যাকাতুল ফিতর

লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২৭ জুলাই, ২০১৪, ১১:৩২:২৭ রাত

প্রশ্ন ১ : ফিতরা কি ?

উত্তর : রামাদান মাসের সিয়ামের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্থকে খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সলাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে- শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতর বা ফিতরা বলা হয়ে থাকে।

প্রশ্ন ২ : ফিতরা প্রদানের হুকুম কি?

উত্তর : ফিতরা দেয়া ওয়াজিব।

প্রশ্ন ৩ : কোন ব্যক্তির উপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব?

উত্তর : প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন, ধনী-গরীব সকলের উপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। প্রশ্ন ৪ : কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হয়?

উ: ঈদের দিন যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়ে অতিরিক্ত আরো ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট খাবার মওজুদ থাকে তাহলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের সকল সদস্যদের উপর ফিতরা প্রদান ওয়াজিব হয়ে যাবে।

(ক) আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাধীন, কৃতদাস, নারী, পুরুষ, ছোট, বড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমাযানের সিয়ামের কারণে এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ যব ফিতরা হিসেবে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। (বুখারী ও মুসলিম)

(খ) আহমাদের একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আবূ হুরাইরাহ রাদিআল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক স্বাধীন, পরাধীন, নারী, পুরুষ ছোট, বড়, ফকীর- ধনী, প্রত্যেকের উপর জনপ্রতি এক সা‘আ (২ কেজি ৪০ গ্রাম) পরিমাণ খেজুর ফিতরা হিসেবে দান করা ওয়াজিব। তবে ইমাম আবূ হানীফার (রহ.) মতে ঈদের দিন যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অর্থাৎ ঐদিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে যার ঘরে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমপরিমাণ নগদ অর্থ থাকবে শুধু ঐ পরিবারের উপর ফিতরা দেয়া ওয়াজিব হবে।

প্রশ্ন ৫ : যে দরিদ্র ব্যক্তি ফিতরা গ্রহণ করবে সেও কি তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ফিতরা প্রদান করবে?

উত্তর : না, দিবে না।

প্রশ্ন ৬ : ফিতরা কাকে দিব?

উত্তর : যারা যাকাত খেতে পারে তাদেরকেই ফিতরা দেবেন।

প্রশ্ন ৭ : একাধিক লোকের ফিতরা কি একজন দরিদ্রকে দেয়া জায়েয?

উত্তর : হা, তা জায়েয। অপরদিকে এক ব্যক্তির ফিতরা ভাগ করে একাধিক লোককে দেয়াও জায়েয আছে।

প্রশ্ন ৮ : ফিতরা হিসেবে কী ধরনের খাদ্য দ্রব্য দেয়ার বিধান আছে?

উত্তর : গম, ভুট্টা, যব, খেজুর, কিসমিস, পনির, আটা, চাউল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য।

প্রশ্ন ৯ : প্রতি একজনের উপর কী পরিমাণ ফিতরা দেয়া ওয়াজিব?

উত্তর : এক সা‘আ পরিমাণ।

আলেমদের মতে সা‘আর সমপরিমাণ হল ২ কেজি ৪০ গ্রাম। (ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাদিআল্লাহু আনহু বলেছেন যে, আমরা ফিতরা দিতাম মাথাপিছু এক সা‘আ পরিমাণ খাদ্য বা এক সা‘আ যব বা এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ পনির বা এক সা‘আ কিসমিস। (বুখারী ও মুসলিম) (খ) নাসাঈর অন্য এক হাদীসে আছে ফিতরা হচ্ছে এক সা‘আ পরিমাণ খাদ্যবস্তু। এ মাসআলাটি মতবিরোধপূর্ণ।

ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) বলেছেন, ফিতরার পরিমাণ অর্ধেক সা অর্থাৎ ১ কেজি ২০ গ্রাম খাদ্য দ্রব্য। উলামায়ে কিরাম অনেক যাচাই বাছাই করে দেখেছেন যে, অর্ধেক সা এর পক্ষের অধিকাংশ হাদীসই দূর্বল। সে কারণে সক্ষম ব্যক্তিদের এক সা‘ পরিমাণ ফিতরা প্রদান করাই উত্তম ।

প্রশ্ন ১০ : খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে এর বদলে টাকা পয়সা দিয়ে কি ফিতরা আদায় হবে?

উত্তর : মালিকী, শাফেয়ী, ও হাম্বালী এ তিন মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন, যেহেতু হাদীসে খাদ্য দ্রব্য দান করতে বলা হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে ফিতরা আদায় হবে না। কিন্তু কিয়াসের আলোকে হানাফী মাযহাবে আদায় হবে বলেছেন। বিবেকের বিশ্লষণে আপনি যে কোন একটা মত গ্রহণ করতে পারেন।

প্রশ্ন ১১ : ফিতরা কোন সময় প্রদান করব?

উত্তর : ফিতরা দেয়ার দু’টি সয়য় আছে : একটি হল উত্তম সময়, অন্যটি হল বৈধ সময়। উত্তম সময় হল ঈদের দিন

ঈদের সলাত আদায় করার পূর্বে ফিতরা প্রদান শেষ করা। আর জায়েয সময় হল ঈদের দু’এক দিন আগেই ফিতরা প্রদান করে ফেলা। ইবনু ‘উমার বলেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের ঈদের সালাত আদায় করার আগেই

ফিতরা দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। (মুসলিম)

প্রশ্ন ১২ : ফিতরা প্রদানের ওয়াজিব সময় কখন শুরু হয়?

উত্তর : ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।

প্রশ্ন ১৩ : যদি কোন ব্যক্তি ঈদের সলাত আদায়ের পর ফিতরা প্রদান করে তাহলে কি তা আদায় হবে? উ: সালাত আদায়ের

পূর্বে হলে তা ফিৎরা হিসেব হবে। আর সালাতের পর হলে তা হবে সাধারণ দান। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাস কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্র

এবং গরীব মিসকীনদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিতরা প্রদান করাকে ওয়াজিব করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা ফিতরা হিসেবে কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের সালাতের পর দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিতরা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবূ দাউদ,

ইবনে মাজাহ)

প্রশ্ন ১৪ : ঈদের দিন সূর্যোদয়ের আগে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তার কি কোন ফিতরা দেয়া লাগবে?

উত্তর : হা, লাগবে। তবে সেদিন সূর্যোদয়ের পর ভূমিষ্ট হলে ফিতরা দেয়া লাগবে না তবে দিয়ে দিলে সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ ইন্তেকাল করলে তার ফিতরা দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন সূর্যাস্তের পর

মারা গেলে তার পক্ষে ফিতরা দিতে হবে। কারণ ফিতরা প্রদানের ওয়াজিব সময় শুরু হয় ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।

প্রশ্ন ১৫ঃ রোযার ফিতরা কখন থেকে শুরু হয়?

উত্তরঃ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রাঃ) হতে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত রাসূলে কারীম (সাঃ) রামাদান মাসের রোযার ফিতরা এক সা পরিমাণ শুষ্ক খেজুর কিংবা এক সা পরিমাণ যব মুসলমান সমাজের প্রত্যেক স্বাধীন, মুক্ত কিংবা দাস পুরুষ কিংবা স্ত্রীলোকের উপর ফরয করে দিয়েছেন। মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ হাদীসটিতে রামাদান মাসের রোযার ফিতরা সম্পর্কে বলা হয়েছে। শরীয়াতের দৃষ্টিতে ফিতরা বলা হয় এমন পরিমাণ অর্থ বা সম্পদকে যারা যাকাত গ্রহণ করতে পারে এমন গরীব ব্যক্তিকে বিশেষ পদ্ধতিতে দেয়া হয়। হিজরতের দ্বিতীয় বছর ঈদুল ফিতরের দুই দিন পূর্বে ইসলামী সমাজে এই ফিতরা সর্বপ্রথম বাধ্যতামূলকভাবে ধার্য ও প্রচলন করা হয়। কাইম ইবনে সা’দ বলেছেন, যাকাত ফরয হয়, কিন্তু সাদকায়ে ফিতর সম্পর্কে নতুন কিছু বলা হয় নাই। কিন্তু তাতে একথা প্রমাণিত হয় না যে, যাকাত ফরয হওয়ার পর রোযার ফিতরা দিতে হবে না। রবং ইহা বাধ্যবাধকতা পূর্বের মতই চালু থাকার কথা ইহা হতে প্রমাণিত হয়। অর্থাৎ সদকায়ে ফিতর পূর্বে যেমন ওয়াজিব ছিল, তেমনি ওয়াজিব থেকে গেল। হাদীসের ভাষা হলঃ ফরয করে দিয়েছেন। অর্থাৎ ধার্য করেছেন, বাধ্যতামূলক করেছেন ও ওয়াজিব করে দিয়েছেন। এই দৃষ্টিতে ফিতরা যাকাত সমতুল্য। এ দু’টি একই উৎস হতে ধার্য হয়েছে এবং উভয়ের অর্থনৈতিক ফায়দা অভিন্ন। কেননা উহা আল্লাহর ধার্য করা ফরয যাকাতের মতই। বস্তুত ফিতরা আদায় করার কর্তব্য সম্পর্কে ইসলামী শরীয়াতে পূর্ণ ঐক্যমত্য বা ইজমা রয়েছে। এতে কারও কোন দ্বিমত নেই। ইমাম মালিক ও ইমাম শাফেয়ীর মাযহাব অনুযায়ী ইহা সুন্নাত-সুন্নাতে মুয়াক্কিদা- ওয়াজিব বা ফরয নয়। তাহাদের মতে আলোচ্য হাদীসের শব্দ ‘ফরয করেছেন, কথাটির অর্থ হল পরিমাণ নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, কিংবা ধার্য করে দিয়েছেন। ইমাম আবু হানীফা (র) মাযহাবে ইহা ফরয নয় -ফরয বলতে যা বুঝায় তা নয় বরং ইহা ওয়াজিব। হানাফী মাযহাবে ফরয ও ওয়াজিব শব্দ দু’টির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে।

হাদীসের ভাষা হইল ‘যাকাতুল ফিতর’ অর্থাৎ রোযা খোলা যাকাত। রোযা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইহা আদায় করা ওয়াজিব হয়ে যায়। ইহাকেই ‘সদাকায়ে ফিতর’ বলা হয়। এ দু’টি শব্দের অর্থ একই। ইহা স্বাধীন মুক্ত পুরুষ, স্ত্রী ও ক্রীতদাস নির্বিশেষে সব মুসলমানের উপর ওয়াজিব। ‘ক্রীতদাস’ কথাটি এখানে তদানীন্তন আরব সমাজের প্রেক্ষিতে বলা হয়েছে। বর্তমান স্থায়ী গৃহভৃত্য ইহার স্থলে গণ্য হবে এবং বাড়ীর কর্তাকে তার ফিতরাও আদায় করতে হবে। মুসলিম শরীফের হাদীসে বলা হয়েছে, ক্রীতদাসের জন্য মনিবকে ফিতর ছাড়া অন্য কোন সদকা দিতে হয় না।

‘সদকায়ে ফিতর’ মুসলমান মাত্রেরই আদায় করা কর্তব্য। পুরুষদের ব্যাপারে তো কোন অস্পষ্টতা নাই। মেয়েলোক বিবাহিতা হলে স্বামীই তার সদকায়ে ফিতর আদায় করবে। অবিবাহিতা হলেও তার নিজের সামর্থ্য থাকলে সে নিজে আদায় করবে। অন্যথায় তার এবং অন্যান্য না বালেগদের ফিতরা আদায় করবে তার পিতা, অলী বা অভিভাবক। অবশ্য যার পক্ষে যাকাত গ্রহণ জায়েয ও হালাল, তার পক্ষে ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, ফকীর গরীবের পক্ষেও ফিতরা দেয়া ওয়াজিব। সে যাহা দিবে আল্লাহ তাকে তার দেয়া পরিমাণের বেশী ফিরাইয়া দিবেন। কিন্তু ইহা বাধ্যবাধকতামূলক নয়; বরং স্বেচ্ছামূলক ও অধিক সওয়াব পাওয়ার আশায় বান্দার আত্মোৎসর্গের ব্যাপার।

ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব এমন মুসলমানের পক্ষে, যে নিজে রোযা রেখেছে। উহার পরিমাণ হাদীসে বলা হয়েছে এক সা’- সা’ একটা বিশেষ পরিমাণের ওজন। এক সা’ ওজনে চার মুদ্দ হয়। সা’ দ্ইু ধরণের, একটি হিজাযী আর অপরটি ইরাকী। হিজাযী সা’র ওজন ৫ রতল এবং এক ইরাকী সা’ ৮ রতল। এক রতল আমাদের দেশী ওজনে প্রায় অর্ধসের। অতএব এক হিজাযী সা’ আমাদের দেশে চলতি ওজনে প্রায় পৌনে তিনসের। আর ইরাকী সা’র ওজনে প্রায় ৪ সের। এই ওজনের খাদ্যশস্য কিংবা উহার বিক্রয় মূল্যই দেয়া। সা’র ওজন বিভিন্ন হওয়ায় ফিতরার পরিমাণে কিছুটা মতভেদ হয়েছে। বাংলাদেশের মুফতী সাহেবদের ফিতরা সংক্রান্ত ফতোয়ার ভিত্তিতে এদেশের মুসলমানদের ফিতরা আদায় করতে হবে।

(সংগৃহীত)

বিষয়: বিবিধ

১৫৯৫ বার পঠিত, ৩ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

248947
২৮ জুলাই ২০১৪ রাত ০২:০৬
সন্ধাতারা লিখেছেন : Jajakalla for nice sharing
248967
২৮ জুলাই ২০১৪ রাত ০৪:৫৬
বাজলবী লিখেছেন : জাযাকাল্লাহ খাইর।
248989
২৮ জুলাই ২০১৪ সকাল ০৯:৫৫
ব১কলম লিখেছেন : Jajakalla khairan for sharing

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File