দাজ্জাল

লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২১ মে, ২০১৩, ০৬:৩৬:২৯ সন্ধ্যা



...........আমি মদীনার সবচেয়ে প্রাচীন অঞ্চলের সর্পিল গলিপথে প্রবেশ করি । ছায়াতে শিকড় গেড়ে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের দেয়াল, পাথরের তৈরী; গলির উপর ঝুলে আছে ঘুল ঘুলি দেওয়া জানালা এবং ব্যলকনি.... গলিগুলি দেখতে গিরিসংকঠের মতই এবং কোন জায়গায় এত চিপা যে, দুজন মানুষের পক্ষেও একে অন্যের পাশ দিয়ে বিপরীত দিকে যাওয়া প্রায় অসম্ভব । এক সময় আমি নিজেকে দেখতে পেলাম প্রায় একশ বছর আগে একজন তুর্কি পণ্ডিত কর্তৃক স্থাপিত ধূষর পাথরের তৈরী কুতুবখানার সম্মুখে ।

এরই প্রাঙ্গনে, গেটের পেটানো ব্রোঞ্জের গ্রিলের পশ্চাতে রয়েছে এমন একটি নিরবতা যেন একটি আমন্ত্রন! আমি পাথর বিছানো প্রাঙ্গন পার হয়ে প্রাঙ্গনের মাঝখানে যে একাকী গাছটি নিশ্চল দাঁড়িয়ে আছে তা পেছনে ফেলে প্রবেশ করি গম্বুজওয়ালা হল ঘরটিতে, যাতে রয়েছে সারি সারি কাঁচ ঢাকা বুক- কেস—হাজার হাজার হাতে লেখা বই—আর এসবের মধ্যে রয়েছে ইসলামী বিশ্বের জানা কিছু –কিছু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি । এ ধরনের বই –পুস্তকই গৌরব দান করছে অজানা কিছু –কিছু দুর্লভ পাণ্ডুলিপি । এ ধরনের বই –পুস্তকই গৌরব দান করেছে ইসলামী তমদ্দুনকে, যা হারিয়ে গেছে গত কালকের হাওয়ার মতো!

আমি যখন যন্ত্রের সাহায্যে কাজ করা মলাটে ঢাকা এই পুস্তকগুলির দিকে তাকাই, তখন মুসলিমের অতীত ও মুসলিমের বর্তমান অসংগতি আমাকে আঘাত করে এক যন্ত্রনাদায়ক ঘুষির মতো....।

-‘তোমাকে কি যেনো পীড়া দিচ্ছে বেটা? মূখে এই তিক্ততার ছাপ কেন বলোতো?

আমি এই কন্ঠস্বরের দিকে ঘুরে দাঁড়াই এবং দেখি একটি ঘুলঘুলি দেয়া জানলার মাঝখানে, হাঁটুর উপর একটি ফলিও ভলিউম নিয়ে কার্পেটের উপর বসে আছেন আমার পুরানো বন্ধু ছোট্ট অবয়বের শায়খ আবদুল্লাহ ইবনে বুলাইহিদ । ........................ইবনে সউদের রাজত্বে খোদ রাজা ছাড়া আর যে কোন মানুষের কথার চাইতে তাঁর কথার মূল্য অনেক বেশী । তিনি চঠ করে তাঁর বইটি বন্ধ করে ফেলেন এবং আমাকে কাছে টেনে নেন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে, আমার দিকে তাকিয়ে । ...............................

................................................মাগরিবের সালাত ষেষ হওয়ার সাথে সাথে শায়খ ইবনে বুলাইহিদ নজদি বেদুইন ও শহরবাসীদের এক উত্সুক চক্রের কেন্দ্র হয়ে উঠেন, কারণ, এরা তাঁর পাণ্ডিত্য ও জাগতিক প্রজ্ঞা থেকে ফায়দা নিতে ইচ্ছুক । ................

............ব্যাপার কি ভাইয়া জিগ্‌গাস করে এক বেদুইন,’একি সত্যি যে আপনি নিজেই একজন ফিরিংগি ছিলেন? –যখন আমি মাথা ঝুকিয়ে সায় দেই, সে ফিস্ ফিস্ করে বলে...................ফিরিংগিরা আল্লাহ সম্পর্কে এত উদাসীন তার কারণ কী?

-‘এ এক লম্বা কাহিনী, ‘আমি জবাব দেই, ‘কয়েক কথায় এর ব্যাখ্যা করা যাবেনা । আমি এই মুহূর্তে তোমাকে যা বলতে পারি তা এই যে, ফিরিংগিদের দুনিয়া হয়ে উঠেছে ‘দজ্জালের’ দুনিয়া ---চোখ ঝলসানো প্রবঞ্চকের দুনিয়া । তুমি কি আমাদের নবীর এই ভবিষ্যতবানীর কথা শোননি যে আখেরী জমানায় দুনিয়ার বেশিরভাগ লোকই এই বিশ্বাসে ‘দজ্জালের’ অনুসারী হয়ে উঠবে যে, সেই আল্লাহ !

এবং ও যখন জিগ্‌গাসু চোখে আমার দিকে তাকালো, আমি তখন শায়খ ইবনে বুলাইহিদের সম্মতি নিয়ে বর্ণনা করি বাইবেলের সর্বশেষ গ্রন্থে উল্লিখিত ‘দাজ্জ্লের’ আবির্ভাব সম্পর্কিত ভবিষ্যতবানী- যার একটি চোখ হবে অন্ধ, কিন্তু তার থাকবে আল্লাহর দেয়া রহস্যময় ক্ষমতা । পৃথিবীর দূর অঞ্চলে যা বলা হচ্ছে তা-ও সে শুনতে পাবে তার কান দিয়ে এবং অসীম দুরত্বে যা কিছু ঘটছে তার এক চোখ দিয়ে দেখতে পাবে । সে উড়ে কয়েকদিনের মধ্যে ঘুরে আসবে পৃথিবী; মাটির নীচ থেকে নিয়ে আসবে সোনা-রূপার ভাণ্ডার; তার হুকুমে বর্ষণ হবে, তরুলতা উত্পন্ন হবে, সে হত্যা করবে এবং নতুন জীবন দান করবে । যার ফলে, ঈমান যাদের দুর্বল তারা তাকে বিশ্বাস করবে খোদ আল্লাহ বলে এবং ভক্তিতে তার সামনে সিজদায় যাবে – কিন্তু যাদের ঈমান মজবুত তারা আগুনের হরফে তার কপালে যা লেখা আছে তা পড়তে পারবে ‘আল্লাহ্‌কে অস্বীকারকারী’ এই কথা এবং এভাবে তারা জানতে পারবে যে মানুষের ঈমান পরীক্ষা করার জন্য দাজ্জাল একটা ছলনা ছাড়া আর কিছুই নয়......’

এবং যখন আমার বেদুইন বন্ধুটি দু’চোখ বিস্ফোরিত করে আমার দিকে তাকায় এবং গুনগুন করে বলে, ‘আমি আল্লাহর নিকট আশ্রয় মাগি’, তখন আমি ইবনে বুলাইহিদের দিকে ঘুরে বলিঃ

-‘হে শায়খ , এই রূপক কাহিনীটি কি আধুনিক সভ্যতার একটি যথোচিত বর্ণনা নয়? এ সভ্যতা হচ্ছে ‘এক চক্ষু’ঃ অর্থাত্ এ কেবল জীবনের একটি দিক; তার বৈষয়িক উন্নতির দিকে তাকায় এবং জীবনের রুহানী দিক সম্পর্কে বেখবর । এর কারিগরী তেলেসমাতির সাহায্যে মানুষকে দিয়েছে তার স্বাভাবিক সামর্থের বাইরে অনেক দূরের বস্তুর দেখার ও শোনার ক্ষমতা, দিয়েছে ধারণাতীত গতিতে অসীম দুরত্ব অতিক্রম করার সামর্থ্য । এই সভ্যতার বৈজ্ঞানিক জ্ঞান দ্বারা বর্ষানো হয় বৃষ্টি এবং জন্মানো হয় তরুলতা এবং মাটির নীচ থেকে উদঘাটিত করা হয় অপ্রত্যাশিত ঐশ্বর্যের ভাণ্ডার । এই বিজ্ঞানের ওষুধ জীবন দেয় তাকে যার মৃত্যু মনে করা হয় অবশ্যম্ভাবী, অন্যদিকে এর যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং বৈজ্ঞানিক ধ্বংসলীলা ধ্বংস করে দেয় জীবনকে আর এর বৈষয়িক অগ্রগতি এতই চোখ ঝলসানো যে, দুর্বল ঈমানের লোকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে, নিজের অধিকারেই এ হচ্ছে একজন ‘খোদা’ কিন্তু যারা তাদের স্রষ্টা সম্পর্কে সচেতন রয়েছে তারা স্পষ্টতই বুঝতে পারে যে, ‘দাজ্জালের’ পুজা করা মানে আল্লাহকে অস্বীকার করা .....।’

-‘তুমি ঠিকই বলেছ মুহাম্মদ, তুমি ঠিকই বলেছ’, উত্তেজিত ভাবে আমার হাঁটুর ইপর থাবা মারতে মারতে চীত্কার করে ওঠেন বুলাইহিদ,---‘দজ্জাল’ সম্পর্কিত ভবিষ্যত বানীর প্রতি এভাবে তাকানোর কথা কখোনো আমার মনে হয়নি কিন্তু তুমি ঠিকই বলেছ ! মানুষের অগ্রগতি এবং বিজ্ঞানের উন্নতি যে আমাদের আল্লাহরই একটা রহমত, এটা উপলব্ধি না করে অজ্ঞতা বশতঃ মানুষ বেশি মাত্রায় ভারতে শুরু করেছে যে এ খোদাই একটা লক্ষ্য এবং পুঁজা পাওয়ার যোগ্য ।

...................................এবং এভাবে ‘দজ্জাল’ আবির্ভূত হয়েছে স্বরূপে-.....

( মুহাম্মদ আসাদ রচিত ‘The Road toদি রোড টু মক্কাMacca,’ শাহেদ আলী অনূদিত” মক্কার পথ’ বই থেকে সংকলিত, সংক্ষেপিত

বিষয়: সাহিত্য

১৯৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File