সারাদেশে এক মাস ও ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ । বাংলাদেশের ভবিষ্যত কোন দিকে চলেছে?
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ২১ মে, ২০১৩, ০৩:০০:৩৯ রাত
সারাদেশে এক মাস ও ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করে তোপের মুখে পড়েছে আওয়ামী লীগ সরকার। বিরোধী দলের পাশাপাশি দেশের বরেণ্য নাগরিকরাও সরকারের এ সিদ্ধান্তের তীব্র সমালোচনা করেছেন। একে একদলীয় বাকশাল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে মন্তব্য করেছেন তারা।
সোমবার ওই ঘোষণার পর জনগণের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। জনরোষের ভয়ে সরকারও পিছুটান দিতে বাধ্য হয়েছে।
রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চট্টগ্রামে এক অনুষ্ঠানে এবং পরে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাত্কারে স্পষ্ট করেই সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করার কথা জানান। তারপর সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি করেন। তিনি আরও যোগ করেন যে, ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের পর ত্রাণকাজের জন্য সরকার সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে।
তবে উপকূলীয় এলাকায় মাঝারি আকারের ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানলেও ঢাকায় কেন সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হলো তার কোনো ব্যাখ্যা দেননি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিংবা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।
চরম এ ব্যবস্থা গ্রহণের কারণ হিসেবে সরকারের এক এক নেতা এক এক ধরনের মন্তব্য করেছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হেফাজতে ইসলাম ও বিএনপির ‘তাণ্ডব’কে দায়ী করেছেন।
রোববার সরকারের ওই সিদ্ধান্তের পরপরই মোহাম্মদপুরে ১৪ দলের পূর্বঘোষিত একটি সমাবেশ বাতিল করা হয়। এতে সবাই ধরে নেন যে সরকারের এ সিদ্ধান্ত সর্বোচ্চ মহলের।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গণবিস্ফোরণে ভয়ে এবং জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযমের সম্ভাব্য রায় ঘোষণাকে সামনে রেখে সরকার এ অসাংবিধানিক পদক্ষেপ নিয়েছে।
সরকারের ওই সিদ্ধান্তকে অঘোষিত জরুরি অবস্থা বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্টজনরা। গতকাল টিআইবির প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অসাংবিধানিক। সরকারের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এমকে আনোয়ার বলেছেন, একে অনানুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা মন্তব্য করে বলেছেন এখন বাকি আছে শুধু আনুষ্ঠানিক জরুরি অবস্থা ঘোষণা।
রোববার রাত থেকেই সরকারের অবস্থান পরিবর্তন শুরু হয়। রাতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক ব্যাখ্যায় বলা হয়, সব ধরনের সভা সমাবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ব্যাখ্যায় জানিয়েছে, ‘সাধারণ’ সভা-সমাবেশের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।
এর আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর বিবিসিকে বলেছিলেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য ঢাকায় সব রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছে সরকার। তখন তার ভাষ্য ছিল, রাজনৈতিক দলগুলো শান্তিপূর্ণভাবে সভা-সমাবেশ করবে এমন নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত রাজধানীতে কোনো দলকেই সভা সমাবেশ করতে দেয়া হবে না।
তবে রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয় এক ব্যাখ্যা দিয়ে যে বিবৃতি দেয় তাতে বলা হচ্ছে, কোনো দলের কর্মসূচিতে জানমালের ক্ষতি বা নাশকতার আশঙ্কা থাকলে তাদের সমাবেশ করার অনুমতি দেবে না সরকার। তবে ‘সাধারণ’ সভা-সমাবেশে সরকারের আপত্তি নেই।
বিবিসি বাংলা জানায়, সরকারের উচ্চপর্যায়ে আরও কয়েকজনের সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে তাদের কথা হয়েছে। কিন্তু তারা এ নিষেধাজ্ঞার কথা স্পষ্টভাবে জানতেন বলে তাদের কথায় মনে হয়নি।
গতকাল অবশ্য আওয়ামী লীগের নেতাদের সুর কিছুটা পাল্টাতে দেখা গেছে। জোট শরিক দলগুলোর নেতারা এ নিয়ে প্রকাশ্যে মুখ খোলেন। আওয়ামী লীগের নেতারাও ইঙ্গিতে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম এর প্রতিক্রিয়ায় শুধু বলেছেন, ‘আমি মনে করি রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সভা-সমাবেশ বন্ধ করে এ সমস্যার সমাধান হবে না।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেছেন, এটা তো অটোক্র্যাটিক সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। এ সিদ্ধান্তে তো বিরোধী দল থেকে আওয়ামী লীগেরই ক্ষতি বেশি। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ তো মাঠের দল। সভা-সমাবেশ না করতে পারলে জনগণের কাছে যাব কী করে?
সভা-সমাবেশের ওপর সরকারের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মহাজোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন জানিয়েছেন এটি সরকারের একটি জনবিচ্ছিন্ন উদ্যোগ। সরকারের আরেক শরিক জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ জানিয়েছেন, সরকারের এ সিদ্ধান্তের কারণে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচিতে বিরোধী দলকে উত্সাহিত করবে।
উল্লেখ্য, সভা সমাবেশ জনগণের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। সংবিধানের ৩৭ ধারায় বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধা নিষেধ সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিবার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’
কিন্তু এই অধিকার ঢালাওভাবে অস্বীকার করে সরকার যে ঘোষণা দিয়েছিল তা ছিল অঘোষিত জরুরি অবস্থা। জরুরি অবস্থায় জনগণের সংবিধান স্বীকৃত অধিকার স্থগিত করা হয়, সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয় এবং গণমাধ্যমের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
সম্প্রতি বিরোধী দল বিএনপিকে ঢাকায় কয়েক দফায় সমাবেশ করতে দেয়নি সরকার। এরপর আরও একাধিক সংগঠনকেও সমাবেশ ও মানববন্ধন করতে বাধা দেয়া হয়েছে।
তারও আগে সরকার গায়ের জোরে বহুল প্রচারিত দৈনিক আমার দেশ বন্ধ করে দিয়েছে। এরপর বিরোধী দল সমর্থক দিগন্ত টিভি ও ইসলামিক টিভির সম্প্রচারও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
এর মাধ্যমে কার্যত দেশে জরুরি অবস্থাই জারি করা হলো। জরুরি অবস্থার অন্যতম অনুসঙ্গ সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা এবং গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ।
জরুরি অবস্থায় গণমাধ্যমে সেন্সরশিপও আরোপ করা হয়। সেই ব্যবস্থাও দেশে বহাল আছে। এ কারণে শাপলা চত্বরে গণহত্যার মতো স্বাধীন বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় গণহত্যার খবরও প্রচার করেনি দেশের গণমাধ্যমগুলো।
সম্প্রতি প্রভাবশালী মার্কিন টিভি স্টেশন সিএনএন সরাসরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই জানিয়েছে, সিএনএনসহ বিদেশি গণমাধ্যমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। তারা ভিসা চাইলে ভিসা অফিসার জানায়, প্রতিবেদন প্রচারের আগে তা বাংলাদেশ সরকারকে দেখাতে হবে এবং সরকারের মনঃপুত নাহলে সেই রিপোর্ট বাজেয়াপ্ত করা যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের আরেক প্রভাবশালী টিভি স্টেশন আল জাজিরাও একই পরিস্থিতি মাথায় নিয়ে বাংলাদেশের খবর প্রচার করছে। সোশ্যাল মিডিয়াকেও নিয়ন্ত্রণ করার পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার।
জরুরি অবস্থার শুধু আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি —এম কে আনোয়ার : সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দিয়ে সরকার শুধু জরুরি অবস্থার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি রেখেছে বলে অভিযোগ এনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য এম কে আনোয়ার বলেছেন, আপনারা শেষ অস্ত্র ছেড়েছেন, এখন সরকারের বাকি আছে শুধু জরুরি অবস্থা ঘোষণা। প্রধানমন্ত্রীর অধীনে কোনো নির্বাচন এদেশে হবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে তিনি সরকারের উদ্দেশে বলেন, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংলাপে আসুন। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা পুনর্বহালে সচেষ্ট হোন। অন্যথায় জনতার চাপে টিকতে পারবেন না।
গতকাল বিকালে নয়াপল্টনে ভাসানী মিলনায়তনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের রোগমুক্তি কামনায় মহানগর বিএনপি আয়োজিত দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে এম কে আনোয়ার প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন।
একই স্থানে সকালে মহিলা দল আয়োজিত দোয়া মাহফিলে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দাসখত দিয়ে বিএনপি কখনও রাজনীতি করেনি। আপসহীন থেকেই দেশনেত্রী বেগম জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির নেতাকর্মীরা লড়াই চালিয়ে যাবে। বাধা পেরিয়েই গণতান্ত্রিক কর্মসূচি চলবে বলে তিনি ঘোষণা দেন।
বিকালের দোয়া মাহফিলে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, মশিউর রহমান, ঢাকা মহানগর সদস্য সচিব আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক এমরান সালেহ প্রিন্স, ঢাকা মহানগর যুগ্ম আহ্বায়ক আবু সাঈদ খান খোকন, কাজী আবুল বাশার, শামছুল হুদা, আলী আজগর মাতাব্বর, আতিক উল্লাহ আতিক, আনোয়ারুজ্জামান আনোয়ার, ওলামা দল সভাপতি হাফেজ মাওলানা আবদুল মালেক, ঢাকা মহানগর শ্রমিক দল সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নাসিম, মুক্তিযোদ্ধা দলের সিনিয়র সহসভাপতি আবুল হোসেন, মহিলা দল ঢাকা মহানগরীর সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন প্রমুখ।
এম কে আনোয়ার আরও বলেন, ক্ষমতাসীনরা একটি সাজানো নির্বাচন আয়োজনের ষড়যন্ত্র করছে। এজন্যই তারা সংবিধান সংশোধন করেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কে হবেন, তা স্পষ্ট করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনমতের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখা দিন। জাতি ইতিবাচক সাড়া দেবে।
একটি পত্রিকায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিষয়ে জরিপের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। জনগণের এ দাবি মেনে নিয়ে নির্দলীয় সরকারের বিষয়ে সংলাপে বসুন। তিনি বলেন, আজকে সবচেয়ে বেশি দোয়া দরকার সরকারের। কারণ তারা অসুস্থ হয়ে অগণতান্ত্রিক এবং অসাংবিধানিক কাজ করে চলেছে।
সকালে দোয়া মাহফিলে মহিলা দলের সভাপতি নূরে আরা সাফার সভাপতিত্বে আরও বক্তৃতা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান, অর্থনৈতিক সম্পাদক আবদুস সালাম, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক শিরিন সুলতানা, সংসদ সসদ্য রাশেদা আক্তার হীরা প্রমুখ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আবদুল মঈন খান আরও বলেন, এক মাসের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুচলেকা বা দাসখত দিয়ে বিএনপি রাজনীতি করবে না। একটি গণতান্ত্রিক দেশে অনুমতি নিয়ে রাজনীতি করতে হবে, এটা হতে পারে না। বিএনপি শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পথে হেঁটে যাবে।
তিনি বলেন, সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা সরকারের, সে কারণে আমরা চাইলেও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনতে পারব না। তাই সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। এটা একটা রাজনীতির খেলা। আমরা শান্তিপূর্ণ সংলাপের মাধ্যমে এ ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাই।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে সম্প্রতি একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত জরিপ প্রসঙ্গে বিএনপির এই সিনিয়র নেতা বলেন, দেশের ৯০ ভাগ মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। আমরাও চাই একটি সভ্য, গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন।
সিঙ্গাপুরে চিকিত্সাধীন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের জন্য দোয়া কামনা করে তিনি বলেন, আন্দোলন বন্ধ করতে সরকার বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে নির্যাতন করছে। কিন্তু এতে আন্দোলন বন্ধ হবে না।
সভা-সমাবেশ বন্ধ করে রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না —নাসিম : রাজধানীতে সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপের সরকারি সিদ্ধান্তে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছে। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলা করতে হবে। সভা-সমাবেশ বন্ধ করে এ সমস্যার সমাধান হবে না।
গতকাল দুপুরে রাজধানীর ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস উপলক্ষে এক আলোচনা সভা শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে দেয়া এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এ কথা বলেন।
নিষেধাজ্ঞার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে নাসিম বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্ট হলেও পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রেসনোটে সব দ্বিধা কেটে গেছে। ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশের নামে যেভাবে ভাংচুর ও হামলা চালানো হয়, তা বিবেচনা করে এবং ৫ মে হেফাজতের সমাবেশের পর সরকার এ বিষয়ে অনুমতি দিতে সতর্কতা অবলম্বন করছে।
দেশে অঘোষিত জরুরি অবস্থা চলছে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না, তা কেন হবে? জরুরি অবস্থার আশঙ্কা বিভ্রান্তিকর ও অমূলক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যার পর এ বিষয়ে কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। তবে রাজপথের ব্যাপারে, বিশেষ করে ঢাকা শহরে এ নিষেধাজ্ঞা এক মাস নয়, আরও বেশি হলে ভালো হয়।
নাসিম বলেন, যে কোনো দল অনুমতি নিয়ে এখনও সভা-সমাবেশ করতে পারে। তবে রাজপথে সভা-সমাবেশের অনুমতি দেয়া যায় কি না, এ বিষয়ে ভাবতে হবে।
বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যক্রম সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক এ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, তার কার্যক্রম অত্যন্ত ইতিবাচকভাবে দেখছি। তিনি অত্যন্ত দক্ষ লোক। আর দক্ষভাবেই কাজ করছেন।
এর আগে আলোচনা সভায় বক্তব্যকালে নাসিম বলেন, বর্তমান নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান থাকবেন। বিশ্বের সব সংসদীয় গণতান্ত্রিক দেশেও এমন বিধান রয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাঠামো নিয়ে কেউ চাইলে সংসদে আলোচনা হতে পারে।
তিনি এ সময় অতিকথক মন্ত্রীদের কথা কম বলার পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীরা অযথা কথা বলে মানুষের কাছে সরকারকে বিতর্কিত করছেন; কোনো ঘটনা ঘটলে অহেতুক অন্যের ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছেন। এতে প্রকারান্তরের সরকারেরই বেশি ক্ষতি হচ্ছে।
সরকার নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে —ইফতেখারুজ্জামান : রাজধানীতে সব ধরনের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধে সরকারের সমালোচনা করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের প্রধান নির্বাহী ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা অসাংবিধানিক। সরকারের মধ্যে আস্থাহীনতা দেখা দিয়েছে। মহাসেনের কারণে সরকার এটি করলে দুর্যোগকবলিত এলাকায় সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করতে পারত; পুরো ঢাকায় কেন? এর মাধ্যমে সরকার নিজেকে জনবিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে।
গতকাল সকালে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) হিউম্যান রাইটস ফোরাম আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির পর্যালোচনা এবং মানবাধিকার ফোরাম বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়া জানাতে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের অভিযোগগুলো বিবেচনায় নিয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে শাস্তি প্রদান সংক্রান্ত যেসব সুপারিশ জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে করা হয়েছে, সেগুলো দ্রুততার সঙ্গে সম্পাদন এবং জনসম্মুখে প্রকাশের দাবি জানিয়েছেন হিউম্যান রাইটস ফোরামের (এইচআরএফ) সভাপতি সুলতানা কামাল।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের তীব্র সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও গুমের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য অত্যন্ত হতাশাজনক ও অগ্রহণযোগ্য। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে কোনো ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের জিরো টলারেন্স নীতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও নির্যাতনের যেসব অভিযোগ রয়েছে, তা বাতিল করে দিয়ে এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটছে না বলে দাবি করেছেন—যা অগ্রহণযোগ্য।’ তিনি বলেন, ‘ফোরাম মনে করে, এ বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি সত্যকে এড়িয়ে গেছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিশেষ করে র্যাবের মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ কোনোভাবেই এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। আমরা দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানিয়ে আসছি।’
প্রসঙ্গত, মানবাধিকার কাউন্সিলের ১৬তম অধিবেশনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনার তিন ঘণ্টার ওই আলোচনায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি গত চার বছরের (২০০৯-২০১২) মানবাধিকার উন্নয়নে প্রথম ইউপিআর অধিবেশনে প্রদত্ত সুপারিশ ও অঙ্গীকারগুলো বাস্তবায়নের অগ্রগতি এবং সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রম তুলে ধরেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য উপস্থাপনের পর পারস্পরিক অংশগ্রহণমূলক আলোচনায় ৯৭টি দেশের প্রতিনিধি আগামীতে মানবাধিকার উন্নয়নের বিষয়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রায় ১৯৬টি সুপারিশ উপস্থাপন করেন এবং তাদের বক্তব্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করেন। সর্বোচ্চ সংখ্যক সুপারিশ আসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, শ্রমিক অধিকার ও শ্রমিকদের নিরাপদ কাজের পরিবেশ নিশ্চিতকরণ, নারী ও শিশু অধিকার, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, মানব পাচার প্রতিরোধ, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সনদ স্বাক্ষর ও সংরক্ষণ তুলে নেয়া, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ সংক্রান্ত। এসবের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ১৬৪টি সুপারিশ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য অনুযায়ী রাজনৈতিক বিবেচনায় স্পর্শকাতর ২৫টি সুপারিশ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানাতে সরকার সময় নিয়েছে সেপ্টেম্বরের মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশন পর্যন্ত। অন্যদিকে সাতটি বিষয়ে সুপারিশ বাংলাদেশ সরকার প্রত্যাখ্যান করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মৃত্যুদণ্ড বিলোপ করা এবং তা বিলোপের আগ পর্যন্ত সব ফাঁসি বন্ধ রাখা, রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে সহায়তা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি প্রদান প্রভৃতি।
তথ্যসূত্রঃ আমারদেশ
বিষয়: বিবিধ
১৫৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন