ধর্মীয় চরমপন্থা ও তার কারণ
লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৪, ১০:০৭:২৯ রাত
ধর্মীয় চরমপন্থা ও তার কারণ
আক্ষরিক অর্থে, উগ্রতাবাদ বা চরমপন্থার অর্থ হচ্ছে কেন্দ্র থেকে সম্ভাব্য সর্বশেষ প্রান্তে অবস্থান ৷ বাহ্যতঃ এটা ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, চিন্তাধারা তথা আচার-আচরণের ক্ষেত্রে অনুরূপ দূরত্বে অবস্থানের দিকেই অঙ্গুলি নির্দেশ করে ৷ চরমপন্থার একটি অন্যতম পরিণাম হচ্ছে এটি সমাজকে বিপজ্জনক ও নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয় ৷ অথচ ঈমান, ইবাদত, আচার-আচরণ, আইন-বিধি তথা জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলাম মধ্যম সুষমপন্থা অবলম্বনের সুপারিশ করেছে ৷ এটাকেই আল্লাহ তায়ালা ‘সিরাতুল মুস্তাকীম’ বা সহজ সরল পথ বলে উল্লেখ করেছেন ৷ এ পথের একটি সুনির্দিষ্ট ও সুষ্পষ্ট বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর বিপরীত যতো মত পথ রয়েছে তার অনুসারীরা আল্লাহর গযবে পতিত হয়েছে ।
আল্লাহ বলেন- “এমনিভাবে আমরা তোমাদেরকে একটি মধ্যপন্থী উম্মাহ হিসেবে সৃজন করেছি যাতে তোমরা মানব জাতীর জন্যে সাক্ষী হবে আর রাসূল (সা) তোমাদের জন্যে সাক্ষী হবেন ৷” (২: ১৪৩)
এই দৃষ্টিতে,মুসলিম উম্মাহ একটি সুবিচারপূর্ণ ও ভারসাম্যপূর্ণ পন্থার পথিক ৷ একইভাবে এই জাতি ইহলৌকিক ও পরলৌকিক জীবনে সরল পথ থেকে মানুষের প্রতিটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে সাক্ষী ৷ ইসলামে এমন কিছু পরিভাষা রয়েছে যাতে মধ্যপন্থা অবলম্বনের এবং সব ধরনের চরমপন্থা ও হঠকারিতা প্রত্যাখ্যান ও পরিহারের আহবান জানানো হয়েছে ৷ যেমন গুলু (বাড়াবাড়ি), তানাতু (উগ্রতা) ও তাশদীদ (কঠোরতা) -এই পরিভাষাগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসলাম বাড়াবাড়িকে শুধু নিরুৎসাহিত করেনি বরং এর বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছে ৷ নিম্নোক্ত হাদীসগুলোতে এর সত্যতা পাওয়া যায় ৷
১. “ধর্মে বাড়াবাড়ি সম্পর্কে সাবধান! তোমাদের পূর্ববর্তী (জাতিগোষ্ঠি) এরূপ বাড়াবাড়ির পরিণামে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৷” (আহমাদ, নাসাই ও ইবনে মাজাহ) এখানে জাতি বলতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী জাতিগোষ্ঠিকে বোঝানো হয়েছে ৷” এর মধ্যে আহলে কিতাব বিশেষত খ্রীষ্টানরা উল্লেখযোগ্য ৷ এদেরকে সম্বোধন করে আল-কুরআন বলছে: “আপনি বলুন, হে আহলে কিতাব! তোমরা তোমাদের দ্বীন সম্বন্ধে অন্যায় বাড়াবাড়ি করো না; এবং যে-সম্প্রদায় অতীতে বিপথগামী হয়েছে এবং অনেককে বিপথগামী করেছে এবং সরল পথ থেকে বিচ্যুত হয়েছে তাদের স্বেচ্ছাচারিতার অনুসরণ করো না” ৷ (৫:৭৭)
২. “তারা অভিশপ্ত, যারা চুল ফাঁড়তে (অর্থাৎ ক্ষুদ্র বিষয়ে) লিপ্ত এবং রাসুলূল্লাহ (সা) তিনবার এই কথা উচ্চারণ করলেন ৷”(মুসলিম, আহমাদ ও আবু দাউদ) ইমাম আননববী বলেন, “এখানে ‘চুল ফাঁড়তে’ লিপ্ত ব্যক্তিদের বলতে তাদের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যারা কথায় ও কাজে সীমা অতিক্রম করে ৷” উল্লিখিত দু’টি হাদীসে স্পষ্টত এ কথাই ব্যক্ত করা হয়েছে যে, বাড়াবাড়ি ও হঠকারিতার পরিণামে মানুষ সম্পূর্ণরূপে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক ক্ষতির সম্মুখীন হবে ৷
৩. রাসুলুল্লাহ (সা) বলতেন, “নিজের ওপর এমন অতিরিক্ত বোঝা চাপিও না যাতে তোমার ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থাকে ৷ তোমাদের পূর্ববর্তী জনগোষ্ঠী নিজেদের ওপর অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে ধ্বংস হয়েছে ৷ তাদের ধ্বংসাবশেষ পুরাতন মঠ-মন্দিরে খুঁজে পাওয়া যায় ৷” আবু ইয়ালা তার মসনদে, আনাস ইবনে মালিকের বরাতে এবং ইবনে কাছীর সূরা হাদীদের ২৭ আয়াতের তাফসীরে এই হাদীস উল্লেখ করেছেন ৷ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা) সর্বদা ধর্মীয় বাড়াবাড়ির প্রবণতাকে প্রতিহত করতে চেয়েছেন ৷ তিনি তাঁর সাহাবীদের মধ্যে যাদেরকে ইবাদত-বন্দেগীতে বাড়াবাড়ি করতে দেখেছেন, সংসার ধর্ম পালনে বিমুখ দেখেছেন তাদেরকে প্রকাশ্যে ভৎর্সনা করেছেন ৷ কারণ এসবই হচ্ছে ইসলামের মধ্যপন্থার পরিপন্থী ৷ ইসলাম দেহ ও আত্মার সুষম বিকাশ চায় অর্থাৎ মানুষের পূর্ণরূপে বেঁচে থাকার অধিকার এবং স্রষ্টাকে উপাসনা করার অধিকারের মধ্যে সমন্বয় চায় ৷ মানুষের অস্তিত্বের যৌক্তিকতা এখানেই ৷
চরমপন্থার লক্ষণঃ
1. চরমপন্থার প্রথম লক্ষণ হচ্ছে অন্ধতা ৷ চরমপন্থী বা গোঁড়া ব্যক্তি নিজের মতের প্রতি একগুঁয়ে ও অসহিষ্ণুর মতো এমন অটল থাকে যে, কোনো যুক্তিই তাকে টলাতে পারে না ৷ অন্য মানুষের স্বার্থ, আইনের উদ্দেশ্য ও যুগের অবস্থা সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা থাকে না ৷ তারা অন্যের সাথে আলোচনায়ও রাজী হয় না যাতে তাদের মতামত অন্যের মতামতের সাথে তুলনামূলক পর্যালোচনা করা যায় ৷ তাদের বিবেচনায় যা ভাল হয় কেবল তা অনুসরণেই তারা প্রবৃত্ত হয় ৷ যারা অন্যের মতামত দাবিয়ে রাখা ও উপেক্ষা করার চেষ্টা চালায় এবং যারা এর জন্য তাদেরকে অভিযুক্ত করে, আমরা উভয়কেই সমভাবে নিন্দা করি ৷ বস্তুতপক্ষে যারা নিজেদের মতকেই কেবল নির্ভেজাল বিশুদ্ধ এবং অন্যদেরকে ভ্রান্ত বলে মনে করে তাদেরকে কঠোরভাবে নিন্দা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই বিশেষ করে তখন, যখন তারা কেবল ভিন্নমতের জন্যে প্রতিপক্ষকে জাহিল, স্বার্থান্বেষী, অবাধ্য তথা ফিসকের অভিযোগে অভিযুক্ত করে ৷ তাদের আচরণে মনে হবে যেন তারাই নির্ভেজাল, খাঁটি বিশুদ্ধ এবং তাদের প্রতিটি কথাই যেন ওহী বা এলহাম! এ ধরণের একগুঁয়ে দৃষ্টিভঙ্গি উম্মাহর ইজমার পরিপন্থী ৷ কেবলমাত্র কুরআন ও সুন্নাহ ছাড়া অন্য যে কোনো ব্যক্তির যে কোনো মত গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে ৷ এটাই উম্মাহর সর্ববাদী সম্মত রায় ৷ কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কিছু লোক বিভিন্ন জটিল বিষয়ে নিজেদের ইজতিহাদের অধিকার প্রয়োগ করে খেয়ালখুশী মতো রায় দিয়ে থাকেন ৷ কিন্তু সমকালীন বিশেষজ্ঞ আলিমদেরকে একক বা যৌথভাবে ইজতিহাদের অধিকার প্রয়োগ করতে দেখলে তারা বেজায় নাখোশ হন ৷ অথচ ঐ সব ব্যক্তি কুরআন ও সুন্নাহর এমন হাস্যকর ব্যাখ্যা দেন যা আমাদের পূর্বপুরুষ বুজুর্গানে দ্বীন এবং সমসাময়িক আলিমদের রায় বা সিদ্ধান্তের পরিপন্থী ৷
2. চরমপন্থার দ্বিতীয় পরিচয় হচ্ছে, সর্বক্ষণ বাড়াবাড়ি করার নীতিতে অটল থাকা এবং সমঝোতার যুক্তিসঙ্গত কারণ থাকা সত্ত্বেও অন্যকে তার মতো আচরণে বাধ্য করতে প্রয়াসী হওয়া যদিও তার কাজটি আল্লাহর বিধানসম্মত নয় ৷ তাকওয়া ও সতর্কতার কারণেও এক ব্যক্তি ইচ্ছা করলে কোনো কোনো বিষয়ে কখনো কখনো কঠোর মত পোষণ করতে পারে ৷ কিন্তু এটা এমন অভ্যাসে পরিণত হওয়া উচিত নয় যাতে সে যেখানে প্রয়োজন এমন ক্ষেত্রেও সহজ সরল বিষয়গুলো পরিহার করে ৷ এরুপ দৃষ্টিভঙ্গি কুরআন ও হাদীসের শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় ৷ আল্লাহ বলেন: “আল্লাহ তোমাদের জন্যে যা সহজ তা চান, যা তোমাদের জন্যে ক্লেশকর তা চান না ৷” (২:১৮৫)
আল্লাহ রাসূলও (সা.) হাদীসে বলেছেন: “(ধর্মীয় বিষয়গুলো) সহজ করে তুলে ধরো কঠিন করো না ৷” (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)
তিনি আরো বলেছেন : “তাঁর প্রদত্ত সুবিধা ভোগ করলে আল্লাহ খুশী হন যেমন (লোকেরা) তাঁর অবাধ্য হলে তিনি নারাজ হন ৷” (আহমাদ, বায়হাকী ও তাবারানী) এছাড়া রেওয়ায়েত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা) কে যখনি দু’টি কাজের মধ্যে একটি বেছে নিতে বলা হয়েছে, গর্হিত না হলে তিনি সহজতম পথটিই সর্বদা বেছে নিয়েছেন ৷” (বুখারী ও তিরমিযী)
3. চরমপন্থার আরেকটি লক্ষন হচ্ছে নির্দয় কঠোরতা ৷ চরমপন্থীদের স্থানকালের বিবেচনা জ্ঞান নেই ৷ নও-মুসলিমদের প্রতি অন্তত প্রাথমিক অবস্থায় নম্র আচরণ করা উচিত-সেই নও-মুসলিম মুসলিম অথবা অমুসলিম যে দেশেরই হোক ৷ এমনকি ধর্মের প্রতি সদ্য অনুরক্ত মুসলমানদের প্রতিও সহৃদয় দৃষ্টি দেয়া দরকার ৷ নব দীক্ষিত মুসলমানদের প্রথমেই ছোটখাট বিষয়গুলো মানতে বাধ্য করানো উচিত নয় ৷ প্রথমে তাদেরকে মৌলিক বিষয়গুলো বোঝার সুযোগ দিতে হবে ৷ তাদের ধ্যান-ধারণা, চিন্তাধারা ইসলামের আলোকে সংশোধনের চেষ্টা করতে হবে ৷ একবার তাদের মনে ঈমানের চেতনা বদ্ধমূল হয়ে গেলেই ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ এবং ক্রমান্বয়ে বাস্তব জীবনে আল্লাহর বিধি বিধান রূপায়ণের তাগিদ সৃষ্টি করতে হবে ৷ রাসূলুল্লাহ (সা)-এর জীবন থেকে আমরা এর সত্যতা খুঁজে পাই ৷ হযরত মুয়ায (রা) কে ইয়ামেনে পাঠানোর সময় হযরত মুহাম্মদ (সা) বলেছিলেন, “তুমি আহলে কিতাবের একটি জনগোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছ ৷ সেখানে পৌঁছে তাদেরকে এই সাক্ষ্য দিতে বলবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বুদ নেই ৷ এবং হযরত মুহাম্মদ (সা) তাঁর প্রেরিত রাসূল ৷ যদি তারা এটা মেনে নেয় তখন তাদেরকে বলবে যে, আল্লাহ দিনে রাতে পাঁচ বার নামায আদায়ের নির্দেশ দিয়েছেন ৷ তারপর বলবে যে, আল্লাহ তোমাদের মধ্যে ধনীদের কাছ থেকে যাকাত আদায় করে গরীবদের মধ্যে বন্টনের আদেশ দিয়েছেন ৷ ........ (সকল প্রামাণ্য সূত্রে সমর্থিত)
4. গোঁড়ামির চতুর্থ লক্ষণ হচ্ছে, মানুষের প্রতি আচার-আচরণে অশিষ্টতা, উপস্থাপনায় স্থুলতা এবং দাওয়াতী কাজে গোবেচারা ভাব ৷ এসবই হচ্ছে কুরআন ও সুন্নাহর শিক্ষার সাথে সঙ্গতিহীন ৷ আল্লাহ তায়ালা কুশলী ও মধুর ভাষায় ইসলামের প্রতি মানুষকে আহবান করার আদেশ দিয়েছেন: “হিকমতের সাথে ও সদুপদেশ দ্বারা তোমার প্রভুর দিকে (মানুষকে) আহবান জানাও এবং সদ্ভাবে (উৎকৃষ্টতম ও সুবিবেচনা প্রসূত পন্থায়) তাদের সাথে আলোচনা করো ৷”(১৬:১২৫)
রাসূলুল্লাহ (সা)-এর প্রসঙ্গ টেনে কুরআন বলছে: “এখন তোমাদের কাছে তোমাদের মধ্য থেকে একজন রাসূল এসেছেন ৷ তোমাদেরকে যা বিপন্ন করে তা তার জন্যে বেদনাদায়ক, তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, ঈমানদারদের প্রতি তিনি দয়াময় ও করুণাশীল ৷” (৯:১২৮ ৷
আল কুরআনুল কারীমে সাহাবীদের সাথে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সম্পর্কের রূপ বর্ণনা করে বলা হয়েছে: “আল্লাহর রহমতে আপনি তাদের প্রতি কোমল হৃদয় হয়েছিলেন, আপনি যদি কর্কশ ও কঠোর হৃদয়ের হতেন তাহলে তারা আপনার কাছ থেকে সরে পড়তো ৷” (৩:১৫৯)
চরমপন্থার কারণ
১. ছোট খাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা
বুদ্ধিবৃত্তিক বন্ধাত্বের একটি লক্ষন হচ্ছে বড় বড় বিষয় উপেক্ষা করে ছোটখাট বিষয় নিয়ে মেতে থাকা ৷ অথচ বৃহৎ বিষয়গুলো এতো গুরুত্বপূর্ন যে, এগুলোর প্রতি উদাসীনতা উম্মাহর অস্তিত্ব, আশা-আকাক্ষা, পরিবেশ তথা সামগ্রিক সত্তাকে বিপন্ন করতে পারে । দাঁড়ি রাখা, গোড়ালীর নিচে পযর্ন্ত কাপড় পরা, তাশাহুদের সময় আঙ্গুল নাড়ানো, আলোকচিত্র রাখার মতো ছোটখাট বিষয়গুলো নিয়ে অবিরাম বাড়াবাড়ি চলছে ৷এমন এক সময় এসব নিয়ে হৈ চৈ করা হচ্ছে যখন মুসলিম উম্মাহ ধর্ম নিরপেক্ষবাদ , ইহুদীবাদ ও খৃষ্টবাদের নিরবচ্ছিন্ন বৈরিতা ও অনুপ্রবেশের সম্মুখীন ৷ ক্রীশ্চান মিশনরীরা মুসলমানদের ঐতিহাসিক ও ইসলামী চরিত্র ক্ষুণ্ণ করার জন্যে নতুন ক্রুসেড শুরু করেছে ৷ দুনিয়ার বিভিন্ন আংশে মুসলমানদেরকে নির্মমভাবে হত্যা করা হচ্ছে ৷ মুসলিম ধর্ম প্রচারকরা চরম ভীতি ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন ৷
ইমাম আহমদ তাঁর মসনদে বর্ণনা করছেন:
আমি ইবনে উমরের সাথে বসেছিলাম ৷ একটি লোক এসে তাকে মশার রক্ত সম্পর্কে জিজ্ঞস করলো ৷ ইবনে উমর (রা) তাকে বললেন, “তুমি কোত্থেকে এসেছ?” সে জবাব দিল, “ইরাক থেকে ৷” তখন ইবনে উমর বললেন, “দেখ লোকটির দিকে! সে আমাকে মশার রক্ত সম্পর্কে প্রশ্ন করছে, অথচ তারা (ইরাকিরা) রাসূলুল্লাহ (সা)- এর পৌত্রকে (আল-হুসাইন ইবনে আলী (রা)) হত্যা করেছে ৷ আমি রাসূলুল্লাহ (সা) - কে বলতে শুনেছি : “তারা (হাসান ও হুসাইন) এই জগতে আমার দু’টি মিষ্টি মধুর সুরভিত ফুল ৷” (আহমাদ)
২.নিষেধাজ্ঞা নিয়ে বাড়াবাড়ি
ইসলামী আইনশাস্ত্র ও শরীয়াহর জ্ঞানের অভাবে নিষেধাজ্ঞার ক্ষেত্র নিয়ে অধিক বাড়াবাড়ি দেখা যায় ৷
একদিন এক গোঁড়া লোক অপর এক ব্যক্তিকে দাঁড়িয়ে পানি পান করতে দেখে তার পাক সাফ হওয়ার জন্যে তৎক্ষণাৎ বমি করতে বলল ৷ আমি তখন গোঁড়া লোকটিকে নম্রভাবে বললাম, “এজন্য এতো কঠোর ব্যবস্থার দরকার পড়ে না ৷ এটা একটা ছোট ব্যাপার ৷” সে বলল, হাদীসে এটা স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ ৷ আর কেউ যদি ভুলক্রমে করে বসে তবে সহীহ হাদীসে বমির বিধান আছে ৷” আমি জবাব দিলাম, “কিন্তু দাঁড়িয়ে পানি খাওয়ার পক্ষে যে হাদীস আছে তা অধিক প্রমাণিত এবং বুখারীর একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম হলো, “দাড়িয়ে পানি পান করা ৷” ঐ ব্যক্তি নিষিদ্ধ হওয়ার পক্ষে কোনো হাদীসের উদ্ধৃতি দিতে পারল না ৷ অথচ এটা সত্য যে, রাসূলুল্লাহ (সা) বিদায় হজ্জের সময় দাঁড়িয়ে পানি পান করেছিলেন ৷ (বুখারী, মুসলিম)
একইভাবে, আজকাল অনেক তরুণ ইসলামী পোশাক নিয়ে জল্পনা কল্পনায় লিপ্ত ৷ হাদীসে এর দৃঢ় ভিত্তি আছে: “(পোশাকের) যে অংশ গোঁড়ালির নিচে (ঝুলে থাকে) তা আগুনে (পুড়বে) ৷” (বুখারী)
এ জন্য অনেক তরুণকে গোঁড়ালির উপরে পোশাক পরতে দেখা যায় এবং তাদের সঙ্গী-সাথীদের উপরেও এটা চাপাতে চায় ৷ কিন্তু এরূপ চাপাচাপির ফলটা এই হবে যে, একপক্ষ অপরপক্ষের বিরুদ্ধে নিশ্চিতভাবেই গোঁড়ামির অভিযোগ আনবে ৷ এটা সত্য যে, কিছু হাদীসে গোড়ালির নিচে কাপড় পরিধানের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে ৷ আবার অন্য হাদীসে এই নিষেধাজ্ঞার কারণ খুঁজে পাওয়া যায় ৷ একদা এভাবে কাপড় পরাকে অহঙ্কার, ঔদ্ধত্য ও অপচয়ের লক্ষণ মনে করা হতো ৷ দৃষ্টান্তস্বরূপ রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেন, “আল্লাহ কিয়ামতের দিনে সেই ব্যক্তির দিকে থাকবেন না যে অহঙ্কারবশতঃ তার কাপড়কে (পেছনে) টেনে নিয়ে যায় ৷” (মুসলিম)
হযরত আবু বকর (রা) রাসুলুল্লাহ (সা)-কে বললেন, “আমার ইজার অসাবধানতাবশতঃ নিচে নেমে যায় ৷” রাসূলুল্লাহ (সা) বলেন “যারা গর্বোদ্ধত হয়ে এরূপ করে তুমি তাদের মধ্যে নও ৷” (বুখারী) এ কারনে আন-নববী ও অন্যান্য মুসলিম মনীষীরা মত প্রকাশ করেছেন যে, এরূপ কাপড় পরা মাকরূহ ৷ কিন্তু মাকরূহ অনিবার্য কারণে মুবাহ হতে পারে ৷
৩. ভ্রান্ত ধারণা
ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক সম্পর্কে অগভীর জ্ঞান থেকেই মূলতঃ বিতর্কের সূত্রপাত ৷ ফলতঃ অনেকেই রূপক ও প্রকৃত অর্থের মধ্যে তারতম্য উপলদ্ধি করতে পারেন না ৷ ঈমান ও পূর্ণ ইমান, ইসলাম ও প্রকৃত ইসলাম, বিশ্বাসে মুনাফেকী ও কর্মে মুনাফিকী, ছোট ছোট শিরক ও বড় বড় শিরকের মধ্যে তারা পার্থক্য করতে অক্ষম ৷
৪. রূপকের ওপর গুরুত্ব প্রদান
বর্তমান ও অতীতে অনেক গোঁড়ামি ও ভুল বোঝাবুঝির মূল কারণ হলো স্পষ্ট ভাষণের প্রতি উপেক্ষা করে রূপক অর্থের ওপর বেশি গুরুত্ব দেয়া ৷ রূপক আয়াত হচ্ছে যেগুলোর গূঢ় অর্থ আছে ৷ আক্ষরিক অর্থই শেষ কথা নয় ৷ আর সুস্পষ্ট আয়াত হচ্ছে- পরিষ্কার স্বচ্ছ দ্ব্যর্থহীন যার অর্থ বুঝতে বেগ পেতে হয় না ৷ কুরআনুল করীম বলছে: “তিনিই তোমার কাছে এই কিতাব পাঠিয়েছেন, যার কতক আয়াত সুস্পষ্ট দ্ব্যর্থহীন; এগুলো কিতাবের মূল অংশ আর অন্যগুলো রূপক ৷ যাদের অন্তরে সত্য লংঘন প্রবণতা রয়েছে শুধু তারাই ফিত্ না এবং ভুল ব্যাখ্যার উদ্দেশ্যে যা রূপক তার অনুসরণ করে ৷ আল্লাহ্ ছাড়া অন্য কেউ এর ব্যাখ্যা জানেন না ৷” (৩:৭)
প্রাচীন বিদয়াতী ও গোঁড়া লোকেরা এই রূপক আয়াতগুলোকে চূড়ান্ত প্রমাণ বলে মনে করেছে ৷ তারা স্পষ্ট মৌলিক বক্তব্যগুলোকে উপেক্ষা করেছে ৷ বর্তমান চরমপন্থীরাও তাই করেছে ৷ বিভিন্ন বিষয়ে তারা এর আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভাল-মন্দ, শত্রু-মিত্র ও কাফির-ঈমানদার নির্ধারণ করেছে ৷ ফলে এক মারাত্মক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে ৷ সতর্ক পর্যালোচনা ও পরীক্ষা- নিরীক্ষা ছাড়া কেবল রূপক আয়াতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেয়া জ্ঞানে অগভীরতা ছাড়া আর কিছু নয় ৷ আল-খাওয়ারিজ এভাবে আত-তাকফিরের ফাঁদে পড়েছিলো ৷ তারা তো সকাল মুসলমানকে কাফির বলে মনে করতো কেবল নিজেরা ছাড়া ৷ ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়েই তারা হযরত আলীর (রা) বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল, অথচ তারা তাঁরই সহচর ও সৈনিক ছিলো ৷ তাদের মত পাথর্ক্যের মূল কারণ ছিল আমীর মুয়াবিয়ার সাথে হযরত আলীর (রা) আপোস রফা ৷ হযরত আলী (রা) সৈন্যদের সংহতি ও মুসলমানদের জীবন রক্ষার জন্যে এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন ৷ কিন্তু আল-খাওয়ারিজ কুরআনের আয়াতের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আপোস অগ্রাহ করে ৷ আয়াতটি হচ্ছে “আল্লাহ ছাড়া কারো আদেশ দেয়ার ক্ষমতা নেই ৷” (১২:৪০০)
অতএব কুরআন ও সুন্নাহকে গভীরভাবে ও সতর্কতার সাথে অনুধাবন না করলে বিপথগামী হওয়ার আশংকাই সমধিক ৷ বাড়াবাড়ি ও অগভীর জ্ঞানের ফাঁদে পড়ে আজকাল এক শ্রেণীর লোক খারিজীদের মতে শরীয়াহর তাৎপর্য সঠিকভাবে বোধগম্য না হওয়ার দরুণই এরূপ গোঁড়ামির উদ্ভব হয়ে থাকে ৷ অন্যদিকে গভীর জ্ঞানের অধিকারী লোক কখনোই হঠকরী আচরণ করতে পারে না ৷ কুরআন-হাদীস সঠিক প্রেক্ষাপটে অধ্যয়ন করলে এর সুসংলগ্ন ও সুমহান অর্থ অনুবাধন করা অসম্ভব নয় ৷ আর এর বিপরীত পন্থায় কুরআন পাঠের অর্থ হবে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর ভাষায় তাদের মতো “যারা কুরআন তিলাওয়াত করে কিন্তু অর্থ তাদের হৃদয়ে স্পর্শ করে না ৷”
“একদা একাকী বসে থাকার সময় উমর ইবনে খাত্তাব (রা) বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, যারা এক রাসূলের অনুসরণ করে এবং কিবলার দিকে মুখ করে নামায পড়ে তারা কেন মতভেদে লিপ্ত হয় ৷ উমর (রা) তখন ইবনে আব্বাস (রা)কে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “এই উম্মাহ কেন মতভেদে লিপ্ত হয় যখন তারা এক রাসূল (সা) ও এক কিবলাহ্র অনুসারী?” (সাঈদ-এর সাথে “এবং একই কিতাব” কথাটি যোগ করেছেন) ৷ ইবনে আব্বাস (রা) জবাব দিলেন: “আল-কুরআন নাযিল হয়েছে এবং আমরা তা পাঠ করে ঐশী বাণীর মর্ম উপলব্ধি করেছি ৷ কিন্তু এমন লোক আসবে যারা কুরাআন তিলাওয়াত করবে অথচ এর শানে নুযূল ও বক্তব্য বিষয় উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হবে ৷ ফলে তারা বিভিন্ন রকম ব্যাখ্যা দেবে এবং মতানৈক্যে জড়িয়ে পড়বে ৷”
ইবনে আব্বাসের (রা)-এর জবানীতে সাঈদ আরো বলেন, “প্রতিটি গ্রুপের একটি মত থাকবে, তারপর মতভেদ থেকে সংঘাত সৃষ্টি হবে ৷” কিন্তু সেখানে উপস্থিত উমর ও আলী (রা) তাঁর এই অশুভ ব্যাখ্যা পছন্দ করলেন না এবং তাকে ভৎর্সনা করলেন ৷ কিন্তু ইবনে আব্বাস (রা) চলে যাওয়া মাত্র তার মনে হলো যে, তার কথায় কিছু সত্য থাকতে পারে ৷ তিনি তাকে ডেকে পাঠালেন এবং তার কথার পুনরাবৃত্তি করতে বললেন, সতর্ক বিবেচনার পর উমর (রা) ইবনে আব্বাস (রা)-এর সাথে একমত হলেন ৷
আশ-শাতিবী লিখেছেন: ইবনে আব্বাস (রা) সঠিক ছিলেন ৷ যখন এক ব্যক্তি একটি সূরা নাযিলের কারণ জানে তখন সে এটাও বুঝতে পারে যে, এর ব্যাখ্যা ও উদ্দেশ্য কী ৷ কিন্তু এ সম্পর্কে অজ্ঞতার ফলে তারা ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে মতভেদে লিপ্ত হয় এবং তাদের মতামতের পেছনে শারীয়াহর কোনো সমর্থন না থাকায় তারা বিভ্রান্ত হয় ৷ এর একটি নযীর পাওয়া যায় ইবনে ওয়াহাবের বর্ণনায়: বাকির জিজ্ঞেস করলেন নাফিকে, “ইবনে উমর (রা) আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে কি চিন্তা করেন? (আল-খাওয়ারিজিকে আল-হারুরিয়াও বলা হয় ৷ কারণ তারা হারাওয়া নামক একটি স্থানে দেখতে পান) ৷ জবাব দিলেন, “ তিনি তাদেরকে খুব খারাপ লোক বলে মনে করেন ৷ কুফফার সংক্রান্ত আয়াত তারা ঈমানদারদের ওপর প্রযোজ্য করে ৷” সাঈদ এই বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন, আল-খাওয়ারিজ যেসব রূপক আয়াতের অপব্যাখ্যা দেয় তাদের মধ্যে রয়েছে: “আল্লাহ যা অবতীর্ণ করেছেন তদনুসারে যারা বিধান দেয় না তারাই সত্য প্রত্যাখ্যানকারী ৷” (৫:৪৪) এর সাথে তারা জুড়ে দেয় এই আয়াতটি, তথাপি কাফেররা স্বীয় পালনকর্তার সংগে অন্যকে সমতুল্য করে ৷ (৬:১)
সুতরাং তারা এই উপসংহার টানে যে, কোনো শাসক যদি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন না করে সে কুফরী করে ৷ আর যে কুফরী করলো সে অন্যকে আল্লাহর সাথে শরীক করলো ৷ অতএব সে শিরক করলো ৷ আর এই ভুল বিচারের ভিত্তিতে তারা অন্যকে মুশরিকুন বলে ঘোষণা করে, তাদের সাথে যুদ্ধ করে এবং হত্যা করে ৷ আবনে আব্বাস (রা) এই ধরনের অপব্যাখ্যা ও ভ্রান্ত ধারণার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছিলেন ৷ আর এর উৎপত্তি হয় ওহীর অর্থ বুঝতে অক্ষমতার দারুন ৷
নাফি বলেন, যখনি ইবনে উমর (রা)-কে আল-হারুরিয়াদের সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হতো তিনি বলতেন: “তারা মুসলমানদেরকে কুফফার ঘোষণা করে, তাদের রক্তপাত ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্তির অনুমোদন কের; তারা নারীর ইদ্দাহর সময় তাকে বিয়ে করে এবং স্বামীর বর্তমানে বিবাহিত মেয়েদের বিয়ে করে ৷ আমি জানি না তাদের চেয়ে আর কে আছে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা যায় ৷” (শাতিবী, আলইতিসাম)
৫. বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজনীয়তা
চরমপন্থীদের জ্ঞানের অগভীরতার আরেকটি লক্ষণ হচ্ছে তারা ভিন্ন মতাবলম্বীর কথা শুনতে মোটেও রাজী থাকে না কিংবা কোনোরকম আলোচনায় বসতে চায় না ৷ তাদের অর্থাৎ গোঁড়াদের মত যে অন্যের মতের আলোকে বিশ্লেষণ করে গ্রহণ বা বর্জন করা যেতে পারে তাও তারা স্বীকার করে না ৷ তারা বিশেষজ্ঞ আলিমদের কাছ থেকে কোনো শিক্ষা পায়নি ৷ বই-পুস্তক, সংবাদপত্র ইত্যাদি হচ্ছে তাদের স্বল্প জ্ঞানের একমাত্র উৎস ৷ এগুলো আলোচনা পর্যালোচনার সুযোগও পায় না ৷ ফলে তারা যা পড়ে তা থেকে ইচ্ছামতো সিদ্ধান্তে পৌঁছে ৷ সুতরাং তাদের পড়া ও সিদ্ধান্তে যে ভুল হবে তাতে আর সন্দেহ কী! কেউ কোথাও কখনো তাদের মতো যুক্তিপূর্ণ সমালোচনা করলেও এগুলোর প্রতি কেউ তাদে দৃষ্টি আকর্ষণ করে না ৷ আশ-শারিয়াহ বুঝতে হলে যে নির্ভরযোগ্য আলিমদের শরণাপন্ন হওয়া উচিত সে প্রয়োজনীয়তাও তারা স্বীকার করে না ৷ কোনো মুসলিম তরুণ যদি একা একা এরূপ প্রচেষ্টা চালায় তবে তা হবে আনাড়ি সাঁতারুর মতো গভীর পানিতে ঝাঁপ দেয়া ৷ বিশেষজ্ঞদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছাড়া শারীয়াহর জ্ঞান পূর্ণ হতে পারে না, বিশেষ করে সেসব ক্ষেত্রে যেগুলো নিয়ে মতভেদ আছে ৷ এ কারণে আমাদের অভিজ্ঞ আলিমরা তাদের কাছ থেকে জ্ঞান আহরণের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন যারা বিষয়বস্তু উপলব্ধি ছাড়াই কেবল কুরআনের হাফিজ হয়েছেন কিংবা কিছু বইপত্র পাঠ করে যাদের অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্কর হয়েছে ৷
৬. ইতিহাস, বাস্তবতা ও আল্লাহর সুনান সম্পর্কে সচেতনতার অভাব
ইসলাম সম্পর্কে সঠিক চেতনার অভাব ছাড়াও বাস্তবতা, জীবন, ইতিহাস এবং আল্লাহ্ র সৃষ্টির রীতি সম্পর্কেও যথার্থ সচেতনার অভাব রয়েছে ৷ এর অভাবে কিছু লোক অসাধ্য সাধন করতে চায় ৷ যা ঘটতে পারে না তারা তাই কল্পনা করে এবং পরিস্থিতি ও ঘটনা প্রবাহের ভুল বিচার করে বসে যা আল্লাহ্ র রীতি ও শরীয়তী চেতনার পরিপন্থী ৷ তারা অসমসাহসিক পদক্ষেপ নেয়, এমনকি জীবনেরও ঝুঁকি নেয় ৷ এর পক্ষে বিপক্ষে কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে তারা তা মোটেও বিবেচনা করে না ৷ কারণ তারা মনে করে তাদের লক্ষ্য তো আল্লাহ্ ও তাঁর কালাম সমুন্নত করা ৷ অতএব এসব লোকের পদক্ষেপকে অন্যরা “আত্মঘাতী” বা উম্মাদনাপূর্ণ বলে অভিহিত করলে আশ্চর্যের কিছু নেই ৷
বস্তুতঃ এই মুসলমানরা যদি মুহুর্তের জন্যেও রাসূলুল্লাহ (সা)-এর সুন্নাহর প্রতি ভ্রুক্ষেপ করতো তাহলে নিশ্চিতভাবে সঠিক পথ-নিদের্শ লাভ করতো ৷ আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর ১৩ বছরের মক্কী জীবন ৷ তিনি শুধু দাওয়াত দিয়ে ক্ষান্ত হননি, ৩৬০টি মূর্তি থাকা সত্ত্বেও কা’বায় নামায ও তাওয়াফ করতে বলেছেন ৷ কেন এরূপ করলেন? তিনি কাফিরদের তুলনায় তাঁর অনুল্লেখযোগ্য শক্তি ও অবস্থানের কথা ভেবে অতি বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন ৷ তিনি কখনোই কমান্ডো হামলা চালিয়ে পাথরের মূর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলার চিন্তা করেননি ৷ তাহলে তো আসল উদ্দেশ্যই পণ্ড হয়ে যেতো ৷ ঐ পদক্ষেপে কাফিরদের মন থেকে তো বহু-ইশ্বরবাদের ভুত মুছে ফেলা যেতো না ৷ তিনি সর্বাগ্রে চেয়েছিলেন তাঁর স্বজাতির মনকে মুক্ত করতে-কা’বাকে মূর্তিমুক্ত করতে নয় ৷ এ জন্যে তওহীদের শিক্ষা দিয়ে প্রথম মুশরিকদের মন পবিত্র করার লক্ষ্যে এমন একদল ঈমানদার তৈরি করেন যারা তাদের লক্ষ্য সম্পর্কে সচেতন এবং কঠোর অধ্যবসায় ও পরিশ্রমের মধ্য দিয়ে তারা বাতিলের বিরুদ্ধে হকের লড়াই চালিয়ে যেতে সক্ষম ৷ এসব বিশ্বাসীর বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- তারা নিরলস নির্বিকার চিত্তে আল্লাহ্র সন্তুষ্টির জন্যে কাজ করে যায়, বিজয়ের উল্লাসে তারা মাদকতায় বিভোর হয়ে যায় না, আবার পরাজয়ে মুষড়ে পড়ে না ৷ অবশ্য কখনো কখনো তারা কাফিরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে রাসূলুল্লাহ (সা)-এর অনুমতি প্রার্থনা করেছিল ৷ কিন্তু তিনি এখনো সময় আসেনি বলে তা অগ্রাহ্য করেছিলেন এবং আল্লাহ্ র নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ধৈর্য ধারনের উপদেশ দিয়েছিলেন ৷ একদিন রাসূলুল্লাহ (সা) আম্মার বিন ইয়াসির (রা) ও তাঁর পিতাকে নিগৃহীত হতে দেখলেন ৷ তিনি তাঁদেরকে সহ্য করার জন্যে উৎসাহিত করলেন এবং তাঁদের জান্নাতের সুসংবাদ দিলেন ৷ স্বাধীনতা ও ধর্মরক্ষার জন্যে আল্লাহ্ র আদেশ না পাওয়া অবধি ঘটনা এভাবে চলতে থাকে ৷ অবশেষে আদেশ এলো ৷ কুরআনের ঘোষণা: “যুদ্ধের অনুমতি দেয়া হলো তাদেরকে যারা আক্রান্ত হয়েছে ৷ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম; তাদেরকে তাদের ঘরবাড়ি থেকে অন্যায়ভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে শুধু এ কারণে যে, তারা বলে: আমাদের প্রভু হচ্ছেন আল্লাহ্ ৷” (২২:৩৯-৪০)
ড. ইউসুফ আল কারযাভীর " ইসলামী পূণর্জাগরণ: সমস্যা ও সম্ভাবন" শীর্ষক বই অবলম্বনে ।
বিষয়: আন্তর্জাতিক
১৬৭৯ বার পঠিত, ১১ টি মন্তব্য
পাঠকের মন্তব্য:
জনাব মডারেটর সাহেব, এ সময়ের প্রেক্ষাপটে এ লেখা স্টিকি করা উচিত ।
মন্তব্য করতে লগইন করুন