মধ্যপ্রাচ্যে গণঅভ্যুত্থান ও মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র প্রসঙ্গে

লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ৩১ মার্চ, ২০১৩, ০৯:০৭:১৫ রাত

মধ্যপ্রাচ্যে গণঅভ্যুত্থান ও মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র প্রসঙ্গে

বছরের শুরুতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে গণজাগরণ ও গণ অভ্যুত্থানের যে টর্ণেডো আঘাত হেনেছিল যার প্রভাবে তিউনিসিয়ার প্রায় আড়াই দশকের স্বৈরশাসক বেন আলী ক্ষমতা ছেড়ে দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন, মিসরের স্বৈরাচারী হোসনে মোবারক পদত্যাগ করে প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন এবং লিবিয়ায় কর্নেল গাদ্দাফীর তখতে তাউসেরও পতন হয়েছে । আলজেরিয়া সহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই এ টর্ণেডো ছোঁয়া লেগছে এবং সৌদী আরব সহ অন্যান্য দেশও আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছে ।

আরব বিশ্বে যে আন্দোলন এখন চলছে যা জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন। এবং এ আন্দোলনে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী লোকেরাই মূখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে বিশ্বাস করা হয়। কারণ ইসলাম ও মুসলিমবিশ্ব বেশ কয়েক শতাব্দী ধরেই প্রতিদ্বনদ্বী শক্তির হাতে পর্যুদস্ত হয়ে আসছে এই শক্তির হাতে অর্থ অস্ত্র জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি রয়েছে। যা এক সময় মুসলমানদের হাতে ছিল। মুসলমানদের পদক্মখলনের কারণে এই সম্পদ তাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। এই সুযোগে বস্তুবাদী সভ্যতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ইসলামবিরোধী শক্তি, অর্থ, অস্ত্র ও প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে ইসলাম ও মুসলমানদের মানবতাবিরোধী একটি শক্তি হিসেবে বিশ্ববাসীর সামনে উপস্থাপন করে। এবং তারা সফলও হয়। এই প্রজন্মের যারা সচেতন নাগরিক মিথ্যা প্রচারণা ও প্ররোচনা দিয়ে তাদের কাছ থেকে উক্ত সত্যকে লুকিয়ে রাখা এখন কঠিন হয়ে পড়েছে। তারা যেমন নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে চায় তেমনি জাতির ভাগ্য নির্ণয় এবং উন্নয়নে শরীক হতেও চায়। মিসর, তিউনিসিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যসহ এশিয়া আফ্রিকার দেশগুলোতে নতুন জাগরণের যে বন্যা পরিদৃষ্ট হচ্ছে তা এই চেতনারই অংশ।

মধ্যপ্রাচ্যের এ নতুন জাগরণের ক্ষমতাসীন জান্তাদের এর সময়ের নাগরীক অধিকার লুন্ঠণের সহযোগী পাশ্চত্যের শক্তিধরদের সমর্থন ঈশান কোনে কালো মেঘের মত শঙ্কার সৃস্টি হচ্ছে । কারণ এই শক্তিটিই বিশ্বযুদ্ধ-উত্তর তাদের অনুকুল পরিবেশে তাদেরই সুবিধা অনুযায়ী মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বের মানচিত্র পরিবর্তন করেছে। তূর্কী সালতানাতকে ভেঙ্গে বৃহদাংশ তাদের নিজ নিজ দেশের সাথে লীন করে নিয়েছে । মুসলিম বিশ্বের বুক থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনী মুসলমানকে উৎখাত করে তাদের ঘরবাড়ি ও জায়গা জমিতে দুনিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে ইহুদীদের এনে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে।

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এখন যে পরিবর্তন ও বিপ্লব ঘটছে তার অনুকুল পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে উক্ত গোষ্ঠী আবার নতুন খেলায় মেতে উঠছে কিনা সে আসঙ্কা এখন চিন্তাশীলদের ঘুম হারাম করে দিয়েছে । অথবা এ অধিকার আদায়ের আন্দোলনের পেছনে বাইরের কোন শক্তি ইন্ধন যোগাচ্ছে কিনা এবং তার ফলে কোন বিশেষ শক্তির ইঙ্গিতে তা নতুন মানচিত্র তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ কিনা এই নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠছে। কারণ এরাইর আফগানিস্তানে সোভিয়েত হটিয়ে তালেবানদের ক্ষমতায় যেতে সহযোগীতা করেছিল । তারপর জঙ্গী অজুহাতে তারা দেশটি দখল করে নিয়েছিল । আরব বিশ্বের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের সংগ্রামে ইসলামী জীবন ব্যবস্থায় বিশ্বাসী লোকেরাই মূখ্য ভূমিকা পালনের অপরাধ(?)কে অছিলা ধরে মধ্যপ্রাচ্যে জঙ্গী আবিষ্কারের নামে আরব দেশগুলোর বর্তমান সীমানা পূনর্বিন্যাসের পূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ শুরুকরা হচ্ছে কিনা এ প্রশ্ন উঠেছে । এই প্রশ্ন উঠার পিছনে যথেষ্ট কারণও রয়েছে। কারণ, ২০০৬ সালের জুলাই মাসে মার্কিন সশস্ত্র বাহিনীর একটি জার্নালে (ARMED FORCES JOURNAL) Blood Borders How a better Middle East World Look শীর্ষক একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। (http://bigthink.com/ideas/21057)। প্রবন্ধটি লিখেছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের একজন অবসরপ্রাপ্ত গোয়েন্দা কর্মকর্তা মি. রাল্ফ পিটার। প্রবন্ধের সাথে তিনি একটি মানচিত্র দিয়েছিলেন এবং এই প্রবন্ধটির মূল প্রতিপাদ্য ছিল সৌদি আরব, তুরস্ক, মধ্য এশিয়া হতে পাকিস্তান পর্যন্ত সব মুসলিম দেশকে ছিন্ন ভিন্ন করে মার্কিনীদের ইচ্ছামাফিক এগুলোর সীমানাকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানো। তার যুক্তি হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যকে স্থিতিশীল করতে হলে, দাঙ্গা হানাহানি বন্ধ করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য বর্তমান মানচিত্রটিকে পুনর্বিন্যাস করা অপরিহার্য।



(ছবি-১, মধ্যপ্রাচ্যের নতুন মানচিত্র)

মি. বাল্ফ যে পরিকল্পনার কথা বলেছেন তাতে দেখা যায় যে নতুন মানচিত্রে সৌদি আরবের মধ্য থেকে পবিত্র ধর্মীয় স্থান মক্কা মদীনাকে নিয়ে গঠিত হবে পবিত্র রাষ্ট্র। ইরাক হবে তিনভাগে বিভক্ত। বসরাকে নিয়ে হবে দক্ষিণের শিয়া রাষ্ট্র, মধ্যখানে সুন্নী রাষ্ট্র এবং কুর্দীদের নিয়ে কুর্দীস্থান। এই মহাপরিকল্পনা পাকিস্তান পর্যন্ত এসে তিনি শেষ করেছেন। বলা বাহুল্য উপসাগরীয় যুদ্ধের পর থেকে ইরাককে কার্যত তিন অংশে বিভক্ত করলেও আমেরিকার সিনেট এই সেদিন দেশটিকে তিন টুকরা করার আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দিয়েছিল। এদিকে আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনীর উপস্থিতির পর হঠাৎ গজিয়ে ওঠা বেলুচিস্তান সমস্যা দিন দিন যেভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠছে তা দেখে অন্তত ইরাক ও পাকিস্তানে রাল্ফ পিটারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোন অনুসর্গ যদি কেউ দেখেন তাতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। একইভাবে রাল্ফ পিটারের চিন্তার একটি প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রকাশিত ভারতীয় সাপ্তাহিক আউটলুক পত্রিকায়। পত্রিকাটি ‘এশিয়া ২০২৫' শিরোনামে প্রকাশিত প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে যে তথ্য দিয়েছে তাতে বলা হয়েছে যে পাকিস্তান ২০১২ সালের দিকে পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাবে এবং তার ভৌগোলিক অখন্ডতা হারাবে। এক্ষেত্রে ভারত সক্রিয় ভূমিকা পালন করবে। প্রতিবেদনের কিছু অংশ এ রকম¬ ‘২০১২ সালের দিকে পাকিস্তান পুরোপুরি অকেজো হয়ে যাবে এবং ইসলামি উগ্রবাদীদের কাছে দেশটি তার নিয়ন্ত্রণ হারাবে আর উগ্রবাদীরা অনুপ্রবেশ করবে কাশ্মীরে। ভারত চাইবে পাকিস্তান তার ইসলামি জঙ্গিবাদীদের অনুপ্রবেশ বন্ধ করুক। পাকিস্তান তা করতে ব্যর্থ হলে ভারতীয় বাহিনী আজাদ কাশ্মীরে প্রবেশ করবে। জবাবে পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের হুমকি দেবে। চীন পাকিস্তানের সাথে সুর মিলিয়ে নেপাল ও ভুটানের মাঝখানে তার সেনাবাহিনী মোতায়েন করে ভারতের মিজোরাম-নাগাল্যান্ড-আসাম-সিকিম সীমানাকে হুমকিতে ফেলে দেবে।

জবাবে যুক্তরাষ্ট্র সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাবে এবং অন্যান্য উত্তপ্ত জায়গা থাকা সত্ত্বেও সে বঙ্গোপসাগরে নৌবাহিনী পাঠাবে এবং চীনকে হুঁশিয়ার করে দেবে। পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করতে পারে এ ভয়ে ভারত পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোর ওপর প্রচলিত অস্ত্র দিয়েই হামলা চালালেও তা তেমন সফল হবে না। জবাবে পাকিস্তান দুই দেশের মধ্যবর্তী সীমান্তে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীর ওপর মরিয়া হয়ে পরমাণু হামলা চালাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের এই অতিরঞ্জিত পদক্ষেপের উদ্দেশ্য পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে একটি পূর্ণ মাপের পরমাণু শক্তির মোকাবেলাকে ত্বরান্বিত করা। যুক্তরাষ্ট্র বি-২ বোমারু বিমান থেকে গভীর লক্ষ্যভেদী ওয়ারহেডের সাহায্যে পাকিস্তানের অবশিষ্ট পারমাণবিক শক্তিও ধ্বংস করে দেবে। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র মৈত্রীর বাস্তব অবস্থা দেখে চীন ভারতের উত্তরাঞ্চল থেকে পিছু হটবে। পাকিস্তানের ওপর আঘাত করেই যুক্তরাষ্ট্র চীনকে সম্ভাব্য বিপদ সম্পর্কে সতর্ক করে দেবে। পাকিস্তানে সর্বাত্মক বিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে। ভারতীয় বাহিনী সেখানে শৃঙ্খলার জন্য ঢুকে পড়বে।

দেশটি বিভাজিত হয়ে পড়লে পাকিস্তানের অঞ্চলগুলো ধীরে ধীরে ভারতে একীভূত হয়ে যাবে। সিন্ধু, বালুচ আর সীমান্ত প্রদেশের পার্লামেন্ট ভারতের নেতৃত্বাধীন কনফেডারেশনে যোগদানের পক্ষে ভোট দেবে। ভারতীয় কনফেডারেশন তৈরি হওয়ার ফলে পাঞ্জাব একাকী টিকতে না পেরে একীভূত হয়ে যাবে এবং ভারতীয় পাঞ্জাবের সাথে যুক্ত হয়ে বৃহৎ পাঞ্জাব রাজ্য তৈরি করবে।’



(ছবি-২ ,ভারতীয় আউটলুক পত্রিকায় ভারত মাতার আঁচলে অখণ্ড রামরাজ্যের মানচিত্র)

এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চল ও প্রদেশগুলো ধীরে ধীরে ভারতের সাথে একীভূত হয়ে যাবে। আউটলুকে প্রকাশিত এই রিপোর্টে যে নতুন মানচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে তাতে বাংলাদেশকে ভারতের অঙ্গীভূত একটি অঞ্চল হিসেবে প্রদর্শন করা হয়েছে। তবে এতে ভারত কর্তৃক পাকিস্তান দখল করার কথা বলা হলেও বাংলাদেশ কিভাবে ভারতের সাথে একত্রীভূত হবে সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি। পাঠকরা এই তথ্যগুলো http://www.armedforces journal.com/2006/06/1833899 এবং http://www.outlook india.com/ article.aspx?210036 ওয়েবসাইটে দেখতে পারেন। ইহুদী মুশরেকসহ পাশ্চাত্যের ইসলামবিদ্বেষী শক্তিগুলোর এজেন্ডা বাস্তবায়নে তারা ইসলাম ও মুসলমানদের শান্তি ও কল্যাণমুখী চরিত্রকে সবচেয়ে বড় বাধা বলে মনে করে। ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে আখ্যাদান এবং মুসলমানদের ধর্মান্ধ মৌলবাদী হিসেবে চিত্রিত করে বিশ্ববাসীর সামনে হেয় প্রতিপন্ন করার পেছনে উপরোক্ত ষড়যন্ত্রই মুখ্য ভূমিকা পালন করছে বলে আমার বিশ্বাস। তবে মধ্যপ্রাচ্যের জনগণকে আন্দোলনের সূচনা করেছে তা যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয় তা হলে এই ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হতে বাধ্য।

বিষয়: বিবিধ

১৬৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File