কবে কিভাবে আওয়ামী সরকার বিদায় নেবে - শফিক রেহমান
লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ২৮ এপ্রিল, ২০১৩, ০২:০১:৩৩ রাত
রানা প্লাজায় নিহত ৩৫২; জীবিত উদ্ধার ২,৪২৮; এখনো চাপা পড়ে আছে (???)
২৯ ডিসেম্বর ২০০৮-এর সন্দেহজনক নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ৬ জানুয়ারি ২০০৯-এ সরকার গঠন করে। এর মাত্র ৪১ দিন পর থেকে আওয়ামী সরকার স্বরূপে আবির্ভূত হতে থাকে। শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানের ভিত্তিতে দেশকে সামনে দিকে নিয়ে যাবার বদলে আওয়ামী সরকার মনোনিবেশ করে যথাক্রমে, ইনডিয়ার কাছে ব্যক্তি ও দলের ঋণ পরিশোধে, ষড়যন্ত্রে, মামলা দায়ের এবং প্রতিপক্ষকে জেলে পাঠানোতে, দলীয় উদ্দেশ্যসাধনে বিচারবিভাগ বশীকরণে এবং দলকে ক্ষমতায় চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় আওয়ামী লীগের অন্তর্নিহিত চক্রান্তপ্রিয়তা ও অযোগ্যতা, যা এর আগের দুটি আওয়ামী সরকারের সময়েও দেখা গিয়েছিল, যেমন পুলিশবাহিনীসহ প্রশাসনকে দলীয়করণ, অর্থনৈতিক ম্যানেজমেন্টে অদক্ষতা, শীর্ষপর্যায় থেকে স্থানীয়পর্যায় পর্যন্ত ব্যাপক দুর্নীতি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিভিন্ন দিবস পালনে আসক্তি ও ব্যক্তিপূজায় মত্ত হয়ে নাম বদলের নেশা, প্রভৃতি।
তাই এটা কোনো আশ্চর্য নয় যে আওয়ামী সরকারের গত চার বছর চার মাস শাসনে যে পনেরটি বড় বিপর্যয় বাংলাদেশে ঘটেছে তার মধ্যে বারোটির সঙ্গেই আওয়ামী সরকার ও দলের নিবিড় সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছে। এই বারোটি হলো :
এক. ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯-এ ঢাকায় পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে ৭৩ জন নিহত, যার মধ্যে ছিলেন ৫৭ সেনা অফিসার। এই বিদ্রোহে জড়িতদের বিরুদ্ধে তদন্ত ও মামলা চলাকালে মৃত্যু হয় ৫৭ বিডিআর কর্মচারীর। অভিযোগ ওঠে এ ঘটনার বিষয়ে আগেই জানতেন আওয়ামী সরকারের প্রতিমন্ত্রী নানক, নেতা মির্জা আজম ও ব্যারিস্টার তাপস। ওই ঘটনায় নিহত বিডিআর চিফ, জেনারেল শাকিলের ছেলে লন্ডন থেকে দাবি করেন, ঘটনার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী আগেই জানতেন এবং সে জন্যে তিনি এই দিনে পূর্বনির্ধারিত অনুষ্ঠানে যোগ দিতে পিলখানায় যাননি। সার্বিক ভাবে তদানিন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের অযোগ্যতা এবং প্রধানমন্ত্রীর ভুল সিদ্ধান্তের ফলে পিলখানায় নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি হয় বলে অভিযোগ ওঠে।
দুই. ২০০৯ সালে আওয়ামী সরকার দেশের চলমান বিদ্যুৎ সঙ্কট মেটানোর লক্ষ্যে স্থায়ী সাশ্রয়ী পদক্ষেপ না নিয়ে এগিয়ে যায় ব্যয়বহুল কুইক রেন্টাল সিস্টেম স্থাপনে। ফলে একটি সূত্র মতে, বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড) ক্ষতি ২৫,০০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। আওয়ামী সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রাইভেট কুইক রেন্টাল কম্পানি থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে তা কম দামে বিক্রি করায় প্রতি বছর বিপিডিবি-র ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপিডিবি-র এক কর্মকর্তা জানান, রেন্টাল পাওয়ার প্লান্ট থেকে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়ছে ১৪ থেকে ১৭ টাকা। কিন্তু গ্রাহকপর্যায়ে তা বিক্রি হচ্ছে ৭ থেকে ৮ টাকার মধ্যে। এখানে অর্ধেকই ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। ভর্তুকির যে ৯,০০০ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে তার ৮০ শতাংশই দিতে হচ্ছে কুইক রেন্টাল থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনায়। অর্থাৎ, রেন্টাল কম্পানিগুলো লাভ করছে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড তথা সরকার এবং সাধারণ গ্রাহক, যাদের বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে।
কুইক রেন্টাল সিসটেমে যারা জড়িত তাদের মধ্যে নাম এসেছে মন্ত্রী (এবং প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয়) কর্নেল ফারুক খান ও আজিজ গ্রুপ, গার্মেন্টস রফতানিকারক মোহাম্মদী গ্রুপ, ফার্নিচার বিক্রেতা অটবি গ্রুপ, সালমান রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপ ইত্যাদি।
তিন. ১০ জানুয়ারি ২০১০-এ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তিন দিনের সফরে নতুন দিল্লিতে যান। এই সফরের সময়ে দুই দেশের মধ্যে তিনটি চুক্তি ও দুটি সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এর বাইরে আরো একটি নিরাপত্তাচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে বলে মিডিয়ায় উল্লেখ করা হয়। এখন পর্যন্ত এসব চুক্তি সংসদে আলোচিত হয়নি। কিন্তু ২০১০ সাল থেকেই আশুগঞ্জ-আখাউড়া স্থলপথে ইনডিয়া ট্রানজিট সুবিধা নেয়। ইনডিয়ানরা তাদের হেভি লরি চলাচলের জন্য ১৬টি কালভার্ট বন্ধ করে দেয় এবং তিতাস নদীর দুটি স্থানে পানিপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলে গুরুতর পরিবেশ বিপর্যয় ঘটে। বিষয়টি দৈনিক নয়া দিগন্তে এই লেখক কর্তৃক প্রকাশের পরে ইনডিয়ানরা সাময়িকভাবে ওই স্থলপথে তাদের লরি চলাচল বন্ধ করে দেয়।
চার. ২০১০-এর শেষাংশে শেয়ারবাজার কেলেংকারিতে একটি হিসাবে দেশের ৩৩ লক্ষ বিনিয়োগকারী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদি প্রতিটি বিনিয়োগকারীর পেছনে পাচজন আত্মীয়-বন্ধু সেকেন্ডারি বিনিয়োগকারী থাকে, তাহলে দেশে মোট ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা হবে এক কোটি ৬৫ লক্ষ। অর্থাৎ দেশের এক-দশমাংশ জনসংখ্যার কিছু বেশি। ডেইলি স্টার (১০.১০.২০১০)সহ কয়েকটি পত্রিকা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের হুশিয়ারি সত্ত্বেও, শেয়ারবাজার বিপর্যয়ের মুখে এগিয়ে যেতে থাকে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ উপেক্ষা করে চলে আগাম সতর্কবাণীগুলো। নভেম্বর ১৯৯৬-এ আওয়ামী সরকারের সময়ে যেমন শেয়ারবাজারে ধস নেমেছিল, তার পুনরাবৃত্তি ঘটে পনের বছর পরে আবার চলতি আওয়ামী সরকারের সময়ে অক্টোবর ২০১১-এ।
ুদ্র বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে যান। দিশাহারা বিনিয়োগকারীরা মতিঝিলে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করলে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেন, ‘ওরা দেশের শত্রু। সমাজের শত্রু। ওদের জন্য মাথা ঘামানোর কোনো কারণ নেই। তাদের কষ্টে আমার মন কাদে না। শেয়ারবাজার ধসে সরকারের মাথাব্যথার কিছু নেই। কারণ শেয়ারবাজারে পুজি প্রকৃত বিনিয়োগে যায় না… শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীরা দেশের অর্থনীতিতে কোনো অবদান রাখে না।’ (আমার দেশ ২১.০১.২০১১)
অর্থমন্ত্রী এ এম এ মুহিত একপর্যায়ে সংসদে বলেন, ‘আমি জানি আমি দেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি।’
এই কেলেংকারিতে যারা জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে তাদের মধ্যে আছেন, ম্যানপাওয়ার বিজনেসম্যান খ্যাত জনৈক আওয়ামী এমপি এবং শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের সেই সময়ের বন্ধু ও বর্তমানে “দরবেশ” রূপে খ্যাত ব্যক্তি, প্রমুখ।
পাচ. ১১ ডিসেম্বর ২০১১-তে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল টুর্নামেন্টে অংশ নিতে আদিষ্ট হয় চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে কিছু স্কুলছাত্র। ওই টুর্নামেন্টে অংশ নিতে যাবার পথে ট্রাক উল্টে ৫৩ স্কুলছাত্রের মৃত্যু হয়।
ছয়. দীর্ঘকাল জুড়ে বিভিন্ন দিক থেকে মালটিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কম্পানি ডেসটিনি গ্রুপের বিরুদ্ধে আওয়ামী সরকারকে বারবার সতর্ক করে দেওয়া সত্ত্বেও কোনো পদক্ষেপ নেয়নি তারা। সম্ভাব্য কারণ ছিল, এই গ্রুপের প্রেসিডেন্ট পদে ছিলেন অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও কট্টর আওয়ামীপন্থী রূপে পরিচিত সাবেক সেনাপ্রধান লে. জে. হারুন-অর-রশিদ।
অবশেষে ১১ জুলাই ২০১২-তে দুদক বাধ্য হয় পদক্ষেপ নিতে। ডেসটিনির ৩,২৮৫ কোটি টাকা মানিলন্ডারিং ও আত্মসাতের মামলায় জেনারেল হারুনকে টানা সাত ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করে দুদক তদন্ত টিম। ওই তদন্তে দুদক জানতে চায় জেনারেল হারুনের ব্যাংক একাউন্টে ২০ কোটি টাকা ঢুকল কিভাবে? উত্তরে হারুন বলেন, ‘মাসিক সম্মানী, ডিভিডেন্ড ফান্ড, এলাউন্স, কমিশন বাবদ এই টাকা আমার একাউন্টে ঢুকেছে। এ ছাড়া কিছু টাকা বাড়িভাড়া থেকেও এসেছে।‘ (যুগান্তর ৫.১১.২০১২)
হাইকোর্ট জেনারেল হারুনকে আটটি শর্তসাপেক্ষে জামিন দেন। তবে ডেসটিনি গ্রুপের ম্যানেজিং ডিরেক্টর মোহাম্মদ রফিকুল আমীন, ডিরেক্টর দিদারুল আলম ও ডেসটিনি ২০০০ লিমিটেডের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হোসাইন-কে জেলে যেতে হয়। ডেসটিনির বিরুদ্ধে অর্থের অবৈধ ব্যবহার সংক্রান্ত দুটি মামলায় আসামির সংখ্যা ২২ হলেও ১৮ জনই পলাতক হয়। ডেসটিনি সংশ্লিষ্ট ৫৩৩ ব্যাংক একাউন্ট জব্দ করা হলেও তাদের অঙ্গসংগঠন বৈশাখী টেলিভিশনের একাউন্ট জব্দ হয়নি। এই লাইফলাইনের জন্য কৃতজ্ঞ বৈশাখী টিভির কর্মকর্তারা সুকৌশলে তাদের টিভিতে এবং অন্যান্য টিভির টকশোতে আওয়ামী সরকারের পক্ষে এবং আমার দেশ পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক জেলবন্দি মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ডেসটিনি ছাড়া আরো ত্রিশটির বেশি এমএলএম কম্পানি অবাধে মানুষকে প্রতারণা করার সুযোগ পায় আওয়ামী সরকার শাসনে। এসব কম্পানির মধ্যে রয়েছে ইউনিপে টু ইউ, সাকসেস লিংক, গ্লোবাল নিউওয়ে, প্রভৃতি। দুদকের তদন্ত অনুযায়ী, কয়েকটি এমএলএম প্রতিষ্ঠান জনগণের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে ৪,৯৬৩ কোটি টাকার কিছু বেশি এবং এর মধ্যে ব্যক্তিগত একাউন্টে সরিয়ে ফেলা হয়েছিল প্রায় ৪,৬০১ কোটি টাকা। (প্রথম আলো ৯.৯.২০১২)।
টাকা বানানোর এমন সহজ সুযোগ দেখে ২০০৫-এ এগিয়ে আসে চায়না থেকে তিয়ানশি (বাংলাদেশ) লিমিটেড। (আমাদের সময়.কম ৫.১১.২০১২)। গোয়েন্দা সূত্র জানায় মোট ১২৯ এমএলএম কম্পানি তাদের নজরদারিতে আছে।
সাত. আগস্ট ২০১২-তে বিভিন্ন পত্রিকায় হলমার্ক গ্রুপের জালিয়াতির খবর প্রকাশিত হতে থাকে। জানা যায়, সরকারি ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের শেরাটন হোটেল ব্রাঞ্চে (বর্তমানে শেখ হাসিনার দেয়া নাম রূপসী বাংলা হোটেল) বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে কুশ্রী অর্থনৈতিক কেলেংকারির পরিমাণ ৩,৬০৬ কোটি ৪৮ লক্ষ বা প্রায় ৪,০০০ কোটি টাকা। এর মধ্যে হলমার্ক একাই নিয়েছে প্রায় ২,৬৬৮ কোটি টাকা। একটি ব্যাংকের একটি ব্রাঞ্চে একটি কম্পানির এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা আর কোথাও ঘটেছে বলে ব্যাংকিং খাতের কেউ বলতে পারেন নি। বাংলাদেশে এর আগে বিভিন্ন সময়ে ঋণের নামে অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলেও অঙ্কের বিচারে এটি সর্ববৃহৎ। স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটিই ব্যাংকিং খাতে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেংকারি। (প্রথম আলো ৫.৯.২০১২)।
এরপর এক গোলটেবিল অনুষ্ঠানে সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকার সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ‘ব্যাংকিং খাতে আমরা ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দিই। এর মধ্যে মাত্র তিন বা চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ঝামেলা হয়েছে। এটা কোনো বড় অঙ্কের অর্থ নয়। এ নিয়ে হইচই করারও কিছু নেই। সংবাদমাধ্যম এটা নিয়ে অতিরিক্ত প্রচারণা করে দেশের ক্ষতি করছে। এমন ভাব যেন দেশের ব্যাংকিং সেক্টর ধসে গেছে। এতে আমাদের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে।’
অর্থমন্ত্রীর এই বক্তব্য প্রচারের পর ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। তথ্য সংগ্রহ করে দেখা গেছে, কেলেঙ্কারির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সোনালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা। গত ৩১ মার্চ পর্যন্ত তৈরি করা তথ্য অনুযায়ী, সংরক্ষিত মূলধনের পরিমাণ চার হাজার ৫১৯ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। অথচ সোনালী ব্যাংকের এক রূপসী বাংলা শাখায় জালিয়াতি করা অর্থের পরিমাণই তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অন্য কোনো বেসরকারি ব্যাংকে এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটলে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যেত। যেমন বন্ধ হয়েছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। (প্রথম আলো ০৫.০৯.২০১২)
অর্থমন্ত্রীর এই মন্তব্যের পর দেশজুড়ে সমালোচনার সিডর ওঠে। দি নিউজ টুডে-র সম্পাদক রিয়াজউদ্দিন আহমেদ লেখেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অর্থমন্ত্রী অধিক থেকে অধিকতর পরিমাণে অধৈর্য হয়ে উঠছেন, মিডিয়ায় তার সমালোচকদের সহ্য করতে পারছেন না। তার সঙ্গে কেউ দ্বিমত পোষণ করলে তাকে ননসেন্স, রাবিশ ও স্টুপিড-জাতীয় শব্দ শুনতে হয়। সোনালী ব্যাংক দুর্নীতি নিয়ে অর্থমন্ত্রী যে অসহিষ্ণু আচরণ করেছেন, তাতে অনেকেই বিস্মিত হয়েছেন। সোনালী ব্যাংকের দুর্নীতি নজরদারিতে ব্যর্থতার জন্য ওই ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকে বিলুপ্ত করার অনুরোধ জানিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই অনুরোধ অবজ্ঞা করতে তিনি দ্বিধান্বিত হননি।’ (মানবজমিন ০৭.০৯.২০১২)
যে কারণে অর্থমন্ত্রী মুহিত অসহিষ্ণু হন, ঠিক সেই একই কারণে আওয়ামী মিডিয়া হলমার্ক কেলেংকারি বিষয়ে খবর প্রকাশে কার্পণ্য প্রকাশ করে। কিন্তু তখন এগিয়ে আসে দৈনিক মানবজমিন। এই পত্রিকার দুটি সাহসী রিপোর্টে জানা যায় হলমার্ক কেলেংকারির নায়ক তানভীর মাহমুদ তফসির-এর উত্থানকাহিনী এবং তার সঙ্গে আওয়ামী সরকারের সংশ্লিষ্টতা।
প্রথম রিপোর্টে লায়েকুজ্জামান জানান, মাত্র এক দশক আগে আগারগাঁও তালতলা বাজারে ছোট একটি মুদি দোকান ছিল তার। এ দোকান চালাতেন পিতাকে সঙ্গে নিয়ে। এতে সংসার চলত না তাদের। এই সময়ে সংসারে অভাব-অনটন ঘোচাতে মাত্র ৩,০০০ টাকা বেতনে একটি গার্মেন্ট কম্পানিতে চাকরি নেন। মাত্র এক দশক পরে সেই গার্মেন্টশ্রমিক এখন হাজার কোটি টাকার মালিক। রাজকীয় বিলাসী জীবন তার। মিরপুরের শেওড়াপাড়ায় চোখধাঁধানো রাজপ্রাসাদের মতো বাড়ি। বাড়ির ভেতরটা যেন স্বর্গপুরী। বিদেশি সব কারুকার্যখচিত ফিটিংস ও ঝাড়বাতি। ঝকঝকে তকতকে দামি সব গাড়ি। শেওড়াপাড়ার এই বাড়ির পাশেই বিশাল গারাজ। পাজেরো, প্র্যাডো, ল্যান্ডক্রুজার মিলে বড় গাড়ি ১৫টি। প্রাইভেট কার ১২টি।
যখন যেটি পছন্দ হয় সেটি নিয়ে বের হন। তানভীর চলেন রাজকীয় স্টাইলে। রাজপথে তার গাড়ির আগেপিছে থাকে ১০টি গাড়ি। এসব গাড়িতে থাকে তার সশস্ত্র ক্যাডার। এরা সবাই তার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত। মানুষকে খাওয়ানোর জন্য কখনো একটি দু’টি গরু কেনেন না, গরু কেনেন ট্রাকভরে। এখন গ্রামের বাড়িতে যান ঘন ঘন। সেখানে উৎসব করেন মানুষকে খাওয়ান, সংবর্ধনা নেন। চলাফেরা করেন ক্ষমতাধর বড় বড় লোকের সঙ্গে। তার ২০৫/৪ রোকেয়া সরণি শেওড়াপাড়ার কার্যালয়ে মাঝে মধ্যে আসেন বর্তমান সরকারের একজন উপদেষ্টা, একজন প্রতিমন্ত্রী ও কয়েকজন এমপি। এখন তার বিলাসী জীবন হলেও মাত্র এক দশক আগেও ছিলেন কপর্দকশূন্য। থাকতেন শেওড়াপাড়ার ভাড়াবাসায়।
২০০১ সালেও আগারগাঁও তালতলা বাজারে ছোট একটি মুদি দোকান ছিল তানভীরের পিতার। সকালে-বিকালে মুদি দোকানে পিতার সহযোগী ছিলেন তিনি। সংসারের নিদারুণ অভাব-অনটন ঘোচাতে মাত্র তিন হাজার টাকা বেতনে একটি গার্মেন্ট কম্পানিতে চাকরি নেন তানভীর। তার উত্থান শুরু তত্ত্বাবধায়ক জমানার শেষ দিকে। গার্মেন্টের চাকরি ছেড়ে নিজে একটি গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি দেন। ওই সময় তার সঙ্গে সম্পর্ক হয় সোনালী ব্যাংক শেরাটন শাখার সে সময়ের ম্যানেজারের সঙ্গে। ওই ম্যানেজারকে ধরে অল্প কিছু টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। সেটা ২০০৬ সাল। ২০০৮ সালে সরকার পরিবর্তন হলে তানভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন বর্তমান সরকারের একজন প্রভাবশালী উপদেষ্টার সঙ্গে। ওই উপদেষ্টাকে তিনি তার প্রতিষ্ঠান হলমার্কের উপদেষ্টা করেন। ২০০৯ সাল থেকে সকল নিয়মনীতি উপেক্ষা করে সোনালী ব্যাংকে তানভীরের ঋণ বর্ধিত হতে শুরু করে অস্বাভাবিকভাবে ।
ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেয়ে তানভীর বেশি নজর দেন জমি কেনার দিকে। মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকায়। একের পর এক জমি কিনতে থাকেন বেশি দামে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত তানভীর কম করে হলেও ত্রিশটি দামি গাড়ি উপহার দিয়েছেন সোনালী ব্যাংকের বড় বড় কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের। দেড় শ’ জন আনসার পাহারা দেয় রোকেয়া সরণির হলমার্কের প্রধান কার্যালয়সহ তানভীরের বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। তানভীরের নিজের কাছে থাকে একটি পিস্তল। সব সময় চলেন বিশাল বহর নিয়ে। মিরপুর শেওড়াপাড়া এলাকা এবং সাভারের হেমায়েতপুরে আছে তার বিশাল ক্যাডার বাহিনী। শেওড়াপাড়া এলাকার তার এক প্রতিবেশী জানান, তানভীর তার বর্তমানের রাজকীয় বাড়িতে উঠেছেন মাত্র দুই বছর হলো, এর আগে ওই মহল্লারই একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন সপরিবারে। নতুন বাড়িতে ওঠার পর দ্ইু বছর ধরে ঈদের সময় এক এলাহি কাণ্ড দেখা যায় তার বাড়ির সামনে। পুরো রমজান মাস ধরে গরু, মহিষ, উট আসে ট্রাক বোঝাই করে। ওই সব গরু, মহিষ, উট জবাই করে খাওয়ানো হয় রোজাদারদের। দান খয়রাতও করেন যথেষ্ট।
মিরপুর এলাকার মানুষ জানে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জ থেকে আগামী নির্বাচনে অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি। সে কারণে এখন ঘন ঘন এলাকায় যাচ্ছেন ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে। (মানবজমিন, ১.৯.২০১২)
একই দিনে দ্বিতীয় রিপোর্টে জাবেদ রহিম বিজন জানান, রাজকীয় সেই সংবর্ধনার কথা এখন মুখে মুখে। কোটি টাকা খরচ করে বিশাল আয়োজনের সেই সংবর্ধনার গল্প নতুন করে উঠে এসেছে আবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের মুখে মুখে। আলোচিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান হলমার্কের মালিক তানভীর মাহমুদ তফসিরের এত্ত বড় সংবর্ধনার রহস্য মানুষ ভেদ না করতে পারলেও এখন বুঝতে পারছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জের তারুয়া গ্রামের মানুষ। সংবর্ধনার আগে কেউ তার নামও শোনেনি। সংবর্ধনার সময়েই আলোচনা ছড়িয়েছিল আগামী সংসদ নির্বাচনে সরাইল-আশুগঞ্জ আসন থেকে মনোনয়ন চাইবেন তানভীর। এর অংশ হিসেবেই বিশাল সংবর্ধনা।
গত বছরের ২০শে জানুয়ারি হয় এই সংবর্ধনা। সংবর্ধনার এক দিন আগেই এ ব্যবসায়ী চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। নিজেই তদারকি করেন সব। এর আগে বিজিএমইএ আয়োজিত ২২তম বাটেক্সপোতে পোশাক শিল্পের সেরা উদ্যোক্তার পুরস্কার পান তানভীর মাহমুদ। এ উপলক্ষেই বিশাল সংবর্ধনার আয়োজন।
সংবর্ধনায় যোগদানকারীদের অনেকেই তখন বলেন, সংবর্ধনার আয়োজন চোখধাধিয়ে দিয়েছে সবার। বলাবলি হচ্ছিল, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের অনুষ্ঠানও এত গর্জিয়াস হয় না। সংবর্ধনা অনুষ্ঠান ঘিরে ওই ব্যবসায়ীর গ্রাম তারুয়ায় সাজসাজ রব পড়ে গিয়েছিল। বসানো হয়েছিল মেলা। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রায় দুই সপ্তাহ আগে থেকে জেলার প্রায় সর্বত্র লাগানো হয় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের ঢাউস সাইজের পোস্টার। পোস্টারের অর্ধেকাংশে জুড়ে দেয়া হয় ট্রফি গ্রহণের সেই ছবি। প্রায় ১০ হাজার পোস্টার লাগানো হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর এক উপদেষ্টা। তবে বিশেষ অতিথি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন (অব এ বি তাজুল ইসলাম ও সংসদ সদস্য আ ম ওবায়দুল মুকতাদির চৌধুরী এ সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দেননি।
জানা গেছে, সংবর্ধনার মঞ্চ তৈরি ও অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেয়া হয় ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানকে। প্রায় ২০ লাখ টাকা চুক্তি হয় তাদের সঙ্গে। বিশাল প্যান্ডালে ৩ সহস্রাধিক লোক বসার ব্যবস্থা করা হয়। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বসানো হয় ৩১টি স্পিকার, ২টি ডিজিটাল ডিসপ্লে। নিরাপত্তার আয়োজনে ছিল কোজ সার্কিট ক্যামেরা ও মেটাল ডিটেক্টর। ছিল ৫ শ’ কেভির দুটি জেনারেটর। দুপুরে আপ্যায়ন করা হয় হাজারেরও বেশি অতিথিকে। খাবার মেনুতে ছিল বিভিন্ন জাতের মাছ আর মুরগি। সব কিছু দেখাশোনার জন্য নিয়োগ দেযা হয় দেড় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক। পুরো সংবর্ধনা অনুষ্ঠান একটি প্রাইভেট চ্যানেলে ২০ মিনিট প্রচারের চুক্তিও করা হয়। ২ শ’ ফুলের তোড়া আনা হয় অতিথিদের দেয়ার জন্য। সংবর্ধিত ব্যবসায়ী প্রধান অতিথির কাছ থেকে গ্রহণ করেন সোনার ক্রেস্ট। অতিথিদের ফুল দেয়ার জন্য ছিল ২০ তরুণী। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ৩ শ’ গাড়িতে করে আসেন হলমার্কের স্টাফরা। গাড়িতে গাড়িতে সয়লাব হয়ে যায় তারুয়া গামের সব রাস্তাঘাট। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের মঞ্চের পাশে বসানো হয় মেলা। মেলা চলে ৩ দিন ধরে। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান গাওয়ানোর জন্য আনা হয় ঢাকা থেকে প্রখ্যাত শিল্পীকে। সব মিলিয়ে হুলস্থুল কারবার।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এক চিত্রগ্রাহক বলেন, আমি প্রথমে গিয়ে গরু-ছাগলের ভিড় দেখে মনে করেছিলাম, এখানে কোনো হাট বসেছে। পরে আমার ভুল ভাঙে। এগুলো অতিথিদের খাওয়ানোর জন্য জড়ো করা হয়েছিল। এই ব্যবসায়ী বা শিল্পপতির পরিচয় এত দিন তারুয়া গ্রামেই ছিল সীমাবদ্ধ। সংবর্ধনার আয়োজন আর প্রচারণা তাকে জেলাব্যাপী পরিচিত বা আলোচিত করে তোলে। আর হলমার্ক-কেলেঙ্কারির পর রাজকীয় সংবর্ধনা কথা এখন ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর মুখে মুখে। (মানবজমিন ১.৯.২০১২)
পরবর্তীকালে তানভীরের সঙ্গে প্রতিমন্ত্রী রিটায়ার্ড ক্যাপ্টেন তাজুল ইসলাম ও আওয়ামী এমপি ওবায়দুল মুকতাদিরের সম্পর্ক বিষয়ে রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। লায়েকুজ্জামান ও জাবেদ রহিম বিজনের দুটি রিপোর্টে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টার নামটি অপ্রকাশিত থাকে। পরবর্তী সময়ে এই নামটিও প্রকাশিত হয়। তিনি ছিলেন চোখের ডাক্তার সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী এবং তিনি স্বীকার করেন শেরাটনের সোনালী ব্যাংক ব্রাঞ্চে তার যাতায়াত ছিল।
৪ অক্টোবর ২০১২-তে এসব আওয়ামী নেতার স্নেহপুষ্ট তানভীর শেষ পর্যন্ত গ্রেফতার হন। তার সঙ্গে গ্রেফতার হন তার স্ত্রী জেসমিন ও ভায়রা তুষার আহমেদ। হলমার্কের সাতজন এবং সোনালী ব্যাংকের ২০ জন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে দুদক।
এর কয়েক দিন পরে অর্থমন্ত্রী মুহিত বলেন, ‘২০১০ সালেই হলমার্কের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক জেনেছিল। ২০১০ সালে তারা কিছুই করেনি। ২০১২ সালে তারা জেগে উঠল। এতে প্রমাণিত হয় যে বাংলাদেশ ব্যাংক নিজে অতটা সক্ষম নয়।’ (প্রথম আলো ১৭.১০.২০১২)।
যেটা অর্থমন্ত্রী বলেননি সেটা হলো, তিনি নিজেই ‘২০১০ সাল থেকে ঘুমিয়ে ছিলেন’ এবং তাই তিনি কিছুই করেন নি। তার বক্তব্যে প্রমাণিত হয় যে তার সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর আতিউর রহমানের চরম দ্বন্দ্ব রয়েছে এবং তিনি (অর্থমন্ত্রী) এই অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে অক্ষম।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ স্থানে থাকতে মুহিত ভালোবাসেন। সামরিক শাসনের তীব্র সমালোচক হলেও সামরিক শাসক এরশাদের প্রথম অর্থ উপদেষ্টা ছিলেন তিনি। এরপর শেখ হাসিনার অর্থমন্ত্রী হয়েছেন। তবে অর্থমন্ত্রী কখনোই পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করেন নি। সূচনা থেকেই একের পর এক আর্থিক কেলেংকারি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী তাকে পদত্যাগে বাধ্য করেন নি। সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী ভেবেছিলেন তার নিজের মাথার ওপর পদ্মা সেতু দুর্নীতিবিষয়ক ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঝুলন্ত ডেমোকিসের তলোয়ার মোকাবেলায় ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের সাবেক এই অলটারনেট ডিরেক্টর মুহিতের সাহায্য দরকার হবে। মুহিত অর্থমন্ত্রী থেকে যান। কিন্তু মুহিত পারেননি তার বসকে বাচাতে।
অন্য দিকে আতিউর রহমানও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর থেকে যান। সম্প্রতি তার চাকরির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে।
আর ড. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলীও তার উপদেষ্টা পদে বহাল আছেন।
আওয়ামী সরকারের এই আমলে আর্থিক ক্ষেত্রে অনেক কমেডির মধ্যে এটি একটি।
আট. ২৪ নভেম্বর ২০১২-তে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডের গার্মেন্ট কারখানায় আগুন লেগে ১১১ কর্মী পুড়ে মারা যায়। তাজরীনের ম্যানেজিং ডিরেক্টর দেলোয়ার হোসেন সরকার সমর্থক ব্যক্তি রূপে পরিচিত।
নয়. দুই দিন পরেই ২৬ নভেম্বর ২০১২-তে চট্টগ্রামে বহদ্দারহাট পুকুরপাড়ে নির্মীয়মান ফাইওভারের গার্ডার ধসে ১৫ জন নিহত হয়। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর সাত্তার টিংকু-র মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অ্যাকটো পারিসা লিমিটেড এবং মীর আক্তার কনস্ট্রাকশন দুটি ফার্ম যুগ্মভাবে এই ফাইওভার নির্মাণের কার্যাদেশ পেয়েছিল।
দশ. ১১ জানুয়ারি ২০১৩-তে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক চূড়ান্তভাবে জানিয়ে দেয় আওয়ামী সরকারের দুর্নীতির কারণে তারা পদ্মা সেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না। ইতোপূর্বে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যখন এই অভিযোগটি আনে তখন বহু গড়িমসির পরে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন। কিন্তু ক্ষতিপূরণস্বরূপ তাকে ‘দেশপ্রেমিক’ রূপে আখ্যায়িত করেন প্রধানমন্ত্রী। আবুল হোসেন ইতোমধ্যে শেখ হাসিনার ছবিসহ তিনটি বড় বিলবোর্ড স্থাপন করেন ফার্মগেট থেকে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয় পর্যন্ত, যেখানে শেখ হাসিনার স্তুতি বড় অক্ষরে দেখানো হয়েছে। পদ্মা সেতু দুর্নীতিতে আওয়ামী সরকারের অন্য কারা জড়িত ছিলেন সে বিষয়ে গুঞ্জন শোনা গেলেও মেইনস্টৃম পত্রিকায় অসমর্থিত থেকে যায়।
এগারো. কিন্তু ১৯ এপৃল ২০১৩-তে কানাডায় টরন্টোর আদালতে কানাডিয়ান কম্পানি এসএনসি-লাভালিন ও পদ্মা সেতু দুর্নীতিসংক্রান্ত মামলায় এসব নাম প্রকাশিত হয়।
আদালতে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী ডায়েরিতে প্রথমেই রয়েছে মন্ত্রীর কথা। সংক্ষেপে লেখা হয়েছে, এমআইএন বা মিন। এই ব্যক্তি হচ্ছেন সাবেক যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন। মন্ত্রীর জন্য বরাদ্দ ৪ শতাংশ ঘুষ।
কায়সার লিখে তার পাশে লেখা রয়েছে ২ শতাংশ। এই কায়সার হচ্ছেন সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী। তিনিই এসএনসি-লাভালিনের সঙ্গে সাবেক যোগাযোগমন্ত্রীর যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছিলেন।
এরপরই রয়েছে নিক্সনের নাম। কাজ পেলে তিনিও ২ শতাংশ ঘুষ পেতেন। এই নিক্সন হচ্ছেন মুজিবুর রহমান নিক্সন চৌধুরী। ডায়েরিতে তার পরিচয় লেখা রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর ভাতিজা। নিক্সন চৌধুরী হুইপ নুরে আলম চৌধুরীর ছোট ভাই। নুরে আলম চৌধুরী লিটন চৌধুরী নামে পরিচিত। তিনি শেখ হাসিনার ফুপাতো ভাইয়ের ছেলে। তিনিও দুই পক্ষের মধ্যে যোগাযোগ করিয়ে দেন।
এরপর রয়েছে ‘মসি রহমানের নাম’ তিনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমান। তার নামের পাশে রমেশ শাহ (লাভালিনের সাবেক কর্মকর্তা) লিখে রেখেছেন ১ শতাংশ ঘুষের কথা।
আরো ১ শতাংশ অর্থ ঘুষের জন্য ডায়েরিতে, ‘সেক্রেটারি’ কথা লেখা রয়েছে। এই সেক্রেটারি হচ্ছেন সাবেক সেতুসচিব মোশারফ হোসেন ভূইয়া।
সূত্র জানায়, নিক্সনের নামের পরই রয়েছে আরেকটি নাম। তার জন্য বরাদ্দ ২ শতাংশ বলে ডায়েরিতে উল্লেখ রয়েছে। (প্রথম আলো ২০.০১.২০১৩)
পাঠকরা লক্ষ করুন মোটা হরফের শব্দগুলো। আরেকটি নাম ….. । টরন্টোর কোর্টে অভিযোগ গঠনের সময়ে উপস্থিত ছিলেন প্রথম আলো, ইত্তেফাকসহ আরো কয়েকটি পত্রিকার প্রতিনিধি। তারা সবাই জানেন নামটি কার। এই আরেকটি নাম যে কার সেটা প্রথম আলোর সম্পাদকসহ আরো বহু সম্পাদক জানেন। তাদের সঙ্গে জেলবন্দি সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের পার্থক্য এই যে, মুক্ত থাকলে স্কাইপ সংলাপ এবং রাজীবের নূরানীচাপা-র মতো কানাডায় প্রকাশিত সব নামই হয়তো তিনি দৈনিক আমার দেশ-এ প্রকাশ করতেন জাতীয় স্বার্থে। এই অতি স্পর্শকাতর নামটি উচ্চারিত হতে পারে সেই দুশ্চিন্তায় কানাডায় মামলা শুরু হওয়ার পরপরই বাংলাদেশে মাহমুদুর রহমানকে গ্রেফতার করা হয়। বস্তুত, ইন্টারনেট ও মোবাইল ফোনের কল্যাণে এই স্পর্শকাতর নামটি এখন আর গোপন নেই। এটি অনেকেই জানেন। সম্ভবত শেখ হাসিনা ও তার বোন শেখ রেহানাও জানেন। আগামী ২৯ মে-তে টরন্টোর সুপিরিয়র কোটে এই মামলার পূর্ণাঙ্গ শুনানি শুরু হবে। তখন এই নামটি হয়তো আবার আদালতে উচ্চারিত হবে। তখন হয়তো বাংলাদেশের সবাই নামটি জানবে।
পদ্মা সেতুর পরামর্শকের কাজটি পেলে এসএনসি-লাভালিন আয় করত ৪৭ লক্ষ ডলার অথাৎ ৩৭৬ কোটি টাকা। এ ১২ শতাংশ হিসেবে ঘুষ দেয়ার কথা ছিল ৪৫ কোটি ১২ লক্ষ টাকা।
বারো. বুধবার ২৪ এপৃল ২০১৩-তে সাভারে সকাল ৯টার দিকে নয়তলা ভবন রানা প্লাজা হঠাৎ ধসে যায়। এই দুর্ঘটনায় হতাহতদের উদ্ধারের কাজ এখন চলছে।
(চলবে)
তথ্যসূত্রঃ facebook.com/ShafikRehmanPresents
বিষয়: বিবিধ
১৩১৮ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন