MK Traders বিশ্বস্ততার এবং সরলতার মূল্য কত? একটি বাস্তব সত্য ঘটনা
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ১৮ নভেম্বর, ২০১৪, ১০:০৯:১১ রাত
বিশ্বস্ততার এবং সরলতার মূল্য কত?
একটি বাস্তব সত্য ঘটনা
মোরশেদ ও খালেদ (আসল নাম নয়) দুই বন্ধূ । শুধু বন্ধু নয়, সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু ও দ্বীনী ভাই। খালেদ একটা সরকারী প্রজেক্টে ভাল বেতনে চাকুরী করতেন। লোকসান দেখিয়ে প্রজেক্টটি সরকার বন্ধ করে দেয় । ফলে খালেদ বেকার হয়ে পড়েন । ৫ সদস্য বিশিষ্ট সংসারের খরচ আর বাসাভাড়া টিউশনী করে চালাতে হিমসিম খেতে হচ্ছে খালেদকে । বন্ধ হওয়ার পরে প্রজেক্ট থেকে এককালীন কিছু টাকা দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ । শত কষ্টের মধ্যেও খরচ না করে ব্যাংকে আমানত রেখেছিল খালেদ ।
মোরশেদ চাকুরী করতেন বিএডিসি’তে । বিএডিসি কম্পাউন্ডের মসজিদে ইমামতি করত আর তার বিনিময়ে বিনাভাড়ায় থাকত সরকারী বাসায় ।
বিএডিসি সরকার বন্ধ করে দিবে এ রকম সিদ্ধান্ত নিতে সরকার কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বিদায় দেয়ার উদ্দশ্যে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের ঘোষণা দেয় । মোরশেদ এ সুযোগে চাকুরী ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন ।
মোরশেদ ও খালেদ পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় দুজনে মিলে ব্যবসা করবে । সিদ্ধান্ত মোতাবেক দু জনের পুঁজি খাটিয়ে একটি দোকান ভাড়া নিয়ে MK Traders (দুই জনের নামের আদ্যাক্ষর দিয়ে, বাস্তবেও এটাই ছিল) নামে রিক্সা-সাইকেলের পার্টসএর ব্যবসা শুরু করেন ।
খালেদ ৫ সদস্য বিশিষ্ট সংসারের খরচ চালাতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টিউশনী করেন, দোকানে কদাচিৎ বসা হয় । তবে আসা যা্ওয়ার পথে প্রতিদিনই দেখা হয় মোরশেদের সাথে । মোরশেদ ৫ ওয়াক্ত ইমামতি করে আর সারা দিন ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকেন ।
এভাবে দিন যায় বছর যায় । মোরশেদ একাই দোকান চালায়, দোকানের আয় দিয়েই সংসার চালায় । আয়-ব্যয়ের হিসাব ও তার কাছে । খালেদ কদাচিৎ দোকানের খোজ খবর নেয়, তবে দোকান থেকে কোন টাকা পয়সা নেয়না । টিউশনী করেই সংসার চালায় ।
একদিন হঠাৎ খালেদের নজর পড়ে সাইবোর্ডের উপর । দেখে সাইবোর্ড খালেদের নাম মুছে মোরশেদের একার নামে সাইনবোর্ড বানানো হয়েছে । খালেদের মাথায় যেন বাজ পড়ল । মোরশেদকে সে জিজ্ঞেস করল, ভাই দোকান কি আপনার একার নামেই নিয়ে নিলেন । জবাবে মোরশেদ বলল, হ্যাঁ । এতটুকু দোকান, তাতে কি দুটো সংসার চলে?
মোরশেদকে খালেদ সাহেব এতটাই বিশ্বস্ত বন্ধু মনে করত যে রাতের অন্ধকারে কোন স্বাক্ষী ছাড়াই কোটি টাকা তার তাতে তুলে দিতেও খালেদ এতটুকুও ভাবনা হত না । সেই মোরশেদ একার সিদ্ধান্তে দোকানের সাইনবোর্ড পল্টালো আর একক সিদ্ধান্তে একা মালিক বনে গেল, নিজকে বিশ্বাস করতে পারছিলনা খালেদ । খুব কষ্ট করে নিজকে সংবরন করে কোন কথা না বলে চলে গেল । বাহ্যিক ভাবে সে মোরশেদের সাথে বন্ধুত্ব আর দ্বীনী সম্পর্ক অক্ষুন্ন রেখে চলল আর ভিতরে ভিতরে তুষের আগুনে দগ্ধ হচ্ছিল । মোরশেদ এমন কাজ করতে পারে তা সে যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলনা ।
দিন যায়, মাস যায় মোরশেদের দোকানের উন্নতি হয়না । পাইকারী দোকানে বাকী বাড়তে থাকে আর দোকানের মাল কমতে থাকে । খালেদ দোকানের পাশ দিয়ে প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আসা যাওয়া করে । যখনই দোকানের সাইনবোর্ডের উপর তার নজর পড়ে তখনই তার কলজেটা যেন পুড়ে যায় ।
খালেদ টিউশনী করে কিছু টাকা সঞ্চয় করে একটুকরা জমি কেনার সিদ্ধান্ত নেয় । জমি ঠিক করে মোরশেদের কাছে দেয়া দোকানের অংশের টাকা ফেরত নিয়ে আর সঞ্চয়ী টাকা মিলিয়ে ৭.৭৫ শতক জমি ক্রয় করে । কিছুদিন পরে খালেদ নিজের টিউশনী থেকে আয় আর বিশিষ্ট কিছু বন্ধুদের কাছ থেকে ধার করে দুই ইউনিটের টিন শেড ঘর তৈরীর কাজে হাত দেয়, উদ্দেশ্য হল এক ইউনিটে নিজে থাকবে, আর অন্যটা ভাড়া দিয়ে ধার শোধ করবে ।
বাড়ীর কাজ শেষ করার পূর্বেই খালেদের চাকুরী হয় ঢাকার একটা প্রতিষ্টিত বড় বেসরকারী ব্যাংকে । মাঝে মাঝে ঢাকা থেকে এসে বাড়ীর কাজ শেষ করে ভাড়া দিয়ে সে তল্পীতল্পাসহ চলে যায় রাজধানীতে, ফেলেযায় একরাশ দীর্ঘশ্বাস, এম কে ট্রডার্স ।
দিন যায়, মাস যায়, বছর যায়, খালেদের ব্যাংকের চাকুরীতে উন্নতি হয় । ব্যাংকের হাউস বিল্ডিং ফাইন্যানসিং এর আওতায় রাজধানীতে ৫তলা একটি ভবন ক্রয় করে । এক তলায় নিজে থাকে, অন্য তলাগুলো ভাড়া দেয় । ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করার পরেও মাসে নীট আয় থাকে মাসে ৩০-৩৫ হাজার টাকা ।
আর মোরশেদ সাহেব! ব্যাবসায়ে আয়ে সংসার চলে না । আগের বড় দোকান ছেড়ে দিয়ে একটা ছোট দোকান ভাড়া নেয় । একদিন খালেদ সাহেব মোরশেদ সাহেবের সাথে দেখা হলে সার্বিক অবস্থার খোঁজ খবর জিজ্ঞেস করেন । মোরশেদ সাহেব বললেন, ভাই খুব সমষ্যায় আছি । দোকানে যা আয় হয় তাতে সংসার চলে না । পুঁজি খেয়ে শেষ করে ফেলেছি । এখন একটি এনজিও থেকে সুদে টাকা এনে কোন ভাবে দোকান চালিয়ে রেখেছি । দোকানে সময় বেশী দেয়ার কারনে মাঝে মাঝে মসজিদে যেতে পারিনি, তাই ইমামতির চাকরীটাও চলে গিয়েছে, বাসাটাও তাই ছাড়তে হয়েছে । পরিবারবর্গকে গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছি । দোয়া করবেন ।
খালেদ সাহেব শুনছিলেন, মুখে তার বলার মত কোন ভাষা ছিল না । মনের কানে শুনছিলেন কয়েক বছর আগের বলা কথা ”ভাই দোকান কি আপনার একার নামেই নিয়ে নিলেন”-------- -’” হ্যাঁ, এতটুকু দোকান, তাতে কি দুটো সংসার চলে?”
কিছুদিন পরে খালেদ সাহেব জানতে পারলেন, মোরশেদ সাহেব দোকান ছেড়ে দিয়ে নিজেও গ্রামের বাড়িতে গিয়ে কৃষি কাজে মনোনিবেশ করছেন । শত চেষ্টা করেও খালেদ সাহেব তার সেই বিশ্বস্ত বন্ধুটির ভাল মন্দের খোঁজ খবর নিতে পারলেন না ।
বিষয়: বিবিধ
১৬৯২ বার পঠিত, ১৩ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
মন্তব্য করতে লগইন করুন