১৯৭১-এর ইতিহাস নিয়ে রাজনীতি (সম্পুর্ণ অংশ) মূলঃ এবনে গোলাম সামাদ

লিখেছেন লিখেছেন মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ তরফদার ১০ এপ্রিল, ২০১৩, ০৭:৫০:৩১ সকাল

১৯৭১-এর ইতিহাস নিয়ে এখন এমন অনেক কিছু বলা হচ্ছে, যা আদৌ ইতিহাস সম্মত নয়। সম্প্রতি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে বলেছেন, পাকিস্তানে চলে যেতে। খালেদা জিয়া এক সময় বর্তমান পাকিস্তানে তার স্বামীর সাথে অনেক দিন ছিলেন। তার স্বামী ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় ভারতীয় সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন, খেমকারান সেক্টরে। পাকিস্তান সরকার থেকে তিনি পুরস্কৃত হয়েছিলেন। কিন্তু তা বলে বেগম জিয়ার যে পাকিস্তানের ওপর কোনো বিশেষ দুর্বলতা আছে, তা বলা চলে না। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমার প্রধানমন্ত্রী বলছেন, বেগম জিয়া হলেন পাকিস্তানপন্থী। তিনি সম্ভবত জানেন না যে, বর্তমানে পাকিস্তানে প্রায় ১০ লাখের ওপর বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষ রুজি রোজগার করে খাচ্ছে। আর পাকিস্তানে মানুষ বলছে না, এসব বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত মানুষকে বাংলাদেশে চলে আসার কথা। সাবেক পাকিস্তান যদি ভেঙে না যেত, তবে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আরো অনেক লোক হয়তো যেতেন পশ্চিম পাকিস্তানে জীবন ও জীবিকার অন্বেষণে। আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কথা অনেক বলেছি। কিন্তু এখনো সেভাবে আলোচনা করতে চাইনি পূর্ব পাকিস্তান থেকে মানুষের পশ্চিম পাকিস্তানে যেয়ে জীবনযাপনের কথা। জীবনের গোড়ার জীবিকার কথা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে বহু মানুষ গিয়েছে জীবিকার অন্বেষণে। ব্যাপারটা কেবলই পূর্ব পকিস্তানকে শোষণের চিত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। তবে এ প্রসঙ্গে আরো অনেক ঘটনার কথা অবশ্যই বিবেচনায় রাখতে হয়। সাবেক পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি বাস করতেন তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে। তারাই জোগাতেন সমগ্র পাকিস্তানের মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি। সাবেক পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান উপায় ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বিক্রয়। কিন্তু সাবেক পাকিস্তানে রাজনীতিতে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ কুড়াতে থাকেন বিশেষ অবহেলা। এই অবহেলার ফলে সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে জন্ম নেয় একটা পৃথক বাংলা ভাষাভিত্তিক জাত্যভিমান, যা জনপ্রিয় করে তোলে ‘জয়বাংলা’ আওয়াজকে। কিন্তু তথাপি বলতে হয়, শেখ মুজিব চাননি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দিতে। তিনি চেয়েছিলেন সাবেক পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হতে। আর এ জন্য তিনি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সাথে। ঠিক কী কারণে আলোচনায় অচলাবস্থা দেখা দেয়, সেটা এখনো পরিজ্ঞাত নয়। অনেকে এখন মনে করছে, মেজর জিয়া কালুরঘাট রেডিও স্টেশন থেকে যদি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিতেন, তবে ইতিহাস অত জটিল হয়ে উঠত না। এ সময়ের অনেক কথাই আমরা জানি না। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে কোনো সম্প্রচার খুব দূরে শ্রবণ হওয়ার কথা নয়। কারণ ওই বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার খুব শক্তিশালী ছিল না। কিন্তু এ সময় জিয়ার কণ্ঠ শোনা গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের সর্বত্র। কী করে এটা হতে পেরেছিল সেটা এখনো হয়ে আছে রহস্যময়। জনশ্রতি, চট্টগ্রামের কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল একটি অস্ট্রেলীয় জাহাজ। সেই জাহাজ থেকে কালুরঘাটের ঘোষণাটি করা হয়েছিল পুনঃপ্রচার, যা রেডিও অস্ট্রলিয়াও প্রচার করেছিল। রেডিও অস্ট্রলিয়ার এই প্রচার পরে বিবিসির মাধ্যমে সারা পৃথিবী জানতে পেরেছিল। জিয়া এ সময় পরিচিতি পান জিয়া খান হিসেবে। আমার মনে পড়ে, আমার মহল্লার অনেকে এসে আমার রেডিওতে জিয়ার এই প্রচার বার্তাকে শ্রবণ করেছিলেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গে এখন আর যথেষ্ট আলোচনা হচ্ছে না। অনেকে বলেন, শেখ মুজিব বিনা প্রস্তুতিতে দেশকে ঠেলে দিয়েছিলেন যুদ্ধের মধ্যে। এটা ছিল তার হঠকারিতা। কিন্তু আসলে তিনি চাননি দেশকে একটা যুদ্ধের মধ্যে ঠেলে দিতে। এ প্রসঙ্গে গবেষণামূলক গ্রন্থ এখনো প্রকাশিত হয়নি। এখন আওয়ামী লীগ দাবি করছে শেখ মুজিব ছিলেন স্বাধীনতার ঘোষক। কিন্তু ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালে ৬ নভেম্বর নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বক্তৃতা দেন। এতে তিনি বলেন- তিনি যত দূর জানেন, শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি। তিনি চাচ্ছেন, পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান। শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায়ের পথ এখনো রুদ্ধ হয়ে যায়নি। তিনি তার এই বক্তৃতায় আরো বলেন যে, শেখ মুজিব হলেন একজন মধ্যপন্থী নেতা। তিনি কোনো বিপ্লবী মন্ত্রে উদ্দীপ্ত নন। শেখ মুজিব একজন মার্কিনবিরোধী মনোভাবসম্পন্ন ব্যক্তিও নন। আসলে এক সময় তার বিরুদ্ধে প্রচারণা ছিল যে, তিনি মার্কিনঘেঁষা নেতা। ইন্দিরা গন্ধীর নিজের কথায়- And he is not an extremist, he was a moderate person. In fact, if I may use the term, he used to be called by some others an American stooge at one time। ইন্দিরা গান্ধী তার এই বক্তৃতায় আরো বলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনরতার দাবি উঠেছে শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর। তার আগে নয়। শেখ মুজিব গ্রেফতার হওয়ার পর বাংলাদেশে ঘটেছে বিরাট গণহত্যা। বাংলাদেশে মানুষ তাই ভাবতে শুরু করে স্বাধীন হওয়ার কথা। ইন্দিরা গান্ধীর নিজের কথা …the cry for independene arose after Sheikh Mujib was arrested and not before. He himself, so far as know, has not asked far independence, even now. But after he was arrested, after there was this tremendous massacre, it people should say: after this how can we live together? We have to be separate. ইন্দিরা গান্ধীর এই বক্তৃতাটি পাওয়া যাবে India Speaks নামক বইতে। বইটি ভারত সরকারের প্রচার বিভাগ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭১-এর ডিসেম্বর মাসে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ তনয়া হাসিনা বলছেন হাজার বছরের বাঙালির কথা। কিন্তু ইন্দিরা গান্ধীর উপকারের কথা যথার্থ হলে বলতে হবে শেখ মুজিব ১৯৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা কামনা করেননি। শর্মিলা বসু তার ডেড রেকনিং বইতে বলেছেন- ইন্দিরা গান্ধী সে সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে যা বলেছিলেন, সেটা ছিল একটা ধাপ্পা। কারণ তিনি নিজে নিচ্ছিলেন বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার নামে পাকিস্তানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে বিরাট যুদ্ধের প্রস্তুতি। কিন্তু ধাপ্পা হলেও ইন্দিরা গান্ধী যা বলেছেন, তা থেকে প্রমাণিত হয় না, শেখ মুজিব চাচ্ছিলেন পৃথক স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে। শেখ মুজিবের লক্ষ্যে নিয়ে তার মনেও ছিল সংশয়। শর্মিলা বসু হলেন, বিখ্যাত নেতা সুভাসচন্দ্র বসুর আপন ভাতিজী এবং সুভাষচন্দ্রের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরৎচন্দ্র বসুর নাতনী। শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৭ সালে চেয়েছিলেন অখণ্ড স্বাধীন বাংলা গড়তে। কিন্তু হিন্দুরা তার ডাকে সাড়া দেননি। দিলে আজকের বাংলাদেশের মানচিত্র হতো ভিন্ন। আমাদের দেশের একদল বুদ্ধিজীবী খুব বেশি বাঙালি বাঙালি করছেন। জানি না, তাদের এই বাঙালিত্বের ভিত্তি আসেলে কিসের ওপর প্রতিষ্ঠিত। ১৯০৫ সালে যে বাঙালি হিন্দু চেয়েছিল বাংলা ভাগ রোধ করতে, ১৯৪৭ এ তাদেরই উত্তরসূরিরা চেয়েছিলেন বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলের বিভাজন। তারা বাঙালিত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেননি। শেখ হাসিনা জ্যোতি বসুকে মরণোত্তর সম্মাননা দিলেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, জ্যোতি বসু তদানীন্তন বাংলা আইন পরিষদে দিয়েছিলেন বাংলা বিভাজনের পক্ষ্যেই তার ভোট। সম্ভবত এই ইতিহাস আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে পরিজ্ঞাত নয়। থাকলে তিনি হয়তো জ্যোতি বসুকে এতটা সম্মাননা দিতে আগ্রহী হতেন না। জ্যোতি বসুর দলের পত্রিকা গণশক্তিতে শেখ মুজিবকে বলা হয়েছিল মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ’র সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলা ব্যক্তি হিসেবে। অনেক কথায় বলেছিলেন বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের উগ্র বামপন্থীরা শেখ মুজিব সম্পর্কে। শেখ মুজিব এক সময় চাকরি করতেন পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতি ইউসুফ হারুনের আলফা ইনস্যুরেন্স কোম্পানিতে। ইউসুফ হারুন ছিলেন একজন সিআইএ’র লোক। এ রকমই ছিল ব্যাপক জনশ্রুতি। আমি নিজেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেককে এ রকম কথা বলতে শুনেছি। কিন্তু আশ্চার্যজনকভাবে শেখ মুজিবকে এক পর্যায়ে দেখা গেল, সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে হাত মিলিয়ে বাকশাল গড়তে। শেখ মুজিব যদি বাকশাল না গড়তেন, তবে মনে হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ভয়াবহ ঘটনা ঘটতে পারত না। ১৯৭১ সালের ইতিহাস লিখতে গেলে চারজন ব্যক্তির নাম সবার লেখাতেই আসবে। এরা হলেন- শেখ মুজিব, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আগা মুহাম্মদ ইয়াহিয়া খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও ইন্দিরা গান্ধী। এই চারজনের মধ্যে ইয়াহিয়া খান ছাড়া কারো স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যু হয়েছে ঘাতকের হাতে। ইন্দিরা গান্ধীর পুত্র রাজীব গান্ধীও মারা গিয়েছেন ঘাতকের হাতে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর ফাঁসি হয়েছে লোক খুনের অপরাধে। জুলফিকার আলী ভুট্টোর কন্যা বেনজির ভুট্টোরও মৃত্যু হয়েছে ঘাতকের হাতে। জানি না আরো কত রাজনীতিকের অস্বাভাবাবিক মৃত্যু হবে এই উপমহাদেশে। রাজনীতি এই উপমহাদেশেও ঠিক অহিংস ধারায় চলছে না। অহিংস রাজনীতির প্রবক্তা মহাত্মা গান্ধীকেও খুন হতে হয়েছে ঘাতকের হাতে।

এখন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বিশেষভাবে প্রচার করা হচ্ছে, বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। আর বলা হচ্ছে শেখ মুজিব ছিলেন, এই জাতীয়তাবাদের জনক, যার ভিত্তিতে বর্তমান বাংলাদেশের উদ্ভব সম্ভব হতে পেরেছে। কিন্তু ১৯৭১-এর দলিল দস্তাবেজ আমরা যা হাতের কাছে পাচ্ছি, তা সমর্থন করছে না আওয়ামী লীগের দাবিকে। সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহ্যাস তার বহুল পঠিত বাংলাদেশ এ লিগ্যাসি অব ব্লাড বইতে ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বলেন যে, তিনি পাকিস্তান ভেঙে দিতে যাচ্ছেন না, তিনি চাচ্ছেন বর্তমান পাকিস্তানের সাথে একটা বিশেষ ধরনের সম্পর্ক (লিঙ্ক) বজায় রাখতে। সাংবাদিক মাসকারেনহ্যাসের এই কথার প্রতিবাদ দল হিসেবে আওয়ামী লীগ করেছে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু তথাপি বলা হচ্ছে, হাজার বছরের বাঙালি জাতীয়তাবাদের কথা। আর সেই সাথে বলা হচ্ছে শেখ মুজিব হলেন এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিশেষ প্রবক্তা। একজন ঘাদানিক নেতাকে বলতে শোনা গেল, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তান। আমরা পাকিস্তান ভেঙে বেরিয়ে এসেছি। বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের তাই ঠাঁই হতে পারে না। কিন্তু আমাদের হাতের কাছে যে সামান্য দলিল দস্তাবেজ আছে, তা থেকে এ রকম কোনো মনোভাবের সমর্থন মিলছে না। ১৯৭১ সালে ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরের বিখ্যাত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের তিনটি লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছিল: মানবতা (ইকুয়েলিটি), মানবমর্যাদা (হিউম্যান ডিগনিটি) সামাজিক সুবিচারের (সোশ্যাল জাস্টিস) কথা। এখানে ধর্মের প্রসঙ্গ মোটেও তোলা হয়নি। কোনো কিছু বলা হয়নি ইসলামপন্থী রাজনীতির বিপ।ে কিন্তু আমাদের ঘাদানিক বন্ধুরা বলছেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল, ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ। বাংলাদেশ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি পাওয়া যাবে পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ-এর প থেকে প্রকাশিত Bangladesh নামক বইতে। বইটি প্রকাশিত হয়েছিল প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিদেশ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ১৯৭১ সালে। যার ভূমিকা লিখেছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমদ। আমাদের হাতে যথেষ্ট প্রমাণপঞ্জি নেই। তবে সামান্য যেটুকু আছে, তাতে হাজার বছরের বাঙালিত্বের আদর্শের ওপর বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতিষ্ঠার চেষ্টা ছিল বলে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। মুজিবনগরের বিখ্যাত ঘোষণা পত্রটিতে বলা হয়েছে, যেহেতু ইয়াহিয়া ভোটের রায় অনুসারে শেখ মুজিবকে সরকার গঠনের অধিকার থেকে বঞ্চিত করছেন, তাই বাংলাদেশ বাধ্য হচ্ছে স্বাধীনতা ঘোষণা করতে। ১৯৭০ সালে যে ভোট হয়, তাতে বাংলাদেশের মোট ভোটারের শতকরা ৫৬ ভাগ ভোট প্রদান করেছিলেন। আর শতকরা ৪৪ ভাগ ভোটার ভোটদানে বিরত ছিলেন। এই ৫৬ ভাগ ভোটারের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল শতকরা ৭৬ ভাগ ভোট, যার অর্থ হলো, আওয়ামী লীগ সে সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের মোট ভোটারের শতকরা ৪২ ভাগ ভোট পেয়েছিলেন। এ থেকে প্রমাণ হয় না, বাংলাদেশের বেশির ভাগ ভোটার ছিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষে। যদিও এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সেই রকমই দাবি করা হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে অনেক মানুষ ভোটে অংশ নিতে চাননি। এর একটা কারণ হলো, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছিলেন, ‘ভোটের আগে ভাত চাই’। এই দেশে চীনপন্থী কমিউনিস্টরা করেছিলেন ১৯৭০ সালের ভোটের বিরোধিতা। তারা বলেছিলেন ভোটের মাধ্যমে মানুষের কোনো মুক্তি আসবে না। মুক্তি আসা সম্ভব কেবল কৃষক শ্রমিকের বিপ্লবের মাধ্যমে। কিন্তু যখন ভোটের ফলাফল বের হলো, তখন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বললেন, এই ভোট হয়েছে গণভোট। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ চাচ্ছে স্বাধীনতা। তিনি শেখ মুজিবকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি যদি স্বাধীনতা না চাও, তবে দেশের মানুষ তোমার পিঠের চামড়া তুলে ফেলবে’। যতগুলো কারণে শেখ মুজিব ১৯৭১-এ বিপাকে পড়েছিলেন, তার মধ্যে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর চাপ ছিল অন্যতম। কিন্তু এই ভাসানী সাহেবকে দেখা গেল ১৯৭১ সালের ১৬ এপ্রিল তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান থেকে কলকাতায় হিজরত করতে। কলকাতায় তাকে রাখা হয় গৃহবন্দী করে। কলকাতা থেকে ভাসানী ঢাকায় আসেন ১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি। ভাসানী সাহেব অনেক কথা বললেও ১৯৭১ সালের যুদ্ধে কোনো ভূমিকা পালন করেননি। দেশে ফিরে তিনি অনেক পরে ফারাক্কা নিয়ে শুরু করেন আন্দোলন। ১৯৭৬ সালে তিনি রাজশাহী আসেন ফারাক্কা মিছিল পরিচালনা করার জন্য। এ সময় তিনি একটি ঘরোয়া সভায় বলেন, তড়িঘড়ি করে সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দিয়ে ভুল করা হয়েছে। ভাসানী ছিলেন একজন বিরাট মাপের নেতা। রাজশাহীতে তার ভক্তের অভাব ছিল না। কিন্তু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়াটা ঠিক হয়নি, এ রকম উক্তি করাতে প্রায় হতবাক হয়ে পড়েছিলেন তার ভক্তরা। ভাসানী সাহেবের কথা থেকে মনে হয়, তিনি তার অতীত ভুলের কথা মনে করে অনুতপ্ত হয়েছিলেন। আমি এ কথা বলছি এ কারণে যে, আবদুল হামিদ খান ভাসানী একজন বড় মাপের নেতা ছিলেন। তিনি সাবেক পাকিস্তান ভেঙে দেয়াকে মনে করেছিলেন একটা বড় রকমের ভুল করা হয়েছে বলে। মওলানা ভাসানী দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের প নেননি। ১৯৭৬ সালে তিনি গ্রহণ করেছিলেন প্রেসিডেন্ট জিয়ার পক্ষ। জানি না, ভাসানী সাহেবকে বর্তমান আওয়ামী লীগ কিভাবে মূল্যায়ন করে। তাকে মনে করে কি না পাকিস্তানের এজেন্ট হিসেবে। তবে বেশ বোঝা যায়, ভাসানী সাহেবকে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চমূল্যায়ন করতে রাজি নয়। ভাসানী সাহেবের স্মৃতি আওয়ামী লীগ চাচ্ছে নানাভাবেই মুছে ফেলতে। যদিও একদিন ভাসানী সাহেব আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছিলেন।

আবদুল হামিদ খান ভাসানী কলকাতা থেকে ফিরে এসে চান এ দেশে বিশেষভাবে ইসলামি রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করতে। তিনি প্রকাশ করেন হককথা নামে একটি সাপ্তাহিক প্রত্রিকা, যাতে তিনি প্রচার করেন হুকুমাতে রব্বানিয়ার দর্শন। যার গোড়ার কথা হলো- আল্লাহর দোস্ত, আমাদের দোস্ত। আর আল্লাহর দুশমন, আমাদের দুশমন। আল্লাহর দুশমনের বিরুদ্ধে জিহাদ করতে হবে। বর্তমান হেফাজতে ইসলাম এই একই রকম বক্তব্য প্রদান করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার বুদ্ধিজীবীরা বলছেন, হেফাজতে ইসলাম আসলে পরিচালিত হচ্ছে জামায়াতে ইসলাম দিয়ে, যেটাকে যথার্থ বলে ধরে নেয়ার কোনো ভিত্তি নেই।

১৯৭৬ সালে হতে পেরেছে ভাসানীর নেতৃত্বে ইসলামি চিন্তাচেতনার এক বিশেষ জাগরণ। কিন্তু আমাদের প্রগতিশীলরা ভাবছেন, ইসলামি চিন্তাচেতনাকে বাতিল করে দেয়ারই কথা। যেটা সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। আসলে ইসলামি রাজনীতি বলতে ঠিক কী বুঝতে হবে সেটা নিয়ে অনেকে তুলছেন প্রশ্ন। অনেকে বলছেন ধর্ম নয়, রাজনীতির ভিত্তি হতে হবে অর্থনীতি। মনে হচ্ছে, এই সব বুদ্ধিজীবী ইসলামের মূলগ্রন্থ কুরআন শরিফ পড়েননি। পড়লে তারা জানতে পারতেন, কুরআন শরিফে বলা হয়েছে "ধন কেবল ধনীদের মধ্যে সঞ্চারিত হতে দেয়া যাবে না। তাকে সঞ্চারিত করতে হবে এতিম, অভাগা ও বিপাকে পড়া পথচারীদের মধ্যে" (সূরা ৫৯ : ৭)। কুরআন শরিফে বলা হয়েছে "দুর্ভিক্ষের সময় নিরন্ন মানুষকে অন্ন প্রদান করতে" (সূরা ৯০ : ১২-১৪)। ইসলামে কেবল পরলোকের কথাই বলা হয়নি। ধর্ম হিসেবে তাতে বলা হয়েছে ইহজগতে মানুষের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানেরও কথা। এর মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় একটি কল্যাণব্রতী রাষ্ট্রের ধারণা (Welfare State)।

১৯৭০ সালের কাছাকাছি থেকে সারা মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলে ইসলাম আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করেছে একটি রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে। যার একটা প্রভাব এসে পড়েছে আমাদের দেশে। হেফাজতে ইসলামের প্রাণকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগ। এই অঞ্চলে মুসলমানেরা চিরকালই ছিলেন যথেষ্ট অগ্রসর। ব্রিটিশ বাংলায় অন্যান্য জেলাশহরে যখন ছিল হিন্দুপ্রাধান্য তখন চট্টগ্রাম শহরে ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতা। চট্টগ্রামে বাংলা মুসলিম প্রত্রিকা ছাপা হতো আরবি-ফারসি অক্ষরে যা বাংলাদেশের অন্য কোনো অঞ্চলে হতো না। চট্টগ্রামকে বলা হতো বারো আউলিয়ার দেশ। ‘বদর’ মানে হলো পূর্ণিমার চাঁদ। বদর হলো আরবি শব্দ। চট্টগ্রামে আছে পীর বদরের আস্তানা। পীর বদরকে ভক্তি করেন প্রায় সারা বাংলাদেশেরই মাঝিমাল্লারা। চট্টগ্রাম তাদের কাছে একটা পুণ্যভূমি। এই সূত্রেও চট্টগ্রামের মুসলমানেরা বাংলাদেশের মুসলিম রাজনীতিতে দিতে পারছেন নেতৃত্ব। চট্টগ্রামের নাম নিয়ে নানা কাহিনী প্রচলিত আছে। চাটি বা চেরাগ মানে হলো প্রদীপ। চট্টগ্রামে ছিল অনেক জিন-পরী। বাবা বদর এসে বলেন, আমি এখানে আল্লাহর ইবাদত করব। তাই সামান্য একটু জায়গা চাই। পরীরা বলল, কতটুকু জায়গা। বাবা বললেন, তার হাতে চাটি জ্বালাবেন তিনি। তার আলো যতটুকু জায়গায় পড়বে সেই জায়গাটুকু হলেই চলবে। কিন্তু চাটি যখন জ্বলল, তখন চট্টগ্রামের বিরাট অংশ আলোকিত হয়ে উঠল। পরীরা পালাতে শুরু করল। পরীদের কানের ফুল পালানোর সময় ঝরে পড়ল চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবহমান নদীতে। সেই থেকে নদীর নাম হলো কর্ণফুলী। হিন্দুরা বলেন চট্টেশ্বরী দেবীর নামে নাম হয়েছে চট্টগ্রামের। কিন্তু মুসলমানেরা বলেন, বাবা বদরের চাটি থেকে নাম হয়েছে চাটগাঁও; যাকে কিছু পরিশুদ্ধ করে বলা হয় চট্টগ্রাম।

১৯০৫ সাল থেকে ১৯৩০ সাল পর্যন্ত এই ২৫ বছর ধরে ব্রিটিশ-বাংলায় হয়েছিল সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন কেবল উচ্চবর্ণের হিন্দুরা। মুসলমানেরা সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন না। আর বাংলাদেশে মুসলমানেরা নিজেরাও চাননি এ সময় কোনো সন্ত্রাসবাদী দল গড়ে তুলতে। হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা করতেন মা কালীর পূজা। মা কালীকে ভাবতেন তাদের ক্ষমতার উৎস। হিন্দু সন্ত্রাসবাদী নেতা সূর্য সেন ও তার দল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করেন ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল, রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে। চট্টগ্রাম শহর দুই দিন ছিল প্রায় তাদেরই দখলে। কিন্তু চট্টগ্রামের মুসলমানেরা সূর্য সেনের পক্ষ গ্রহণ করেননি। কিছু দিনের মধ্যে চট্টগ্রামে ঘটেছিল হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা। চট্টগ্রামের মুসলিম রাজনীতি গ্রহণ করে ভিন্ন পথ। বাংলাদেশের হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা যখন চাচ্ছিলেন বাংলাদেশকে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করতে, তখন চট্টগ্রামের মুসলমানেরা করেছিলেন এর বিশেষ বিরোধিতা। এই পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলাম আন্দোলনকে দেখলে তার একটা বিশেষ উৎস খুঁজে পাওয়া যায়। হঠাৎ করেই এই আন্দোলনের উদয় হয়নি চট্টগ্রামে। সন্ত্রাসবাদকে এখন সবাই বলছেন ভালো নয়। কিন্তু সেই একই সাথে আমরা পত্রপত্রিকায় দেখছি, বামপন্থী মহল থেকে সূর্য সেনকে বিশেষ প্রশংসা করতে। বাংলাদেশের বাম রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছে হিন্দুত্ববোধ।

মামলা-মোকদ্দমার কথা আমরা বেশি বুঝি না। দেশে গঠন করা হয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল। কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন জাগছে আন্তর্জাতিক কথাটা নিয়ে। কম্বোডিয়ায় খেমাররুজ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধের ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। ১৯৯৭ সালে এই ট্রাইব্যুনাল গঠন করার সময় কম্বোডিয়ার সরকার জাতিসঙ্ঘের জেনারেল সেক্রেটারিকে অনুরোধ করে, কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশী বিচারককে নিযুক্তি দিতে। কম্বোডিয়ায় আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের বিচার হয়েছে প্রকৃত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে। কারণ এই ট্রাইব্যুনালে কেবল কম্বোডিয়ার বিচারকেরা ছিলেন না; আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশী বিচারকেরাও ছিলেন। কিন্তু আমাদের দেশের ট্রাইব্যুনালে কোনো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিদেশী বিচারক নেই। বিচার করছেন কেবল আমাদের দেশের বিচারকেরাই। তাই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে উঠতে পারছে প্রশ্ন। এ ছাড়া আরেক কারণেও দেখা দিয়েছে। পাক সেনাবাহিনীর ১৯৫ জনকে চিহ্নিত করা হয়েছিল যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। কিন্তু এদের কোনো বিচার না করে সিমলা চুক্তি অনুসারে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিমলা চুক্তি হয়েছিল, ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৭২ সালের ৩ জুলাই। ১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে ১৬ তারিখ পাকিস্তান বাহিনী ভারতের সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। তারা পৃথকভাবে আত্মসমর্পণ করেননি বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানীর কাছে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সব সৈন্যকে ভারত বন্দী করে নিয়ে যায় ভারতে। ১৯৭১-এর যুদ্ধ বিবেচিত হয় পাক-ভারত যুদ্ধ হিসেবে। ভারত সিমলা চুক্তির সময় বাংলাদেশের কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানায়নি। ভারত পাকিস্তানের সব যুদ্ধবন্দীকে নিজের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রদান করে মুক্তি। মুক্ত পাক সৈন্যরা সবাই ফিরে যায় পাকিস্তানে। তাদের কারোরই বিচার করা সম্ভব হয় না বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে। বাংলাদেশে বর্তমানে বিচার হচ্ছে কেবল জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের। এই বিচারকে তাই অনেকের কাছে মনে হতে পারছে কেবলই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মনে হয় আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হিসেবে কিছু ভুল হয়েছে। আওয়ামী লীগ দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীকে যতটা দুর্বল ভেবেছিল, বাস্তবে জামায়াত ততটা দুর্বল নয়। খালি হাতে জামায়াতের কর্মীরা প্রহার করছেন পুলিশকে। তাদের পক্ষে ছিনিয়ে নেয়া সম্ভব হচ্ছে পুলিশের কাছ থেকে অস্ত্র। আশ্চর্যজনকভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন টেলিভিশনে পুলিশের ওপর হামলাকে বিশেষভাবে দেখানো হচ্ছে। এতে পুলিশের ভাবমূর্তি বিশেষভাবে হচ্ছে বিবর্ণ। রাজশাহীতে একজন পুলিশ কর্মকর্তা জামায়াতকর্মীর ছুড়ে মারা বোমাকে হাত দিয়ে ধরতে গেলেন ক্রিকেট বলের মতো। বোমা ফেটে তার হাতের কব্জি উড়ে গেল। তিনি কি জানতেন না, হাত দিয়ে বোমা ধরতে গেলে বিপত্তি হতে পারে? বলা হচ্ছে, রাজশাহী শালবাগান এলাকায় পুলিশের এক কর্মকর্তাকে দেখা গেল, ইট দিয়ে তার মাথা থেঁতো করা হচ্ছে। তার ধারে-কাছে আর কোনো পুলিশ নেই। সম্ভবত তারা বিপদ বুঝে সরে যান তাদের সহকর্মীকে একা ফেলে। তিনি পড়ে থাকেন পথের মধ্যে। রাজশাহীর শালবাগান এলাকা শহরের মধ্যে অবস্থিত হলেও এখনো বেশ কিছুটা গ্রাম্য। গ্রাম থেকে আসা এক গ্রাম্য নারী (ঝর্ণা) ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে পাজা করে তুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। এটাও বারবার দেখানো হলো টেলিভিশনে। জানি না এর প্রভাব জনমনে কিভাবে পড়তে যাচ্ছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগ মনে করেছিল শাহবাগ চত্বরের জমায়েত তাদের মর্যাদাকে বাড়াবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, দেশবাসী মনে করছে এই জমায়েত ছিল একটি বিশেষ বিদেশী রাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তানির্ভর। আর আওয়ামী লীগ করেছিল এই জমায়েতের বিশেষ পুলিশ ও র্যাকব প্রহরার ব্যবস্থা। কিন্তু এই জমায়েত নিয়ে আওয়ামী লীগ পড়েছে এক মহারাজনৈতিক সমস্যারই মধ্যে। আমরা আলোচনাকে বেশি দূর বিস্তৃত করতে চাই না। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভুল রাজনীতি দেশকে এনে ফেলেছে যেন এক গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে। গৃহযুদ্ধ এড়ানোর চেষ্টা করতে হবে।

আমরা আলোচনা শুরু করেছিলাম ১৯৭১-এর যুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে। এই যুদ্ধের ইতিহাস এখনো যথাযথভাবে লিখিত হয়েছে বলে আমাদের মনে হচ্ছে না। ১৯৭১-এর যুদ্ধ অনেকের কাছে ছিল মুক্তিযুদ্ধ। অনেকের কাছে তা আবার প্রতিভাত হয়েছিল পাকিস্তানকে ধ্বংস করে অখণ্ড ভারত প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ হিসেবে। যারা মনে করেছিলেন, ভারত এই যুদ্ধ করছে কেবল পাকিস্তানকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে, তারা নিয়েছিলেন ভারতবিরোধী ভূমিকা। আজ তাদের অনেকের বিচার হচ্ছে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে। তবে এই বিচার দেশবাসী মেনে নেবে কি না, সেটা নিয়ে থাকছে সংশয়।

বলা হচ্ছে, হেফাজতে ইসলাম চাচ্ছে না ষুদ্ধাপরাধের বিচার। বিরাট এক সমাবেশ হতে দেখা যাচ্ছে ঢাকায় হেফাজতের পক্ষ থেকে। এই বিরাট সমাবেশ দেশবাসীকে ভাবাচ্ছে ভিন্নভাবে। হেফাজতে ইসলামের মহাসমাবেশ শাহবাগ চত্বরের সমাবেশ থেকে অনেক বড় পরিমাপের বলেই প্রতিভাত হচ্ছে দেশবাসীর কাছে। আওয়ামী লীগকে বুঝতে হবে এর প্রকৃত সঙ্কেত।

ফরহাদ মজহারের মতো এক কালের বাম বুদ্ধিজীবীকে স্বাগত করতে দেখা যাচ্ছে হেফাজতকে। হেফাজতকে স্বাগত করতে দেখা যাচ্ছে সাদেক খানের মতো এককালের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীকে। তাই হেফাজত সম্পর্কে ভিন্নভাবে করতে হবে হিসাব-নিকাশ। বাংলাদেশের মানচিত্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সাতটি জেলায় হেফাজতে ইসলাম পাচ্ছে বিপুল জনসমর্থন। এর মধ্যে আছে চট্টগ্রাম ও খুলনা। দু’টিই হলো বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর। রাজশাহীতে হেফাজতের সমর্থন যথেষ্টই আছে। সমর্থন আছে চাঁপাইনবাবগঞ্জে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ হলো একটি উল্লেখযোগ্য স্থলবন্দর। হেফাজতকে ক্ষুব্ধ করে আওয়ামী লীগ কি এ দেশে বাস্তবধর্মী রাজনীতি করতে পারবে?

বিভিন্ন দেশের রাজনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, গণতন্ত্র চরম অবস্থায় টেকে না। আওয়ামী লীগ যদি দেশকে চরম অবস্থার মধ্যে ঠেলে নিয়ে চলে, তবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়েই পড়বে। আওয়ামী লীগ নেতারা ইতালির বিনীত মুসোলিনি অথবা জার্মানির হে’র হিটলারের মতো ফ্যাসিস্ট বা নাৎসি দল গড়ে তুলতে পারেনি। ফ্যাসিস্ট ও নাৎসি দল ত্রাসের মাধ্যমে তাদের দেশের জনমতকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হতে পেরেছিল। কিন্তু দল হিসেবে আওয়ামী লীগ কি সেটা পারবে? মুসোলিনি জোর দিয়েছিলেন ইতালীয় জাতীয়তাবাদের ওপর। ইতালিয়ানদের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন নতুন রোমান সাম্রাজ্য গড়ার। হিটলার বলেছিলেন আর্য জাতির কথা। আওয়ামী লীগ বলছে হাজার বছরের বাঙালিত্বের কথা। উগ্র জাতীয়তাবাদকে নির্ভর করে আওয়ামী লীগ রাজনীতি করতে চাচ্ছে। কিন্তু হিটলার মুসোলিনির মতো কোনো নেতা নেই আওয়ামী লীগে। শেখ হাসিনাকে মুসোলিনি, হিটলারের সাথে তুলনা করা যায় না। তার নেতৃত্ব হলো খুবই দুর্বল এবং বিশেষ অর্থে নারীসুলভ।

বিষয়: বিবিধ

১৬৪৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File