একজন আদর্শ পিতার ১১টি উপদেশঃ

লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২২ মে, ২০১৩, ১০:১৬:৪৭ সকাল

একজন আদর্শ পিতার ১১টি উপদেশঃ পুত্রের প্রতি

লুকমান হাকীম, একজন আদর্শ পিতা তার প্রিয় পুত্রকে একজন আদর্শ মুসলিম তথা আদর্শ সমাজ সংস্কারক হিসাবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছিলেন । তিনি তার প্রিয় পুত্রকে যে উপদেশ দিয়েছিলেন তা আল্লাহ তায়ালা সুরা লুকমানের (১২-১৯) নং আয়াতে উদ্ধৃত করেছেন, এভাবে-

وَلَقَدۡ اٰتَيۡنَا لُقۡمٰنَ الۡحِكۡمَةَ اَنِ اشۡكُرۡ لِلّٰهِ‌ؕ وَمَنۡ يَّشۡكُرۡ فَاِنَّمَا يَشۡكُرُ لِنَفۡسِهٖ‌ۚ وَمَنۡ كَفَرَ فَاِنَّ اللّٰهَ غَنِىٌّ حَمِيۡدٌ(১২) وَاِذۡ قَالَ لُقۡمٰنُ لِابۡنِهٖ وَهُوَ يَعِظُهٗ يٰبُنَىَّ لَا تُشۡرِكۡ بِاللّٰهِ‌ؕ اِنَّ الشِّرۡكَ لَظُلۡمٌ عَظِيۡمٌ(১৩)وَوَصَّيۡنَا الۡاِنۡسٰنَ بِوٰلِدَيۡهِ‌ۚ حَمَلَتۡهُ اُمُّهٗ وَهۡنًا عَلٰى وَهۡنٍ وَّفِصٰلُهٗ فِىۡ عَامَيۡنِ اَنِ اشۡكُرۡ لِىۡ وَلِوَالِدَيۡكَؕ اِلَىَّ الۡمَصِيۡرُ(১৪)وَاِنۡ جَاهَدَاكَ عَلٰٓى اَنۡ تُشۡرِكَ بِىۡ مَا لَيۡسَ لَكَ بِهٖ عِلۡمٌۙ فَلَا تُطِعۡهُمَا‌ وَصَاحِبۡهُمَا فِىۡ الدُّنۡيَا مَعۡرُوۡفًا‌ وَّاتَّبِعۡ سَبِيۡلَ مَنۡ اَنَابَ اِلَىَّ‌ۚ ثُمَّ اِلَىَّ مَرۡجِعُكُمۡ فَاُنَبِّئُكُمۡ بِمَا كُنۡتُمۡ تَعۡمَلُوۡنَ(১৫)يٰبُنَىَّ اِنَّهَاۤ اِنۡ تَكُ مِثۡقَالَ حَبَّةٍ مِّنۡ خَرۡدَلٍ فَتَكُنۡ فِىۡ صَخۡرَةٍ اَوۡ فِىۡ السَّمٰوٰتِ اَوۡ فِىۡ الۡاَرۡضِ يَاۡتِ بِهَا اللّٰهُ‌ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَطِيۡفٌ خَبِيۡرٌ‏(১৬) يٰبُنَىَّ اَقِمِ الصَّلٰوةَ وَاۡمُرۡ بِالۡمَعۡرُوۡفِ وَانۡهَ عَنِ الۡمُنۡكَرِ وَاصۡبِرۡ عَلٰى مَاۤ اَصَابَكَ‌ؕ اِنَّ ذٰلِكَ مِنۡ عَزۡمِ الۡاُمُوۡرِ‌ۚ‏(১৭) وَلَا تُصَعِّرۡ خَدَّكَ لِلنَّاسِ وَلَا تَمۡشِ فِىۡ الۡاَرۡضِ مَرَحًا‌ؕ اِنَّ اللّٰهَ لَا يُحِبُّ كُلَّ مُخۡتَالٍ فَخُوۡرٍ‌ۚ‏(১৮) وَاقۡصِدۡ فِىۡ مَشۡيِكَ وَاغۡضُضۡ مِنۡ صَوۡتِكَ‌ؕ اِنَّ اَنۡكَرَ الۡاَصۡوَاتِ لَصَوۡتُ الۡحَمِيۡرِ

অর্থঃ

আমি লুকমানকে দান করেছিলাম সূক্ষ্ম জ্ঞান৷ যাতে সে আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হয় যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে তার কৃতজ্ঞতা হবে তার নিজেরই জন্য লাভজনক৷ আর যে ব্যক্তি কুফরী করবে, সে ক্ষেত্রে প্রকৃতপক্ষে আল্লাহ অমুখাপেক্ষী এবং নিজে নিজেই প্রশংসিত ৷

স্মরণ করো যখন লুকমান নিজের ছেলেকে উপদেশ দিচ্ছিল , সে বললো, “ হে পুত্র ! আল্লাহর সাথে কাউকে শরীক করো না৷ যথার্থই শিরক অনেক বড় জুলুম৷

আর প্রকৃতপক্ষে আমি মানুষকে তার পিতা-মাতার হক চিনে নেবার জন্য নিজেই তাকিদ করেছি৷ তার মা দুর্বলতা সহ্য করে তাকে নিজের গর্ভে ধারণ করে এবং দু’বছর লাগে তার দুধ ছাড়তে ৷ (এ জন্য আমি তাকে উপদেশ দিয়েছি) আমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করো এবং নিজের পিতা-মাতার প্রতিও, আমার দিকেই তোমাকে ফিরে আসতে হবে৷

কিন্তু যদি তারা তোমার প্রতি আমার সাথে এমন কাউকে শরীক করার জন্য চাপ দেয় যাকে তুমি জানো না, তাহলে তুমি তাদের কথা কখনোই মেনে নিয়ো না৷ দুনিয়ায় তাদের সাথে সদাচার করতে থাকো কিন্তু মেনে চলো সে ব্যক্তির পথ যে আমার দিকে ফিরে এসেছে৷ তারপর তোমাদের সবাইকে ফিরে আসতে হবে আমারই দিকে৷ সে সময় তোমরা কেমন কাজ করছিলে তা আমি তোমাদের জানিয়ে দেবো৷

(আর লুকমান বলেছিল ) “ হে পুত্র! কোন জিনিস যদি সরিষার দানা পরিমাণও হয় এবং তা লুকিয়ে থাকে পাথরের মধ্যে , আকাশে বা পৃথিবীতে কোথাও , তাহলে আল্লাহ তা বের করে নিয়ে আসবেন৷ তিনি সূক্ষ্মদর্শী এবং সবকিছু জানেন৷

পুত্র! নামায কায়েম করো, সৎকাজের হুকুম দাও, খারাপ কাজে নিষেধ করো এবং যা কিছু বিপদই আসুক সে জন্য সবর করো৷ একথাগুলোর জন্য বড়ই তাকিদ করা হয়েছে৷

আর মানুষের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বলো না, পৃথিবীর বুকে চলো না উদ্ধত ভঙ্গিতে, আল্লাহ পছন্দ করেন না আত্মম্ভরী ও অহংকারীকে৷

নিজের চলনে ভারসাম্য আনো এবং নিজের আওয়াজ নীচু করো৷ সব আওয়াজের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ হচ্ছে গাধার আওয়াজ৷

লুকমানের পরিচয়

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে লুকমানের ব্যক্তিত্বের ব্যাপারে ব্যাপক মতবিরোধ দেখা যায়৷ জাহেলিয়াতের অন্ধকার যুগে কোন লিখিত ইতিহাসের অস্তিত্ব ছিল না ৷ শত শত বছর থেকে মুখে মুখে শ্রুত যেসব তথ্য স্মৃতির ভাণ্ডারে লোককাহিনী-গল্প-গাথার আকারে সংগৃহিত হয়ে আসছিল সেগুলোর ওপর ছিল এর ভিত্তি৷ এসব বর্ণনার প্রেক্ষিতে কেউ কেউ হযরত লকুমানকে আদ জাতির অন্তরভুক্ত ইয়ামনের বাদশাহ মনে করতো৷ মাওলানা সাইয়েদ সুলাইমান নদবী এসব বর্ণনার ওপর নির্ভর করে তার "আরদুল কুরআন" গ্রন্থে এ মত প্রকাশ করেছেন যে, আদ জাতির ওপর আল্লাহর আযাব নাযিল হবার পর হযরত হূদের (আ) সাথে তাদের যে ঈমানদার অংশটি বেঁচে গিয়েছিল লুকমান ছিলেন তাদেরই বংশোদ্ভূত৷ ইয়ামনে এ জাতির যে শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তিনি ছিলেন তার অন্যতম শাসক ও বাদশাহ৷ কিন্তু কতিপয় প্রবীণ সাহাবী ও তাবেঈদের মাধ্যমে প্রাপ্ত অন্য বর্ণনাগুলো এর সম্পূর্ণ বিপরীত৷ ইবনে আব্বাস (রা) বলেন , লুকমান ছিলেন একজন হাবশী গোলাম ৷ হযরত আবু হুরাইরা (রা) , মুজাহিদ, ইকরিমাহ ও খালেদুর রাব'ঈও একথাই বলেন৷ হযরত জাবের ইবনে আবদুল্লাহ আনসারী (রা) বলেন, তিনি ছিলেন নূবার অধিবাসী৷ সাঈদ ইবনে মুসাইয়েবের উক্তি হচ্ছে, তিনি মিসরের কালো লোকদের অন্তরভুক্ত ছিলেন৷ এ তিনটি বক্তব্য প্রায় কাছাকাছি অবস্থান করছে৷ কারণ আরবের লোকেরা কালো বর্ণের মানুষদেরকে সেকালে প্রায়ই হাবশী বলতো৷ আর নূবা হচ্ছে মিসরের দক্ষিণে এবং সুদানের উত্তরে অবস্থিত একটি এলাকা৷ তাই তিনটি উক্তিতে একই ব্যক্তিকে নূবী, মিসরীয় ও হাবশী বলা কেবলমাত্র শাব্দিক বিরোধ ছাড়া আর কিছুই নয়৷ অর্থের দিক দিয়ে এখানে কোন বিরোধ নেই৷ তারপর রওদাতুল আনাফে সুহাইলির ও মরূজুয যাহাবে মাস'উদীর বর্ণনা থেকে এ সূদানী গোলামের কথা আরবে কেমন করে ছড়িয়ে পড়লো এ প্রশ্নের ওপরও আলোকপাত হয়৷ এ উভয় বর্ণনায় বলা হয়েছে, এ ব্যক্তি আসলে ছিলেন নূবী৷ কিন্তু তিনি বাসিন্দা ছিলেন মাদযান ও আইল (বর্তমান আকাবাহ )এলাকার৷ এ কারণে তার ভাষা ছিল আরবী এবং তার জ্ঞানের কথা আরবে ছড়িয়ে পড়ে৷ তা ছাড়া সুহাইলী আরো বিস্তারিত ভাবে বলেছেন যে, লুকমান হাকীম ও লুকমান ইবনে আদ দু'জন আলাদা ব্যক্তি৷ তাদেরকে এক ব্যক্তি মনে করা ঠিক নয়৷ (রওদুল আনাফ, ১ম খণ্ড, ২৬৬ পৃষ্ঠা এবং মাসউদী , ১ম খণ্ড, ৫৭ পৃষ্ঠা ৷ )

লুকমানের উপদশ উদ্ধৃত করার কারণ

একটি শক্তিশালী বুদ্ধিবৃত্তিক যুক্তির মাধ্যমে শিরকের অসারতা প্রমাণ করার পর এখন আরবের লোকদেরকে একথা জানানো হচ্ছে যে, এ যুক্তিসঙ্গত কথা প্রথমবার তোমাদের সামনে তোলা হচ্ছে না বরং পূর্বেও বুদ্ধিমান ও জ্ঞানীরা একথাই বলে এসেছেন এবং তোমাদের নিজেদের বিখ্যাত জ্ঞানী লুকমান আজ থেকে বহুকাল আগে একথাই বলে গেছেন৷ তাই শিরক যদি কোন অযৌক্তিক বিশ্বাস হয়ে থাকে তাহলে ইতিপূর্বে কেউ একথা বলেনি কেন, মুহাম্মদ (সা) এর দাওয়াতের জবাবে তোমরা একথা বলতে পারো না৷

একজন বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হিসেবে আরবে লুকমান বহুল পরিচিত ব্যক্তিত্ব৷ জাহিলী যুগের কবিরা যেমন ইমরাউল কায়েস, লবীদ, আ'শা , তারাফাহ প্রমুখ তাদের কবিতায় তার কথা বলা হয়েছে৷ আরবের কোন কোন লেখাপড়া জানা লোকের কাছে "সহীফা লুকমান " নামে তার জ্ঞানগর্ভ উক্তির একটি সংকলন পাওয়া যেতো৷ হাদীসে উদ্ধৃত হয়েছে, হিজরাতের তিন বছর পূর্বে মদীনার সর্বপ্রথম যে ব্যক্তি নবী (সা) এর দাওয়াতের প্রভাবিত হন তিনি ছিলেন সুওয়াইদ ইবনে সামেত৷ তিনি হজ্ব সম্পাদন করার জন্য মক্কায় যান৷ সেখানে নবী করীম (সা) নিজের নিয়ম মতো বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত হাজীদের আবাসস্থলে গিয়ে ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেককে ইসলামের দাওয়াত দিতে থাকেন৷ এ প্রসঙ্গে সুওয়াইদ যখন নবী (সা) এর বক্তৃতা শুনেন, তাকে বলেন, আপনি যে ধরনের কথা বলেছেন তেমনি ধরনের একটি জিনিস আমার কাছেও আছে৷ তিনি জিজ্ঞেস করেন, সেটা কি ? জবাব দেন সেটা লুকমানের পুস্তিকা ৷ তারপর নবী করীমের (সা) অনুরোধে তিনি তার কিছু অংশ পাঠ করে তাকে শুনান৷ তিনি বলেন, এটা বড়ই চমৎকার কথা৷ তবে আমার কাছে এর চেয়েও বেশি চমৎকার কথা আছে৷ এরপর কুরআন শুনান৷ কুরআন শুনে সুওয়াইদ অবশ্যই স্বীকার করেন, নিসন্দেহে এটা লুকমানের পুস্তিকার চেয়ে ভালো৷ (সীরাতে ইবনে হিশাম, ২ খণ্ড, ৬৭-৬৯ পৃ; উসুদুল গাবাহ, ২ খণ্ড, ৩৭৮ পৃষ্ঠা ) ঐতিহাসিকগণ বলেন, এই সুওয়াইদ ইবনে সামেত তার যোগ্যতা, বীরত্ব, সাহিত্য ও কাব্য মনীষা এবং বংশ মর্যাদার কারণে মদীনায় " কামেল " নামে পরিচিত ছিলেন৷ কিন্তু নবী (সা) এর সাথে সাক্ষাতের পর যখন তিনি মদীনায় ফিরে যান তার কিছুদিন পর বুয়াসের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় এবং তাতে তিনি মারা যান৷ তার গোত্রের লোকদের সাধারণভাবে এ ধারণা ছিল যে, নবী (সা) এর সাক্ষাতের পর তিনি মুসলমান হয়ে যান৷

লুকমানের পাণ্ডিত্যপূর্ণ উপদেশমালা থেকে এ বিশেষ উপদেশ বাণীটিকে এখানে উদ্ধৃত করা হয়েছে দুটি বিশেষ সম্পর্কের ভিত্তিতে৷ এক, তিনি নিজ পুত্রকে এ উপদেশটি দেন৷ আর একথা সুস্পষ্ট, মানুষ যদি দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কারো ব্যাপারে আন্তরিক হতে পারে তাহলে সে হচ্ছে তার নিজের সন্তান৷ এক ব্যক্তি অন্যকে ধোঁকা দিতে পারে, তার সাথে মুনাফিকী আচরণ করতে পারে কিন্তু সবচেয়ে নিকৃষ্ট প্রকৃতির লোকটিও নিজ পুত্রকে এ নসীহত করা অকাট্যভাবে প্রমাণ করে যে, তার মতে শিরক যথার্থই একটি নিকৃষ্ট কাজ এবং এ জন্যই তিনি সর্বপ্রথম নিজের প্রাণাধিক পুত্র কে এ গোমরাহীটি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দেন৷ দুই, মক্কার কাফেরদের অনেক পিতা-মাতা সে সময় নিজের সন্তানদেরকে শিরকী ধর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত থাকার এবং মুহাম্মদ (সা)এর তাওহীদের দাওয়াত থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবার জন্য বাধ্য করছিল৷ সামনের দিকের একথা বর্ণনা করা হয়েছে৷ তাই সেই অজ্ঞদেরকে শুনানো হচ্ছে, তোমাদের দেশেরই বহুল পরিচিতি জ্ঞানী পণ্ডিত তো তার নিজের পুত্রের মঙ্গল করার দায়িত্বটা তাকে শিরক থেকে দূরে থাকার নসিহত করার মাধ্যমেই পালন করেন৷ এখন তোমরা যে তোমাদের সন্তানদেরকে শিরক করতে বাধ্য করছো, এটা কি তাদের প্রতি শুভেচ্ছা না তাদের অমঙ্গল কামনা ?

লুকমান প্রদত্ত উপদেশ সমূহ

1. ১ম উপদেশ- শিরক বর্জনঃ ( بِاللّٰهِ‌ لَا تُشۡرِكۡ)

শিরক সম্পর্কে প্রত্যেকের স্পস্ট ধারনা থাকা আবশ্যক । অন্য যেকোনো পাপ ক্ষমা করা হলেও শিরকের পাপ ক্ষমা করা হবে না । এটি সবচাইতে বড় পাপ । শিরকে পতিত অবস্থায় মৃত্যূবরণ করলে জাহান্নামে যেতে হবে ।

আল্লাহ ঘোষনা-

إِنَّ اللّهَ لاَ يَغْفِرُ أَن يُشْرَكَ بِهِ وَيَغْفِرُ مَا دُونَ ذَلِكَ لِمَن يَشَاء وَمَن يُشْرِكْ بِاللّهِ فَقَدِ افْتَرَى إِثْمًا عَظِيمًا

আল্লাহর সাথে শিরক করলে তিনি তা কখনো ক্ষমা করবেন না । শিরক ছাড়া যাকে ইচ্ছা ক্ষমা করবেন । ( নিসা-৪৮)

শিরক শব্দটির অর্থ হল শরীক করা, অংশীদার বানানো বা সমকক্ষ সাব্যস্ত করা । আল্লাহর সাথে কি কি ভাবে শরীক করা হয় তা বুঝতে পারলে শিরক সম্পর্কে স্পস্ট ধারণা পাওয়া যাবে এবং শিরক থেকে বেঁচে থাকও সহজ হবে ।

শিরক দুভাগে বিভক্ত:

ক. শিরকে আকবর বা বড় শির‌ক

খ. শিরকে আসগর বা ছোট শিরক

ব্যাখ্যাঃ

ক. শিরকে আকবর বা বড় শিরক:

যে কোন প্রকারের ইবাদত আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য করা। যেমন, কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে যবেহ করে থাকে, কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে মান্নত করে, কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে বিপদ-আপদে ডাকে, কেউ আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নিকট সাহায্য চায়, (যে সাহায্য করার ক্ষমতা তার নেই) যেমন মূর্তি-প্রতিমার নিকট সাহায্য চাওয়া অথবা আউলিয়া ও নেককার লোকদের নিকট সাহায্য চাওয়া। (উদাহরণতঃ সন্তান চাওয়া।) এই যুক্তিতে যে ইহা ব্যক্তিকে আল্লাহর সান্নিধ্য পৌছে দিবে। এ প্রকার শিরকের বিধান হলো, এই শিরক কুফরী, ইহা ব্যক্তিকে মুসলিম মিল্লাত থেকে বের করে দেয়। আর এ শিরককারীর অন্য কোন ভাল আমল ও এই শিরকের বদলা হিসেবে আল্লাহর নিকট গ্রহনীয় নয়। এই শিরককারী যদি এ অবস্থায় মারা যায় তবে সে চিরস্থায়ীভাবে জাহান্নামবাসী হবে। যেমন রাসুল সাঃ বলেছেন: (من مات و هو يدعو من دون الله ندا دخل النار) অ র্থাৎ যে ব্যক্তি আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে সমকক্ষ মনে করে ডাকে, আর এ অবস্থায় মৃত্যু বরণ করে সে নিশ্চিত জাহান্নামে যাবে।” স্বাভাবিকভাবে শিরক সবচেয়ে বড় গুনা। আর শিরকের উপর যে মৃত্যু বরণ করবে আল্লাহ কক্ষনো তাকে ক্ষমা করবেন না। যেমন আল্লাহ তাআলা বলেনঃ إن الله لا يغفر أن يشرك به و يغفر ما دون ذلك لمن يشاء ومن يشرك بالله فقد ضل ضلالا بعيدا) “নিশ্চয় আল্লাহ তাঁর সাথে অংশী (শিরক) স্থাপনকারীকে ক্ষমা করেন না। এতদ্ব্যতীত, তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে ক্ষমা করে থাকেন। আর যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশীস্থাপন করে সে সুদূরবর্তী পথভ্রষ্টতায় নিমজ্জিত হয়।”(সূরা নিসা ৪:১১৬ আয়াত) আল্লাহ আরো বলেছেনঃ (إنه من يشرك بالله فقد حرم الله عليه الجنة و مأواه النار و ما للظالمين من أنصار) অর্থাৎ নিশ্চয় যে ব্যক্তি আল্লাহর সাথে অংশী(শিরক) স্থাপন করে আল্লাহ তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেন। তার গন্তব্য হবে জাহান্নাম। আর জালেমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। সূরা মায়িদা ৫:৭২ আয়াত। শিরককারীর আমল কবুল হবে না এ মর্মে আল্লাহ তাআলা বলেন وقدمنا إلى ما عملوا من عمل فجعلناه هباء منثورا ) “অর্থাৎ আমি তাদের কৃতকর্মের প্রতি মনোনিবেশ করব আর সেগুলোকে বিক্ষিপ্ত ধূলিকণারূপে উড়িয়ে দেব।” (সূরা আল ফুরক্বান ২৫:২৩ )

শিরকে আকবর ৪ ধরনের হয়ে থাকেঃ

(১) আল্লাহর সত্তার সাথে শরীক করা-

وَقَالَتِ الْيَهُودُ عُزَيْرٌ ابْنُ اللّهِ وَقَالَتْ النَّصَارَى الْمَسِيحُ ابْنُ اللّهِ ذَلِكَ قَوْلُهُم بِأَفْوَاهِهِمْ يُضَاهِؤُونَ قَوْلَ الَّذِينَ كَفَرُواْ مِن قَبْلُ قَاتَلَهُمُ اللّهُ أَنَّى يُؤْفَكُونَ

ইয়াহুদীরা বলে ওযাইর আল্লাহর পুত্র এবং নাসারা বলে 'মসীহ আল্লাহর পুত্র' । এ হচ্ছে তাদের মুখের কথা । এরা পূর্ববতী কাফেরদের মত কথা বলে । আল্লাহ এদের ধ্বংস করুন, এরা কোন উল্টা পথে চলে যাচ্ছে ।

(২) আল্লাহর গুণাবলীর সাথে শরীক করা-

যে সব গুণ একান্তই আল্লাহর সেসব গুণ কারো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক । যেমন- গায়েবী ইলম বা অদৃশ্য সম্পর্কে জ্ঞান। কারো সম্পর্কে এমন ধারনা পোষন করা যে, তিনি সবকিছু জানেন, দেখেন বা শুনেন এবং সব দোষ-ত্রুটি থেকে মুক্ত ।

(৩) আল্লাহর ক্ষমতায় কাউকে শরীক করা -

যে সব ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর সে সব ক্ষমতা আরো করো মধ্যে আছে বলে বিশ্বাস করা শিরক । যেমন- আইন দেবার ক্ষমতা, হালাল ও হারাম নিধারণ করা । মানব জীবনের জন্য বিধি-বিধান রচনা করা একমাত্র আল্লাহর ইখিতিয়ার । আল্লাহর দেওয়া আইনের অধীনে মানুষেরও আইন রচনার ক্ষমতা আছে; কিন্ত মৌলিক আইন রচনার অধিকার আল্লাহ ছাড়া আর করো নেই ।

কারো উপকার বা ক্ষতি, প্রয়োজন পূরণ, দোয়া কবুল, ভাগ্যে ভাল-মন্দ ইত্যাদি আল্লাহ ছাড়া আর করো পক্ষে করার ক্ষমতা আছে বলে মনে করা শিরক ।

(৪) আল্লাহর অধিকারে কাউকে শরীক করা -

যেমন- রুকু ও সিজদা করা, কোরবানী করা, দোয়া করা, দয়া ও অনুগ্রহ পাবার আশায় কোনো কিছু দান করা ইত্যাদি একমাত্র আল্লাহর প্রাপ্য হক । এ সব আল্লাহ ব্যতীত অন্য করো উদ্দেশ্যে সম্পাদন করা শিরক ।

এই উম্মতের মধ্যেও শিরক পাওয়া যায় । যেমন আল্লাহ বলেন,

وَمَا يُؤْمِنُ أَكْثَرُهُمْ بِاللّهِ إِلاَّ وَهُم مُّشْرِكُونَ

অনেক মানুষ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে কিন্তু সাথে সথে শিরকও করে । ( ইউসূফ-১০৬)

খ. শিরকে আসগর বা ছোট শিরকঃ

যেমন, রিয়া (الرياء) বা লোক দেখানো কাজ। তা হল এই, মানুষের প্রশংসা, স্তুতি ও গুনগান পাওয়ার জন্য আমল করা। আর এটা (রিয়া) যে আমলে ঢুকে পড়ে সে আমলকে বিনষ্ট করে দেয়। নবী করিম (সঃ) এ সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেনঃأخوف ما أخاف عليكم الشرك الأصغر" "“ আমি তোমাদের জন্য যে বিষয়ে সবচেয়ে বেশী ভয় করি তা হল ছোট শিরক। ” (মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ) তখন তাকে ছোট শিরক সম্পর্কে জিজ্ঞস করা হল। তখন তিনি বললেনঃ রিয়া বা লোক-দেখানো কাজ।আর তা হল ইখলাসের বিপরীত, যা ইবাদত কবুলের অন্যতম একটি শর্ত। ছোট শিরকের আরো উদাহরণ হল, যেমন কেউ বলে (لو لا الله و فلان) অর্থাৎ“যদি আল্লাহ এবং অমুক না হত” অথবা (ما شاء الله و فلان) অর্থাৎ “আল্লাহ এবং অমুক ব্যক্তি যা চান” কেননা আরবীতে ওয়াও (واو) অব্যয়টি নিশর্ত মিলনাত্মক অর্থবোধক। যা অংশদারি অর্থের সম্ভাবনা রাখে। রাসুল (সাঃ) এক লোককে বলতে শুনলেন (ما شاء الله وشئت)অর্থাৎ“আপনার এবং আল্লাহর যা ইচ্ছা হয়।” নবী (সাঃ) তখন বললেনঃ أجعلتنى لله عدلا بل ما شاء الله وحده অর্থাৎ “তুমি কি আমাকে আল্লাহর সমকক্ষ বানালে? বরং নিরঙ্কুশভাবে আল্লাহর যা ইচ্ছা হয়।” (মুসনাদে আহমদ)

2. ২য় উপদেশ- পিতা-মাতার অধিকার আদায় (وَوَصَّيۡنَا الۡاِنۡسٰنَ بِوٰلِدَيۡهِ‌ۚ)

আল্লাহপাক বনী ইসরাইলে বলেছেন¬ -

‘তোমার রব সিদ্ধান্ত দিয়েছেন যে, তাঁকে ছাড়া অন্য কারো ইবাদত কোরো না। আর তোমার মা-বাবার সাথে সদাচরণ করবে। তাদের মধ্যে একজন অথবা উভয়েই যদি তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হয়, তবে তাদের ‘উহ’ শব্দটিও বলো না এবং তাদের ধমক দিয়ো না বরং তাদের সাথে ভদ্রোচিত কথা বলো’।

পিতা-মাতার প্রতি সদাচরণ প্রসঙ্গে হাদিস শরিফে এসেছে-¬

‘হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাঃ বলেন, আমি রাসূল সাঃ-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর নিকট সর্বাপেক্ষা পছন্দনীয় আমল কি? তিনি বললেনঃ সময়মতো নামাজ পড়া। আমি বললাম, তারপর কি? তিনি বললেনঃ পিতা-মাতার সাথে ভালো ব্যবহার করা। আমি বললামঃ অতঃপর কোন আমল? তিনি বললেনঃ আল্লাহর পথে জিহাদ করা’।

একবার এক ব্যক্তি আমাদের প্রিয় নবী হজরত রাসুলে করিমের (সা.) খেদমতে এসে আরজ করলেন ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! আমার পিতা-মাতার ইন্তেকাল হয়েছে, তাদের জন্য আমার কি কি হক পালনীয়? হজরত রাসুলে পাক (সা.) বলেনঃ নামাজ আদায় করে গুনাহ খাতা মাফির জন্য আল্লাহ রাহমানুর রাহিমের দরবারে ক্ষমা ফরিয়াদ করো এবং তাদের কোনোখানে কোনো ওয়াদা থাকলে তাও যথাযথ পালন করো।

আরেকবার কোনো এক ব্যক্তি হজরত রাসুলে মকবুলকে (সা.) প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ (সা.)! আমি কার সঙ্গে আদব রক্ষা করব, সদ্ব্যবহার করব। আল্লাহর রাসুল (সা.) তাৎক্ষণিক বলে দিলেন, তোমার পিতা-মাতার সঙ্গে। লোকটি আবার বলল, তারা তো ইন্তেকাল করেছেন। হুজুরে আকরাম (সা.) জবাবে বললেন, তার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করো।

দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা অনেক সময় লক্ষ্য করি কোনো কোনো সন্তান পিতা-মাতাকে অবজ্ঞা, অবহেলা ও ঘৃণার চোখে দেখে এবং তাচ্ছিল্য করে। এটা আদৌ ন্যায়সঙ্গত নয়। যা ধর্ম ও সমাজের নীতিমালার ঘোর পরিপন্হী। সন্তানের কাছে পিতা-মাতার সম্মান বা কদর সম্পর্কে আমাদের মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন-জেনে রাখো, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। তিনি আরো বলেছেন, পিতার সন্তুষ্টিতে আল্লাহপাকের সন্তুষ্টি। পিতার অসন্তুষ্টিতে আল্লাহপাকের অসন্তুষ্টি। অতএব, দুনিয়ার জীবনে এবং পরকালে বেহেশত পেতে হলে অবশ্য অবশ্যই পিতা-মাতার প্রতি সেবা-যত্ম, সম্মান-সেবা-যত্ম-সম্মান ও আনুগত্য থাকতে হবে। সর্বোপরি স্মরণ ও বরণ করে নিতে হবে-পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কর্তব্য অপরিসীম।

‘হজরত মা’আয ইবনে জাবাল রাঃ বলেন, ‘রাসূল সাঃ দশটি অসিয়ত করেছিলেন। তন্মধ্যে ১. আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক করবে না, যদি তোমাদের সে জন্য হত্যা কিংবা অগ্নিদগ্ধ করা হয়। ২. নিজের পিতা-মাতার নাফরমানি কিংবা তাদের মনে কষ্ট দেবে না, যদি তারা এমন নির্দেশও দিয়ে দেন যে, তোমরা তোমাদের পরিবার-পরিজন ও ধন-সম্পদ ত্যাগ করো’।

‘হজরত মুয়াবিয়া ইবনে জাহিমা সালামী রাঃ হতে বর্ণিত, তিনি বলেনঃ আমি রাসূল সাঃ-এর কাছে এসে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনার সাথে জিহাদে শরিক হতে চাই, যাতে আমি আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখিরাতের মঙ্গল লাভ করব। তিনি বললেনঃ আফসোস তোমার জন্য, তোমার কি মা জীবিত আছেন? আমি বললাম, হ্যাঁ। তিনি বললেনঃ ফিরে যাও, গিয়ে তার খিদমত করো... আফসোস তোমার জন্য। তার পায়ের কাছে পড়ে থাকো, সেখানেই জান্নাত’।

‘রাসূল সাঃ বলেছেন, যে পুত্র স্বীয় পিতা-মাতার অনুগত, সে যখনই নিজের পিতা-মাতার প্রতি সম্মান ও মহব্বতের দৃষ্টিতে তাকায়, তখন প্রতিটি দৃষ্টিতে সে একটি করে কবুল হজের সাওয়াবপ্রাপ্ত হয়’।

হজরত আবু উমামা রাঃ থেকে বর্ণিত। ‘এক ব্যক্তি জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সন্তানের ওপর পিতা-মাতার কি হক রয়েছে? উত্তরে তিনি বললেন, তারা দু’জন তোমার জান্নাত ও জাহান্নাম’।

ইসলাম মায়ের মর্যাদাকে বাবার মর্যাদার সমান করেনি; বরং মায়ের মর্যাদা বাবার মর্যাদার চেয়ে তিন গুণ বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ প্রত্যেক মা¬ বাবার চেয়ে তিনটি বিষয়ে কষ্ট বেশি করে থাকেন। ১. গর্ভে ধারণ করে নিজ শরীর ক্ষয় করে সন্তানের দেহাকৃতি দান করেন। ২. মৃত্যুসম কষ্ট সহ্য করে সন্তান প্রসব করেন। ৩. নিজ শরীরের রক্ত-গোশত গলানো বুকের অমৃত সুধা পান করিয়ে সন্তানকে প্রতিপালন করেন।

হাদিসে এসেছে ‘হজরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি (মুয়াবিয়া ইবনে হীদা আল-কুরাইশী) রাসূল সাঃ-কে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার উত্তম আচরণ পাওয়ার অধিক হকদার কে? তিনি বললেন, তোমার মা। লোকটি বললেন, তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। অতঃপর লোকটি বললেন তারপর কে? তিনি বললেন, তোমার মা। অতঃপর লোকটি বললেন তারপর কে? তিনি বললেন তোমার বাবা’। এখানে বাবার মর্যাদার চেয়ে মায়ের মর্যাদা তিন পয়েন্ট বেশি বলে বর্ণনা করা হয়েছে। ইসলাম মায়ের জাতকে কতখানি মর্যাদা দিয়েছে তার প্রমাণ রাসূল সাঃ-এর ওই বাণীতে পাওয়া যায়।

‘এক ব্যক্তি রাসূল সাঃ-এর কাছে গিয়ে বললেন¬ হে আল্লাহর রাসূল, আমি একটি বড় পাপ করেছি। আমার কি তওবার কোনো সুযোগ আছে? রাসূল সাঃ বললেন, তোমার কি মা আছে? লোকটি বললেনঃ না। রাসূল সাঃ আবার জিজ্ঞেস করলেনঃ তোমার কি খালা আছে? লোকটি বললেনঃ হ্যাঁ, আছে। রাসূল সাঃ বললেন, তোমার তওবা আল্লাহর কাছে কবুল করার জন্য তোমার খালার সেবা করো’।

সুতরাং প্রমাণিত হলো পুরুষ জাতির তুলনায় নারী জাতির মর্যাদা ইসলাম কত বেশি ঘোষণা করেছে। এ পৃথিবীতে ‘মা’ ডাকের ন্যায় মিষ্টি মধুর ডাক আর দ্বিতীয়টি নেই। ‘মা’ ডাকে যত তৃপ্তি, যত প্রশান্তি পৃথিবীজুড়ে তা আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। তাই মায়ের অধিকার আদায় করা সন্তানের ওপর ফরজ। এ অধিকার আদায়ে অবহেলা করা কবিরা গোনাহ।

3. ৩য় উপদেশ- আল্লাহর পাকড়াওকে ভয় করাঃ

আল্লাহর জ্ঞান ও তার পাকড়াও এর বাইরে কেউ যেতে পারে না৷ পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি কণা দৃষ্টির অগোচরে থাকতে পারে কিন্তু তার কাছে তা সুস্পষ্ট ৷ আকাশ মণ্ডলে একটি ক্ষুদ্রতম কণিকা তোমার থেকে বহু দূরবর্তী হতে পারে কিন্তু তা আল্লাহর বহু নিকটতর৷ ভূমির বহু নিম্ন স্তরে পতিত কোন জিনিস তোমার কাছে গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত ৷ কিন্তু তার কাছে তা র য়েছে উজ্জ্বল আলোর মধ্যে৷ কাজেই তুমি কোথাও কোন অবস্থায়ও এমন কোন সৎ বা অসৎ কাজ করতে পারো না যা আল্লাহর অগোচরে থেকে যায়৷ তিনি কেবল তা জানেন তাই নয় বরং যখন হিসেব-নিকেশের সময় আসবে তখন তিনি তোমাদের প্রত্যেকটি কাজের ও নড়াচড়ার রেকর্ড সামনে নিয়ে আসবেন৷

4. ৪র্থ উপদেশ- নামায কায়েম করাঃ

বস্তুতঃ নামাজ হল সমাজ সংশোধনের একটা বড় হাতিয়ার । আমরা নামাজ পড়ি আখেরাতে কিছু সওয়াব পাওয়ার আশায় । কিন্তু আখেরাতে কিছু সওয়াব দানের জন্য আল্লাহ নামাজ ফরজ করেননি । নামাজ ফরজ করা হয়েছে দুনিয়াতে সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে আখেরাতে মুক্তি নিশ্চিত করার জন্য ।

إِنَّ الصَّلَاةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاء وَالْمُنكَرِ

নিশ্চয়ই নামায অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে।(২৯:৪৬)

নামাজের সময় হলে মুয়াজ্জিন সকলক ডাকেন ‘ হাইয়্যা আলাস সালাহ’, ‘হাইয়্যা আলাল ফালাহ’ নামাজের জন্য আস, কলাণের জন্য আস । এ কল্যাণ কি শুধু আখেরাতের কল্যাণ ? না তা মোটেই নয় । ছোট-বড়, গরীব-ধনী, আমীর- ফকির সকলকে এ কাতারে দাঁড় করিয়ে সামাজিক ভেদাভেদ দুর করা, এক ইমামের পিছনে দাঁড় করিয়ে সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে নেতার আনুগত্য করতে শিখানোর মাধ্যমে দুনিয়ার ও আখেরাতের কল্যাণ সাধনের জন্যই নামাজ ফরজ করা হয়েছে ।

5. ৫ম উপদেশ- সৎকাজের হুকুম করাঃ

6. ৬ষ্ঠ উপদেশ- খারাপ কাজে নিষেধ করাঃ

একজন সমাজ সংস্কারকের প্রধানতম উদ্দেশ্য থাকে সমাজ জীবনে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা । সমাজ সকল প্রকার ভাল কাজের প্রচলন ও খারাপ কাজের বিলোপ সাধনের মাধ্যমেই সমাজ জীবনে সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখা সম্ভব ।

বস্তুতঃ হাদীসে সমাজ জীবন থেকে যাবতীয় পংকীললতা উৎখাত করাকে ঈমানের অপরিহার্য অংগ বলে উল্লেখ করা হয়েছে । বলা হয়েছে-

من راى منكم منكرا فليغيره بيده فإن لم يستطع فبلسانه فإن لم يستطع فبقلبه وذلك أضعف الإيمان" متفق عليه

যে ব্যক্তি কোন নিন্দনীয় কাজ আনুষ্ঠিত ততে দেখবে তখন তার প্রথম কর্তব্য হল তা শক্তি প্রয়োগ করে বন্ধ করা । যদি তাতে সে অক্ষম হয় তবে তখন তার কর্তব্য হল মুখ দিয়ে ( বক্তৃতা, লেখনী ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত গঠন করে ) বন্ধ করা । তাতেও যদি সে অক্ষম হয় অর্থাৎ সে পরিবেশ ও যদি বজায় না থাকে তবে তার কতর্ব্য হল মনে মনে পরিলকল্পনা করা যে, উহা কিভাবে বন্ধ করা যায় । আর এ স্তরকে আল্লাহর রসুল (স) ঈমানের সর্বশেষ স্তর বলে আখ্যায়িত করেছেন ।

7. ৭ম উপদেশ- বিপদে সবর করাঃ

বিপদে সবর করার নির্দেশ দানের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম ইঙ্গিত রয়েছে যে, সৎকাজের হুকুম দেয়া এবং অসৎকাজে নিষেধ করার দায়িত্ব যে ব্যক্তিই পালন করবে তাকে অনিবার্যভাবে বিপদ আপদের মুখোমুখি হতে হবে৷ এ ধরনের লোকের পেছনে দুনিয়া কোমর বেঁধে লেগে যাবে এবং সব ধরনের কষ্টের সম্মুখীন তাকে হতেই হবে৷

এগুলোসমাজ সংশোধনের কাজ বড়ই হিম্মতের কাজ৷ মানবতার সংশোধন এবং তার সংকট উত্তরণে সাহায্য করার কাজ কম হিম্মতের অধিকারী লোকদের পক্ষে সম্ভব নয়৷ এসব কাজ করার জন্য শক্ত বুকের পাটা দরকার৷

8. ৮ম উপদেশ- মানুষকে অবজ্ঞা না করাঃ

মূল শব্দগুলো হচ্ছে, صَعِّر "সা'আর" বলা হয় আরবী ভাষায় একটি রোগকে৷ এ রোগটি হয় উটের ঘাড়ে৷ এ রোগের কারণে উট তার ঘাড় সবসময় একদিকে ফিরিয়ে রাখে৷ এ থেকেই বলাহয যে,"অমুক ব্যক্তি উটের মতো তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে৷" অর্থাৎ অহংকারপূর্ণ ব্যবহার করলো এবং মুখ ফিরিয়ে কথা বললো৷ এ ব্যাপারেই তাগলাব গোত্রের কবি আমর ইবনে হাই বলেনঃ

" আমরা এমন ছিলাম কোন দাম্ভিক স্বৈরাচারী আমাদের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে কথা বললো তখন আমরা তার বক্রতার এমন দফারফা করলাম যে একেবারে সোজা হয়ে গেলো ৷"

9. ৯ম উপদেশ- দম্ভভরে চলাফেরা না করাঃ

মূল শব্দগুলো হচ্ছে مُختَال ও فَخُور "মুখতাল" মানে হচ্ছে, এমন ব্যক্তি যে নিজেই নিজেকে কোন বড় কিছু মনে করে৷ আর ফাখূর তাকে বলে ,যে নিজের বড়াই করে অন্যের কাছে৷ মানুষের চালচলনে অহংকার, দম্ভ ও ঔদ্ধত্যের প্রকাশ তখনই অনিবার্য হয়ে উঠে , যখন তার মাথায় নিজের শ্রেষ্ঠত্বের বিশ্বাস ঢুকে যায় এবং সে অন্যদেরকে নিজের বড়াই ও শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করাতে চায়৷

10. ১০ম উপদেশ- নিজের চলনে ভারসাম্যঃ

কোন কোন মুফাসসির এর এই অর্থ গ্রহণ করেছেন যে, "দ্রুতও চলো না এবং ধীরেও চলো না বরং মাঝারি চলো৷" কিন্তু পরবর্তী আলোচনা থেকে পরিষ্কার জানা যায়, এখানে ধীরে বা দ্রুত চলা আলোচ্য বিষয় নয়৷ ধীরে বা দ্রুত চলার মধ্যে কোন নৈতিক গুণ বা দোষ নেই এবং এ জন্য কোন নিয়মও বেঁধে দেয়া যায় না৷ কাউকে দ্রুত কোন কাজ করতে হলে সে দ্রুত ও জোরে চলবে না কেন৷ আর যদি নিছক বেড়াবার জন্য চলতে থাকে তাহলে এ ক্ষেত্রে ধীরে চলায় ক্ষতি কি ? মাঝারি চালে চলার যদি কোন মানদণ্ড থেকেই থাকে, তাহলে প্রত্যেক অবস্থায় প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য তাকে একটি সাধারণ নিয়মে পরিণত করা যায় কেমন করে ? আসলে এখানে উদ্দেশ্য হচ্ছে, প্রবৃত্তির এমন অবস্থার সংশোধন যার প্রভাবে চলার মধ্যে দম্ভ অথবা দীনতার প্রকাশ ঘটে৷ বড়াই করার অহমিকা যদি ভেতরে থেকে যায় তাহলে অনিবার্যভাবে তা একটি বিশেষ ধরনের চাল-চলনের মাধ্যমে বের হয়ে আসে৷ এ অবস্থা দেখে লোকটি যে কেবল অহংকারে মত্ত হয়েছে, একথাই জানা যায় না, বরং তার চাল-চলনের রং ঢং তার অহংকারের স্বরূপটিও তুলে ধরে৷ ধন-দওলত, ক্ষমতা-কর্তৃত্ব, সৌন্দর্য, জ্ঞান, শক্তি এবং এ ধরনের অন্যান্য যতো জিনিসই মানুষের মধ্যে অহংকার সৃষ্টি করে তার প্রত্যেকটির দম্ভ তার চাল-চলনে একটি বিশেষ ভঙ্গি ফুটিয়ে তোলে৷ পক্ষান্তরে চাল-চলনে দীনতার প্রকাশ ও কোন না কোন দূষণীয় মানসিক অবস্থার প্রভাবজাত হয়ে থাকে৷ কখনো মানুষের মনের সুপ্ত অহংকার একটি লোক দেখানো বিনয় এবং কৃত্রিম দরবেশি ও আল্লাহ প্রেমিকের রূপ লাভ করে এবং এ জিনিসটি তার চাল-চলনে সুস্পষ্টভাবে ফুটে ওঠে৷ আবার কখনো মানুষ যথার্থই দুনিয়া ও তার অবস্থার মোকাবিলায় পরাজিত হয় এবং নিজের চোখে নিজেই হেয় হয়ে দুর্বল চালে চলতে থাকে৷ লুকমানের উপদেশের উদ্দেশ্য হচ্ছে, নিজের মনের এসব অবস্থার পরিবর্তন করো এবং একজন সোজা-সরল- যুক্তিসঙ্গত ভদ্রলোকের মতো চলো, যেখানে নেই কোন অহংকার ও দম্ভ এবং কোন দুর্বলতা, লোক দেখানো বিনয় ও ত্যাগ৷

এ ব্যাপারে সাহাবায়ে কেরামের রুচি যে পর্যায়ের গড়ে উঠেছিল তা এ ঘটনাটি থেকেই অনুমান করা যেতে পারে৷ হযরত উমর (রা)একবার এক ব্যক্তিকে মাথা হেঁট করে চলতে দেখলেন৷ তিনি তাকে ডেকে বললেন, "মাথা উঁচু করে চলো৷ ইসলাম রোগী নয়৷" আর একজনকে তিনি দেখলেন যে কুঁকড়ে চলছে৷ তিনি বললেন, "ওহে জালেম! আমাদের দীনকে মেরে ফেলছো কেন ? এ দুটি ঘটনা থেকে জানা যায় , হযরত উমরের কাছে দীনদারীর অর্থ মোটেই এটা ছিল না যে, পথ চলার সময় রোগীর মতো আচরণ করবে এবং অযথা নিজেকে দীনহীন করে মানুষের সামনে পেশ করবে৷ কোন মুসলমানকে এভাবে চলতে দেখে তার ভয় হতো, এভাবে চললে অন্যদের সামনে ইসলামের ভুল প্রতিনিধিত্ব করা হবে এবং মুসলমানদের মধ্যেই নিস্তেজ ভাব সৃষ্টি হয়ে যাবে৷ এমনি ঘটনা হযরত আয়েশার (রা) ব্যাপারে একবার ঘটে৷ তিনি দেখলেন একজন লোক কুঁকড়ে মুকড়ে রোগীর মতো চলছে৷ জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছে ? বলা হলো, ইনি একজন কারী অর্থাৎ কুরআন অধ্যয়ন ও অধ্যাপনা করেন এবং শিক্ষাদান ও ইবাদত করার মধ্যে মশগুল থাকেন । এ কথা শুনে হযরত আয়েশা(রা)বললেন, "উমর ছিলেন কারীদের নেতা৷ কিন্তু তার অবস্থা ছিল, পথে চলার সময় জোরে জোরে হাঁটতেন৷ যখন কথা বলতেন, জোরে জোরে বলতেন৷ যখন মারধর করতেন খুব জোরেশোরে মারধর করতেন৷" ।

11. ১১শ উপদেশ- নিজের আওয়াজ নীচু রাখাঃ

এর মানে এ নয় যে, মানুষ সবসময় আস্তে নীচু স্বরে কথা বলবে এবং কখনো জোরে কথা বলবে না৷ বরং গাধার আওয়াজের সাথে তুলনা করে কোন ধরনের ভাব-ভঙ্গিমা ও কোন ধরনের আওয়াজে কথা বলা থেকে বিরত থাকতে হবে তা পরিষ্কার করে বলে দেয়া হয়েছে৷ ভঙ্গী ও আওয়াজের এক ধরনের নিম্নগামিতা ও উচ্চগামিতা এবং কঠোরতা ও কোমলতা হয়ে থাকে স্বাভাবিক ও প্রকৃত প্রয়োজনের খাতিরে৷ যেমন কাছের বা কম সংখ্যক লোকের সাথে কথা বললে আস্তে ও নীচু স্বরে বলবেন৷ দূরের অথবা অনেক লোকের সাথে কথা বলতে হলে অবশ্যই জোরে বলতে হবে৷ উচ্চারণভঙ্গীর ফারাকের ব্যাপারটাও এমনি স্থান-কালের সাথে জড়িত৷ প্রশংসা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী নিন্দা বাক্যের উচ্চারণভঙ্গী থেকে এবং সন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং এবং অসন্তোষ প্রকাশের কথার ঢং বিভিন্ন হওয়াই উচিত৷ এ ব্যাপারটা কোন অবস্থায়ই আপত্তিকর নয়৷ হযরত লুকমানের নসীহতের অর্থ এ নয় যে, এ পার্থক্যটা উঠিয়ে দিয়ে মানুষ সবসময় একই ধরনের নীচু স্বরে ও কোমল ভঙ্গীমায় কথা বলবে৷ আসলে আপত্তিকর বিষয়টি হচ্ছে অহংকার প্রকাশ, ভীতি প্রদর্শন এবং অন্যকে অপমানিত ও সন্ত্রস্ত করার জন্য গলা ফাটিয়ে গাধার মতো বিকট স্বরে কথা বলা৷

বিষয়: বিবিধ

২০৫৩ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File