সাভারে গণহত্যা : নিখোঁজ হাজার থেকে রহস্যজনকভাবে দেড়শ’তে আসল যেভাবে
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ০৩ মে, ২০১৩, ০২:৩১:৫৮ রাত
সাভারের যুবলীগ নেতা সোহেল রানার মালিকানাধীন রানা প্লাজার নয়তলা ভবন ধসে নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের সংখ্যা নিয়ে বড় ধরনের বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। গত তিনদিন ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা বা নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা সর্বনিম্ন ৯শ’ থেকে সর্বোচ্চ ১৬শ’ পর্যন্ত বলা হচ্ছিল। সরকারি কন্ট্রোল রুম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পরিচালিত বেসরকারি তালিকা অনুযায়ী নিখোঁজের এই সংখ্যা বিভিন্ন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও জাতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও এ নিয়ে সরকারের তরফ থেকে কিংবা সমন্বয়কারীর পক্ষ থেকে কোন আপত্তি তোলা হয়নি। কিন্তু অনেকটা আকস্মিকভাবেই গত পরশু প্রথমবারের মতো এবং গতকাল আবারও নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা ১৪৯ জন বলে সরকারের পক্ষ থেকে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি সাংবাদিকদের জানান। হঠাত্ করে নিখোঁজ শ্রমিকের সংখ্যা এত কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বিভিন্ন তালিকায় একই শ্রমিকের নাম ৪/৫ বার করে উঠানো হয়েছে বলে দাবি করেন। ১ মে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক সমাবেশে লাশ গুমের অভিযোগ আনেন। এ জাতীয় অভিযোগের প্রতিবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী।
এ প্রেক্ষিতে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে সাভারে গতকাল সরেজমিনে উদ্ধার অভিযান ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে লাশ ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে।
গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হাসান শহীদ সোহরাওয়ার্দী জানান, এ পর্যন্ত ধসে পড়া ভবন থেকে ৪২৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৪৩৭ জনকে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৮৬৬ জনকে। এখনও ১৪৯ জন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। পরে গতরাত ৯টা পর্যন্ত আরও ১২টি লাশ উদ্ধার করার খবর সরকারি সূত্র জানায়। সরকারি এই হিসাব অনুযায়ী সব মিলে ধসে পড়া ভবন থেকে মোট ৪৪১টি লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়া অনুসন্ধানে জানা গেছে, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালসহ কয়েকটি হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় আরও সাতজন মারা গেছেন। এ নিয়ে ভবনধসে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৪৮। এর মধ্যে ৩৮৩টি লাশ তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আরও ৫২টি লাশ মিটফোর্ড ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে হস্তান্তরের অপেক্ষায় আছে ১৬টি লাশ।
ধসে পড়া রানা প্লাজার কতজন শ্রমিক এখনও নিখোঁজ রয়েছে, সে সংখ্যা নিয়ে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ্য করা গেছে। নিখোঁজদের সংখ্যা নিয়ে সরকারি সংস্থাগুলোর বিরুদ্ধে লুকোচুরির অভিযোগের প্রমাণ গতকাল সরেজমিন ঘুরে পাওয়া গেছে। নিখোঁজদের প্রকৃত তালিকা প্রস্তুত না করায় জেলা প্রশাসনের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা। তবে সংখ্যা যা-ই হোক, রানা প্লাজার সামনে, অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠ, এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মিডর্ফোঁ হাসপাতালে গতকালও শত শত নিখোঁজ শ্রমিকের ছবি নিয়ে তাদের স্বজনদের অপেক্ষার দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। নিখোঁজদের জীবিত পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়ে অন্ততপক্ষে লাশটি পেলেও সেটি বাড়িতে নিয়ে দাফন করতে পারবেন, এমন আকঙ্ক্ষা নিয়ে স্বজনরা দিন-রাত অপেক্ষা করছেন। নিখোঁজদের ছবিসহ সন্ধান চাই, এমন পোস্টারে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের প্রতিটি দেয়াল পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। বিদ্যালয়ের এমন কোনো দেয়াল পাওয়া যাবে না, যেখানে নিখোঁজদের সন্ধানের পোস্টার নেই।
এসব স্বজনের সঙ্গেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনীর সদস্য ও জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা অসৌজন্যমূলক আচরণ করছেন। এমনকি লাঠিপেটা করতেও দেখা গেছে। এ ছাড়া ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে উদ্ধার অভিযানে গতকালও ধসে পড়া ভবনের প্রতিটি পরতে পরতে শ্রমিকদের লাশ ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। এর আগে উদ্ধার অভিযানে অংশ নেয়া সাধারণ স্বেচ্ছাসেবী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলেছেন, এখনও প্রচুর লাশ ভবনের সিঁড়িতে পড়ে থাকতে দেখেছেন তারা। গতকাল ভারী যন্ত্রাংশের সঙ্গে নিহতদের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ খসে আসতেও দেখা গেছে। প্রচুর লাশ থাকায় দুর্গন্ধও ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। অভিযোগ রয়েছে, লাশের এসব খণ্ডিত অংশ বুলডোজারসহ ভারী যন্ত্রপাতি দিয়ে চুরমার করা কংক্রিটের সঙ্গে সেগুলো গাড়িতে করে বংশী নদীর পাড়ে ফেলে দেয়া হচ্ছে। লাশ গুমের অভিযোগে নিখোঁজদের স্বজনদের এসব কংক্রিটবাহী গাড়ি ঠেকিয়ে তল্লাশি করতেও দেখা গেছে। গতকাল অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে এই প্রতিনিধির পাশেই কংক্রিটবাহী গাড়ির নিরাপত্তায় নিয়োজিত এক পুলিশ কর্মকর্তাকে মুঠোফোনে সাভার থানার ওসি আসাদুজ্জামানকে ‘যারা গাড়িতে বাধা দিতে আসবে, তাদেরই গ্রেফতার করার নির্দেশ দিতে দেখা গেছে।’
লাশ ও নিখোঁজ নিয়ে লুকোচুরি : ভবনধসের গতকাল নবম দিনেও সরকারের পক্ষ থেকে জেলা প্রশাসন কিংবা অন্য কোনো সংস্থাকে প্রকৃত নিখোঁজদের তালিকা তৈরি করতে দেখা যায়নি। তবে এত দিন অধিকাংশ মিডিয়ায় নিখোঁজদের সংখ্যা সহস্রাধিক হিসেবেই উল্লেখ করার পর বুধবার থেকে সেনাবাহিনী ও জেলা প্রশাসনকে হঠাত্ এ সংখ্যা কমিয়ে ১৪৯ জন নিখোঁজ রয়েছে বলে দাবি করছে। গত সোমবার অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ের ক্যানটিনে স্থাপিত জেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কার্যালয়ে থেকে জানানো হয়, নিখোঁজের সংখ্যা ৮৪। অথচ একই দিন জেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কার্যালয়ের পাশেই মসজিদের সামনে বিদ্যালয়ের মাঠে স্থাপিত সাভার থানা পুলিশের কন্ট্রোল রুমে নিখোঁজদের স্বজনদের দেয়া তথ্য নিয়ে নিখোঁজদের তালিকা প্রস্তুত করতে দেখা গেছে। জানা যায়, পুলিশের হিসাব অনুযায়ী, নিখোঁজ তালিকা তৈরি করা হয়েছে। গত সোমবার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই তালিকায় এক হাজার ২২৫ জনের নাম যুক্ত হয়েছে বলে জানা যায়। তবে এ সংখ্যা ক্রমেই দীর্ঘ হচ্ছে বলেও জানা গেছে। সাভার থানার ওসি (তদন্ত) আমিনুর রহমান ওই দিন সাংবাদিকদের জানান, নিখোঁজদের স্বজনরা অভিযোগ করে গেলেই আমরা তালিকায় নাম, ঠিকানা ও ফোন নম্বর যুক্ত করছি। তা ছাড়া সাভার থানার এসআই মো. মোস্তফা নিখোঁজ এক হাজার ২০০ জনের তালিকা করা হয়েছে বলে সাংবাদিকদের জানান। তবে এ তালিকায় নাম থাকা অনেকেই আবার তাদের স্বজনদের জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় খোঁজ পেয়েছে এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে একই ব্যক্তির নাম কয়েকবারও আসতে পারে, এ জন্য সংখ্যা কিছুটা বেশি হয়েছে বলেও জানান পুলিশের ওই কর্মকর্তা।
এ ছাড়া জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সোস্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের উদ্যোগে নিখোঁজদের স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুসারে একট পৃথক তালিকা তৈরি করা হয়। ওই তালিকা অনুযায়ী নিখোঁজদের সংখ্যা এক হাজার ৩৫০ জন। তাছাড়া মঙ্গলবার এবং এমনকি বুধবার দুপুর পর্যন্ত প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক বিভিন্ন গণমাধ্যমের দেয়া তথ্য অনুয়ায়ী কিছুটা কম-বেশি থাকলেও অন্ততপক্ষে সহস্রাধিক ব্যক্তি এখনও নিখোঁজ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু নিখোঁজদের চিত্র পুরো পাল্টে যায় বুধবার দুপুরের পর থেকে। বুধবার বিকালে নারায়ণগঞ্জের কাঁচপুরে এক শ্রমিক সমাবেশে বিরোধীদলীয় নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ‘সাভারে নিহত কয়েকশ’ শ্রমিকের লাশ সরকার গুম করেছে এবং লাশের সংখ্যা কম করে দেখানো হচ্ছে’ প্রকাশ্যে এমন অভিযোগ তোলার সঙ্গে সঙ্গে সরকারি বিভিন্ন সংস্থা আকস্মিকভাবেই সহস্রাধিক নিখোঁজের সংখ্যা এক লাফে কমিয়ে এনে বলতে শুরু করে ভবন ধসের ঘটনায় এখনও ১৪৯ জন নিখোঁজ রয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউটের সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের তৈরি করা তালিকা অনুযায়ী নিখোঁজদের সংখ্যার বিষয়ে জানতে চাইলে সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার ক্লাবের সভাপতি মাহমুদুল হাসান হিমু বলেন, আমরা কয়েক দিন অনেক কষ্ট করে এই তালিকাটি প্রস্তুত করেছি। তবে কিছু নাম একাধিকবার আসার কারণে সংখ্যাটি একটু বেশি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এ সংখ্যা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। শেষ হলে পরবর্তীকালে সেটা প্রকাশ করে হবে। তবে এ সংখ্যা কিছুটা কমবে বলে তিনি জানান। ক্লাবের অভিভাবক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের প্রধান মাফরুহী সাত্তার আমার দেশকে জানান, যাচাই-বাছাই শেষে এক হাজার ৩৫০ জন নিখোঁজের ওই সংখ্যা কমে ৫২০ জনে আসবে। প্রাথমিকভাবে তিনি এমনটিই জানতে পেরেছেন বলে জানান।
গতকাল অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠে প্রবেশ করতেই দেখা গেছে হাতের বাম পাশে ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস ক্রাইম রিপোর্টার ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠনের নামে নিখোঁজদের স্বজনদের কাছ থেকে ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ করে একটি তালিকা করা হচ্ছে। সংগঠনটির প্রেস বিষয়ক সম্পাদক রাসেল রেজা জানান, ৮৩০ জন নিখোঁজের একটি তালিকা তৈরি করা হয়।
এছাড়া বিজিএমই’র নির্দেশে বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের উদ্যোগে নিখোঁজ, ভবন ধসে আহতদের নাম সংগ্রহ করা হচ্ছে। সংগঠনটির সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুমন জানান, তারা নিখোঁজদের স্বজনদের কাছ থেকে ৮০২ জনের নাম পেয়েছেন। এছাড়া আহত ২ হাজার ৪০৩ জনেরও তারা একটি তালিকা করেছেন, যাদের বিজিএমই’র পক্ষ থেকে বেতন-ভাতা দেয়া হবে। তবে এ সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি জানান।
বিজিএমই’র তথ্যমতে, ভবনের পাঁচটি পোশাক কারখানায় তিন হাজার ১২২ জন শ্রমিক কাজ করতেন। সেনাবাহিনী ও আইএসপিআরের দেয়া তথ্যমতে গতকাল সন্ধ্যায় পর্যন্ত জীবিত ও মৃত উভয় মিলে রানা প্লাজা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে দুই হাজার ৮৭০ জনকে। এখনও নিখোঁজ রয়েছে ১৪৯ জন। বিজিএমই’র দেয়া তথ্য যদি আসল ধরে নিই, তাহলে দেখা যাচ্ছে এখনও নিখোঁজ রয়েছে ২৫২ জন। সেখানেও সরকারি হিসাবের সঙ্গে বিজিএমই’র দেয়া তথ্যের মিল পাওয়া যাচ্ছে না। তাছাড়া ভবন থেকে সোহেল রানাসহ জীবিত শতাধিক সরকারদলীয় নেতাকর্মীকেও উদ্ধার করা হয়েছে। তবে সরকারি হিসাবের সঙ্গে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠনের দেয়া নিখোঁজদের তালিকার সংখ্যার ফারাক অনেক বেশিই দেখা যাচ্ছে। গতকাল অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসনের কন্ট্রোল রুমে গিয়ে দেখা গেছে দু’জন কর্মকর্তা কম্পিউটারে স্বজনদের দেয়া তথ্যমতে নিখোঁজদের তালিকা করছেন। সেখানে তারা এ পর্যন্ত ১৮৫ জনের নাম সংগ্রহ করেছেন বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক কর্মকর্তা জানান। কিন্তু সেখানেই জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক এ কে এম আমিনুর রহমান জানান, এ পর্যন্ত ১৪৯ জন নিখোঁজ ব্যক্তির তালিকা পাওয়া গেছে।
কিন্তু নিখোঁজদের সরকারি এ হিসাব মানতে নারাজ সাভারের মানুষ, বিশেষ করে স্বজনের খোঁজে সাত দিন ধরে হন্যে হয়ে হাসপাতাল, অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় আর রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের আশপাশে ঘোরা হাজারখানেক মানুষ, যারা এখনো খোঁজ পাননি তাদের স্বজনদের। তারা বলছেন, ধ্বংসস্তূপ থেকে লাশ গুম করা হচ্ছে। এই আশঙ্কায় তারা ধ্বংসস্তূপ অপসারণের কাজে ব্যবহৃত গাড়িতে তল্লাশি করছেন। ধ্বসধংস্তূপ থেকে যখনই কোনো গাড়ি কংক্রিট নিয়ে বংশী নদীর তীরে ফেলতে যাচ্ছে, তখনই নিখোঁজদের স্বজনরা গাড়ি ঠেকিয়ে তল্লাশি করছেন তাদের স্বজনের লাশ গুম করা হচ্ছে কি-না এমন আশঙ্কায়। নিখোঁজদের সরকারি হিসাব যদি ঠিক ধরা হয়, তাহলে এখনও যে শত শত স্বজনহারা মানুষ নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানের জন্য দিন-রাত রানা প্লাজা, এনাম মেডিকেল, অধরচন্দ্র বিদ্যালয় মাঠসহ বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছে তারা কারা। তাদের স্বজনরা কোথায় গেলেন?
সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল হাসান শহীদ সরওয়ার্দী লাশ গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, এ অভিযোগ সত্য নয়। তবে সরকারি হিসাবে নিখোঁজদের যে সংখ্যা বলা হচ্ছে তাও স্বজনদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী। তারা বিজিএমই’র কাছ থেকে এখন পর্যন্ত শ্রমিকদের তালিকা সংগ্রহ করতে পারেনি। আইএসপিআরের পরিচালক গতকাল জানান, আমরা কোন কারখানায় কতজন শ্রমিক কাজ করতেন তার তালিকা বিজিএমই’র কাছে চেয়েছি, কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত আমাদের কোনো তালিকা দিতে পারেনি। ওই তালিকা পেলে বোঝা যাবে আসলে কতজন শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছে।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় নিখোঁজ মানুষের প্রকৃত সংখ্যাটা হয়তো বোঝা যাবে উদ্ধার কাজ পুরোপুরি শেষ হলে। তবে স্বজনদের খোঁজে এখনও যারা ঘোরাঘুরি করছেন, তাদের আমলে নিলে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সংখ্যাটা দাঁড়ায় হাজারের ওপর। এই নিখোঁজ ব্যক্তিরা শেষ পর্যন্ত কী হিসেবে গণ্য হবেন, তার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।
আসলে কতজন নিখোঁজ রয়েছে এবং লাশ গুম করা হচ্ছে কি-না এমন তথ্য জানতে গতকাল সকাল ১১টার দিকে এই প্রতিনিধি যান স্থানীয় অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে। সেখানে গিয়ে দেখা যায় বিদ্যালয়ের ক্যান্টিনে স্থাপিত জেলা প্রশাসনের অস্থায়ী কার্যালয়ে খুব হট্টগোল হচ্ছে এবং এক নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজন কান্নাকাটি করছে। তার নাম আবদুর রহমান। বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার সাদাতপুর উপজেলার জবতলা গ্রামে। কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি জানান, তার স্ত্রী চায়না বেগম রানা প্লাজার তৃতীয় তলায় গার্মেন্টে চাকরি করত। ভবন ধসের পর থেকেই চায়না নিখোঁজ রয়েছে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর গতকাল সকালে একটি লাশ উদ্ধারের খবর পেয়ে তিনি সেনাবাহিনীর সঙ্গে কথা বলেন। লাশের পরনে থাকা পোশাক ও লাশের সুরতহাল দেখে আবদুর রহমান নিশ্চিত হন ওই লাশটি তার স্ত্রী চায়নার। সেনাবাহিনীর সদস্য শনাক্ত করা লাশটি আবদুর রহমানের স্ত্রী চায়নার বলে জানিয়ে আবদুর রহমানকে অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করে লাশটি নেয়ার পরামর্শ দেন। আবদুর রহমান অধরচন্দ্র বিদ্যালয়ে গিয়ে জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের বিষয়টি জানালে তারা দ্বিতীয় দফায় আবদুর রহমানকে নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে লাশটি চায়নার বলেই নিশ্চিত হন। কিন্তু তারপরও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সায়েদ ইকবাল চায়নার লাশ তার স্বামীকে না দিয়ে গড়িমসি করেন এবং ডিএনএ টেস্ট করা হবে, কয়েক দিন পরে যোগাযোগ করতে আবদুর রহমানকে পরামর্শ দেন। এ নিয়ে সাংবাদিকরা জেলা প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে একপর্যায়ে সায়েদ ইকবাল সাংবাদিকদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও প্রথম আলোর সাংবাদিক আনোয়ারকে ঘাড় ধরে বের করে দেয়ার নির্দেশ দেন। চায়নার আরেক আত্মীয় শেফালী জানান, শুধু আমাদেরই নয়, একইভাবে জেলা প্রশাসনের লোকজন নিখোঁজদের স্বজনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করছে এবং অনেকের লাশ গুম করে বলছে লাশ দেয়া যাবে না তথ্য মেলেনি। এ সময় নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা নিয়ন্ত্রণকক্ষের ভেতর অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভ করেন এবং ওই ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রত্যাহারের দাবি জানান।
পরে অন্য সাংবাদিক ও জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক একেএম আমিনুর রহমান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সায়েদ ইকবালকে সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করে নিলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। পরে অবশ্য চায়নার লাশ তার স্বামীর কাছে হস্তান্তর করা হয়।
রানা প্লাজায় কত মানুষ ছিলেন : বিজিএমইএ’র তথ্যমতে, ৯ তলা রানা প্লাজার তিন থেকে সাত তলা পর্যন্ত গার্মেন্ট কারখানার পাঁচটি ইউনিট ছিল। এতে ৩ হাজার ১২২ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এর মধ্যে ইথারটেক্স লিমিটেডে ৩৭৭ জন, নিউ ওয়েভ বটমস লিমিটেডে ৫২৬ জন, নিউ ওয়েভ স্টাইল লিমিটেডে ১ হাজার ৭৩ জন, ফ্যানটম অ্যাপারেলস লিমিটেডে ৭৩৯ জন এবং ফ্যানটম ট্যাক লিমিটেডে ৪০৭ জন শ্রমিক কাজ করতেন। এদের অধিকাংশই ছিল নারী শ্রমিক। বিজিএমইএ’র এই হিসাব শ্রমিকদের বীমাসংক্রান্ত তালিকা। তাও এটি করা হয়েছে গত ফেব্রুয়ারি মাসে। তাছাড়া গার্মেন্ট মালিক ও শ্রমিক সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অধিকাংশ গার্মেন্ট কারখানায় শ্রমিক নিয়োগের কোনো নিয়মকানুন থাকে না। প্রতি মাসেই কোনো নিয়োগপত্র ছাড়াই নিয়োগ দেয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে, মাসে এবং বছরেই নতুন নতুন শ্রমিক নিয়োগ দেয়া হয়। এছাড়া পোশাক কারখানায় এমন বহু শ্রমিক কাজ করেন, যাদের কোনো নিয়োগপত্র নেই। বীমার তালিকাতেও তাদের নাম না থাকাই স্বাভাবিক। তাই বিজিএমই’র তালিকাটি ওই ভবনে অবস্থান করা লোকজনের প্রকৃত সংখ্যা নয়। অন্যদিকে রানা প্লাজার তিন তলা থেকে ৮ তলা পর্যন্ত গার্মেন্ট কারখানা ছাড়াও প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন বিপণি বিতান, ব্র্যাক ব্যাংকের অফিসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল। তাছাড়া ওই দিন হরতাল থাকায় যুবলীগ নেতা সোহেল রানার নেতৃত্বে দেড় শতাধিক দলীয় লোকজন হরতাল বিরোধী মিছিল করার জন্য জড়ো হচ্ছিল। তারাও ভবন ধসের মধ্যে পড়ে যায়। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে সেদিন রানা প্লাজা ধসের সময় কমপক্ষে চার হাজারের অধিক মানুষ সেখানে ছিলেন, এবং তারা সবাই ভবনের ভেতরে আটকা পড়ে যায়।
কংক্রিটের সঙ্গে বেরিয়ে আসছে লাশের টুকরা : সাভার ট্র্যাজেডির ৯ দিন পর ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরিয়ে আসছে লাশের টুকরো টুকরো অংশ। উদ্ধারকাজের দ্বিতীয় পর্বে ভারী সরঞ্জামের মাধ্যমে ধ্বংসস্তূপ সরানোর সময় লাশের বিভিন্ন অংশের সন্ধান পাচ্ছেন উদ্ধারকর্মীরা। উদ্ধারকর্মীরা বলছেন, দীর্ঘদিন হওয়ায় লাশগুলো এখন পচন ধরেছে। ফলে কোনো ধরনের আঘাতেই তা ছিঁড়ে বের হয়ে আসছে। তবে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ধ্বংসস্তূপ সরানো হচ্ছে। রানা প্লাজার পেছন দিকের ধ্বংসস্তূপে গতকালও বেশ কিছু লাশ ঝুলে থাকতে দেখা গেছে। তবে এ লাশগুলোর কাছে এখনও যাওয়া সম্ভব হয়নি। বড় বড় বিম আর রডের মধ্যে থাকায় উদ্ধার কাজে বেশ সমস্যা হচ্ছে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল চৌধুরী হাসান সোহরাওয়ার্দী ধ্বংসস্তূপের চারপাশে সাত থেকে আটটি লাশের অস্তিস্ত টের পেয়েছেন বলে স্বীকার করেন। এসব লাশের শরীরের নানা অংশ বের হয়ে আছে। কারও দুটি পা, কারও একটি হাত, কারও মাথার অস্তিস্ত দূর থেকেই আঁচ করা যাচ্ছে। গতকাল ভবনটির এই অংশ থেকে দুটি লাশের টুকরো বের হয়ে এসেছে বলে জানান উদ্ধার কাজে নিয়োজিত কর্মীরা। এছাড়া ভবনের সিঁড়িতে এখনও লাশের স্তূপ রয়েছে বলে উদ্ধারকর্মীরা জানিয়েছেন। ভবনের প্রতিটি পরতে পরতে লাশ ঝুলতে দেখা গেছে। তাছাড়া ভারী যন্ত্রপাতির আঘাতে অনেক লাশের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকৃত হয়ে বেরিয়ে আসছে বলে উদ্ধারকর্মীরা বলছেন
তথ্যসূত্রঃ আমারদেশ
বিষয়: বিবিধ
১৪৪৪ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন