৬ জনের দেশ বিজয়

লিখেছেন লিখেছেন ব১কলম ২০ মে, ২০১৩, ১১:১৩:০৯ রাত

-------তখন আমার বয়স সতের বছর । আমরা কুয়েতে নির্বাসিতের জীবন যাপন করছি । কিন্তু আমার স্বদেশের উপর ইবনে রশিদের পরিবার বাদশাহী করবে তেমন চিন্তাও ছিলো আমার পক্ষে অসহনীয় । প্রায়ই আমি আব্বার নিকট কাতর মিনতি জানাতাম-- তাঁর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হোক --যুদ্ধ করো আব্বা এবং ইবনে রশিদের খান্দান তাড়িয়ে দাও, রিয়াদের তখতের উপর তোমার চাইতে কারো বেশ দাবী নেই আব্বা । কিন্তু আমার আব্বা আমার উত্তেজনাপূর্ণ দাবীগুলি উড়িয়ে দিতেন অলীক কল্পনা বলে এবং আমাকে মনে করিয়ে দিতেন আরবের দেশগুলিতে মুহাম্মদ ইবনে রশিদই হচ্ছেন সবচেয়ে পরাক্রমশালী শাসক; তিনি যে মুলুকের উপর বাদশাহ করেন, তা উত্তরে সিরীয় মরুভূমি থেকে দক্ষিণে শূন্য প্রান্তরের বালুরাশি পর্যন্ত বিস্তৃত- তাঁর ইস্পাত কঠিন মুষ্টির সামনে সকল বেদুইন কবিলাই ডরে-ভয়ে থরথর করে কাঁপে। যা কোণ এক রাত্রে আমি এক আজব স্বপ্ন দেখি । আমি দেখতে পেলাম, রাতের বেলা, এক নির্জন স্তেপ অঞ্চলে আমি ঘোড়ার পিঠে বসে আছি, আর সামনেই ঘোড়ার উপর রয়েছেন বৃদ্ধ মুহাম্মদ ইবনে রশিদ, আমার খান্দানের রাজ্য অপহরনকারী । আমরা দু’জনেই নিরস্ত্র, কিন্তু ইবনে রশিদ একটা মস্ত বড় উজ্জ্বল লন্ঠন তুলে ধরে আছেন । যখন তিনি আমাকে তাঁর দিকে আগাতে দেখে বুঝতে পারলেন যে, আমি তাঁর দুশমন, হঠাৎ তিনি ঘুরে গোড়ার পিঠে আঘাত করে ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন । কিন্তু আমিও তাঁর পেছনে ঘোড়া ছুটিয়ে দেই । ঘোড়া ছুটাতে ছুটাতে তাঁর জোব্বার একটা প্রান্ত আমি ধরে ফেলি, তারপর ধরে ফেলি তাঁর বাহু এবং পরে তাঁর লন্ঠনটি নিভিয়ে দেই । যখন আমি ঘুম থেকে উঠে বসলাম, আমার নিশ্চিত উপলব্ধি হল যে, ইবনে রশিদের খান্দানের হাত থেকে শাসন ক্ষমতা অবশ্যি ছিনিয়ে আনব আমি একদিন ।

১৮৯৭ সালে, স্বপ্নের নেই বছরটিতে, মুহাম্মদ ইবনে রশিদ ইন্তিকাল করেন । আবদুল আজীজ ইবনে সউদের মনে হলো, আঘাত হানার এই তো প্রকৃষ্ট মূহুর্ত ! কিন্তু তাঁর পিতা আবদুর রহমান এ ধরনের একটি অনিশ্চিত কাজের ঝূঁকি নিয়ে কুয়েতের শান্তিপূর্ণ নির্ভিঘ্ন জীবনকে বিপন্ন করতে রাযী ছিলেন না । তবে পিতার নিষ্ক্রিয়তা থেকে পুত্রের উৎসাহ ছিলো প্রবলতরো । তাই শেষতক পিতা রাযী হয়ে যান । তাঁর বন্ধু কুয়েতের শায়খ মুবারকের সাহায্যে তাঁর খান্দানের প্রতি যে অল্প কটি বেদুইন কবীলা তখনো অনুগত ছিলো, তাদের নিয়ে তিনি একটি ফৌঁজ গড়ে তোলেন এবং পুরানো আরবীয় কায়দায়, উট আর ঘোড়া হাঁকিয়ে নিজ নিজ কবিলার ঝান্ডা উড়িয়ে মুহাম্মদ ইবনে রশিদের পরিবারের বিরূদ্ধে ময়দানে যুদ্ধের জন্য হাজির হন, আর উন্নততরো শত্রু ফৌজের দ্বারা পর্যুদস্ত হন অতি অল্প সময়েই এবং সম্ভবত তাঁর হৃদয়ের গভীরে, হতাশ হওয়ার চাইতেও অনেক বেশী ভারযুক্ত হয়ে তিনি ফিরে আসেন কুয়েতে, প্রতিজ্ঞা করেন আর কখনো তিনি তাঁর জীবনের সান্ধ্যকালটিকে লড়াইয়ের মতো কোন দুঃসাহসিক অভিযানের দ্বারা বিঘ্নিত করবেন না ।

কিন্তু পুত্র অতো সহজেই হার মানতে রাজী ছিলেননা । তিনি সন সময়েই স্মরন করতেন মুহাম্মদ ইবনে রশিদের উপর তাঁর বিজয়ের আবাল্য স্বপ্নের কথা; এবং পিতা যখন নযদের উপর তাঁর রাজত্বের সকল দাবী -দাওয়া ছেড়ে দেন তখন তরুণ আবদুল আজীজের এ স্বপ্নই তাকে ক্ষমতা লাথের দুর্বার প্রায়াসে উদ্দীপিত করে । তিনি তাঁর অল্প কটি বন্ধূকে পান তাঁর সংগী হিসাবে, তাদের মধ্যে ছিলেন চাচাতভাই আবদুল্লাহ ইবনে জিবলূ এবং ইবনে মুস’আদ । ঢোল টিপিয়ে তিনি আরো ক’টি বেদুইনকে তিনি যোগার করেন । এভাবে ওদের সংখ্যা দাঁড়ায় চল্লিশে । এরা সওয়ারী হাকিয়ে কুয়েত থেকে বেড়িয়ে পরে দস্যুর মতো, চুপি চুপি, ঝান্ডা না উড়িয়ে, দফ না বাজিয়ে, গান না গেয়েঃ যে সব রাস্তায় কাফেলা বেশী চলাফেরা করে সেসব রাস্তা পরিহার করে এবং দিনের বেলা লুকিয়ে থেকে ওরা পৌঁছায় রিয়াদের সন্নিকটে এবং তাঁবু গাড়ে নির্জন উপত্যকায় । সেদিনই আবদুল আজীজ চল্লিশজন সংগীর মধ্য থেকে বেছে নেন পাঁচজনকে এবং বাকী সবাইকে উদেম্যে করে বলেনঃ

-‘আমরা ছ’জন এখন আমাদের ভাগ্যকে সম্পুর্ণ ছেড়ে দিয়েছি আল্লাহর হাতে । আমরই যাচ্ছি রিয়াদে; হয় আমরা রিয়াদ জয় করবো না হয় চিরদিনের জন্য তা হারাবো । তোমরা যদি শহর থেকে জংগের শোরগোল শুনতে পাও, আমাদের মদদ করতে এসো; কিন্তু কাল সন্ধ্যার মধ্যে যদি কোন কিছু শুনতে না পাও তাহলে তোমরা মনে করো আমরা মৃত এবং আল্লাহ যেন আমাদের দোয়া কবুল করেন । যদি তাই ঘটে, তোমরা সকলে পুশিদামতো যত দ্রুত পারো ফিরে যেয়ো কুয়েতে’ ।

এবং ছ’টি মানুষ বের হয়ে পড়ে পায়দল । রাতের প্রথম দিকে এরা শহরে পৌঁছায় এবং কয়েক বছর আগে, শহরের বাসিন্দাদের অবমানার উদ্দেশ্যে মুহাম্মদ ইবনে রশিদ নগরের দেয়ালের যে ক’টি জায়গা ভেঙ্গে দিয়েছিলেন তারি একটির ভেতর দিয়ে দাখিল হয় শহরে । ওরা ওদের অস্ত্রশস্ত্র জোব্বার নীচে লুকিয়ে সোজা ঢুকে পড়ে রশিদী ‘আমীরের’ কামরায় । ঘরটি ছিল তালাবন্ধ, কারণ শত্রুভাবাপন্ন জনতার ভয়ে, বিপরীত দিকে যে দুর্গ রয়েছে সাধারণত তাতেই তিনি রাতগুলি কাটাতেন । আবদুল আজীজ এবং তাঁর সংগীরা দরোজার কড়া নাড়েন । একটি গোলাম দরজা খুলে দেয়, কিন্তু সাথে সাথেই তাকে কাবুতে এনে হাত পা বেঁধে ওর চোখ-মুঠ কাপড় দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়; একই দশা ঘটলো ঘরে আর যে কজন লোক ছিল তাদের প্রত্যেকেরই; সে সময় কেবল কয়েকজন নওকর এবং স্ত্রীলোকই ছিল ঘরটিতে । অভিযাত্রী ছ’জন, ‘আমীরের’ খাবারের ভান্ডার থেকে কিছু খেজুর নিয়ে খায় এবং পর্যায়ক্রমে কুরআন তেলাওয়াত করে রাতটা কাটিয়ে দেয় ।

সকাল বেলা কিল্লার দরওয়াজা খোলা হলো এবং আমীর বার হয়ে এলেন সশস্ত্র দেহরক্ষী ও নওকরদের দ্বারা পরিবৃপ্ত হয়ে । ‘হে আল্লাহ ইবনে সউদ তোমারি হাতে সমর্পিত,, চিৎকার করে ওঠেন আবদুল আজীজ এবং তাঁর পাঁচ সংগীকে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন বিস্মিত হতচকিত দুশমনেদের উপর । আবদুল্লাহ ইবনে জিলুভী তাঁর বর্শা ছুড়ে মারেন আমীরের উপর; কিন্তু তাঁর আগেই মুহুর্তের মধ্যে মাথা নুইয়ে দেন । ফলে বর্শাটির দন্ড কেঁপে বর্শাটি গিয়ে বিদ্ধ হয় কিল্লার মাটির দেয়ালে, যেখানে সেটি দেখতে পাওয়া যাবে আজো । আমীর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পিছু হটে গিয়ে ঢুকলেন প্রবেশ দ্বারে; আবদুল্লাহ যখন একাকী ধাওয়া করছেন আমীরকে তখন কিল্লার ভিতরে আবদুল আজীজ সহ বাকী চারজন আঘাত হানেন দেহরক্ষীতের উপর; এরা সংখ্যায় বেশী হলেও এতটা হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলো যে, কার্যকর ভাবে তাদের আত্মরক্ষার কোন তাকতই ছিলনা তাদের । মূহুর্তকাল পরে আবদুল্লাহ ইবনে জিলুভীর পিছু তাগা খেয়ে আমীর এসে দেখা দেন সমতল ছাদের উপর, তিনি দয়া প্রার্থনা করছিলেন, কিন্তু তা কবুল হলোনা ; ওবঙ যখন তিনি ছাদের উপর পড়ে গেলেন এবং তাঁর উপর হানা হলো তলোয়ারের মারাত্মক আঘাত, ঠিক সেই মূহুর্তেই আবদুল আজীজ নীচ থেকে চিৎকার করে উঠলেন, আসো হে রিয়াদবাসীরা আসো! এই যে আমি আবদুল আজীজ, ইবনে সউদের খান্দানের আব্দুর রহমানের পুত্র -- তোমাদের ন্যায়সংগত শাসক ! ওই রিয়াদের লোকেরা, যারা ঘনা করত তাদের উত্তরাঞ্চলের জালিমদের, অস্ত্রশস্ত্র নি ছুটে এলো তাদের শাহজাদার সাহায্যে এবং তাদের উট হাঁকিয়ে লাফিয়ে ছুটলো তাঁর পয়ত্রিশজন সংগী, নগরীর ফটকগুলির ভেতরদিয়ে । এক ঘন্টার মধ্যেই আবদুল আজীজ হয়ে পড়লেন নগরীর অপ্রতিদ্বন্দী শাসক ।

ব্যাপারটা ঘটেছিল ১৯০১ সালের । তখন তাঁর বয়স একুশ বছর । তাঁর জীবনের তারুণ্যের পর্ব তখন শেষ হয়ে এসেছে এবং তিনি প্রবেশ করেছেন দ্বীতিয় আনবস্থায়-- পরিণত মানুষে এবং শ্সকের বয়সে ।

মুহাম্মদ আসাদ লিখিত, ‘দি রোড টু মক্কা’ এর acca বাংলা অনুবাদ- ‘মক্কার পথ’ বই থেকে

বিষয়: আন্তর্জাতিক

১১৩০ বার পঠিত, ০ টি মন্তব্য


 

পাঠকের মন্তব্য:

মন্তব্য করতে লগইন করুন




Upload Image

Upload File