মহাজোটের বিশাল ঘাটতির নির্বাচনী বাজেট
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ০৭ জুন, ২০১৩, ০১:১২:১৭ রাত
২০১৩-২০১৪ অর্থবছরের জন্য ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার জাতীয় বাজেট সংসদে পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ৭২ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা; যার মধ্যে ৬৫ হাজার ৮৭০ কোটি যাবে সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি)। অনুন্নয়ন ব্যয় বা রাজস্ব ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। এ ব্যয়ের বড় একটা অংশই যাবে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও পেনশন বাবদ। এর সঙ্গে বিদেশি ঋণের সুদ মেটানোর দায়ও রয়েছে। নতুন বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭ দশমিক ২ শতাংশ।
গতকাল জাতীয় সংসদে বর্তমান সরকারের শেষ বাজেট পেশ করা হয়। ‘উন্নয়নের চার বছর : স্বপ্ন পূরণের পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তব্যে বরাবরের মতো এবারও জাতিকে দেখানো হয়েছে নানারকম স্বপ্ন। বাজেট বক্তব্যের শুরুতেই নতুন অর্থবছরকে ‘ঝুঁকির’ বছর উল্লেখ করে এর আগাম দায় চাপানো হয়েছে বিরোধী দলের ওপর।
নতুন বাজেটে অর্থের উত্স হিসেবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে (এনবিআর) আয় প্রত্যাশা করা হয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার ৪৫৯ কোটি টাকা। ঘাটতি ৫৫ হাজার ৩২ কোটি টাকা। অর্থাত্ মোট দেশজ উত্পাদনের (জিডিপি) তুলনায় ঘাটতি ধরা হয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। ঘাটতি মেটাতে বৈদেশিক ঋণ নেয়া হবে ১৪ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা এবং অনুদান হিসেবে প্রত্যাশা করা হয়েছে ৬ হাজার ৬৭০ কোটি টাকা। বাকি ঘাটতি মেটানো হবে অভ্যন্তরীণ ঋণ থেকে। অভ্যন্তরীণ ঋণ ধরা হয়েছে ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকা।
রাজস্ব আয়ের মধ্যে মূল্য সংযোজন কর বা মূসক এবং আয়কর এবার অনেকটা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। মূসক চলতি অর্থবছর যেখানে মোট রাজস্ব আয়ের ৩৬ শতাংশ ছিল, এবার তা বাড়িয়ে ৩৬ দশমিক ৭ ভাগ প্রত্যাশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে আয়কর চলতি বাজেটে মোট আয়ের ৩১ দশমিক ৫ ভাগ রয়েছে। নতুন বাজেটে প্রত্যাশা করা হচ্ছে ৩৫ দশমিক ৫ শতাংশ। বাজেটে রাজস্ব আয় চলতি অর্থবছরের তুলনায় ২৩ হাজার ৮৩১ কোটি টাকা বেশি প্রত্যাশা আদায়ের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সংসদে উপস্থাপিত বাজেটে নতুন অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের মধ্যে এনবিআর নিয়ন্ত্রিত কর ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০ কোটি টাকা। এতে মূসক ধরা হয়েছে মোট আয়ের ৩৬ দশমিক ৭ ভাগ, আমদানি শুল্ক ১০ দশমিক ৮ ভাগ, আয়কর ৩৫ দশমিক ৫ ভাগ,
সম্পূরক শুল্ক ১৫ দশমিক ৩ ভাগ এবং অন্যান্য আয় ধরা হয়েছে ১ দশমিক ৭ ভাগ। এনবিআর নিয়ন্ত্রিত আয়ের মধ্যে আমদানি শুল্ক, সম্পূরক শুল্ক ও অন্যান্য খাত থেকে আয় চলতি অর্থবছরের (২০১২-২০১৩) তুলনায় কম প্রত্যাশা করা হয়েছে। বেশি আয় আশা করা হচ্ছে মূসক ও আয়কর থেকে। তবে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আর্থিক বৈষম্য হ্রাস করে ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় বর্তমান সরকারের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিটি করপোরেশন কেন্দ্রিক করদাতাদের ন্যূনতম আয়কর ৩ হাজার টাকা বহাল রেখে জেলা শহরভিত্তিক পৌর এলাকার করদাতাদের জন্য নূ্যূনতম ২ হাজার টাকা এবং জেলা সদরের বাইরে অবস্থিত অন্যান্য এলাকা বা গ্রামীণ এলাকার করদাতার ন্যূনতম আয়কর ১ হাজার টাকায় নির্ধারণের প্রস্তাব করছি।’ এতে এনবিআরের ঘাড়ে যে বিশাল রাজস্ব আয়ের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে তা পূরণ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
সরকারের দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে দাতারা অর্থসহায়তায় আশানুরূপ সাড়া দিচ্ছেন না। তাই নতুন বাজেটে বৈদেশিক অনুদান খাত থেকে আয় কিছুটা কমানো হয়েছে। চলতি অর্থবছরে বাজেটে আয়ের মধ্যে যেখানে বৈদেশিক অনুদান থেকে প্রত্যাশা ছিল মোট আয়ের ৩ দশমিক ২ শতাংশ, এবার তা ২ দশমিক ৯ ভাগ প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিরোধী দলের অনুপস্থিতিতে গতকাল বিকালে সংসদ অধিবেশন শুরু হয়। এর কিছুক্ষণ পর অর্থমন্ত্রী বাজেট বক্তৃতা উপস্থাপনের জন্য স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর অনুমতি চান। স্পিকার অনুমতি দেয়ার পর অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে প্রাথমিক বক্তৃতার পর তার আসনে বসে মূল বাজেট বক্তৃতা পাঠ করেন। এর আগে মন্ত্রিসভা এ বাজেট অনুমোদন করে। অর্থমন্ত্রী এবারও ডিজিটাল পদ্ধতিতে (পাওয়ার পয়েন্টের মাধ্যমে) বাজেট উপস্থাপন করেন।
নতুন বাজেটে পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য ৬ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। আগামী অর্থবছরের জন্য সড়ক যোগাযোগ ও রেলপথ খাতে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন মিলে ১৮ হাজার ২৩২ কোটি ৭৩ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী জানান, ভারতের ২০ কোটি ডলারের (২০০ মিলিয়ন) অনুদানও পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যবহার করবে সরকার। এ সেতু নির্মাণে দেশের জনগণ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশী অভিবাসীদের সহায়তা চেয়েছেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন বাজেটে প্রতিরক্ষা খাতে ১৪ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। সশস্ত্রবাহিনীর আধুনিকায়নের কথা জানিয়ে বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী বলেন, আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র কেনার মাধ্যমে সেনাবাহিনীর আধুনিকায়ন এবং ইউনিট সদর দফতরের অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
এবারের ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষাখাতে ১৩ হাজার ১৭৯ কোটি ২৩ লাখ বরাদ্দের প্রস্তাব করেন আবুল মাল আবদুল মুহিত। এছাড়া প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ১১ হাজার ৯৩৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেট বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী করপোরেট বা কোম্পানির করের কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনার প্রস্তাব রেখেছেন। অন্যান্য কর প্রস্তাব পুনর্বিন্যাস না করে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মুঠোফোন অপারেটরদের করের হার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন তিনি। এর আগে মুঠোফোন প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তিতে উত্সাহ দিতে কর হার ১০ শতাংশ ছাড় দেয়া হয়েছিল। নতুন বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত মুঠোফোন কোম্পানির করপোরেট কর ৪০ শতাংশ হবে। এতে গ্রামীণফোনকে আগের চেয়ে বেশি কর দিতে হবে। সিম কার্ড, ওয়েব ও ডিজিটাল ক্যামেরা, অপটিক্যাল ফাইবার কেবলের শুল্ক কমানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী।
নতুন বাজেটে পুঁজিবাজার নিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের ব্যবস্থাপনা থেকে মালিকানা পৃথককরণ বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন শুরু হলে পুঁজিবাজারে অস্থিতিশীলতা কমে আসবে। তবে কর সুবিধা ছাড়া শেয়ারবাজারে বড় কিছু নেই। প্রস্তাবিত বাজেটে শেয়ারবাজারের জন্য বড় কোনো প্রণোদনা দেয়া হয়নি। পুঁজিবাজারে বিনিয়োগে আলাদা ফান্ড গঠনসহ শেয়ারবাজারের জন্য বড় ধরনের ঘোষণা থাকবে—এমন আশাবাদ শোনা গেলেও শেষ পর্যন্ত তার কোনো কিছুই হয়নি।
২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ইসির জন্য ১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন অর্থমন্ত্রী। ২০১১-২০১২ অর্থবছরে ইসির ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ১৯২ কোটি টাকা। ইসির বরাদ্দ সংসদ ও উপজেলা নির্বাচনের জন্য বড় ব্যয়ের পাশাপাশি ইসির নিজস্ব ভবন নির্মাণ, স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতেও ব্যয় হবে। সর্বশেষ নবম সংসদ নির্বাচন পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাখাতে ব্যয় হয়েছিল ১৬৫ কোটি টাকার বেশি।
নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে কৃষিখাতে ১২ হাজার ২৭৫ কোটি ৯৫ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ৭.৯ শতাংশ। এছাড়া নতুন অর্থবছরে কৃষিখাতে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকির প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে এ খাতে ভর্তুকি ছিল ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকা, সংশোধিত বাজেটে যা বেড়ে ১২ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়।
আগামী অর্থবছরে ব্যক্তিশ্রেণীর করদাতাদের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী। এতে মধ্যবিত্ত সাধারণ করদাতারা আরও কিছুটা কর ছাড় পাবেন। আয়ের সীমা ২ লাখ ২০ হাজার টাকা করার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। নারীদের ক্ষেত্রে তা হবে আড়াই লাখ টাকা পর্যন্ত।
নির্বাচনের বছরের বাজেটে দেশের ১৩ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর জন্য স্থায়ী পে-কমিশন গঠনের ঘোষণা দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী। বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আগামী অর্থবছরই আরেকটি বেতন কমিশন গঠনের সময় হয়ে যাবে। আমরা এই সুযোগে স্থায়ী বেতন কমিশন গঠন করব এবং তারাই ভবিষ্যতে বেতনভাতা নিয়ে সময়ে সময়ে সরকারকে সুপারিশ দেবে।’ মুহিত বলেন, সরকার আগামী অর্থবছর বাংলাদেশ ব্যাংক এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর জন্যও স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো চালু করবে।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত অনুন্নয়ন বাজেটের সিংহভাগ চলে যাবে সুদ পরিশোধে। এ অর্থবছরে খাতভিত্তিক বরাদ্দের ১৭ দশমিক ৯০ শতাংশ সুদের পিছনে ব্যয় হবে। সরকার ২০১৩-১৪ অর্থবছরের জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে নিট ৩৩ হাজার ৯৬৪ কোটি টাকার ঋণ নেয়ার প্রস্তাব করেছে। এতে মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে এক লাখ ৬১ হাজার ৪৯২ কোটি টাকা। সে হিসাবে সরকারকে এ সময়ে ২৭ হাজার ৭৭৪ কোটি ১৮ লাখ টাকার সুদ পরিশোধ করতে হবে।
বিষয়: বিবিধ
১০২১ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন