
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ০৬ জুলাই, ২০১৩, ০৬:২০:৪৩ সন্ধ্যা
আধুনিক বিশ্ব ফুটবলে যতগুলো ঘরোয়া লিগ চালু আছে তার মধ্যে দর্শকপ্রিয়তা, টেলিভিশন স্বত্ত্ব ও আর্থিক মূল্যমানের দিক দিয়ে সবার উপরে আছে ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ বা ইপিএল’। ইপিএলে একটা সময় মুসলিম খেলোয়াড়দের প্রতিনিধিত্ব ছিল না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমান সময়ের ইপিএলের চেহারা ও সংস্কৃতিই পাল্টে দিচ্ছেন মুসলিম ফুটবলাররা।
১৯৯২ সালে ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লিগ যখন ‘ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ’ নামে শুরু হয়েছিল তখন প্রিমিয়ার লিগে খেলা মুসলিম খেলোয়াড়ের সংখ্যা ছিল মাত্র একজন। টটেনহ্যাম হটস্পার্সের হয়ে খেলতেন স্প্যানিশ মিডফিল্ডার নাঈম। তবে এখন সেই সংখ্যা অনেকগুন বেড়েছে। বর্তমানে প্রিমিয়ার লিগের বিভিন্ন ক্লাবে খেলা মুসলিম খেলোয়াড়ের সংখ্যা ৪০ জন। এই মুসলিম খেলোয়াড়ই নিগুরে পাল্টে দিচ্ছেন ইপিএলের সংস্কৃতি।
মুসলিম খেলোয়াড়রা বেশ কিছুদিন আগে থেকে খেলে আসলেও তাদের গোল উৎযাপন ছিল একেক রকম। তবে প্রিমিয়ার লিগের সংস্কৃতি পাল্টে দেয়া ঘটনা ঘটে ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১২। সেন্ট জেমস পার্কে চলছিল নিউক্যাসল ইউনাইটেড বনাম অ্যাস্টন ভিলার ম্যাচ। ওই ম্যাচের একটি গোল উৎযাপনের ভঙ্গিই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক।
খেলার ৩০ মিনিটের মাথায় ইউনাইটেডের হয়ে গোল করেন সেনেগালের মুসলিম খেলোয়াড় ডেম্বা বা। তিনি গোল উৎযাপনের জন্য দৌড়ে চলে যান কর্নার পতাকার কাছে। যেখানে দাড়িয়েছিলেন তার স্বদেশী আরেক খেলোয়াড় পাপিস সিসে। সবাইকে অবাক করে দিয়ে দুই সতীর্থ গোল উৎযাপনের জন্য সিজদায় পড়ে যান। সেই থেকে ওই সিজদাই হয়ে ওঠে প্রিমিয়ার লিগে মুসলিম সংস্কৃতির প্রতীক। লিগে খেলা প্রত্যেক মুসলিম খেলোয়াড়ই এখন ওই প্রতীক ব্যবহার করছেন।
শুধু প্রিমিয়ার লিগেই নয়, মুসলিম সংস্কৃতির ওই প্রতীককে মুসলিম খেলোয়াড়রা এখন আন্তর্জাতিককরণ করে ফেলেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন লিগে প্রায় দেড় শতাধিক মুসলিম খেলোয়াড় বিভিন্ন ক্লাবে হয়ে খেলছেন।
ফুটবল বিশ্ব নতুন প্রতিভা খুঁজতে যে জাল ফেলেছে। তার মধ্যে ইংলিশি প্রিমিয়ার লিগে জালটাই বোধ হয় বেশি শক্ত। আফ্রিকার মতো অনগ্রসর মহাদেশের প্রত্যন্ত গ্রামের তরুণরাও প্রিমিয়ার লিগে এসে হয়ে উঠছে মহারতারকা। তবে অনগ্রসর আফিকানদের তারকা হওয়ার আরেকটি জায়গা প্যারিসও।
ইংলিশ ক্লাবে খেলে তারা অনেক অর্থ এবং খ্যাতি পায়। কিন্তু তাদের প্রায় সবাই নিজেদের সাংস্কৃতিক পরিচয় ধরে রাখার সর্বাত্নক চেষ্টা করে। কারণ যে সংস্কৃতি তাদের পথ দেখায়, স্বস্তি এবং শক্তি দেয় তা হলো তাদের ইসলামিক বিশ্বাস।
ক্লাবের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো রাখতে ক্লাব পরিবর্তনের সময় অনেক খেলোয়াড়ই তাদের ধর্মের জায়গাটা পরিস্কার করেন। যেমন ডেম্বা বা, তিনি এ বছরই নিউক্যাসল ছেড়ে চেলসিতে যোগ দিয়েছেন। ক্লাব পরিবর্তনের সময় বা চেলসিকে বলেছিলেন, আমি আমার ধর্মের ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস। ক্লাব তার সে কথা মেনে নিয়ে তাকে ধর্মের স্বাধীনতা দিয়ে দলে নিয়েছে তাকে।
মুসলিম খেলোয়াড় দাবি মতোই প্রিমিয়ার লিগের দলগুলো তাদের মুসলিম খেলোয়াড়দের জন্য হালাল খাবারের ব্যবস্থা করে, দলের অন্য খেলোয়াড়দের কাছ থেকে আলাদা থাকার ব্যবস্থা, ভিন্ন গোসলখানা ও প্রার্থনার জন্য তাদেরকে সময় সুযোগ করে দেয়।
প্রিমিয়ার লিগে যিনি ম্যাচ সেরা হন, রীতি অনুযায়ী তাকে এক বোতল স্যাম্পেইন দেয়া হয়। ইসলামে অ্যালকোহল যেহেতু নিষিদ্ধ। তাই মুসলিম খেলোয়াড়রা সেটা নেন না। যেমন ম্যাচ সেরা হয়েও বিনয়ের সঙ্গে স্যাম্পেইনের বোতল পুরস্কার নিতে অস্বীকার করেছিলেন ম্যানচেস্টার সিটির আইভরিকোস্ট মিডফিল্ডার ইয়া ইয়া তোরে। সেসময় লিগ কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করলেও পড়ে তার পরিবর্তন করে।
এখন নতুন নিয়ম অনুযায়ী কোনো খেলোয়াড় স্যাম্পেইন নিতে না চাইলে তাদের জন্য ছোট ট্রফির ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।
২০১২ সালে লিভারপুল যখন লিগ কাপ শিরোপা জিতেছিল। তখন তাদের খেলোয়াড়রা একটি স্যাম্পেইন কোম্পানির পোশাক পড়েছিল এবং প্রত্যেক খেলোয়াড় মাঠেই তাদের পোশাক পরিবর্তন করেছিল। কিন্তু মুসলিম খেলোয়াড়রা ডেসিং রুমে গিয়ে তাদের পোশাক পরিবর্তন করেছিলেন।
মুসলিম খেলোয়াড়দের নিয়ে দল এবং কোচিং স্টাফ কিছুটা সমস্যায় পড়ে রমজাসের সময়। একজন খেলোয়াড় কি প্রায় ১৮ ঘন্টা কিছুই না খেয়ে ৯০ মিনিট পূর্ণ পারফর্ম করতে পারে?
এখানেও একটা উপায় বেড় করে নিয়েছেন মুসলিম খেলোয়াড়রা। তাদের কেউ কেউ ট্রেনিংটা আগেই সেরে নেন। আবার কেউ কেউ ম্যাচের দিন ট্রেনিং করেন না। অথবা রাতের বেলায় সেরে নেন অথবা শুধু ম্যাচের দিন রোজা রাখেন না। ক্লাবগুলোও তাদের সে ব্যাপারে অনেকটা স্বাধীনতা দিয়েছে। তবে মাঝে মধ্যে কিছুটা অসুবিধায় পড়তে হয় কোচকে।
খেলা নয় ধর্মকেই আগে রাখছেন এইসব খেলোয়াড়রা। আর্সেনাল মিডফিল্ডার আবু দিয়াবি বলেন, ‘আমার কাছে আর্সেনালের অগ্রাধিকার আছে। তবে সেটা একনম্বর নয়। কারণ তারা এটা জানে, এই সময়টা (রমজান) আমার কাছে খুবই স্পেশাল। সুতরাং তারা এর মধ্যে দিয়েই আমাকে সেরাভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করে।’
২৮ বছর বয়সী বা বলেন, ‘রমজান নিয়ে ম্যানেজারের সঙ্গে আমার কিছুটা সমস্যা হয়। তবে আমার জায়গায় আমি দৃড়প্রতিজ্ঞ।’
তিনি আরো বলেন, ‘ম্যানেজার সবসময় আমার ওপর খুশি হন না। কিন্তু আমি তাকে বলি, আমি এটা করবো। তবে আমার পারফর্মেন্স ভালো হবে। যদি সেটা না হয়, আপনি আমাকে বেঞ্চে বসিয়ে রাখবেন? তাতে আমার অসুবিধা নেই। তবে এটা আমার করতে হবে।’
তবে এই বছর ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষের জন্য সুখবর এ বছর রোজা শেষ হয়ে যাবে লিগ শুরুর ১০ দিন আগেই।
মুসলিম খেলোয়াড়দের নিয়ে কিছুটা সমস্যায় পড়েছে বিভিন্ন স্পন্সর কোম্পানি। কারণ তাদের দেয়া জার্সি গায়ে তাদের কোম্পানির যে নাম লেখা থাকে তা অনেক সময় মুসলিম বিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। ইসলামিক রীতির সঙ্গে যেগুলো সাংঘর্ষিক, সেই জার্সি পড়তে রাজি হয় না মুসলিম খেলোয়াড়রা।
গত মাসে নিউক্যাসলের স্পন্সন কোম্পানি ওনগার সঙ্গে কথা বলেছেন সিসে। কারণ তিনি খুবই চিন্তিত যে, ওই কোম্পানিকে প্রমোট করতে যেয়ে তার ইসলামিক বিশ্বাসে আঘাত লাগতে পারে। উইগান ও ওয়েস্টব্রুমের দুই মুসলিম খেলোয়াড়ও তাদের ক্লাবকে বলে দিয়েছেন, ক্লাবে পছন্দকৃত স্পন্সরের কারণে যাতে তাদের বিশ্বাস আক্রান্ত না হয়।
উইগানের কুয়েতি গোলরক্ষক আলী আল-হাসবি বলেন, ‘আমরা এখানে ফুটবল খেলতে এসেছি, এটা আমাদের চাকরি। তাই চাকরির জন্য যেন আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসে কোনো ব্যাঘাত না ঘটে।’
প্রিমিয়ার লিগ কর্তৃপক্ষও এই ব্যাপারে কিছু একটা করার চিন্তা-ভাবনা করছে।
মুসলিম খেলোয়াড়দের ওই উৎযাপন ভঙ্গির তালিম নিতে শুরু করেছে ইংলিশ দর্শকরা। ইংল্যান্ডের বিভিন্ন মাঠে খেলার সময় গোল করার পর উৎযাপনের জন্য শিশুরাও পড়ে যাচ্ছে সিজদায়। যদিও তারা জানে না এর মানে কি? এটা মুসলিম রীতি হলেও দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে ইংলিশ সংস্কৃতিতে।
উৎসঃ খেলা ডেস্ক/বিবিসি
বিষয়: বিবিধ
১৬৬৯ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন