রম্য রচনা:একটি শুয়োরের মুখোমুখী
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২৫ মার্চ, ২০১৩, ১১:১৮:৩০ রাত
রম্য রচনা
একটি শুয়োরের মুখোমুখী
শুয়োরের পালটি এগিয়ে চলছিল । আমার পাশ দিয়ে একজন ভদ্রলোক নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন । রাস্তায় দেখলেন তার ছেলে অন্যান্য ছেলেদের সাথে দুষ্টামি করছে । ভদ্রলোক তার ছেলেকে নামাজ না পড়ার কারণে কঠোর ভর্তসনা করে এক পর্যায়ে বললেন, “শুয়োরের বাচ্চা, আজ বাসায় তোর জায়গা নেই..........” । এ সময় হঠাৎ করেই দলনেতা শুয়োরটি উত্তেজিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল । আমি কিছুটা ভীত ও কিছুটা অনুসন্ধিৎসু মনে আস্তে আস্তে সামনে এগুচ্ছিলাম। শুয়োরটি তার কাছে এসে বলল, দাঁড়াও তোমার সাথে কিছু কথা আছে । শুয়োর কথা বলছে দেখে আমিও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম ।
শুয়োরঃ তোমার চেহারা সুরৎ অর্থাৎ মুখে দাড়ি, মাথায় টুপি দেখে মনে হচ্ছে তুমি একজন মুসলমান । তাই নয় কি ?
উত্তরঃ জি, হ্যাঁ ।
শুয়োরঃ আচ্ছা বলতে পারো মুসলমান কাকে বলে?
উত্তরঃ কেন, যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে, হজ্ব ফরজ হলে হজ্ব করে, মালদার হলে যাকাত দেয়, তারাইতো মুসলমান।
শুয়োরঃ আচ্ছা বলতো, আমাদের সম্পর্কে তোমাদের ধারণা কি?
উত্তরঃ তোমরা তো নিকৃষ্টতম জানোয়ার । তোমাদের ভক্ষণ করা আল্লাহ আমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন । তাইতো আমি আমার ছেলেকে নামাজ না পড়ার কারনে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছি ।
শুয়োরঃ বুঝলাম । আমাদের ভক্ষণ করা তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, সেটা তুমি কোথায় পেলে?
উত্তরঃ কেন, আল্লাহ কোরআনের সূরা আল বাকারা ১৭৩ ও আল মায়েদার ৩ নং আয়াতে স্পষ্ট ভাবে শুয়োরের গোশত মুসলমানদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন ।
শুয়োরঃ তুমি বলেছ, আমরা নিকৃষ্টতম জানোয়ার, আল্লাহ কোরআনে আমাদের ভক্ষণ করা তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন । কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে আমরা তোমাদের চেয়ে ভাল মুসলমান ।
উত্তরঃ অসম্ভব, তোমরা নিকৃষ্টতম জানোয়ার, আর আমরা আল্লাহর প্রিয় বান্দা । আল্লাহ আমাদের জন্য জান্নাত সৃষ্টি করেছেন ।
শুয়োরঃ তা ঠিক আছে, আল্লাহ তোমাদের জন্য জাহান্নামও তো সৃষ্টি করেছেন । তার পরেও বলছি আমার তো মনে হচ্ছে আমরা তোমাদের চেয়ে ভাল মুসলমান ।
উত্তরঃ কিন্তু! কিভাবে?
শুয়োরঃ তুমি কি আল কুরআনের সুরা আলে ইমরানের ৮৩ নং আয়াতটি বলতে পার?
উত্তরঃ জি, হ্যাঁ ।
শুয়োরঃ বলতো।
উত্তরঃ আল্লাহ বলেনঃ
أَفَغَيْرَ دِينِ اللّهِ يَبْغُونَ وَلَهُ أَسْلَمَ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالأَرْضِ طَوْعًا وَكَرْهًا وَإِلَيْهِ يُرْجَعُونَ
অর্থঃ এরা কি আল্লাহর দীন ত্যাগ করে অন্য কোন পথের সন্ধান করছে ? অথচ আকাশ ও পৃথিবীর সবকিছুই স্বেচ্ছায় বা অনিচ্ছায় আল্লাহর হুকুমের অনুগত মুসলিম এবং তাঁরই দিকে সবাইকে ফিরে যেতে হবে ৷
শুয়োরঃ তাহলে আমরা স্বেচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায় হোক, মুসলমান কিনা?
উত্তরঃ (আমতা আমতা করে) বুঝে আসছে না।
শুয়োরঃ দেখ, আমি তোমাকে বিষয়টা ছোট একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝিয়ে বলছি । আমার মালিকের বাড়িতে আমরাও যেমন আছি, তেমনি আরো আছে কয়েকটা ছাগল । সকাল বেলা আমার মালিক আমাদের সকলকে আলাদা পাত্রে খাবার দেন । আমরা আমাদের খাবার খাই আর ছাগলগুলো তাদের খাবার খায় । আমরা ছাগলগুলোর খাবার খাই না, আর তারাও আমাদের খাবার খায় না । আমরা মনে করি ছাগলের খাবার আমাদের জন্য হারাম আর ছাগলরাও মনে করে আমাদের খাবার তাদের জন্য হারাম । এভাবে আমরা সকলে জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দীন মেনে চলছি । আর তোমরা! শুয়োরটি বলে চলল- তোমরা কি তোমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে আল্লাহর দীন মেনে চলছ?
উত্তরঃ (আমতা আমতা করে) হয়তো সম্ভব হয় না ।
শুয়োরঃ আচ্ছা, আমাকে জবাই করে তার গোশত তোমার মত লোকদের যদি ১/২ কেজি করে বিনামূল্যে উপহার দেয়া হয় তাহলে তোমরা তা খাবে কিনা?
উত্তরঃ অবশ্যই না, কারণ আগেই বলেছি, আল্লাহ কোরআনে তোমাদের গোশত ভক্ষণ করা আমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন।
শুয়োরঃ খাবে না কথাটা ঠিক, তবে আল্লাহ কোরআনে ‘আমাদের গোশত ভক্ষণ করা তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন এজন্য খাবেনা’ এ কথাটা ঠিক নয় ।
উত্তরঃ তা তুমি কিভাবে বুঝলে?
শুয়োরঃ আচ্ছা তোমাদের কেউ কি ঘুষ খায়?
উত্তরঃ হ্যাঁ, অনেকেই খায় ।
শুয়োরঃ কেন খায়?
উত্তরঃ অনেকেই ঠেকায় পড়ে দারিদ্রের কারণে খায় ।
শুয়োরঃ ‘ঠেকায় পড়ে দারিদ্রের কারণে খায়’ কথাটা ঠিক নয় ।
উত্তরঃ তা তুমি কিভাবে বুঝলে?
শুয়োরঃ আল্লাহ কোরআনের যেখানে আমাদের গোশত ভক্ষণ করা তোমাদের জন্য হারাম করে দিয়েছেন, সে আয়াতটা তুমি বলতে পার?
উত্তরঃ জি, হ্যাঁ ।
শুয়োরঃ বলতো।
উত্তরঃ আল্লাহ বলেনঃ
﴿ اِنَّمَا حَرَّمَ عَلَيۡکُمُ الۡمَيۡتَةَ وَالدَّمَ وَلَحۡمَ الۡخِنۡزِيۡرِ وَمَآ اُهِلَّ بِهٖ لِغَيۡرِ اللّٰهِۚ فَمَنِ اضۡطُرَّ غَيۡرَ بَاغٍ وَّلَا عَادٍ فَلَآ اِثۡمَ عَلَيۡهِؕ اِنَّ اللّٰهَ غَفُوۡرٌ رَّحِيۡمٌ﴾
অর্থঃ তিনি তোমাদের উপর হারাম করেছেন, মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীবজন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়। অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই। নিঃসন্দেহে আল্লাহ মহান ক্ষমাশীল, অত্যন্ত দয়ালু।
শুয়োরঃ মনযোগ দিয়ে শোন । একথা কি ঠিক নয় যে, আল্লাহ তায়ালা সূরা আল বাকারা ১৭৩ ও আল মায়েদার ৩ নং আয়াতে মানুষের জন্য হারাম খাদ্যের বর্ণনা দেয়ার পাশাপাশি এ কথাও বলেছেন যে ‘অবশ্য যে লোক অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়, তার জন্য কোন পাপ নেই’ । অর্থাৎ ‘মৃত জীব, রক্ত, শুকর মাংস এবং সেসব জীবজন্তু যা আল্লাহ ব্যাতীত অপর কারো নামে উৎসর্গ করা হয়’ এগুলো খাওয়া হারাম, কিন্তু সে যদি অনন্যোপায় হয়ে পড়ে এবং নাফরমানী ও সীমালঙ্ঘনকারী না হয়ে অর্থাৎ ‘ঠেকায়’ পড়ে খায় তবে তার জন্য কোন গুনাহ নেই । তুমি যে বলেছিলে ‘কিছু মানুষ ঠেকায় পড়ে ঘুষ খায়’ কথাটা একারণে ঠিক নয় যে, আল্লাহ জানেন যে মানুষ ‘ঠেকায়’ পড়বে । তাই ‘ঠেকা’ থেকে বাঁচার জন্য মানে অভাবের কারণে কেউ যাতে মারা যায় সেজন্য আল্লাহ তায়ালা তার বিধানের মধ্যে উক্ত ‘রুখসাত’ রেখেছেন । তবে মনে রাখবে, এ রুখসাত শুধুমাত্র ‘আল্লাহর হক’ এর বেলায়ই প্রযোজ্য । আল্লাহ তার কোরআনের কোথাও ‘বান্দার হক’ এর বেলায় ‘রুখসাত’ এর ব্যবস্থা রাখেননি । তাই বলেছিলাম মানুষ ‘ঠেকায় পড়ে’ ঘুষ খায় কথাটা ঠিক নয় । ঘুষ খাওয়া তো ‘বান্দার হক’ লঙ্ঘন করা। ‘বান্দার হক’ লঙ্ঘন করার অধিকার কোন মুসলমানের নেই । যে মুসলমান, সে যদি প্রকৃতই ঠেকায় পড়ত তবে তার প্রতিকার রয়েছে উপরে বর্ণিত আল বাকারা ১৭৩ ও আল মায়েদার ৩ নং আয়াতে।
সর্বশেষে বলছি, আল কোরআন তোমাদের যে ধরণের ‘মুসলমান’ হতে বলেছে সে মুসলমান অর্থাৎ তোমরা কুরআনী মুসলমান হতে পারনি । তোমরাতো সামাজিক মুসলমান । তোমাদের সমাজ ব্যবস্থা তোমাদের ‘শুকরের গোশত’ খেতে বাধা দেয় বা ‘শুকরের গোশত’ খেলে তোমরা সমাজে অপাংতেয় হয়ে পড়বে, এ ভয়ে তোমরা ‘শুকরের গোশত’ খাচ্ছ না । আর সুদ, ঘুষ খেলে তোমরা সমাজে অপাংতেয় হয়ে তো পড়বেই না বরং সমাজে তোমরা ‘বড় লোক’ খ্যাতি পাবে। তাই সুদ, ঘুষ খেতে তোমাদের কোন বাধা নেই । এখন বল, আমি যে বলেছি ‘আমরা তোমাদের চেয়ে ভাল মুসলমান’ কথাটা ঠিক নয় কি?
উত্তরঃ জি, হ্যাঁ । আমরা তো এভাবে কখনো চিন্তা করিনি । আমার মাথা ঘুরতাছে । তোমরা শুকররা আমাদের চেয়ে ভাল! মানে, আমরা মুসলমানরা শুকরের চেয়েও খারাপ! খোদার বিধান লঙ্ঘন করার এ পরিনতি!
শুয়োরঃ হ্যাঁ, চিন্তা কর । ভালভাবে চিন্তা কর । তুমি কি আল কুরআনের সূরা আতত্বীন পড়নি? খোদার বিধান পালন করলে তোমরা ‘আশরাফুল মাখলুকাত’ । আর খোদার বিধান লংঘন করলে তোমরাই ‘আসফালা সাফেলীন’ ।
আর মনে রেখ, তুমি তোমার ছেলেকে ‘শুয়োরের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়ে তুমি আমাদের অপমান করেছ । শুয়োরেরা তোমাদের মত সুদ খোর, ঘুষখোর মানুষের চেয়ে ভাল । ভবিষ্যতে যদি কখনও এভাবে গালি দাও, তবে আজ আমি একা এসেছি, সেদিন আমার পালসহ এসে এ অপমানের প্রতিশোধ নিব ।
শুয়োরের কথা শুনে আমার সমস্ত শরীর বিদ্যুত তরঙ্গের মত শিহরিত হল । জানালা থেকে ভেসে আসল মুয়াজ্জিনের আওয়াজ- আচ্ছালাতু খাইরুম মিনানাউম । আচ্ছালাতু খাইরুম মিনানাউম । চোখ খুলে দেখি সমস্ত শরীর ঘামে ভিজে গেছে ।
বিষয়: বিবিধ
১৭৭৫ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন